নিক্কণ ৬-৭/৭

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: শুক্র, ২০/০৬/২০০৮ - ৪:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেকটা পথ এঁকেবেঁকে এগোতে হয় রহিমুদ্দিকে। সামনের গ্রামটাই পঞ্চবটি। কিন্তু খালের পানি কেমন যেন ম্যাদাটে মনে হয়। আশে পাশে পানির নিচ থেকে ভেসে ওঠা উঁচু নিচু মাটির ঢিবি দেখা যায়। নৌকার শব্দ পেয়ে চাঁদের আলোয় স্নানরত ব্যাঙেরা ঝুপঝাপ লাফিয়ে পড়ে পানিতে।

কিছুটা পথ ভালোই এগোতে পারে রহিমুদ্দি। কিন্তু কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে নৌকাটা হঠাৎ কেমন ঝাঁকি খেয়ে থেমে যায়। তলায় মাটি ঘষা খাওয়ার এক ধরনের ভোঁতা শব্দ ছড়িয়ে পড়ে।

ছমেদ মিয়া বললেন, 'নৌকা আইটকে গেল নাহি?'

'হয় মনে কয়!'

রহিমুদ্দি নৌকা থেকে নেমে পড়ে। এখানে পানির উচ্চতা হাঁটুরও নিচে। তার উপর তিনজন মানুষ নৌকায়। তলা তো মাটিতে ঠেকবেই। সে নৌকাটাকে সামনের দিকে প্রাণপনে ঠেলতে থাকে।

সামনে এগিয়ে গিয়ে পানির উচ্চতা পরিমাপ করে। এখানে অনেক পানি। ঠেলে নৌকাটাকে একটু সামনে এগিয়ে দিতে পারলেই মনে হয় ভেসে উঠবে। সে আবার ফিরে আসে নৌকার পেছনে। এবার কাঁধ লাগিয়ে হেঁইয়ো করে ঠেলা লাগায়। কিন্তু জড়বস্তু একটুও নড়ে না।

'আমাগের কি নামতি হবি?'

নৌকায় উঠবার পর এই প্রথম কুলসুমি সরাসরি কথা বলে রহিমুদ্দির সঙ্গে।

কুলসুমির আশঙ্কা যেনো রহিমুদ্দির পৌরুষে প্রবল কষাঘাত করে। সে কিছুটা অস্থিরভাবে বলে, 'না। নামতি হবে ক্যান? আমি থাকতি যদি চড়নদারের পানিতে নামতি অয় তো এই মুখ দেহাবো কেম্বা?'

কুলসুমির কন্ঠস্বরে তার বার্ধক্যের আড়ালে ঘুমিয়ে থাকা যৌবনের অমিত তেজ যেন হঠাৎ করেই আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে। সে কোন শব্দ ছাড়াই নৌকাটাকে ঠেলে বাধা মুক্ত করে পানিতে ভাসায়।

তারপর দ্বিগুণ তেজে লগিতে ভর দিয়ে নৌকার গতি বাড়িয়ে দেয়। লগিতে ভর দেবার ফাঁকে ফাঁকে কুলসুমিকে দেখে রহিমুদ্দি।

কেমন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে কুলসুমি। মুখ উঁচু করে তাকানোর ফলে মাথা থেকে তার ঘোমটা পড়ে গেছে অনেক আগেই, সে দিকে তার খেয়াল নেই কোনো।

এক সময় রহিমুদ্দির কথায় কুলসুমির চমক ভাঙে। 'কোহানে নামাতে হবে কইস কলাম কুলসুমি! বাড়িডা তো ঠিক চেনবো না!'

কুলসুমি মাথা ঘুরিয়ে পাড়ের দিকে তাকিয়েই বলে, 'থামান, থামান! আমাগের বাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে!'

রহিমুদ্দি হঠাৎ করেই চলন্ত নৌকা থামাতে পারে না। সামনের দিকে লগি ফেলে গতি রুদ্ধ করলেও আরো বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে নৌকা থামে।

তারপর নৌকা ঘুরিয়ে কুলসুমির কথামত জায়গায় এনে থামায় রহিমুদ্দি।

নৌকা থামতেই ছমেদ মিয়া বলেন, 'এতডা বছর পর দেখা, তুই একবার বাড়ি যাবি না?'

রহিমুদ্দি বললো, 'উজানে আমার অনেকটা পথ যাতি হবে। আপনের বাড়ি গেইলে আমার ফিরে যাতি দেরি হবেনে!'

ছমেদ মিয়া বলেন, 'আমার তো বয়স হইয়েছে, কোন দিন টুক করে মইরে যাই তাতো কেউ কতি পারিনে! বাড়িডা চিনলি, আমাক মাটি দিতি না আসতি পারিস, খবর পালি কবরডা দেখতিও তো আসতি পারবি!'

কুলসুমি হঠাৎ ছমেদ মিয়ার বাহু ধরে বলে, 'উঠেন বাবা, নেইমে পড়ি!'

তারপর রহিমুদ্দিকে কিছুটা রুক্ষ্ম স্বরে বলে, 'একটা বুড়ো মানুষ তার মেয়াক নিয়ে রাইত বিরেতে একা একা যাবে, পথের বেপদের কতা কি কওয়া যায়? ভোর হতি আর কতক্ষণই বাকি আছে! কী হবে ভোর ভোর উইঠে ফিরে গেলে? এমন তো না যে, বাড়িতে বউ-ছাওয়াল বইসে আছে!'

রহিমুদ্দি অবাক বিস্ময়ে কুলসুমির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলার সময় কুলসুমির নাকের নোলক ঠোঁটের উঠানামার সাথে সাথে দোল খায় আর চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠে বারবার। বিধবা হলে মেয়েরা কোনো অলঙ্কার পরতে পারে না। কিন্তু কুলসুমির নাকে ঠিকই ঝকমক করছে সোনার গয়না।

কুলসুমির কথা শেষ হলে রহিমুদ্দি ছমেদ মিয়ার পাশে এসে বলে, 'আমিও কি যোয়ান ছাওয়াল নাহি? বয়স আমারও ছাপ্পান্ন চলতিছে! তোর বয়সও পোনারো ষোলো লয়!'

'মেয়া মানুষ রাতির বেলা বাইরে বারালি তার বয়স কত ওডা বড় কতা লয়, বেপদ যে কোন সুমায় হতি পারে!'

রহিমুদ্দি কথাটা অস্বীকার করতে পারে না। বলে, 'আচ্ছা, আচ্ছা! আগায় দেবানি কিছুডা পথ!'

নৌকা থেকে নেমে নৌকার মাথা ধরে টেনে কিছুটা পাড়ের দিকে শুকনাতে তুলে রাখে রহিমুদ্দি। এতে করে নৌকা ভেসে যাবার ভয় থাকে না। তারপর সে ছমেদ মিয়ার পেছন পেছন এগিয়ে যায়। পাশাপাশি খানিকটা দুরত্ব রেখে এগোয় কুলসুমিও।

রহিমুদ্দি আড় চোখে কুলসুমির দিকে তাকিয়ে মনে মনে হিসেব কষে বের করে যে, কুলসুমির কম করে হলেও এখন বয়স চলছে একচল্লিশ। সে নিজে যেমন ছাপ্পান্নতে এসে ফুরিয়ে যায়নি, তেমনি কুলসুমি চল্লিশের কোঠা পেরিয়েও দেখতে বেশ! এ কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রহিমুদ্দির। সেই শব্দ বুঝি কুলসুমিকেও আঘাত করে। হঠাৎ কেমন চমকে উঠে ঘাড় ফেরায় সে।


হেমন্তের জোৎস্নালোকে পথ চলতি তিনজন মানুষের ছাঁয়া হালকা শিশিরের ব্যুহ ভেদ করে যাবার সময় তাদের ঘিরে কেমন একটা অস্পষ্ট রঙধনু রঙের বলয় সৃষ্টি হয়। রহিমুদ্দি সেই বলয়ের দিকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পথ চলে। তার এই আনমনা ভাব কুলসুমিকেও কেমন যেন নিরব করে দেয়।

ছমেদ মিয়া বলেন, 'বুঝলি রে রহিমুদ্দি! আমার একটা ছাওয়াল নেই। শেষ বয়সে চলতি ফিরতি না পরলে আমাগের দেখবি কেডা? তাই কতিছিলাম, তুই একা মানুষ, আমাগের সঙ্গে থাইকে গেলেও তো পারিস!'

রহিমুদ্দি ভাবে, তার নিজের ঘরবাড়ি রয়েছে। যেখানে আছে বাবা মা দুজনেরই কবর। তা ছেড়ে সে পড়ে থাকবে পরের বাড়িতে? পরের আশ্রয়ে থাকার অর্থ গলায় শিকল বাঁধা কুকুরের মত কাল কাটানো। সে ছমেদ মিয়ার কথার জবাবে বলে, 'এডা কেম্বা হয়?'

তারপর বেশ কিছুটা পথ নিরবতা অবলম্বন করেই তিনজন হেঁটে চলে।

বাড়ির ঢাল বেয়ে উঠবার সময় ছমেদ মিয়া রহিমুদ্দিকে আহ্বান করেন। কিন্তু রহিমুদ্দি রাজি হয় না। বলে, 'আরেক দিন আসবোনে!'

রহিমুদ্দির গোয়ার্তুমিতে ছমেদ মিয়ার হয়তো রাগ হয়। তিনি একবার দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকান। কিছুটা কন্ঠ চড়িয়ে বলেন, 'কুলসুমি, ওরে তুই নিয়ে আয়!'

তারপর তিনি ঢাল বেয়ে উঠে যান বাড়ির উঠোনে।

কুলসুমি কেমন কাতর কন্ঠে রহিমুদ্দিকে বলে, 'আপনে ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই চইলে যায়েন। না করবো না!'

'আমারে অনেকটা পথ ঘুইরে যাতি হবে!'

রহিমুদ্দির বলার ধরনে জোর থাকলেও কুলসুমি গ্রাহ্য করে না। বলে, 'কিছুক্ষণ জিরোয়ে ভোর হলি নৌকা নিয়ে যাতি কষ্ট হবেনা নে!'

রহিমুদ্দি তবুও আপত্তি জানায়, 'তুই বুঝতি পারতিছিস না ক্যান?'

ছমেদ মিয়া আড়ালে চলে গেলে কুলসুমি হঠাৎ রহিমুদ্দির হাত ধরে বলে, 'বুড়ো হয়েছেন এখনো ছাওয়াল পাওয়ালের মত এত লজ্জা কিসের?'

তারপর রহিমুদ্দিকে প্রায় টেনে নিয়ে ঢাল বেয়ে উঠতে থাকে কুলসুমি।

রহিমুদ্দি টের পায়, কুলসুমির বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেলে কি হবে, ওর গায়ে এখনো যথেষ্ট জোর-বল আছে।

নিজের অসহায় অবস্থা দেখে আত্মসমর্পণের আগে হেসে ফেলে রহিমুদ্দি।

তারপর বলে, 'তুই এহনো তেমনি পাগলীই রইয়ে গেছিস!'

পাশাপাশি দু'টো বড় টিনের ঘর। কিন্তু একটার দরজায় বড়সড় তালা ঝুলতে দেখা যায়। রহিমুদ্দি বলে, 'ও তালা দেওয়া ঘরডা কাগের?'

'আমাগেরই!'

রহিমুদ্দির হাত ছেড়ে দিয়ে কুলসুমি বলে, 'ও ঘরে থাকবার মানুষ নেই। মাঝে মদ্যি কামলারা থাকে!'

তারপর, 'বাবা আর মা এ ঘরেই থাকে।' বলে, আরেকটা ঘর দেখায় কুলসুমি।

'কাকি বাড়ি আছে?'

'আছে। আপনে ঘরে আইসে বসেন!'

কুলসুমি একটা কুপি জ্বালিয়ে এনে রহিমুদ্দিকে কাঠের জলচৌকি এগিয়ে দিয়ে বলে, 'বসেন।'

রহিমুদ্দিকে বসতে দিয়ে কুলসুমি ছমেদ মিয়াকে বললো, 'আমি ভাত বসাচ্ছি বাবা! না খেয়ে ঘুমোয়ে পইড়েন না!'

ছমেদ মিয়া বললেন, 'আমার শরীরডা জবর কাহিল লাগতিছে! ভাত হলি পরে আমারে ডাইকে দিস!'

ছমেদ মিয়া হয়তো ঘুমুতে চলে গেলেন।

কুলসুমি হাঁড়িতে করে চাল নিতে গিয়ে দেখলো তার মা এখনো ঘুমোননি। 'আমি ভাত বসাচ্ছি! দুডো ভাত খাবা?'

'আমি এহন ভাত খাতি পারবো না। অনেক ঘুম পাচ্ছে!'

'তালি আমি পাক ঘরে গেলাম!'

কুলসুমি একহাতে হাঁড়ি আর অন্য হাতে কুপিটা নিয়ে রহিমুদ্দিকে বলে, 'ইট্টু আমার সঙ্গে পুকুর ঘাটে আসেন দিনি!'

কুলসুমি ঘর থেকে বের হলে রহিমুদ্দি তার পেছন পেছন যায়।

কুলসুমি হাঁটু সমান পানিতে নেমে চাল ধোয়। পানি বদলায়। সেই সাথে পানিতে ঢেউ উঠে, ভাঙে। ঢেউয়ের বুকে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে সেই ঢেউ নেচে নেচে এগোয়। কিন্তু ঢেউ পানিতে মিশে গেলে চাঁদের চমকও হারিয়ে যায়। রহিমুদ্দির বুক চিড়ে অকারণেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আর ঠিক তখনই কুলসুমি চাল ধোয়া শেষ করে দাঁড়ায়।

তারপর এক হাতে চালের হাড়ি অন্য হাতে কুপি নিয়ে উঠে আসতে পা বাড়ায়। কিন্তু ঘাটের এবরো থেবেড়ো পথে তার পা হড়কায় কি হড়কায় না, তবুও কেমন যেন দুলে উঠে তার সমস্ত শরীর।

রহিমুদ্দি চকিতে নেমে গিয়ে আগবাড়িয়ে কুলসুমির হাত থেকে কুপিটা নেয়। তারপর বাড়িয়ে দেয় আরেকটা হাত।

সামান্য দ্বিধা। কিন্তু কুলসুমি হাসিমুখে সেই হাত অবলম্বন করে উঠে আসে।

তারপর রহিমুদ্দির কাছ থেকে কুপি নিয়ে রান্না ঘরে ঢোকে কুলসুমি। চুলোয় হাঁড়ি বসিয়ে একমুঠ পাটশোলায় কুপি থেকে আগুন ধরিয়ে তা চুলোয় দেয়। পাটশোলায় ভালো মত আগুন ধরে উঠলে চুলোর ভেতর শুকনো খড়কুটো ঠেলে দিয়ে আগুনের আঁচ আরো বাড়িয়ে দেয় সে।

রহিমুদ্দি সসঙ্কোচে দাঁড়িয়ে থাকলে কুলসুমি তাকে পাশে বসতে বলে। তারপর জানায়, 'ভাত রান্দা হলি বেগুন ভর্তা করবো আর আপনের জন্যি একটা ডিম তেলে দিয়ে দেবানি!'

খড়কুটো টেনে রহিমুদ্দি মাটিতে থেবড়ে বসে পড়ে বলে, 'ভর্তা হলি আর ডিম দিয়ে কি হবে! কোনো কোনো দিন তো কেবল নুন কাঁচা মরিচ দিয়েই ভাত খাওয়া সাইরে ফেলি!'

রান্নাঘরের চালে, বেড়ায় অদ্ভূত ছায়া নাড়াচড়া করে। রহিমুদ্দি দৃষ্টি ফিরিয়ে অবাক হয়ে যায়। আগুনের আঁচে কুলসুমির মুখ কেমন লালচে আর রহস্যময় মনে হয়। রহিমুদ্দি সেই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময় হয়ে।

কুলসুমি একবার আড় চোখে রহিমুদ্দিকে দেখে। দেখে তার দৃষ্টির মুগ্ধতা।

তারপর হাসি হাসি মুখে আস্তে আস্তে চুলোর মুখে খড়কুটো ঠেলে দিতে থাকে।

রহিমুদ্দি হঠাৎ নড়েচড়ে বসে বলে, 'কুলসুমি, অনেক বছর হইয়ে গেল, আমি মেয়াছৌলের রান্দা খাতি পাইনি!'

কুলসুমি এ কথা শুনে কেমন বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রহিমুদ্দির মুখের দিকে। মনে মনে বলে, 'আপনে আমার কাছে থাইকে যান, বাকি জেবন আমি রান্না কইরে খাওয়াবোনে!'

কিন্তু সব কথা কি মানুষ মুখ ফুটে বলতে পারে? পারে না। তার উপর কুলসুমি একজন নারী। শুধু সে নারীই নয়, পরিপক্ক একজন সংসারাভিজ্ঞা নারীও বটে। যে কারণে কথাগুলো তার বুকের কন্দরেই ঘুরপাক খায়। তবুও সে তার মনোভাব কিছুটা ঘুরিয়ে প্রকাশ করে। বলে, 'তাই তো জোর কইরে ধইরে নিয়ে আলাম!'

রহিমুদ্দির বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। সে ভাবে যে, আরো বিশ কি পঁচিশ বছর আগে যদি এমন করে কেউ তাকে সামান্য জোর করে হলেও সংসারের গন্ডিতে টেনে নিতো, তাহলে তার জীবনটা হয়তো এমন যাযাবরের মতো থাকতো না। কিন্তু সে মুখে বললো, 'এমন কি আর সব সুমায় হয়?'

কুলসুমি রহিমুদ্দির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকায়। তারপর মনে মনে বলে, 'আমি তো আছি। ইচ্ছে তো হয় বাকি জেবনডা আপনেরে দেহেশুনে রাখি!'

রহিমুদ্দির বুকের দেয়ালে বুঝি কুলসুমির অন্তর্গত বাসনা প্রতিধ্বণিত হয়ে স্ফুরিত হয় রহিমুদ্দির মাঝে। আর সেই কারণেই বুঝি অকস্মাৎ সে কুলসুমির একটি হাত ধরে বলে, 'কুলসুমি, দুনিয়ায় আমি অনেক একলারে! মাঝে মদ্যি রাইতে ঘরে ঢুকলি মনে হয় য্যান কবরে ঢুকিছি! তুই আমারে ফিরায়ে দিস না! তোরে নিয়ে আমি আবার সংসার সাজাবো! আমাগের সংসার উজালা হইয়ে উঠবেনে! আমরা ফের নতুন কইরে সব শুরু করবো!'

ভাতের চাল ফুটতে থাকে বিচিত্র শব্দে। তেমনি বিচিত্র শব্দে চুলোয় পুড়তে থাকে শুকনো খড়-কুটো, লতা-পাতা। কুলসুমি রহিমুদ্দির মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা না করে মায়াভরা চোখ দু'টো আরও মায়াময় করে রহিমুদ্দির চোখে স্থির রেখে বলে, 'ভোর বেলা বাবারে কথাটা বইলেন।'

'কাকা রাজি হবে?'

বিষম খাওয়ার মত ছটফট করে উঠে রহিমুদ্দি।

তারপর আরো শঙ্কিত কন্ঠে বলে, 'বুড়ো বইলে দূরদূর করে যদি?'

'নাহ, তা করবে না!'
বরাভয় দেওয়ার মত করে হাসে কুলসুমি। 'আমি জানি, এই কথা শুনলে বাবা খুশি হবে! নৌকোয় কি কচ্ছিলো শোনেন নি!'

তারপরই কুলসুমির চোখে মুখে হয়ত একরাশ লজ্জা এসে ভর করে। সে তার হাঁটুর উপর থুতনি রেখে চুলোর ভেতর আরও খড়-কুটো ঠেলে দিতে দিতে যেন আনমনে বলে, 'বাবা রাজি না হলিও আপনেরে আমি যাতি দেবো না!'

'সত্যি কতিছিস? কুলসুমি! আমি যে ঘর পোড়া গরু!'

রহিমুদ্দিকে কেমন বিভ্রান্ত মনে হয়। সহসা কুলসুমির কথাগুলো বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। তার শরীর কেমন যেন থরথর করে কাঁপে। আর তাই দেখে মুখ তুলে হাসিমুখে তাকায় কুলসুমি। নিষ্পলক দু'টি চোখ মেলে রাখে কিছুক্ষণ রহিমুদ্দির দৃষ্টির সমান্তরাল। কিন্তু কিছু না বলে কেবল মাথা দোলায়।

মুহূর্তেই যাবতীয় দ্বিধার ঝোঁপ-ঝাড় ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে রহিমুদ্দি। কুলসুমির অসম্পূর্ণ কথাগুলোও যেন মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে তার মানসলোকে। তার ইচ্ছে হয় চিৎকার করে সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দেয়- দেখ, ছাপ্পান্নতে এসে রহিমুদ্দি এখনো ফুরিয়ে যায়নি! কুলসুমি তাকে কথা দিয়েছে। তার আবার সংসার হবে। আবার তার ঠিকানা হবে। পাকিরা তার বাবা মাকে মেরে ফেলেছে। আয়শাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তার অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখা থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু তাকে বঞ্চিত করতে পারেনি জীবনের আহ্বান থেকে, পারেনি তাকে একবারেই নিঃস্ব করে দিতে।

সে মুগ্ধ চোখে কুলসুমিকে দেখে। দেখে চুলোয় কুটো-কাটা ঠেলে দেওয়ার সময় তার সুন্দর দু'টি হাতের ছন্দায়িত আলোড়ন। হঠাৎ তার মনে পড়ে, হাট থেকে যে চুড়িগুলো কিনেছিলো, সেগুলো কুলসুমির হাতেই ভালো মানাবে। সে স্পষ্ট দেখতে পায় যে, কুলসুমির দু'হাত ভর্তি অনেকগুলো লালচুড়ি। যেগুলো হাতের নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভূত এক মিষ্টি শব্দে মুখরিত হয়ে উঠছে। আর সেই শব্দের মাধুর্য রহিমুদ্দিকে কেমন বিহ্বল করে দেয়। ধীরে ধীরে একটি ঘোরে আচ্ছন্ন হতে হতেও থেকে থেকে সে শুনতে পায় রেশমী চুড়ির মিষ্টি আর মিহি টুংটাং। কিন্তু সে বুঝতে পারে না সেই বলয় নিক্কণ সত্যিই নাকি কল্পনা! (সমাপ্ত।)

নিক্কণ (সম্পূর্ণ)


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

ধন্যবাদ জুলিয়ান ভাই, ভালো লাগলো গোটা গল্পটা। আপনার লেখায় কথার বা ভাষার বিন্যাসটায় একটা আকর্ষণ আছে। নিয়ন্ত্রিত আবেগগুলোর উপস্থাপনও দারুণ।
আমি তো ভাই আপনার গল্পের ভক্ত হয়ে গেলাম !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

বসু, আপনি আমার মতই আবেগী পাঠক। লেখকের দোষগুলো দেখেন না কিংবা দেখলেও এড়িয়ে যান। অথচ আশা করেছিলাম কঠোর সমালোচনা হবে। হওয়াটাই উচিত। ভবিষ্যতে আপনাদের কঠিন সমালোচনা আশাকরি।
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

ধুসর গোধূলি এর ছবি

কুলসুমির কন্ঠস্বরে তার বার্ধক্যের আড়ালে ঘুমিয়ে থাকা যৌবনের অমিত তেজ যেন হঠাৎ করেই আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে। সে কোন শব্দ ছাড়াই নৌকাটাকে ঠেলে বাধা মুক্ত করে পানিতে ভাসায়।

এখানে "কুলসুমি" না হয়ে বোধহয় রহিমুদ্দি হবে!

শেষের দিকে এসে পাঠক হিসেবে খটকা লেগেছে। পাঁচ বছর পরে বাবার বাড়ি এলেও তার ব্যবহার এমনকি মায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার ঘটনাকে মনে হয়েছে খুবই চিরাচরিত। মনে হয়েছে যেনো কুলসুমি বাবার বাড়িতেই থেকেছে সারাটা সময়।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ধন্যবাদ বস্!
১. কুলসুমি যখন নেমে যাওয়ার কথা বলে, তখনই রহিমুদ্দির পৌরুষ জাগে।

২. খটকা ঠিকই আছে। দীর্ঘদিন অদর্শনের পর মাতাকন্যার মিলনে স্বাভাবিক ভাবেই একটি কান্নাকাটির পর্ব চলে আসে। তা যুক্ত করা হয়নি।
৩. আপনাকে আবার ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

কর্ণজয় এর ছবি

bhalo laglo ..

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

Dhonnyobaadh!
Esc button চাপলে ইংরেজি আবার চাপলে বাংলা।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

স্পর্শ এর ছবি

*
পুরো গল্প আবারো একটানে পড়লাম। পিডিএফ থেকে।গল্প ভাল লেগেছে! ভাললেগেছে গল্পের বর্ণনা!! করুণ ফিনিশিং যে না সে কারনে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি অপাঠক। কেন যেন দুঃখের গল্প পড়তে ভাল লাগেনা! ইয়ে, মানে...
এরকম গল্প আরো চাই।

**
তবে প্রথম তিন পর্বে যে 'মহাকাব্যিক' সুচনা হয়েছিল শেষের দিকে কেন যেন মনে হল সে তাল টা থাকেনি। অবশ্য আমার মন্তব্য কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কারন নেই। এরকম একটা গল্প লেখার ক্ষমতা আমার নেই। হাসি তাই সমালোচনাও অবান্তর।

....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ধন্যবাদ। কথা ঠিক আছে। তবে, পাঠক হিসেবে আপনার ভালোলাগা মন্দলাগা নিঃসন্দেহে প্রকাশ করতে পারেন। পাঠকের সব রকম অনুভূতির কথা হজম করার মানসিকতা লেখকের থাকা উচিত।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

"রহিমুদ্দির বুকের দেয়ালে বুঝি কুলসুমির অন্তর্গত বাসনা প্রতিধ্বণিত হয়ে স্ফুরিত হয় রহিমুদ্দির মাঝে। আর সেই কারণেই বুঝি অকস্মাৎ সে কুলসুমির একটি হাত ধরে বলে, 'কুলসুমি, দুনিয়ায় আমি অনেক একলারে! মাঝে মদ্যি রাইতে ঘরে ঢুকলি মনে হয় য্যান কবরে ঢুকিছি! তুই আমারে ফিরায়ে দিস না! তোরে নিয়ে আমি আবার সংসার সাজাবো! আমাগের সংসার উজালা হইয়ে উঠবেনে! আমরা ফের নতুন কইরে সব শুরু করবো!"

গুরু, গল্পের এর পরের অনুভূতি গুলো উপড়ের কথার আগে বলিয়ে নিলে ভাল হতো।
সংলাপে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার অসাধারণ লেগেছে। জায়গা মত তেমন দুএকটা শব্দে বর্ণনাও খুব বাস্তব লেগেছে।
সবকটি পর্বই কিন্তু পড়েছি। একটু দৌড়ের উপড় আছি, তাই মন্তব্য করা হয়নি।

**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

স্পর্শরে কিন্তু কইয়েন না। আমার মাথায় এমনি এক বাড়ি মারছে! তারপর থাইক্যা খুবই চিন্তায় আছি। তিন পর্বের পরেরগুলা নিয়া নতুন কইরা ভাতাছি। কিন্তু দিশা পাই না। কখন না আবার গলা টিপ্যা ধরে কে জানে!
একটু দম ফালানের সুযোগ দিলেন বইল্যা অনেক অনেক ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।