ঘরে ফিরে কারখানায় যাবার জন্যে দ্রুত তৈরী হয়ে সাগর বেরিয়ে পড়ে। আজ খুবই দেরি হয়ে গেছে। মালিকের বকাঝকা কপালে আছে নিশ্চয়ই। সে কিছুটা ভয়ে ভয়েই কারখানায় ঢোকে। কারখানার মালিক জমিরউদ্দিনের খোঁজে এদিক ওদিক দৃষ্টি বুলায়। না। চোখে পড়ে না।
তাইলে কি আইজ আহে নাই?
মনে মনে ভাবে সাগর।
'কি রে সাগর কলা, আইজ দেরী কইরা ঘুম ভাঙলো মনে অয়?'
এক কোণা থেকে তার প্রিয় বন্ধু আসমত মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করে।
সাগর তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, 'দোস্ত আইজ মালিকরে দেহি না যে?'
'তুইও তো কোনোদিন দেরি করস নাই!'
'আমার হঠাৎ একটু অসুবিধা অইছিলো!'
'তর লগে লগে মালিকেরও অসুবিধা শুরু অইছে!' বলে হাসে আসমত।
তারপর আবার বলে, 'খবর পাডাইছে সকাল থাইকা তেনার ডায়রিয়া। তুই যেন একবার বাসায় গিয়া দেখা করস। পারলে অহনই যা!'
দ্বিধান্বিত সাগর অনিশ্চিত কন্ঠে বলে, 'অহনই যাইতে কস?'
'হ। তর কোনো কামের কথা তো কয় নাই!'
'তাইলে আমি গেলাম!'
অন্যান্যদের দিকে ফিরে সাগর বলল, 'মালিকের বাসায় যাইতাছি। কোনো খবর আছে কারো?'
বাতেন বলে একজন বলল, 'হুইলের বেল্ট ছিঁড়া যাইতে পারে। একটা বাড়তি আনাইয়া রাখতে হইবো!'
সাগর বলল, 'আর কারো কিছু?'
কেউ কিছু বলল না।
কারখানা থেকে বের হয়ে লালবাগ বেশি দূরে নয়। ওরা হেঁটেই চলে যায় সবসময়। আজ সাগর মুখ চেনা এক রিকশাঅলাকে বলল, 'লালবাগ লও!'
'লালবাগ কোই যাইবেন?'
সাগর বলল, 'আমি রাস্তা বাতামু!'
রিকশাওয়ালাকে পথ দেখিয়ে মহাজনের বাড়ির সামনে এসে নামে সাগর।
তারপর রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দরজার কড়া নাড়ে।
দরজার পাশে দেয়ালে মার্বেল পাথরে লেখা আছে 'মরিয়ম ভিলা।' প্রত্যেকবারই এ লেখাটা চোখে পড়লে তার মনে পড়ে যে, টিন শেড সেমি পাকা বাড়ি। অথচ এর নাম দিয়েছে ভিলা! এ সমস্ত ছোট-খাট বাড়িওয়ালারা নিজেদের খুব বেশি বাড়িওয়ালা ভাবে। হাবে ভাবে প্রকাশ থাকে যে, সে একটা বাড়ির মালিক! নামও দেয় তেমনি ভিলা, প্যালেস! তাদের ছেলে-মেয়েদের আচরণে প্রকাশ পায় ঈর্ষা, সংকীর্ণতা আর নীচতা।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর মহাজনের এক মাত্র মেয়ে লতা এসে দরজা খোলে। দেখতে বেসাইজ রকমের মোটা। চলে গরিলার মত হেলে দুলে। বয়স দেখতে মনে হয় আঠারো-বিশ। কিন্তু মোটে তের বছর বয়স। দুনিয়ার সব মানুষই তার কাছে ফকির-ফাকরা। যারা অসময়ে এসে বিরক্ত করে!
সাগরের মতে গঠন অনুযায়ী লতা নামটা তাকে মোটেও মানায়নি। মর্জিনা, বা সাজেদা-মাজেদা টাইপের নাম হলেই উপযুক্ত হত। এর আগে তার সাথে আরো অনেকবার দেখা হয়েছে। নামও জিজ্ঞেসস করেছে বহুবার। কিন্তু প্রত্যেকবারই বলে, 'কি চাই? নাম কি? কোত্থেইকা আসা হইলো?'
লতা সাগরকে দেখে গৎবাঁধা প্রশ্ন পর্ব সেরে মহা বিরক্তি নিয়ে বলল, 'আব্বার শরীরটা ভাল না! দেখা হইবো না!'
সাগর বলল, 'তানি আমারে আসতে খবর পাঠাইছিলেন! তানিরে গিয়া আমার নাম বললেই হইবো!'
লতা ভ্রু কুঁচকে বলল, 'নামটা জানি কি?'
'সাগর!'
মেয়েটা একবার মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু যেন ভাবল।
তারপর হেলেদুলে চলে গেল ঘরের ভেতর।
লতার যাবার পথেই তাকিয়ে থাকল সাগর। কিছুক্ষণ পর তাকে আবার দরজায় দেখা যায়।
দু'জনের চোখাচোখি হতেই লতা হাতের ইশারায় ডাকল সাগরকে।
সাগর ভেতরে ঢুকে লতার কাছাকাছি যেতেই জমিরুদ্দিন তাকে দেখতে পেয়ে ডাক দিলেন,'আয় সাগর। এত দেরি করলি কেন রে বাজান?'
'আইজ আইতেই লেট কইরা ফালাইছি!'
'কোনো অসুবিধা হইছিলো বুঝি?'
'হ মহাজন! কাইল্যা পাঁঠার মানুষ আইসা হল্লা-চিল্লা শুরু কইরা দিল!'
'অখন ঝামেলা মিটছে?'
'মিটছে। সবতেরে বিদায় কইরা দিয়া আইলাম!'
জমিরুদ্দিন তাকে ডেকে পাশে বসার ইঙ্গিত করলেন। কিন্তু সে না বসেই বলে, 'ঠিক আছে আপনে কন!'
হালকা ধমকের সুরে জমিরুদ্দিন বললেন, 'আরে বয় ব্যাটা! জরুরি কথা আছে!'
সাগর কাচুমাচু হয়ে এক পাশে বসে।
জমিরুদ্দিন বললেন, 'আমার শইলটা এক্কবারে কাহিল হইয়া গেছে! কাইলকার থেইকা আইজ পর্যন্ত দুইটা স্যালাইন নিছি। আর খাওনেরগুলা তো বাদই দিলাম! মগর অবস্থার কোনো উন্নতি নাই! তরে বাবা যেই কামে ডাকছি তা হইলো, তুই আইজ সব হিসাব-কিতাব লইস! যা-যা ডেলিভারি দ্যাওনের আছে রসিদ দেইখা পাওনা দেনা হিসাব কইরা রাখিস। নতুন কাম আইলে তাও এ্যাডভান্স রাইখা অর্ডার লইস। মনে কর আইজকা তর পরীক্ষা! স্বাধীন মত কাজ করনের কি কি অসুবিধা তাও বুঝবার পারবি!'
সাগরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 'যা অখন। রাইত আটটার দিকে সব বন কইরা তালা দিয় আইয়া পড়িস!'
তারপর কোমর থেকে চাবি বের করে সাগরের হাতে দিয়ে বললেন, 'ক্যাশে চাইর হাজার ট্যাকা আছে। ওই ট্যাকা থাইকা সাতাইশ'শ ট্যাকা দিবি মজিদরে! টালিতে অ্যাডভান্স হিসাবে লেইখা থুইস!'
সাগর উঠে জমিরউদ্দিনের পা ছুঁয়ে সালাম করে।
তিনি আৎকে উঠে বলেন, 'মানুষরে পায়ে সালাম করতে নাই বাপ!'
সাগর বেরোবার মুখে লতাকে দেখতে পায়। মনে মনে ভাবে, পলাইয়া কতা হুননের বদ অভ্যাস আছে মাইয়াডার!'
সে মূল ফটকের দিকে এগোলে পেছন পেছন লতাও আসে।
সাগর দরজা খুলে বাইরে বেরোবার সময় লতা বলল, 'ক্যাশে চাইর হাজার ট্যাকা আছে শুনছি! চুরি-দারি করলে হাকিমরে দিয়া হাত-পা ভাইঙ্গা ফালামু!'
সাগর লতাকে কিছু বলে না। মনেমনে বলে, হাকিমডা আবার কে?
মহাজনের ওপর কিছুটা রাগ হয় তার। তাইলে ক্যাশের চাবি আমারে দিলো ক্যান? ওই হাকিম নামের পালোয়ানটারে দিলেই তো অইতো!
তারপর আবার ভাবে, আসলে মালিক আমারে পরীক্ষায় ফালাইছে। আল্লা-তালা নবী-রসুলগরে যেমুন বিপদে ফালাইয়া পরীক্ষা করছেন, আমার মালিকও সেই বুদ্ধি করছে! হে রাহমানুর রাহিম আমারে বিপদে ফালাইও না! তুমি ছাড়া কিন্তু আমারে দ্যাহনের কেউ নাই! সার্ট ফাঁক করে বুকের কাছটায় একবার থুতু দেয় সে।
(চলবে..)
মন্তব্য
চলুক...
---------------------------------------
অর্থ নয়, কীর্তি নয় ,স্বচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। ধৈর্য থাকবে তো?
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ভাল লাগছে চলুক...
ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
জি জুলিয়ান ভাই বহুদিন পর আপনার লেখা পাইলাম। এইবার চালান দ্রুত। চলছে চলুক.............
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
কোটা পদ্ধতির করণে দ্রুত চালানো যাবে না। কমপক্ষে ২৪ঘন্টা।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
উপন্যাস নিয়া কিসু কইতেই ডর করে।কইলাম একটা দেহা গেল পরের পর্বে উল্টাইয়া গ্যাছে...। চলুক।
ধন্যবাদ।
.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......
.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......
যদ্দুর হইলো তা নিয়া অবশ্যই বলা যায়।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন