পাত্র-পাত্রী:-
বাবুল: ব্যাংক কর্মচারি।
পুষ্পা: বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মচারি।
খোকন: শিক্ষিত বেকার যুবক।
আলিফ: ছাত্র।
টুনি: ফুল বিক্রেতা।
নাজু: গৃহিনী।
আজাদ: পান-সিগারেট বিক্রেতা।
টোকনা: গরুর হাটের দালাল।
স্থান: মফস্বলের একটি বাসস্ট্যান্ড। দূরে দেখা যায় ক্ষেতে কাজ করছে লোকজন। কেউ হালচাষ করছে গরু দিয়ে। কেউ বা চালাচ্ছে হ্যান্ড ট্রাক্টর।
(প্রথম দৃশ্য)
বাবুল: (স্বগত) আজকে বাস কি আসবে না? আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো?
খোকন: (বাবুলের দিকে ফিরে)ভাই, সময়টা কত বলবেন একটু?
বাবুল: (ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায় খোকনের দিকে। তারপর খুবই কষ্টে যেন হাতটা তুলে ঘড়িতে সময় দেখে।) সাতটা চল্লিশ।
আলিফ: (সময়ের কথা শুনে নিজের ঘড়ি দেখে। একই সঙ্গে পুষ্পা ও আড় চোখে নিজের ঘড়ি দেখে নিয়ে মনে মনে বলে: হায় হায়, আজ তো কপালে অপমান ছাড়া আর কিছুই জুটবে না!)
পুষ্পা: (অস্থির হয়ে) বাস এত দেরি করছে কেন? (তাকায় নাজুর দিকে।)
নাজু: (নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। বাস এলো কি এলো না, তাতে যেন তার কিছুই যায় আসে না। তার বিয়ের অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেলেও কোনো সন্তানাদি হয়নি। সে যাবে কবিরাজের বাড়ি। তাই সে বাসের অপেক্ষায় আছে। কপালের ভাঁজ ফেলে মনেমনে ভাবে): আইজ শনিবার। কবিরাজের বাড়িত গিয়া কলা আর ডিম পড়া আনার কথা। কিন্তু দুপুরের আগে যদি যাইতে না পারি তাইলে তো আমার কাজ হইবো না।
খোকন: (পান সিগারেটের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।) আজাদ, একটা বেনসন দে দেখি!
আজাদ: আগের দামগুলা তো বাকি আছে! (কন্ঠে বিরক্তি ফুটিয়ে সে একটি সিগারেট রাখে খোকনের সামনে।)
খোকন: (সিগারেটটা নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে শূন্যে ধোঁয়া ছাড়ে।) পয়সা-পাতি এখনো হাতে আসে নাই।
আজাদ: আপনের কি চাকরি হইছে?
খোকন: না।
আজাদ: তাইলে পয়সা-পাতি পাইবেন কোই?
খোকন: (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) দেখি! একটা ছাত্র পড়াচ্ছি। মাস গেলে কিছু পয়সা হাতে আসবে।
আজাদ: (ভিন্ন একজন বয়স্ক লোক এসে আজাদের কাছে পান চাইলে আজাদ পান বানাতে বানাতে বলবে।) গতবারের মত বেশি বাকি ফালাইয়েন না। আপনের কারণে বাবার হাতে মাইর খাইতে হইছে!
খোকন: (সিগারেটে ঘন ঘন টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কিছু ভাবে।)
আজাদ: (খোকনের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আবার বললো) ‘ভাইজান কি আমার কথায় রাগ হইছেন?
খোকন: রাগ করলে কি পয়সা দিতে হবে না? (সে হাসে।)
আজাদ: (হাসতে হাসতে) তা কি আর হয় ভাইজান!
খোকন: গতবার তোকে সার্ট কিনে দিয়েছিলাম, এবার আরো ভালো কিছু দেবো।
আজাদ: আপনের উপরে এই কারণেই রাগ হইতে পারি না।
খোকন: কেন? (সিগারেটটা সে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে।)
আজাদ: (হাসিতে দন্ত বিকশিত করে) আপনের মনডা খুবই পরিষ্কার।
[আলিফ হঠাৎ নড়ে-চড়ে কাঁধের ব্যাগ ঠিক করে রাস্তার উপর উঠে আসে। দূরে তাকিয়ে বলে: বাস আসতেছে! তখনই অন্যান্যরা মুখ ঘুরিয়ে আলিফের দেখাদেখি রাস্তার দিকে তাকায়। দেখা যায় একটি বাস আসছে ঠিকই। কিন্তু ভিতরে জায়গা নেই। ছাদে, দরজায়, পেছনের বাম্পারেও মানুষ।]
খোকন: (মাথার চুল পেছনের দিকে সরিয়ে দিয়ে) এই বাসে আমার পক্ষে উঠা সম্ভব না!
(পুষ্পা হঠাৎ পাশ থেকে বলে উঠলো) আপনি ছেলে হয়ে এ কথা বললে আমরা মেয়েরা কি বলবো?
খোকন: (ঘুরে দাঁড়ায় পুষ্পার দিকে। একবার হাসে।) ছেলে-মেয়ের কথা বলছি না। বলছি সামর্থ্য আর ক্ষমতার কথা! আপনার শক্তি আর সামর্থ্য থাকলে আপনি উঠে যেতে পারবেন। আমার ও দুটো নেই!
পুষ্পা: (স্বগত) ছেলেটা তো ভালোই মনে হয়। আদব-কায়দাও জানে। এ কোথাকার? আমাদের এলাকার কি? আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে হয় না!
(দ্বিতীয় দৃশ্য)
[মানুষে বোঝাই বাসটা থামলে ভেতর থেকে একটি লোক (টোকনা দালাল) ছাতা হাতে নেমে আসে। তখন আলিফ চেষ্টা করে বাসে উঠার জন্য। কিন্তু কাঁধের ব্যাগের জন্য পারে না। সে ব্যাগটা খুলে জানালা দিয়ে একজন যাত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাসের দরজার হ্যান্ডেল ধরে পা দানিতে এক পা দিয়ে ঝুলে পড়ে। তখনই বাসটা ছেড়ে দেয়। খোকন তাকিয়ে থাকে আলিফের বাদুর ঝোলা হয়ে চলে যাওয়ার দিকে।]
খোকন: (আলিফের দিকে তাকিয়ে) একেই বলে শক্তি আর সামর্থ্য!
পুষ্পা: (কয়েক কদম এগিয়ে এসে) আপনার কথাই ঠিক!
টোকনা দালাল: (পকেট থেকে বিড়ি আর দেশলাই বের করে ছাতাটা বগলে রেখে একটা বিড়ি মুখে নিয়ে ধরিয়ে তারপর খোকনের দিকে এগিয়ে এসে সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়।) খোকন ভাই না?
খোকন: (অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার দৃষ্টি দেখে বোঝা যায় না যে সে লোকটাকে চেনে।)
টোকনা: (বুঝতে পারে যে, খোকন তাকে চিনতে পারছে না। নিজের পরিচয় দিতে বলে): আমারে চিনলেন না? ওই যে আপনেগ গ্যারামের মুন্নাফ চোরার মাইয়ার জামাই!
(তবুও খোকনের চেহারায় কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না।)
পুষ্পা: আমি চিনতে পারছি।
টোকনা: চিনতে পারছেন? আফনে পুষফা আফা না?
পুষ্পা: তোমাকে একবার মন্টু দাসের নিমগাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলো না?
টোকনা: (লজ্জা না পেয়ে বরং মুখে বিগলিত হাসি দেখা যায়।) আফা, আমি তো এখন ভালা হইয়া গেছি। গাবতলীর হাটে গরুর দালালী করি!
খোকন: (স্বগত) এতক্ষণে চিনতে পেরেছি। ব্যাটা গরুচোর!
(মুখের ভাব পরিবর্তন হয় খোকনের।) গরু চুরি ছেড়ে দালালী করছো? নাকি কোন বাড়িতে কত দামের গরুগুলো যাচ্ছে তা তোমার বন্ধুদের জানানোর জন্যই হাটে যাও?
টোকনা: (আস্তে আস্তে পিছু হঁটে।) বলছি না ভালো হইয়া গেছি? আমার শ্বশুর তো কতদিন ধইরা জেলে আছে। আপনেরা তাও কেন যে আমারে বিশ্বাস করেন না!
খোকন: তাহলে গত রাতে আদম খলিফার গরুটা কে নিয়েছে?
টোকনা: (কিছুটা ভিত মনে হয় তাকে।) আমি তো জানি না। আইচ্ছা এখন যাই। খবর পাইলে জানামু!
(টোকনা দ্রুত পদক্ষেপে রাস্তার ঢাল বেয়ে নেমে যায়।)
(তৃতীয় দৃশ্য)
(হাতে গোলাপ আর রজনীগন্ধা ভর্তি ছোট্ট একটি বালতি নিয়ে আট-ন বছরের একটি মেয়ে গ্রামের ক্ষেতের আল ধরে হেঁটেহেঁটে এসে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। আজাদ তাকে দেখতে পেয়েই কথা বলে উঠলো।) কিরে টুনটুনি, আইজও ভাত পাক করতে দেরি অইছে?
(নাজু খানিকটা হাসি হাসি মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে টুনির দিকে।)
টুনি: (রাগ না করলেও তার মুখ গম্ভীর দেখায়) তুমি এই খবর দিয়া কি করবা?
আজাদ: না, দেরি হইলো দেইখ্যা কইলাম।
টুনি: তাইলে তোমাগ ঘর থাইক্যা ভাত নিয়া যাইতা?
আজাদ: আমাগ ঘরে গেলেই পেট ভইরা ভাত খাইতে পারতি।
টুনি: কোন বাড়িডা তোমাগ আমারে কও। কার পোলা তুমি? আমি এখনই যামু তোমাগ বাড়ি। দেখমু পাতিলে কয়ডা ভাত আছে?
আজাদ: (পান বানাতে বানাতে হাসে।) আইজ গেলে কিছু পাবি না! মায় বাইত্যে নাই। সকালে মুড়ি খাইছি।
টুনি: (ফুলের বালতিটা এক পাশে নামিয়ে রেখে একটা ইটের টুকরায় বসে।) প্যাডে কিছু নাই দেইখ্যাই এত ফটর ফটর করতাছো! পেট ভরা থাকলে আর এমন করতা না। (স্বগত) বান্দর ছেড়া!
(আজাদ দাঁত বের করে হাসতে থাকে। তা দেখে টুনির রাগ হয় আরো। চোখ পাকিয়ে তাকায়।) তুমি ভ্যাটকাইতাছ ক্যান?
আজাদ: মনে মনে বান্দর ছেড়া কস নাই?
(টুনি কিছু না বলে চোখ পাকিয়ে থেকেও হঠাৎ হেসে উঠলো।)
(নাজু এতক্ষণ টুনিকে লক্ষ করছিলো।)
টুনি: (হঠাৎ নাজুকে দেখে) খালা, তুমি কই যাও?
নাজু: (স্বগত) এরে কইলে তো ঢোল পিটাইয়া দুনিয়া ছড়াইবো! (শব্দ করে বলে:) যাইতাছি একটা কাজে। ক্যান, তুই যাবি আমার লগে?
টুনি: (মাথা ঝাঁকিয়ে) আমি জানি তুমি কোই যাও।
নাজু: জানলে কি হইবো?
টুনি: কিছু না। (মনোযোগ) দেয় ফুলের প্রতি।)
(চতুর্থ দৃশ্য)
[যাত্রী বোঝাই একটি টেম্পু এসে থামে। একজন মহিলা বাচ্চা কোলে নেমে রাস্তার ঢাল বেয়ে নেমে যায়। টেম্পুর ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে বললো, গোয়াল বাড়ি দুই ট্যাকা।]
(নাজু এগিয়ে গিয়ে দেখলো বসার জন্য খুবই সামান্য জায়গা রয়েছে। (স্বগত) এত কম জাগায় বসুম ক্যামনে? (সে টেম্পুতে না উঠে ফিরে আসে। ড্রাইভার আবার বলতে থাকে, গোয়াল বাড়ি দুই ট্যাকা, কে যাইবেন আসেন। একজন, একজন!)
(টুনি উঠে বালতি রেখেই এগিয়ে যায়।) এক ট্যাকা দিমু। নিবা?
ড্রাইভার: লগে ট্যাকা নাই?
টুনি: থাকলেই কি দিমু নাকি? আমার ভাড়া এক ট্যাকা। নিবা?
(ড্রাইভার মাথা নাড়িয়ে উঠার ইঙ্গিত দিলে টুনি দৌড়ে গিয়ে ফুলের বালতি নিয়ে আসে।)
ড্রাইভার: (হাসতে হাসতে) বালতির ভাড়াই তো দুই ট্যাকা!
(কথা শুনে টুনি বালতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।)
ড্রাইভার: উঠ ছেড়ি!
টুনি: এক ট্যাকা দিমু!
ড্রাইভার (হেসে): উইঠ্যা বয়!
(টুনি আগে বালতিটা তুলে দিয়ে হ্যান্ডেল ধরে উঠে সিটে বসে পড়ে। টেম্পু ছেড়ে দিলে টুনি আজাদের দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে ভ্যাংচায়।)
(পঞ্চম দৃশ্য)
(পুষ্পা হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে তাকায় খোকনের দিকে।) ওদিকে কোনো গন্ডগোল হয়েছে নাকি?
খোকন: (তাকিয়ে পুষ্পার কথা ধরতে চেষ্টা করে।)
পুষ্পা: জানেন কিছু?
খোকন: তেমন কিছু তো শুনিনি।
তারপর (আজাদের দিকে তাকিয়ে) তুই কিছু শুনেছিস নাকি?
আজাদ: বুঝি নাই!
খোকন: ওদিকে কোনো গন্ডগোল হয়েছে কিনা জানিস?
আজাদ: (অবাক হয়ে তাকায়।) কিছু জানেন না? আমি তো ভাবছি আপনে জানেন!
খোকন: কি জানবো?
আজাদ: সকালে মেঘনা ঘাটে লাল আর সবুজ দলের মারামারি হইছে। লাল দলেরা সবুজ দলের গাড়ি আইতে দিতাছে না।
পুষ্পা: তাহলে উপায়? আজ তো আমাকে না গেলেই নয়!
খোকন: আমারও। সাড়ে নটায় ইন্টারভিউ আরম্ভ হওয়ার কথা।
পুষ্পা: কোথায় যাবেন আপনি?
খোকন: নয়া পল্টন।
পুষ্পা: আমার অফিসও সেখানেই।
খোকন: এখান থেকেই রোজ অফিস করেন?
পুষ্পা: না। এখানে আমাদের বাড়ি। প্রতি সপ্তাহে আসি। (হাত তুলে একটা বাড়ি দেখিয়ে) ওই যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা, ওটাই।
খোকন: (কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে স্বগত ভাবে বলে, ওটা তো আলাউদ্দিন মাস্টারের বাড়ি।
তারপর পুষ্পার দিকে ফিরে) আলাউদ্দিন স্যার আপনার কেউ হন?
পুষ্পা: (হেসে) আমার বাবা!
খোকন: (কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পুষ্পার মুখের দিকে।) স্বগত ভাবে বলে, একি পুষ্পা না রূপসা?
পুষ্পা: কি ভাবছেন?
খোকন: (মাথা চুলকে) ভাবছিলাম আপনি পুষ্পা না রূপসা!
পুষ্পা: তাহলে আমাদের চেনেন?
খোকন: অনেক আগে দেখেছি। আমি যখন টেনে পড়ি তখন আপানারা দু বোন সিক্সে পড়েন।
পুষ্পা: (স্বগত) আমাদের কথা জানে। চেনেও। তাহলে কে? বুঝতে তো পারছি না! বাবার প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে আশরাফ, সিরাজ আর হেদায়েত ছিলো। আশরাফকে যে পছন্দ করতাম সেটা আশরাফ জানতো, সেও আমাকে পছন্দ করতো। তারপর যে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল আশরাফ! (সে কিছুক্ষণ খোকনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।) আপনি কি আমাদের বাড়িতে মানে বাবার কাছে প্রায়ই আসতেন?
খোকন: হ্যাঁ কতদিন যে ভাত খেয়েছি তারও ঠিক নেই।
পুষ্পা: (মুখ হঠাৎ ঝলমল করে উঠে।) আপনার নামটা বলেন তো, চিনতে পারি কি না!
খোকন: তার আগে বলেন আপনি পুষ্পা না রূপসা?
পুষ্পা: আপনি ভেবে বলেন তো!
(ফ্লাশব্যাক: দুহাতে বুকে বই-খাতা চেপে ধরে দুবোন গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে। ঢিল ছুঁড়ে গাছ থেকে আম পাড়ছে। গায়ে আর কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে উঠোনে ছড়ানো ধান পায়ে নাড়ছে পুষ্পা। গরুর সামনে পানিতে খৈল আর ভূসি গুলিয়ে দিচ্ছে রূপসা। স্কুলের বার্ষিক নাটকে ঈশ্বরী পাটনী হয়ে লক্ষ্মীর বেশে দীপ্তির সামনে হাত জোড় করে পুষ্পা বলছে, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে! পুষ্পা একদিন খোকনের চিঠি পেয়ে ক্ষেপে উঠে লাঠি হাতে তাড়া করেছিলো তাকে।
এভাবে একবার কিশোরী পুষ্পা আরেকবার রুপসার মুখ ভেসে উঠতে থাকে। খোকন হঠাৎ হাসি মুখে আঙ্গুল তাক করে পুষ্পার মুখের দিকে।): আপনি পুষ্পা!
পুষ্পা: চিনতে এত সময় লাগলো?
খোকন: দশ বছর আগের দেখা। আপনি দেখতে কি তেমন আছেন? তখন ছিলেন এক রকম, এখন আরেক রকম।
পুষ্পা: আমি যতটুকু বুঝতে পারছি আপনি আশরাফ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
খোকন: (কিছু একটা ভেবে নিয়ে) আশরাফ আর সিরাজের চেহারা প্রায় একই রকম দেখতে। অন্যরা ভাবতো আমরা জমজ। তবু কি করে বুঝতে পারছেন আমি আশরাফ?
পুষ্পা: (হাসতে হাসতে) সিরাজের ডান চোখটা ছোট ছিলো।
খোকন: ঠিক। আমারও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে যে, আগে চিনতে পারলেন না কেন?
পুষ্পা (হেসে): কারণ একটাই। ভাবনাতে যেটা থাকে না, তা চোখের সামনে থাকলেও মানুষ সেটাকে গুরুত্ব দেয় না।
খোকন: আমার ডাক নাম যে খোকন তা কিন্তু আপনি জানতেন।
পুষ্পা: (কলকল করে হেসে) এখনই মনে পড়লো। আচ্ছা, নয়াপল্টন কোথায় যাবেন?
খোকন: ঋষি-তে।
পুষ্পা: আমি তো ওখানেই কাজ করি! কোন পোস্টে অ্যাপ্লাই করেছেন?
খোকন: স্ক্রিপ্ট রাইটার!
পুষ্পা: অন্য ভালো পোস্টও তো ছিলো।
খোকন: অন্যগুলো পছন্দ হলো না।
পুষ্পা: আপনি তো লেখক মানুষ। পোস্টটা আপনার জন্য ভালোই হবে। (হাতের ঘড়ি দেখে) আর তো বেশি সময় নেই। আচ্ছা আমি ফোনে কথা বলছি।
পুষ্পা: (কানে সেল ফোন লাগিয়ে) হ্যালো রিয়া, আমি বাস-ট্যাক্সি কিছুই পাচ্ছি না।
রিয়া: তুমি কোথায়?
পুষ্পা: বাবার এখানে এসে এখন ফেঁসে গেছিরে! মেঘনা ঘাটের কাছে নাকি বাসগুলোকে শ্রমিকরা আটকে রেখেছে।
রিয়া: আস্তে ধীরে এসো।
পুষ্পা: সাড়ে নটায় ইন্টারভিউ কল করেছে নাকি?
রিয়া: বারোটার দিকে হতে পারে। আজ নাও হতে পারে।
পুষ্পা: তাহলে রাখছি। কেমন? ফারজানা আপাকে বলিস!
রিয়া: আচ্ছা, বলবো।
(ষষ্ঠ দৃশ্য)
[ পুষ্পা একটা বড়-সড় টেবিলের পেছনে গদি আটা চেয়ারে বসে আছে। সামনে বসে আছে খোকন। টেবিলে রাখা আছে কফির কাপ। কাপ থেকে গরম কফির ধোঁয়া উড়ছে। পুষ্পার সামনে রাখা দুটো সাদা আর সবুজ টেলিফোন। সে সবুজ রিসিভার কানে লাগিয়ে বলবে, হ্যালো) কারো কথা শুনতে শুনতে কেবল জ্বি, আচ্ছা! ঠিক আছে! আপনি ভাববেন না! কথাগুলোই শোনা যাবে।]
(রিসিভার রেখে পুষ্পা খোকনের দিকে মনোযোগ দেয়।) তারপর কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলেন বলেন?
খোকন: (হেসে।) তা জানার কি আর দরকার আছে?
পুষ্পা: আছে। আসলে সেদিনের ঘটনাটার জন্য আজও মনে মনে কষ্ট পাই। অনুশোচনায় ভুগি কৃতকর্মের জন্য। আমার তো মনে হয় আপনি সেদিনের পর থেকেই আমাদের বাড়িতে বা স্কুলে আসেননি।
খোকন: (কফিতে চুমুক দিয়ে) নানার স্কুলে নাম তোলা ছিলো, নাইনে রেজিস্ট্রেশনও করা ছিলো। নানাকে গিয়ে বললাম সমস্যার কথা। আপনার অনাচারের কথা। নানা শুনে বললেন ভালোই করেছিস। তার পর ভিক্টোরিয়া কলেজ। চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে অনার্স-মাস্টার্স।
পুষ্পা: এতদিন বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিলো না?
খোকন: ছিলো।
পুষ্পা: আমাদের মাঝে দেখা হলো না কেন?
খোকন: এতদিন সোনারগাঁ স্টেশন থেকে আসা যাওয়া করেছি। অবশ্য আজও দেখা হতো না। হাতে সময় ছিলো না বলেই এখানে এসে উঠেছিলাম।
পুষ্পা: (মুখটা মলিন। কেমন যেন অপরাধীর ভাব ফুটে আছে।) আমাকে নিশ্চয়ই ঘৃণা করতেন!
খোকন: (হেসে) তা মনে হয় না। নিজেই তো নিজের কাছে অপরাধী হয়ে আছি!
পুষ্পা: সপ্তাহ খানেক পর আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। মুন্নি কিছু বলতে পারেনি।
খোকন: আমি তো ভেবেছি আমার এই পোড়া মুখ আর দেখাবো না। তাই তো...
(খোকন কথা শেষ না করে অস্বস্তি নিয়ে হাতের নখগুলো দেখতে থাকে।)
পুষ্পা (ম্লান মুখে): প্লিজ! ওভাবে বলতে হয় না। (একটা হাত খোকনের হাতের উপর রাখে।) তখন বয়স ছিলো কম। চলেছিও আবেগ দিয়ে। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ বুঝতে পারলে আমাকে এভাবে কষ্ট পেতে হতো না। (পুষ্পার দুচোখের কোলে ফুটে উঠলো দুফোঁটা অশ্রু।)
(সপ্তম দৃশ্য)
[একটি ধীর লয়ের সুন্দর প্রেমের গান নেপথ্যে বেজে উঠে। আর তখনই খোকন আর পুষ্পাকে দেখা যায় একই রিকশায়। দেখা যায় মতিঝিলের বাসস্ট্যান্ডে জনতার ভিড়ে। ফুটপাত ধরে হাঁটে পাশাপাশি। কখনো হাত ধরে। কখনো বসে আছে খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে পার্কের সবুজ ঘাসের গালিচায়।]
(সমাপ্ত)
অক্টোবর-২০০৭
মাজমাহ
সৌদি আরাবিয়া
মন্তব্য
নাটক পাঠ করা কষ্টকর। তবুও পড়লাম এবং ভালো লাগল।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ। ভাবছিলাম ভূষিমাল। মুখ দেখানের পথ রইলো না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
আরি সব্বোনাশ জুলিয়ান ভাই দেহি নাটক নামাইছে!
তয় খারাপ লাগে নাই।
-----------------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ। ভাবছিলাম ভূষিমাল। মুখ দেখানের পথ রইলো না।
নির্দিষ্ট কোনো গুচ্ছের থাকতে চাইতাসি না। চাই পুরা সচলায়তনের দোস্ত থাকতে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ভাল লাগলো! তবে শুরুতে পাত্র পাত্রীর পরিচয় না দিলেই পারতেন। ব্লগে তো প্রথ্মএ ওসব দেখে পাঠ্ক তেমন আসেনি।
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ। ভাবছিলাম ভূষিমাল। মুখ দেখানের পথ রইলো না।
তবে এইটাও একটা ভালো দিক, রঙ দেখাইয়া আকর্ষণের ভয়টা ছিলো না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন