টুনি আশা করছিল এবার বুঝি সাগর তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। উম্মোচিত হবে তার আসল রূপ। কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও সাগরের মাঝে কোনো রকম পরিবর্তন দেখা যায় না। টুনি মনে মনে কিছুটা হতাশও হয়। সাগর কেমন জানি একটু বেশি ভদ্র। আরেকটু কম ভদ্র হলে বরং সে খুশি মনেই স্বাগত জানাতো তাকে। কারণ কাংক্ষিত জিনিস বেদনা বয়ে আনলেও তা সুখের। সাগর যে তাকে এতো ভালবাসে ব্যবহারে তা কোনো দিন প্রকাশ পায়নি। এ কেমন পুরুষ? আজগর তো তাকে প্রথম দিনেই নিষ্ঠুরের মত ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলেছিল। সে তুলনায় সাগর অন্য আরেক মানুষ যেন। সত্যিকার পুরুষ বুঝি এমনই হয়! যে লুটপাট করে না। টানা-হ্যাঁচড়া করে না। ছিন্ন-ভিন্ন করে না। দেবতার প্রাসাদের মত তার কাছে নিজকে সঁপে দিতে হয়। মন প্রসন্ন হলে গ্রহণ করবে, নচেৎ নয়।
দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ থেকে সাগর বলল, 'তোমার জীবনডা এমন না-ও অইতে পারতো। তোমার বাবায় যদি আজগর ভাইয়ের ট্যাকার লোভটা না করতো তাইলে...।' কথা শেষ না করে সাগর থেমে যায়। কিছু ভাবে যেন।
তারপর আবার বলতে থাকে, 'তাও আমি কইছিলাম তোমার কতা। কিন্তু আমি তো আর আজগর ভাইয়ের মন ট্যাকাঅলা না। আমি অইলাম তোমাগো কাছে জাউরা পোলা! বেজন্মা, বেজাত! তোমাগো লগে আমার সমাজ হইতে পারে না। কিন্তু জানো টুনি, আমার এই বয়সে যতগুলা পুরুষ-মানুষ দেখছি, তারা কেউ ভালা মানুষ না। কইলে রাগ কইরো না। এই যে তোমার বাপ এত মুসুল্লি মানুষ। নমাজ পড়ে পাঁচ-অক্ত। হেই তোমার বাপেরে দেখছি মদিনার লগে। দেখছি মালুর খালার লগে থাকতে। তার মাইয়া পরীরে সবে তোমার মত দেখতে কয় ক্যান জান?
টুনি বিভোর কন্ঠে বলে, 'ক্যান কয়?'
'পরী তোমার বাপের পয়দা। কিন্তু জিগাইলে গলায় ছুরি দিয়া না করবো!'
সাগর মাথা নিচু করে ফের কিছু একটা ভাবে। তখন দূর থেকে রাতের টহল পুলিশের বাঁশির শব্দ ভেসে আসে। রাতের নৈঃশব্দ ভেঙে-চুড়ে কোনো একটা মটরসাইকেল খুব দ্রুত রাস্তা অতিক্রম করে যায়।
সাগর এক সময় মাথা তুলে বলে, 'আইচ্ছা টুনি! একটা জিনিস আমার মাতায় ঢুকে না যে, খারাপ মায়ের পোলা জাউরা অয় ক্যামনে? কেউ না কেউ তো তারে জন্ম দিছে। সবে তো আর ঈসা নবী না! তাইলে জাউরা ক্যামনে হইলো আমারে কইতে পার? বাপ যদি মালুর খালার লগে আকাম কইরা তোমার ছোডো বইন পরী জন্ম দ্যায় তাইলে হেয় জাউরা অইবো না ক্যান?'
টুনি এত কঠিন কথা বোঝে না। বুঝতে চায় না। সাগরের জন্ম-ইতিহাসের কোনো প্রয়োজন নেই তার কাছে। তার কাছে এখন একমাত্র সত্য হচ্ছে যে, সে সাগরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। এ মুহূর্তে জগতের বড় সত্য সাগরের ভালবাসা। এটা যদি স্বপ্নও হয় তবুও তা সত্যি!
সাগর মনেমনে ভাবে যে, কে তার বাপ-এ কথা কেউ না জানলেও তার মা আর যে তার জন্ম-দাতা তারা তো জানে। সে কী করে জারজ হয়? তার মা তো বেশ্যা ছিল না। লোকটার সাথে ভালবাসার সম্পর্ক হয়েছিল। ভালবেসে তাকে গর্ভে ধারন করেছে তার মা। বাপ পরে তাকে সন্তান হিসেবে স্বীকার করলেও গ্রহণ করেনি। তার মাকে বিয়েও করেনি। তাই সে আজ পরিচয়হীন। আজ যদি লোকটা এসে বলে, সাগর আমি তোর বাপ! তাহলে তার জারজ অপবাদ ঘুচে যাবে। সমাজের আরো আট-দশটা সন্তানের মতো সেও বুক ফুলিয়ে হাঁটবে। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই। তার মতে জারজ হবে বেশ্যার সন্তানেরা। কারণ একই সময়ে যে নারীর একাধিক পুরুষের সাথে সম্পর্ক থাকে আর সে নারী ঠিক করতে না পারে যে সে-সন্তান কার? তবেই না সে সন্তান জারজ হবে!
আর কী আশ্চর্য! এ কথাটা মনে হতেই অনেকগুলো বছর পর তার বুকের ভেতর চেপে বসে থাকা কষ্টের ভারী পাথরটা অকস্মাৎ সরে যায় যেন। ঝুঁকে পড়া মাথাটা আপনা আপনিই যেন সোজা হয়ে যায়। এতকাল যে লজ্জার বোঝা তার মাথাকে হেঁট করে রেখেছিল সে মাথা আর কখনোই ঝুলে পড়বে না। সমাজের মানুষগুলোর সামনে হেঁট হয়ে আসবে না পিতৃপরিচয়হীনতার গ্লাণিতে।
টুনি কেমন এলোমেলো ভাবে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। খুলে গেছে খোঁপার বাঁধন। আঁচল সরে গিয়ে ব্লাউজের গলার কাছ থেকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে অদ্ভূত সুন্দর আর পেলব আকৃতির একটি ভি। আর তাতে চোখ পড়া মাত্রই সাগরের বুকের ভেতর সংগোপনে লুকিয়ে রাখা ইচ্ছেটা হঠাৎ ডানা ঝাঁপটিয়ে বেরিয়ে এল মুক্ত বিহঙ্গের মত। সে ইচ্ছেটা পরম মমতা মাখানো দু'ঠোঁটে টুনির বুকের ভি ছুঁয়ে দেয়।
টুনি হঠাৎ বিদ্যুৎপৃষ্টের মত উঠে বসে সাগরকে জাপটে ধরে বলে, 'সাগর, তুমি আমারে ছাইড়া যাইবা না। কেউ কোনোদিন আমারে কাইড়া নিতে আইলে তুমি রক্ষা করবা। কও, আমারে তোমার আপন কইরা নিবা?'
টুনির আচরণে একটি সিনেমার দৃশ্য মনে করে হেসে উঠে সাগর। টুনির ঘন কোকড়া চুলের ঘ্রাণ নেয় বুক ভরে। বলে, 'তুমি তো আমার আপনই আছ! তোমারে ছাড়া আমি তো আর কারো কাছে এমন সাহস, এমন ভরসা পাই নাই! কেবল তুমিই আমারে জাউরা বইলা ঘিন্না কর নাই! তুমি ছাড়া আপন আর কারে মনে করমু কও?'
টুনি এবার উঠে সাগরের মুখোমুখি হয়ে দু'হাতে তার চুল আঁচড়িয়ে দিতে দিতে বলে, 'কে তোমার বাপ আর কে তোমার মা, হেইডা দিয়া আমার কাম নাই। আমি জানি তোমারে। চিনি তোমারে। তোমার কি থাকল কি থাকল না, হেইডা আমার কামে আইবো না। তোমারে আল্লায় ভালা রাখুক, আমারে বাকি জীবন তোমার লগে রাখুক, হেইতেই আমি খুশি!'
তারপর বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে সাগরকে কানে কানে বলে, 'অ্যাহন থাইক্যা তুমি আমি এহানেই থাকমু। ঝামেলা মিট্যা গেলে, আমি মাইয়াগো সেলাই কারখানায় চাকরি নিমু। তুমি কিন্তুক না করতে পারবা না!'
সাগর বলে, 'তুমি চাকরি করবা কি! তুমি সেলাই করতে জানো?'
টুনি চোখ বড় করে আরো আগ্রহ নিয়ে বলে, 'আরে কয় কি? আমি সিংগার মেশিন কম্পানির ইস্কুলে কাজ শিখছি না!'
'কবে শিখলা?'
'তিন-চাইর মাস অইয়া গেল!'
তোমারে চাকরি দিবো কে?'
'চাকরি আমার ঠিক করা আছে! চাকরিতে যামু হেই সময়ইত্ত বিপদ অইয়া গেল! গত কাইল জয়েনের তারিখ আছিলো!'
সাগর কেমন যেন খুশি হতে পারে না। চাকরিতে গেলে মনে হয় টুনিকে আবার হারিয়ে ফেলবে। মনেমনে সে প্রার্থনা করে হে খোদা! টুনিরে যদি ফিরাইয়াই দিলা, তারে আর কাইড়া নিও না!
প্রভূ হয়তো তার কথার সমর্থন হিসেবে মোয়াজ্জিনকে দিয়ে আজানের ঘোষনা দেওয়ালেন।
টুনি বলল, 'ফজরের আজান হইতাছে। সকালের বেশি বাকি নাই। তোমার কি নমাজ পড়নের অভ্যাস আছে?'
সাগর যেন লজ্জিত হল কিছুটা। বলল, 'আমি যে নমাজ পড়তে জানি না!'
'তুমি না ইস্কুলে পড়ছো! ওইখানে শিখায় নাই?'
টুনির চোখেমুখে বিস্ময়।
'শিখাইছে!'
লজ্জায় যেন আরো খানিকটা ঝুঁকে পড়ে সাগরের মাথা।
তারপর আবার বলে, 'অনেকদিন পড়ি নাই তো, ভুইল্যা গেছি! পরায় পনের বছর। এহন কলমা তৈয়ব ছাড়া কিছুই মনে নাই!'
'আমার কাছে থাকলে সবই শিখাইয়া দিমু! কিন্তুক ট্যাকা-পয়সা অইলে কি তুমি অন্য আরেক মানুষ অইয়া যাইবা?'
সাগর বলে, 'তাইলে তুমি আমার লাইগ্যা দোয়া কর, আমি য্যান তোমার খুব ভাল সোয়ামী হইতে পারি!'
তারপরই কেমন আলস্যে শরীরটা এলিয়ে দেয় মেঝের উপর। মাথার নিচে দু'হাতের তালু রেখে তাকিয়ে থাকে টুনির মুখের দিকে।
(চলবে..)
মন্তব্য
ভালো লাগছে...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
সুন্দর।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
নতুন মন্তব্য করুন