তাহের সর্দার খেয়াল করলেন, 'সাগরের মুখটা কেমন যেন শুকনো মনে হচ্ছে। তিনি সাগরের হাত ধরে বললেন, 'তোমার তো মিয়া মন ব্যাজারের কিছু নাই! মাসে লাখ ট্যাকা কামাই করবা! থাকবা আরামে! মুখ কালা কোরছো ক্যালা?'
সাগর ঝর-ঝর করে কেঁদে ফেলল। জ্ঞান হবার পর এই প্রথম সে তার কান্না নিবারণে ব্যর্থ হল। তবুও চেষ্টা করতে লাগল কান্না থামাতে। কিন্তু কাজ হল না।
তাহের সর্দার বললেন, 'কান্দনের কি হইলো আবার? ওই মিয়া!'
সাগর বলল, 'জীবনে তো সুখ-আদর কিছুই পাই নাই! হের লাইগা খোদারে কইলাম, আমারে খুশি দিলোই যদি, ওইডা জানি কাইড়া না নেয়!'
দু'বন্ধুই সমস্বরে বলে উঠলেন, 'আলহামদোলিল্লা!'
সাগরের চোখ মুছিয়ে দিয়ে সর্দার বললেন, 'কান্দনেরও অর্থ আছে। কানলে মন পাতলা হয়। কিন্তু ছেমড়িগো মতন কানলে তো মন আরো নরম হইয়া যাইবো!'
সাগর হাতের পিঠে চোখ মোছে।
'অখন মন দিয়া আমার কথা হুনো মিয়া!' সর্দার সাগরের কাঁধে হাত রাখেন। 'আইজগাই আমার কামডা ধরবা! রাইত যতক্ষণ লাগে শেষ করবা। নতুন ডাইস কিনি নাই। তোমারডা দিয়া মেশিন চালু দিমু। ট্যাকা-পয়সা দোস্তরে বুঝাইয়া দিয়া যামুনে! তোমার বখশিশ পাঁচ হাজার-ট্যাকা! কাইল বৈকালে আহুমনে ইনশাল্লা!'
লাঞ্চ টাইমের আগেই চলে গেলেন তাহের সর্দার। যাবার আগে সাগরকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন তার কাজের কথা। সাগর বলেছিল, 'আপনে চিন্তা কইরেন না!'
কথাটা সে বলেছে সত্য। কিন্তু শেষে নিজেই চিন্তায় পড়ে গেল। রাত জেগে কাজ করাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ন। ভেতরে মানুষ থাকলে নিশাচর মানুষগুলো বেশি উৎপাত করে। কাজেই রাত জেগে কাজ করা যাবে না। সে মজিদকে বলল, 'মজিদ ভাই, তোমার হাতে কি কাম আছে এহন?'
মজিদ বলল, 'তেমুন কোনো কাম নাই!'
'তাইলে আমার লগে হাত লাগাও! বখশিশের ভাগ পাইবা!'
সাগর মজিদের আগ্রহ শাণাতে চায়।
মজিদ বলল, 'বখশিশের কাম নাই! তোমার মতন ওস্তাদের লগে কাম করনডা বখশিশেরও বেশি!'
মজিদ হাসি মুখে এগিয়ে আসে।
লোহার পিন্ডটাতে চক দিয়ে দাগ দেয় সাগর।
তারপর দু'জনে ধরাধরি করে তা মেশিনের প্লাটফরমে তোলে।
সাগর মজিদকে বলল, 'আমি কইলে তুমি লিভার টানবা আর ঢিলা দিবা! বাকি কাজ আমার হাতে!'
সাগর মেশিন স্টার্ট করে মিনিট খানেক চোখ বুঁজে থাকল।
মজিদ জানে তার কারণ। শুধু মজিদই নয়' এ কারখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই জানে যে, সাগর চোখ বন্ধ করে তার স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সকাতর আবেদন জানাচ্ছে যে, তার কাজ চলা অবস্থায় যেন বিদ্যুৎ না চলে যায়।
তার প্রার্থনা শেষ হলে সে বিসমিল্লা বলে লোহার পিন্ডটা ঠেলে ধরে মজিদকে বলল, 'টানো!'
মজিদ মেশিনের লিভার টেনে ধরল। আর সেই সাথে লোহার কর্তিত অংশ পাক খেয়ে খেয়ে সাপের মত একেবেঁকে টুকরো হয়ে মেঝেতে ঝরে পড়তে লাগল। এ সময় মজিদের মাথা ঘোরায় প্রায়ই। যে জন্যে সে সাগরের কাজের কৌশলটা আজো শিখতে পারল না। হতে পারল না ওস্তাদ মিস্ত্রি। সহকারিই থেকে গেল। মজিদ সাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পেল তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম বেরোচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে বিন্দুটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে টপ করে গড়িয়ে পড়ল। মজিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সে ঘর্মবিন্দুগুলোর পরিবর্তনের দিকে।
সাগর হঠাৎ বলল, 'ছাড়ো!'
মনোযোগ অন্যখানে থাকায় মজিদের কানে শব্দটা বজ্রপাতের মত গিয়ে আঘাত হানল। আর সঙ্গে সঙ্গেই সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে লিভার ছেড়ে দিয়ে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
লোহার পিন্ডটা ছেড়ে দিয়ে একটু সরে দাঁড়ায় সাগর।
তারপর কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ ও কপালের ঘাম মোছে। মজিদের দিকে চোখ পড়তেই বলল, 'কি মিয়া, তোমার শইল খারাপ লাগতাছেনি?'
'শইল ঠিকই আছে। ধমক খাইয়া মন খারাপ অইয়া গেছে। কোনো ভুল করলাম ওস্তাদ?'
'কি ভুল?'
সাগর অবাক হয়ে তাকায়।
'তাইলে যে, ধমক দিলা?'
'কহন ধমক দিলাম?'
সাগর হা করে তাকিয়ে থাকে মজিদের মুখের দিকে।
'এত জোরে লিভার ছাড়তে কইলা যে, আমি ডরায়া গেছি!'
মজিদের চোখ মুখের ভাব দেখে হেসে ফেলল সাগর।
তারপর বলল, 'কাম করবার সময় মানুষ একটা ধ্যানে থাকে। তহন হঠাৎ কোনো শব্দ হুনলে তার কাছে তা জোরেই মনে অয়। তোমারও তাই অইছে। অন্য কোনো খেয়ালে আছিলা বইলাই আমার কথা তোমার কাছে ধমক মনে অইছে!'
সাগর আবার ঘাম মুছে গামছাটা কাঁধে ফেলে বলল, 'যদি আমি ধমকও দেই, তাইলেও মনে করবা ধমক দেই নাই! কথাডা বেশি জোরে কইছি মাত্র! বুঝলা?'
তারপর মজিদের কাঁধে হাত রেখে সে বলল, 'দ্যাহ মজিদ ভাই, আমরা সারাদিনের মইদ্যে বেশি সময়ডাই এক লগে থাকি! তোমার বউ-বাচ্চাও এত সময় এক লগে থাকে না। তাইলে তোমার আপন কে অইলো? আমরা না? হেই কারণেই একজন আরেক জনের কতায় মনে কষ্ট পাওন ঠিক না! তোমাগো কারু কথায় আমার মন খারাপ করতে দ্যাখছ? দ্যাখ নাই!'
কিছুক্ষণ থেমে সাগর আবার বলতে লাগল, 'এই যে, মাহাজন আমারে এত গালাগালি ধমকা ধমকি করতো, কোনোদিন মন খারাপ অয় নাই! মনে কষ্ট পাই নাই! রাগ করি নাই! মনেরে বুজ দিছি যে, জোরে জোরে কথা কইতাছে! তা না অইলে আইজ কোনো বাসের হেলপার নয়তো কোনো হোটেল-টোটেলের মেসিয়ার অইতাম। আর খুব বেশি কিছু অইলে অইতাম রঙিলা মাইয়াগ দালাল!'
মজিদ বলল, 'কি-যে কও না ওস্তাদ!'
সাগর কিছুটা রেগে যাবার মত জোর গলায় বলল, 'ঠিকই কই! তুমি দ্যাখছ? রমনার মেইন গেইট দিয়া ঢুকলে এট্টু আউগাইলেই দেখবা আমার মতন এক পোলা দুই সাইডে দুই ছেড়ি লইয়া বেঞ্চির মইদ্যে বইয়া রইছে। তার নাম জিগাইলে কইবো কাবুল ফকির। ছেড়ি দুইডা তার বউ। তাগো ঠিকানাই ওই বেঞ্চি। দিনে রাইতে যহন কাস্টমার পায় গতর বেচে। যা আয় অয় তিন জনে মিল্যা খাইয়া বাঁচে। যহন তার কাছে এই কিস্সা হুনছিলাম বিশ্বাস অয় নাই। আর গতর বেচন কি তাও বুঝি নাই। অহন তোমার কথা হুইন্যা হঠাৎ মাথাডা পরিষ্কার অইয়া গেল গিয়া। বুঝতে পারলাম ওই হালায় কি করে! আগে আমার লগে ইস্কুলে যাইতো। দুইজনে বন্ধু আছিলাম। এক লগে একটা হোটেলে মেসিয়ারের কাম লইছিলাম। মালিকের গালি খাইয়া কাবুল পলাইয়া গেল। আমি থাকলাম। কয়েক মাস পরে একদিন মাহাজন হোটেলে নাস্তা করতে গেল। আমারে দেইখ্যা কয় কাম হিকনের ইচ্ছা থাকলে আমার লগে কারখানায় চল! তোর মালিকরে আমি বুঝাইয়া কমুনে!'
মজিদ বলল, 'মালিক তোমারে ছাড়লো?'
'আরে মিয়া অনেক কাহিনী! অ্যাত টাইম নাই! মালিক আমার মাতায় হাত বুলাইয়া মাহাজনরে কইলো, বহুত ভালা পোলা! ঠান্ডা মেজাজ! কামে ফাঁকি দ্যাওন বুঝে না! তোমার হাতে পইড়া যদি মানুষ অইবার পারে, আমি হ্যার-লিগা দোয়া করুমনে!'
সাগর মজিদের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ পর আবার বলে, 'হেই দোয়ার বরকতে আইজ আমি তোমাগো লগে আছি! বুচ্ছো মজিদ ভাই? মানুষের জীবনে মুরুব্বীর দোয়াও অনেক বড় জিনিস!'
মজিদ মনে মনে ভাবে যে, সাগর যদি কোনো ভাল আর ধনী পরিবারের সন্তান হতো তাহলে খুব বিদ্বান আর বড় কোনো ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতো। আজ কথাটা মনে এলেও সাগরকে কিছু বলল না।
মজিদকে চুপ করে থাকতে দেখে, সাগর হতাশ ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, 'মাঝে মইদ্যে পুরানা কতা মনে অইলে আমি আর কাম করবার মতন জোর পাই না! হুইয়া থাকতে মন চায়! আহ এক কাপ চা খাইয়া আহি। তার বাদে কাম ধরমুনে! আইজকা কামডা শেষ করতে অইবো!'
মজিদ বলল, 'অহন চা খাইবা কি! ভাত খাওনের টাইমও পার অইয়া গেছে! দুইটা বাজে!'
'ঠিক আছে। একবারে খানা খাইয়াই আহি!
বের হবার আগে সাগর জমিরুদ্দিনকে বলল, 'মাহাজন, খাইবার যাইতাছি! সর্দার সাবের কামডাও শুরু করছি। দোয়া কইরেন!'
'ফি-আমানিল্লা!'
কারখানা থেকে বেরিয়ে সাগর মজিদকে বলল, 'ঘরে গিয়া তোমার কাম নাই! আইজ আমি খাওয়ামু তোমারে!'
মজিদ বলল, 'খুশি অইলাম!'
(চলবে..)
মন্তব্য
চলতে থাকুক। ভাল।
.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......
.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
নতুন মন্তব্য করুন