কম্পেন্ডার

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: শনি, ০৫/০৭/২০০৮ - ৪:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সকালের কড়া রোদে সময়টা খারাপ গেলেও দুপুরের পর থেকে তেমন একটা খারাপ লাগে না সোভানের। আকাশটা ফের মেঘলা হয়ে যাওয়াতে সূর্যের তেজ অনেকাংশেই স্তিমিত হয়ে এসেছে। রোদে শরীর ঘেমে শুকিয়ে যাওয়ার ফলে চামড়া কেমন চড়বড় করতে থাকে। হালকা পাউডারের গুঁড়োর মত লবন ভাসে। দৃষ্টিতে হতাশা নিয়ে চারদিকে প্লাবিত জনপদের দিকে তাকায় সোভান। পাশেই রোদে শুকোতে দেয়া মলিন গামছাটা নিয়ে শরীরে লেগে থাকা ঘামের লবন পরিষ্কার করে।

শরীর মুছতে মুছতেই প্রচন্ড ক্ষুধা আর পানির তিয়াস অনুভব করলেও পানির বোতলে বা চিড়াগুড়ের প্যাকেটে হাত দিতে অযথাই কালক্ষেপন করে সে। বোতলে যতটুকু পানি আছে তা ফুরিয়ে গেলে পরে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ঘরের ভেতরটা পুরোপুরিই ডুবে আছে পানির নিচে। আজ দশদিন হলো সে বাস করছে ঘরের চালের উপর। ঘুম-নিদ্রা বলতে গেলে নেই। যেটুকু পলিথিন দিয়ে কাঁথা-বালিশ ঢেকে রেখেছে, বৃষ্টির সময় সেটা দিয়ে নিজকেও আবৃত করতে হয়। কিন্তু এত কষ্টের মাঝেও কোথাও যাওয়ার কিংবা বাঁধে গিয়ে আশ্রয় নেয়ারও কোনো আগ্রহ বোধ করে না। রোদের তাপে কাঁথা-বালিশ দু'টো মোটামুটি শুকিয়ে এলেও আকাশের অবস্থা দেখে তার ভালো লাগে না।

চারদিন আগে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে এক প্যাকেট চিড়া-গুড় আর এক বোতল পানি পেয়েছিলো। তাতেই সে টিকে আছে কোনো রকমে। কিন্তু চিড়াগুড় যা আছে তা এখন খেয়ে ফেললে রাতে বা পরদিনের সংস্থান নেই। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার মন খারাপ হয়ে যায়। এবার যদি বৃষ্টি আরম্ভ হয় তাহলে তার চালের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও পানির নিচে চলে যাবে। তখন যে তার কী উপায় হবে তাই বসে বসে ভাবছিলো।

ভাবছিলো নুহের ছেলে কেনানের কথা। যে পাহাড়ে চড়েও প্লাবনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নিজের ঘরের চালে দু'হাঁটু মুড়ে বসে থাকলেও কেমন যেন নিজকে কেনান কেনান মনে হচ্ছিলো সোভানের। নুহের তো নৌকা ছিলো। কেনানকে আহ্বান করেছিলো নৌকায় উঠতে। কিন্তু সে গ্রাহ্য করেনি বলেই ভেসে গিয়েছিলো। তাই তারও উচিত হবে না জাহেদার আহ্বানকে উপেক্ষা করা। সকালের দিকে জাহেদা ভেলায় চড়ে যাওয়ার সময় একবার তার চালের সঙ্গে ভিড়েছিলো। বলেছিলো, 'বান্ধের উপরে আইয়া পড়! খবর পাইছি পানি আরো বাড়বো। বান্ধে নাহি পানি চুয়াইতাছে!'

সোভান কি বলবে! তার জগতে কেউ নেই যে তার এমন দুরবস্থা নিয়ে ভাববে। তবুও তার মনে কিছুটা সান্ত্বনা জাগে যে, জাহেদা অন্তত: তাকে নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবছে। সে জানিয়ে গেছে, বাঁধের উপর নাকি আজ রিলিফ দেবে। খবর সঠিক হলে ফের এসে জানিয়ে যাবে।

সেই থেকেই সোভান মনের সঙ্গে কথা বলে চলেছে। জাহেদা দু'একদিন পরপরই তার খোঁজ নিতে আসে। মাঝে মধ্যে দুঃখ করে বলেছে, 'তোমার তফাজ্জল ভাই যে কোই গায়েব হইয়া গেল আর কোনো হুজ পাইলাম না! মরিয়ম কইছিলো ব্যাডায় আরেকটা বিয়া করছে!'

এত কষ্টের মাঝেও জাহেদার কথা শুনে না হেসে পারেনি সোভান। বলেছিলো, 'ব্যাডায় তোমারেই ভাত-কাফর দিতে না পাইরা পলাইছে, আরেকটা বিয়া করলে নতুন বউরে খাওয়াইবো-পিন্দাইবো ক্যামনে?'

জাহেদা চুপচাপ দূরে বাঁধের দিকে তাকিয়েছিলো। মুখটা বেশ শুকনো দেখাচ্ছিলো। সোভান বলেছিলো, 'তোমার মুখটা দেহি হুগনা মনে অইতাছে! বিয়ানে কিছু খাইছিলা?'

জাহেদা বলেছিলো, 'আমার চিড়াগুড় পানিত পইড়া ডুইব্যা গেছে!'

সোভান পলিথিনে মোড়ানো চিড়াগুড়ের প্যাকেটটা বের করে জাহেদার হাতে তুলে দিয়েছিলো।

প্যাকেট হাতে নিতে নিতে জাহেদা বলেছিলো, 'তোমারিত্ত নাই, আমারে দিতাছ কি বুইজ্যা?'

সোভান কথায় জোর দিয়ে বলেছিলো, 'খাও দুই মুঠ! না খাইলে চলবা ক্যামনে?'

জাহেদা ছোট ছোট দু’মুঠ চিড়া নিয়ে মুখে দিয়ে অনেক্ষণ সময় নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে গিলে ফেলেছিলো গুড় ছাড়াই। পানিও খেয়েছিলো সোভানের ভাগে যেন কম না পড়ে এমন হিসেবে।

তারপর বলেছিলো বাঁধের কথা। তখন কেন যেন সোভানের ততটা আগ্রহ হয়নি। সেখানে আগে থেকেই অনেক মানুষ তাদের গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি নিয়ে থাকতে আরম্ভ করেছে। নতুন লোক গিয়ে কি ঠাঁই পাবে? তা ছাড়া কাড়াকাড়ি করে রিলিফের কতটুকুই বা পাওয়া যায়! তবুও এখন মনে হচ্ছে যে, জাহেদার কথাটাই যেন সঠিক! পানি আরো বৃদ্ধি পেলে তার ঘরের চালও ডুবে যাবে। আর বাঁধের ফাঁটল দিয়ে যদি পানি চুয়ায় তো বিপদ হবে আরো বেশি। বাঁধ ভেঙে গেলে পানির স্রোত ঠেলে কলাগাছের ভেলা নিয়ে উজানে যাওয়া খুব একটা সহজ হবে না। যেতে হলে এখনই। পরে সুযোগ নাও থাকতে পারে!

সে চিড়াগুড়ের প্যাকেট বের করে খুব দ্রুতই সবটুকু খেয়ে নেয়। বোতলের পানিটা শেষ করে ফেলে দু'ঢোকেই। পানির তিয়াস যদিও মিটলো কিন্তু তার পেটের ক্ষুধার কোনো তারতম্য ঘটে না। আর তখনই সে কাঁথা-বালিশ গুটিয়ে পলিথিন দিয়ে ভালো করে প্যাঁচায়। এখানে থাকা আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না!

ঘরের চালের সঙ্গেই বেঁধে রাখা কলার ভেলাটাতেও পঁচন ধরেছে। নাড়া খেলেই কেমন যেন খসে খসে পড়তে চায়। আগের মত পুরোপুরি ভর সইতে পারে না। একদিক দিয়ে গড়ান দিয়ে পানি উঠে অন্যপাশে চলে যায়। একটু জোরে চালাতে চাইলেও সামনের দিকটা ডুবে থাকে পানির নিচে। পথ আগায় না। দু'পায়ের ফাঁকে পলিথিনে মোড়ানো কাঁথা-বালিশ রেখে সাবধানে লগি হাতে ভোলাটাকে সামনের দিকে ঠেলে। কিন্তু জোরে ভর না দিলেও সামনের দিকটা অর্ধেকের মত পানির নিচেই তলিয়ে থাকে। সে ভাবে, বান্ধ পর্যন্ত যাইতে পারমু? সাঁতরাইয়া তো এতটা পথ যাওন সম্ভব না!

লগিতে আরেকটা ভর দিতেই কঞ্চি আর পাঁটের দড়ি দিয়ে জুড়ে রাখা কলাগাছগুলোর একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সে ভেলার উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ডুবে যাচ্ছে ভেলা। ভিজে যাচ্ছে কাঁথা-বালিশ। লগিটাকে ভেলার উপর শুইয়ে দিয়ে সে ঝুঁপ করে লাফিয়ে পড়ে পানিতে। কলাগাছ ধরে পা দু'টো নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে মাটির নাগাল পেতে চেষ্টা করে। কিন্তু পানিতে মাথা ভাসিয়ে রেখেও সে মাটির নাগাল পায় না। ভেলা ধরে আস্তে আস্তে পায়ে পানি কেটে সামনের দিকে এগোতে থাকে সে।

আশপাশের কোনো বাড়িতেই মানুষজন চোখে পড়ে না। যে ক’টি উঁচু বাড়ি আছে, তাতেও দেখা যায় মানুষ আর গরুছাগলে এলাহি কান্ড! সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেও এমন কি বাঁধের দিকে যাচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করলেও কেউ বললো না যে, তাদের এখানে জায়গা আছে। সে ইচ্ছে করলে উঠতে পারে!

এরই মধ্যে টিপটিপ করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়।

সোভান নিজের জন্যে ভাবে না। ভাবে তার কাঁথাবালিশের জন্য। কয়েকটা দিন কষ্ট করার পর আজ রোদে দিয়ে দু’টোকেই কিছুটা শুকিয়ে নিতে পেরেছিলো। আবার যদি ভিজে যায় তো তাকে আবারও কষ্ট করতে হবে। এমনিতেই তো কষ্টে আছে। তার উপর যদি নতুন কষ্ট যোগ হয়, তাহলে সেটা বোঝার উপর শাকের আঁটির চাইতেও খারাপ হবে সন্দেহ নেই। তা ছাড়া সে যাচ্ছে মানিকচর বাঁধের উপর। সেখানে তার এমন কেউ নেই যে তার জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছে। সেখানে সে কোথায় উঠবে, কোথায় বা মাথা গুঁজবে তারই কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সম্পূর্ণ উপন্যাসটি এখানে PDF করে দেওয়া হল


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দারুণ একটা উপন্যাসের সূচনা মনে হচেছ?

চমৎকার

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

তাইলে এখনো পড়েন নাই? পইড়া কমেন্ট না কেবল আলাদা পোস্টে একটা পূর্নাঙ্গ সমালোচনা চাই। সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরী হোক সচলায়তনে।
আশেষ ধন্যবাদ।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পুরো উপন্যাস দিলেন? তাইলে তো সময় নিয়ে পড়ে তারপর মন্তব্যাইতে হবে... পড়ে ফেলবো শিঘ্রি।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

হ! তাইলে আর আপনের সময় হইসে। আর এইডা বুইঝ্যাই লিংক এর ব্যবস্থা করলাম।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

কীর্তিনাশা এর ছবি

হ পড়ে ফেলবো শিঘ্রি। তবে সূচনাটা খুব ভালো।
--------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আর হইসে। এক সময় সেবা প্রকাশনীর বইয়ের খুব ভক্ত ছিলাম। পরে মনে হইলো ঘটনা সবই প্রায় একই রকম (রোমান্টিক ছাড়া), তখন বইয়ের পিছনের দিকের লেখাটা পইড়া রাইখ্যা দিতাম। কিনতাম না। হা হা হা!
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

অমিত আহমেদ এর ছবি

উপন্যাসটি ডাউনলোড করেছি। পড়ে অবশ্যই মন্তব্য দেবো। সচলে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস দেবার জন্য ধন্যবাদ।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

কম্পেন্ডার লিংকটি এখানে
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

শেখ জলিল এর ছবি

বড্ড দেরিতে এলাম পড়তে। শুরুটা খুব ভালো লাগলো। কিন্তু পুরো উপন্যাস ডাউনলোডের লিংকটা এখন আর কাজ করছে না!

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ধন্যবাদ। কিন্তু উপরের মন্তবৌই লিংকটি আছে।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।