জমিরুদ্দিন চলে গেলে সাগর একটু বসে জিরিয়ে নেবার ফাঁকে ফাঁকে তাহের সর্দারের কাজটা খুঁটিয়ে দেখে বার কয়েক। ব্যাপারটা প্রথম দিকে তার কাছে খুব জটিল আর কঠিন মনে হলেও জিনিসটা তৈরীর কারিগরি দিকটা অল্প কিছু হলেও বুঝতে পারছে। সেই সাথে উত্তেজনায় সে ঘামতে শুরু করেছে। মজিদ তার এ অবস্থা দেখে বলল, 'সাগর ভাই তুমি এত ঘামতাছো ক্যান? তোমার মাথার উপরে তো ফ্যান চলতাছে!'
সাগর বলল, 'আরে না! সর্দারের কামডা মনে অয় বুইজা ফালাইছি। দ্যাখ তুমি, ক্যামনে কামডা করি!'
সে উঠে গিয়ে তিন ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি একটা ঢালাই লোহার বার নিয়ে তাতে তারকাঁটা দিয়ে দাগ দেয়।
তারপর সেটা মেশিনে সেট করে খুব আস্তে ধীরে কাটতে থাকে। এক সময় ডাইসটা তৈরী হয়ে এলেও কিছুটা যেন খুঁত থেকে যায় বলে মনে হয়। কিন্তু সে বুঝতে পারে না যে কাজটা নিখুঁত মনে হচ্ছে না কেন? সে আবার তাহের সর্দারের ডাইসটাতে মনোযোগ দেয়। তার কাজের খুঁতটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নজরে আসে। মুখটার কাছে তিন সূতা মাপের প্যাঁচ কাটানো একটা ছিদ্র আছে। যেটাতে বল্টু লাগিয়ে মেশিনের কোনো অংশের সাথে টাইট করে জুড়ে দিতে হয়। অতি আনন্দে সাগর ইয়াও করে একটা শব্দ করে ওঠে। তার এই ধরনের চিৎকারের সঙ্গে অন্যরা পরিচিত বলে তার আনন্দের সাথে শরীক হয়ে মজিদ বলল, 'কাম হইলো?
সাগর বলল, 'তয় কি সাউন্ড পাও নাই?'
মজিদ বলল, 'পাইছি দেইখাই তো জিগাইলাম!'
সাগর কিছু বলল না।
মজিদ বলল, 'তাইলে সর্দারের কামডা পাইয়া গেলা?'
'হ মজিদ ভাই! দোয়া কইরো!' সাগরের মুখে সাফল্যের হাসি ফুটে ওঠে।
মজিদ সাগরের কাঁধে হাত রেখে বলল, 'তুমি যদি বেশি লেখা-পড়া করতে পারতা তাইলে খুব বড় ইঞ্জিনিয়ার হইতে পারতা। বৈজ্ঞানিকও ইচ্ছা করলে হইতে পারতা!'
সাগর মজিদের কথায় গলে না গিয়ে বলল, 'হোনো, মানুষ ইচ্ছা করলেই সব কিছু করবার পারে না। আল্লার রহমতও কিছু থাকন চাই!'
তারপর আবার বলল, 'আল্লার ইচ্ছা আমারে এমনেই রাখবো। আর হেই কারণেই ছোডো থাকতে বাপ-মা হারাইছি। বস্তিতে পয়দা অইছি। তা না অইলে গুলশানের কোনো আলিশান বাড়িতে কোনো বড়লোক কোটিপতির পোলা অইতাম!'
সাগরের কথায় মজিদ সশব্দে হেসে উঠল।
কিছুটা বিরক্তি নিয়ে সাগর বলে, 'হাসির কতা তো কই নাই!'
মজিদ মুখ কালো করে বলে, 'গুলশানে কি চোর-বাটপার, মুর্খ, চোরা-কারবারি নাই? বড়লোকের পোলারা অনেকে লেখা-পড়ার সুযোগ পাইয়াও করে না। নষ্ট অইয়া যায় না? হিরোইন -গাঞ্জা খায় না? কামের ছেড়িরে আকাম কুকাম কইরা মাইরা ফালায় না?'
সম্মতি জানিয়ে নিরবে মাথা দোলায় সাগর।
তারপর বলে, 'ওইখানেও নষ্ট মানুষ আছে। আমার মতন এতিম আছে। ফারাক হইলো তারা বড়লোক আর আমি গরিব!'
মজিদ বলল, 'ওস্তাদ, তুমি কোনো নতুন কাম শিখলে আমাগোরে চা খাওয়াও। আইজকারটা তো বিরাট কাম!'
'হাচাই বিরাট কাম! তোমাগোরে আমি বিরানী খাওয়ামু!'
অন্যরা ধ্বণি তুলল, 'সাগর ভাই জিন্দাবাদ!'
ঠিক তখনই জমিরুদ্দিন কারখানায় ঢুকে বললেন, 'জিন্দাবাদ ক্যানরে হালার পোলারা! কাজ-কাম নাই?'
মজিদ বলল, 'মাহাজন, সাগর তো সর্দার সাবের ডাইসটা বানায় ফালাইছে!'
বিস্ময়ে জমিরুদ্দিন বললেন, 'এত জল্লি? কস কি?'
তারপর সাগরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, 'কোই দেখি, ক্যামতে বানাইলি?'
সাগর তার হাতের ছোট্ট মডেলটা জমির উদ্দিনের হাতে তুলে দেয়।
জমিরুদ্দিন সেটা উল্টে-পাল্টে মুল ডাইসের সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চিত হয়ে বললেন, 'সাবাস! তয় আসল কামটা খুব সাবধানে করতে হইবো! এক আধপাক বেশি ঘুরলেই কিন্তু শ্যাষ! দুই একটা নষ্ট হইলেও ক্ষতি নাই। কাম করতে পারাটাই আসল। নষ্ট হইলে ওইটার খরচা আমার। তর ডরানের কিছু নাই! খুব খুশি অইলাম তর কামে!' জমিরুদ্দিন তার পিঠ চাপড়ে দেন।
তারপর পকেট থেকে এক'শ টাকার একটি নোট বের করে দিয়ে বললেন, 'সাগরের এই কামিয়াবির লাইগা আমরা মিঠা খামু। মিষ্টি আনা!'
মজিদ অতি উৎসাহে টাকা নিয়ে দৌঁড়ে যায়।
কাকতালীয়ভাবে তাহের সর্দারও সে মুহূর্তে তার ডাইসের জন্য ঢালাই লোহার তিন ইঞ্চি বাই এক ফুটের একটি পিন্ড নিয়ে এলেন। খবর শুনে তিনি আরো খুশি। নমুনা দেখে সাগরকে জড়িয়ে ধরলেন। 'ভাতিজা, তুইই পারবি!'
তারপর তার দু'ইগাল নিজের দু'হাতের তালুতে চেপে ধরে বললেন, 'আমার দোস্তের লগে কোনোদিন বেঈমানি করবি না তো?'
সজল চোখে হাসল সাগর। বলল, 'মাহাজন মনে করে আমরা হের পোলা! বুড়া বয়সে হ্যারে কামাই কইরা খাওয়াইতাছি!'
'হাঁচা কথা?'
বিস্মিত তাহের সর্দারের চোখ দু'টো বড়বড় হয়ে ওঠে।
সাগর বললো, 'তাইলে আপনে জিগান!'
তাহের সর্দার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'দোস্ত, ঈমান কইরা কইছো তো?'
জমির উদ্দিনের মুখে অহংকারের হাসি ফুটে উঠল।
তাহের সর্দার বললেন, 'দোস্ত, বিশ্বাস, মহব্বত আর খাঁটি কর্মচারি হইলো আল্লার দান। আল্লা-পাক তোমারে খুব মহব্বত করেন। তোমার নিজের পোলা পয়দা অইলে, এমুন দুইটা পোলা তুমি পাইতা না!'
জমিরুদ্দিন বললেন, 'আমি আল্লার বান্দা। আল্লার রহমত-মহব্বত ছাড়া এক-কদমভি চলবার চাই না! তুমি তো জানো দোস্ত, পোলার খাইশ আমার নাই! এই জমানায় পোলা অইলো গিয়া লটারির লাহান! লাগলে খাঁটি মানুষ। না লাগলে ইয়াযুয-মাযুয। তুমি গ্যারান্টি দিবার পারবা, তোমার পোলা মানুষ অইবো? মানুষ অইলেও দেখবা অমানুষের অত্যাচারে জানোয়ার অইয়া গ্যাতাছে!'
মজিদ মিষ্টি নিয়ে ঢুকল।
জমিরুদ্দিন বললেন, 'ব্যাবাকরে দে! আইজকা আমার ঈদের দিন!'
সাগর মনেমনে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলল, 'ইয়া-খোদা, এত খুশি যহন আমারে দিলা, এইডা কোনোদিন কাইড়া নিও না!'
(চলবে..)
মন্তব্য
হুঁম ?!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নতুন মন্তব্য করুন