রাতের অন্ধকার যেমন চিরকাল থাকে না। দিনের আলোও তেমনি চিরকাল থাকে না। একটি নিয়মে তাদের বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আমরা যে মানুষ, কখনও কখনও প্রকৃতিকে শৃঙ্খলিত করার অপচেষ্টা চালাই। কখনও বা চেষ্টা করি উপেক্ষা করতে। কিন্তু সেই যে “হে অতীত তুমি ভূবনে ভূবনে / কাজ করে যাও গোপনে গোপনে!” কথাটি মনে থাকলেও ঠিক সময়টিতে ভুলে বসে থাকি। কেউ মনে করিয়ে দিলে ব্যথা পাই।
আমি যখন সৌদি আরবে চলে আসি। আমার হাতে একদম সময় ছিলো না। মা বললেন, ভাই-ভাবিদের সঙ্গে দেখা করে বিদায় নিতে। শেষ সময়ে কি হয় বলা যায় না। এক দেশ ছেড়ে আরেক দেশে যাচ্ছি, ফিরতে পারি কি না কিংবা ফিরে এসে আর কারো সঙ্গে দেখা হবে কি না, সেই অনিশ্চয়তা থেকেও মা কথাটি আমাকে বলে থাকতে পারেন। তাই ঘুরে ঘুরে আমি সবার সঙ্গেই দেখা করতে গেলাম।
আমার সেজভাই দীর্ঘকাল সরকারি চাকরি করেছেন সমাজ সেবা অধিদপ্তরের অধীনে। তাঁর চাকরির সময়কালটা বলতে গেলে আমাদের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা করতে আসতেন। মেজ আর সেজ ভাইয়ের চাকরির শুরুতে বাবা তাঁদের জন্যে পাত্রী ঠিক করলেন। অবশ্য মেজ ভাইও বুয়েটের পাট চুকিয়ে পিডব্লিউডিতে যোগ দিয়েছেন। পাত্র হিসেবে মেজ-সেজ দু’ভাই-ই কন্যাপক্ষের কাছে মোটামুটি আদর্শ। পাত্রীর বাবা খুবই ধার্মিক মানুষ ছিলেন। আমাদের বাসায় একদিন তাঁর কন্যার জন্যেও পাত্র দেখতে এলেন। যোহরের সময় হওয়াতে সেই ভদ্রলোক অজু করে নামাজ পড়তে আরম্ভ করলেন। তিনি মাথায় যে টুপিটা পরেছিলেন তা একদিকে সেলাই খুলে গিয়েছিলো। আমার ভাইয়েরা বললেন, ছেঁড়াটুপি। লোকটার মাথা ঠিক নেই। তাঁর মেয়েরাও বাপের স্বভাব পেলেও পেতে পারে। যদিও আমাদের জেলায় তিনি খুবই সম্মানের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু আমার ভাইয়েরা তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ঘোষনা দিয়ে দিলেন যে, এমন লোকের মেয়ে বিয়ে করা যাবে না। বাবা কত না বোঝাতে চেষ্টা করলেন। রাগারাগি করলেন, অভিমান করলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। সেজ ভাই চলে গেলেন তাঁর কর্মস্থলে। ফলে, মেজ ভাইকেও বাবা এ নিয়ে আর বিরক্ত করলেন না। ব্যাপারটি সেখানেই চাপা পড়ে যায়।
কিছুদিন পর জানা গেল যে, তিনি নারী সদনের কোনো এক হিন্দু বিধবার প্রেমে পড়েছেন। শুধু কি তাই। কাচ্চা-বাচ্চা সহ। বিয়ে করার জন্যে তিনি কর্মস্থল থেকে ঢাকায় আসতে লাগলেন। সঙ্গে নিয়ে আসতেন নানা রকম ভেট। কিন্তু বাবা মায়ের মন গলেছিলো কি না বা তাঁরা অনুমতি দিয়েছিলেন কি না জানি না। সেই বিধবাকে বিয়ে করে তার দু’সন্তানকে দত্তক নিয়ে ধর্মান্তরিত করে মোটামুটি সুস্থির হয়েই বাবাকে চিঠিতে সব জানালেন। কষ্ট পেলেও বেশির ভাগ বাবাই কাঁদেন না। কিন্তু মায়েদের অতটা শক্ত মন নয় বলে তাঁদের চোখ পানিতে ভাসে অবলীলায়। মাও কান্নাকাটি করলেন। কিন্তু কান্নাকাটি করলে কি আর সব কিছু বদলায়? ফলে, সেজ ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিবারের যোগাযোগ দিনদিন কমতে লাগলো। বাবা বেতনের টাকায় আমাদের সামলাতে পারতেন না বলে, চাকরিরত ছেলেদের কাছে টাকা চাইতেন। জবাবে সেজ ভাই কড়াকড়া ভাষায় অসৌজন্যমূলক চিঠি পাঠাতেন। বাবা হয়তো কষ্ট পেতেন। সেই কষ্টটুকু বাইরে থেকে তেমন বোঝা যেতো না। হয়তো ছোট ছিলাম বলেই বুঝতে পারতাম না।
তারপর সেজভাই একদিন চিঠিতে জানালেন যে, তিনি একটি পুত্রসন্তানের বাবা হয়েছেন।
সেই পুত্র কালে কালে সাবালক হয়েছে। সেজভাইও চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। পিতার পথ ধরে তাঁর ছেলেও কোনো এক বিবাহিতা হিন্দু রমণীর প্রতি আসক্ত হয়। তো সেদিন দেখা হওয়াতে তিনি দুঃখ করে বলছিলেন যে, ছেলে বাবা মায়ের বারণ মানে না। আমি তখন বলেছিলাম, ‘বাবা মায়ের অমতে আপনি যখন বিয়ে করেছিলেন, তখন বাবা মা কেমন কষ্টটুকু পেয়েছিলেন, তা এখন অনুভব করতে পারবেন!’
যদিও আমাদের পরিবারের সবাই আমাকে ঠোঁটকাটা হিসেবেই জানে। তবুও আমার এই সামান্য ক’টি কথাতেই তাঁর চোখ দু’টো ভিজে উঠেছিলো।
আমি আর সেই বিষয়ের দিকে আগালাম না। আমাকে দেশ ছেড়ে যেতে হচ্ছে জীবিকার তাগিদে। শেষ সময়ে কাউকে ব্যথিত করতে চাই না। মনও সায় দিচ্ছিলো না। তবে আমি মনেমনে তখনই প্রস্তুত হয়ে গেছি যে, বাবার সঙ্গে যেমন আচরণ করেছি, আমার সন্তানরাও আমার সঙ্গে তেমন আচরণই করবে। কারণ ক্ষেতের চাকা তো ক্ষেতেই ভাঙে! এ আর এমন বিচিত্র কি!
মন্তব্য
জুলিয়ান,
আপনার পোষ্টের শিরোনাম সত্য। এ'বিষয়ে দ্বিমত নাই।
ঘটনাগুলিকে আপনি যেভাবে দেখেছেন বা অনুভব করেছেন তার অন্যদিকেও গল্প আছে নিশ্চয়ই। আমরা সব সময়েই শুঢু একটা দিক দেখি, সেটাই িজি বলে বোধ হয়। তবে মুদ্রার অন্যপিঠেও ছবি থাকে, আর সেই ছবিতে গল্পও থাকে। সেগুলোকেও জানা দরকার, বোঝা দরকার নইলে একপেশে হয়ে যায়।
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
মুদ্রার এদিকটার কথাই তো বললাম।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
বাস্তবতা নিয়ে লেখা খুব রূঢ় হয়, এখানেও ব্যতিক্রম নয়।
খুব ভাল লেখা।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
জুলিয়ান ভাই বরাবরের মতই অনবদ্য।
-----------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
বুঝলাম না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ঠিক ক্ষেতের চাকা ক্ষেতেই ভাঙে। শিখলাম।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
খুবই ভাল। বুড়া বয়সে কানতে হবে না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
সাবলীল গদ্য। বেশ শিক্ষণীয়। লিখে যান এরকম আরও অভিজ্ঞতা।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
ধন্যবাদ। কিন্তু জলিল ভাই, অভিজ্ঞতা বেশির ভাগই আমাকে কষ্ট দেয়। সেই সঙ্গে কিছুটা বিব্রতকরও। বিশেষ করে আনন্দের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে হাতে গোণা।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন