তিতিক্ষা-১

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: সোম, ০৮/০৯/২০০৮ - ১:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoঘটনার আবর্তে এতটা জড়িয়ে যাবে জানলে কখনোই এ মুখো হতো না রবিউল। কিন্তু এ কথা সে এখন ভাবছে, আসলে না এসেও সে পারছিলো না। কারণ বয়স্ক বন্ধুর কাছে মান খোয়ানোর চাইতে কিছুটা কষ্ট করে হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মত কষ্ট করা তার কাছে ঢের সহজ। এখানে না এলে হয়তো বাকি জীবন খোঁটা শুনেই কাটাতে হতো তাকে। পরে কোনো একদিন বেকায়দায় পেলে হাতেম আলি নির্ঘাত বলে বসতো যে, তার কোনো উপকারেই লাগেনি রবিউল।

প্রথমে হাতেম আলির অনুনয়-বিনয় এমনকি দু'একবার ধমক খেয়ে যখন গয়নার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে পথে নামে রবিউল তখন কিন্তু এত কিছু ভাববার সময় ছিলো না তার। একটা ঘোরের মধ্যেই সে পথে নেমে এসেছিলো। যাতে তার রওয়ানা হওয়ার বিষয়টি নিজের চোখেই দেখতে পায় হাতেম আলি।

চার-পাঁচদিন আগে হাতেম আলি কিছু একটা নিয়ে প্রথমে রাগারাগি, পরে মারধর করার ফলে গয়না চলে গেছে বাপের বাড়ি। দুদিন পর হাতেম আলিও গিয়েছিলো শ্বশুরবাড়ি। অনেক কাকুতি-মিনতি করে গয়নার হাত ধরে বলেছিলো, 'যা হওনের হইছে বউ! এমন আর হইবো না! মাটির দিকে চাইয়া হইলেও আমার লগে চল!'

কিন্তু মন গলেনি গয়নার। সে নাকি বলেছিলো, 'পরতেক বারই তুমি এমন কথা কইয়া আমারে নিয়া যাও আর তার বাদেই সব ভুইলা যাও!'

হাতেম আলি বলেছিলো, 'পোলাপানের মুখের দিকে চাওন যায় না!'

গয়নার মনে হাতেম আলির কোনো কথাই রেখাপাত করেনি। বরঞ্চ, উল্টো হাতেম আলিকে বলেছিলো, 'এইবার আর কাম হইবো না! যারে তুমি দিনরাইত পিডাইতে পারবা, নাকে মুখে গাইল পারতে পারবা, হেমুন বোবা-কালা কাউরে নিকা কইরা আনো! ট্যাকাও পাইবা বেশি! আমি তের বছর সহ্য করছি, আর পারি না!'

হাতেম আলি যাতে আর কোনো অজুহাত খাড়া করতে না পারে, তাই তার মুখের উপরই দরজার কপাট বন্ধ করে দিয়েছিলো গয়না। উপায় না দেখে হাতেম আলি শাশুড়ির পা চেপে ধরেছিলো। কিন্তু তিনি কোনো সাহায্যই করতে পারেননি জামাতাকে। বলেছিলেন, 'তোমার কাছে মাইয়ারে বিয়া দিছিলাম জোর কইরা, হেই দুঃখে অহনও কান্দি! মাইয়ার সামনে গিয়া খাড়ামু কোন মুখে?'

নিদারুণ অপমান আর ব্যর্থতার গ্লানি কাঁধে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসে শেষ উপায় হিসেবে রবিউলকে চেপে ধরেছিলো হাতেম আলি। কিন্তু রবিউল কী করে জানবে গয়নার মনের কথা? স্বামী-স্ত্রীতে প্রায়ই তো এমন রাগারাগি কিংবা ঝগড়া-ঝাঁটি হয়। পরে আবার ঠিকও হয়ে যায়। কিন্ত এবার কোন কারণেই বা গয়না এতটা শক্ত হয়েছে, তার বিন্দু-বিসর্গও জানে না সে। তা ছাড়া হাতেম আলিও এবার সব কিছু বলেনি খোলাসা করে। অবশ্য গয়নার নিজের মুখ থেকে পুরো ব্যাপারটা শুনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সঙ্গেসঙ্গে রবিউলের মনে কিছুটা হতাশা আর অনিশ্চয়তা মিলে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে। নিজের অজান্তেই সে বিড়বিড় করে বলে, 'ভাবি কি সব কথা কইবো?'

নিজকে প্রশ্ন করতে পারলেও সে নিজ থেকে এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পায় না। শেষে বিকল্প ভাবনার কাছেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, 'না কইলেই কি! আমি তো তার এমন কোনো আপন মানুষ না!'

উঠোনের কোণে কাঁঠাল-ছাঁয়ায় পাটিতে বসে অন্তর্গত ভাবনার জগতে বুঁদ হয়েছিলো রবিউল। কিন্তু সময় ক্ষেপনের সাথে দুটো একটি করে শুকনো কাঁঠালপাতা ঝরে পড়তে পড়তে তার চারদিকে একটি বৃত্তের মত তৈরী হয়েছে। বৃত্তের মাঝে বসে তার মনে হয় যে, শুকনো-ব্যর্থ আর মৃত পাতারা কি তার চতুর্পার্শ্বে দেওয়াল তুলে জানিয়ে দিতে চাচ্ছে আসন্ন পরাজয়ের আগাম বার্তা?

সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়লেও কাউকে সে দ্বিতীয়বার দেখতে পায় না। ভাদ্রমাসের প্রচন্ড দাবদাহে একটু পরপরই তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। পাশে রাখা পেতলের বদনি থেকে পানি মুখে নিলেও সে শীতলতার পরশ থেকে বঞ্চিত হয়। এ মাসের গরমে অতিষ্ঠ কুকুর পানিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। চামার তার সংগৃহীত কাঁচা চামড়া একদিনের রোদে শুকিয়েই ঘরে তুলতে পারে। তেমনি এক উত্তপ্ত দিনে রবিউল তার গায়ের জামা খুলে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছে। প্রচন্ড তাপ থেকে রক্ষা পেতে গামছাটা ভিজিয়ে চাদরের মত জড়িয়ে রেখেছে গায়ের উপর।

এভাবে অনাহূতের মত বার-বাড়িতে পড়ে থাকার অপমান টের পেলেও সে বোঝে যে, কেন এ বাড়ির মানুষ তার সাথে বৈরী আচরণ করছে। কেন ইচ্ছে করেই দেখা করছে না কেউ। আর এমন ব্যাপারগুলো তার কাছে যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হয়। কেন না, কোনো মেয়ে যদি স্বামীর বাড়িতে অত্যাচারিত আর অপমানিত হয়ে বাপের বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয়, সেই মেয়ের স্বামী তো দূরের কথা, স্বামীর আত্মীয়-কুটুম্ব, এমন কি বন্ধু-বান্ধবও নির্যাতিতার বাপের বাড়িতে ঠাঁই পাওয়া অনুচিত। সে ক্ষেত্রে হাতেম আলির বন্ধু বা গ্রমের মানুষ হিসেবে রবিউলের সঙ্গে এরা যথেষ্ঠ ভালো আচরণ দেখিয়েছে। ভদ্রতা বা সৌজন্য প্রকাশেও কোনো অংশে পিছিয়ে থাকেনি।

প্রথমে গয়নার ভাই ইসমাইল এক গ্লাস শরবত হাতে করে এসে কুশল-বার্তা জিজ্ঞেস করেছে। রবিউলের শরবত খাওয়া হয়ে গেলে বলেছিলো, 'বেয়াই, যেই গরম পড়ছে, ঘরে বেশিক্ষণ বসতে পারবেন না! চলেন গাছের ছাওয়ায় গিয়া বসি!'

বাইরে কাঁঠাল-ছাঁয়ায় পাটি বিছিয়ে রবিউলের সাথে ইসমাইলও কিছুক্ষণ বসেছিলো। রবিউলের ঘনঘন পিপাসা পেলে সে নিজে গিয়ে পেতলের বদনি ভরে চাপকল থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে এসেছে। সাথে একটি বাটিতে করে কিছুটা চিড়া-গুড়। এক সঙ্গে বসে খেয়েছেও। কিন্তু একটু পরই সে উঠে পড়ে বলেছিলো, 'আমি একটু আসতাছি। আপনে কিন্তু না খাইয়া যাইবেন না!'

তারপর ইসমাইল আর ফিরে আসেনি। তা ছাড়া মাওই তাকে অপেক্ষা করতে বলে নামাজ পড়তে গেছেন। কিন্তু নামাজ পড়তে কতক্ষণ লাগে, সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই রবিউলের। একাএকা বসে পানি আর চিড়া-গুড় খেতে তার ভালো লাগছিলো না। কিন্তু বসে না থেকেও বা সে করবে কি? এই একটি বাড়ির লোকজন ছাড়া বাকি সবাই তার অপরিচিত। এই অসময়ে সে কোথায় যাবে, কার সাথেই বা আলাপ করবে? এ ছাড়া গ্রামের ভেতর একজন অপরিচিত লোক বিনা কারণে হাঁটাহাঁটি করবে, তা কেউ সুনজরে দেখবে না।

ইসমাইলের কাছ থেকে রবিউল যখন জানতে পারলো যে, গয়নাকে এবার বাঁশ দিয়ে পিটিয়েছে হাতেম আলি। তাই এমন একজন অমানুষের ঘরে তার বোনকে আর ফিরে যেতে দেবে না। তখন থেকেই রবিউলের খুব রাগ হতে থাকে হাতেম আলির উপর। বিয়ের এতগুলো বছর পার হয়ে গেল, বাচ্চারা প্রায় বড় হয়ে গেছে সবাই আর তাদের সামনেই কিনা তাদের মাকে পিটায় বাঁশ দিয়ে? এমনটা কোন স্ত্রী সহ্য করতে পারবে? আর এ ধরনের ঘটনা দেখলে তাদের সন্তানরাই বা শিখবে কি? তা ছাড়া বউ পিটানো কি পুরুষালী কাজ? এতটাই কি নারাধম হয়ে গেছে হাতেম আলি? অভাব-অনটন কি তাহলে মানুষের মনুষ্যত্ব ও ক্ষয় করে দেয়?

রবিউল তো বিয়ের দশ বছরের মধ্যে জনু অর্থাৎ জয়নাবের উপর যে কবার হাত তুলেছে, তাও হাতে গোণা। যেটা ঘটেছে নিতান্তই দূর্ঘটনার বশে। কখনও বা বাধ্য হয়ে।

মানুষ অনেক সময় রাগের বশে হুঁশ-জ্ঞান হারিয়ে বিতিকিচ্ছিরি কান্ড ঘটিয়ে বসে। সজ্ঞানে মানুষটা কখনোই যা করতে পারতো না বা মুখ দিয়ে প্রকাশ করতে পারতো না, তেমন অবস্থায় দু একটি চড়-থাপ্পড়ে মানুষটার বাস্তবতা বোধ ফিরে আসে। এমন ধরনের ব্যাপার তাদের জীবনে ঘটেছে মোটে চারবার। তাও হাতেম আলিদের মত বাড়ি থেকে পাড়া, পাড়া থেকে গ্রাম, এমনকি গ্রমের বাইরে ছড়ানোর মত ব্যাপার নয়। ঘটনা এখনো স্বামী-স্ত্রীর মাঝেই সীমাবদ্ধ।

স্ত্রীর গায়ে হাত তুলবার যে যাতনা, তা কেবল বোধ-সম্পন্ন অনুতপ্ত স্বামীরাই বলতে পারে। বউ পিটানোকে যারা নিত্য-নৈমিত্তিক ডাল-ভাতের মত মনে করে, এক অর্থে তাদের ঘৃণা করে রবিউল। হাতেম আলি তার বন্ধু হলে কি হবে, এই একটি দিক দিয়ে বন্ধুকে পছন্দ করে না সে। আর সেই কথা হাতেম আলিকে জানিয়েছেও অনেকবার। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। হাতেম আলি সে কথা মনে রাখতে পারে না। তাই এবার সে গয়নার কাছ থেকে ফিরে এসে রবিউলের হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলো।


মন্তব্য

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

হায় হায় প্রচ্ছদ দিসিলাম! নাইক্কা!
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

রাফি এর ছবি

চলুক জুলিয়ান ভাই। পড়ছি।
আপনার 'নষ্ট সময়' পড়েছি; কম্পেন্ডারের মত একটানে শেষ করতে না পারলেও ভাল লেগেছে।

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

পাঠকের ভালো লাগবে আশা করেই কষ্ট করে লিখি। আর তা জানতে পারলে লেখক হিসেবে আমার ভালো লাগার পরিমাণটা সত্যি সত্যিই আরো কয়েকগুণ হয়। ধন্যবাদ।

পুনশ্চ: কম্পেন্ডারের পরের পর্বটি আপন-পর। বাংলাবুক ডট কম-এ পাবেন।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

কীর্তিনাশা এর ছবি

আমিও পড়ছি। চলুক জুলিয়ান ভাই।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

জেনে ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

সচলে এটা আপনার তৃতীয় উপন্যাস। আপনার অনেক আগে শুরু করেও শেষ করতে পারছি না। ঈর্ষা হচ্ছে। নষ্ট সময় এখনো পড়িনি। তবে পড়ব। তারপর জানাব কেমন লাগল।
এটা চলুক মাটি আর মানুষের গন্ধ পাচ্ছি।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আমিই বরং ঈর্ষাবোধ করি। আপনার মত ধারাবাহিক পারি না। উপন্যাসটি প্রথমে লিখে শেষ করতে হয়। আপনি তো এক পর্ব লিখেন আর পোস্ট করেন। সেই ক্ষমতা আমার কস্মিনকালেও হবে না। তা ছাড়া আমার উপন্যাসগুলো পিডিএফ করে দেই বলে ঝটিতি ফুরিয়ে যায় বলে মনে হয়। এ না হলে নষ্ট-সময় এখনও চলতো।

হ্যাঁ, মাটি আর মানুষের ঘ্রাণসিক্ত এ উপন্যাসটিও। কিন্তু এখানে আমার চিন্তা-ভাবনা আর দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা ভিন্ন পথে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কতটুকু পেরেছি জানি না।

সাথে থাকার জন্য আবারও ধন্যবাদ পুতুল।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পরিবর্তনশীল এর ছবি

এই পড়লাম। কিন্তু কেন যেন অনিয়মিত হয়ে পড়ি।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।