গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক বাড়িতে অতিথিকে না খাইয়ে বিদায় না দেওয়ার চল রয়ে গেছে। অতিথি যেমনই হোক, তাকে আপ্যায়ন করাবেই। এই যেমন গয়নার বাপের বাড়ি। রবিউল যতই বলে যে, খাবে না। কে শোনে কার কথা! হাতেম আলির শাশুড়ি অর্থাৎ গয়নার মা পাটি বিছিয়ে রবিউলের জন্য খাবার দিয়ে বললেন, 'তুমি না খাও, পাতে বইয়া এক লোকমা মুখে দ্যাও!'
মুরুব্বী মানুষের অনুরোধ চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও অনেক সময় রক্ষা না করে পারা যায় না। তাই রবিউলকে বাধ্য হয়েই পাতে বসতে হয়।
হাতেম আলির শাশুড়ি মেয়েকে বললেন, 'তুই রবিউলরে বাইড়া খাওয়া! আমি যাইতাছি মজির মায়ের কাছে!'
গয়না বিরক্ত হয়ে বলে, 'মজির মায়ের কাছে অহন কি কাম?'
'হ্যার নাকের জিনিস হারাইয়া গেছে। কান্দা-কাটি কইরা উঠানের মাটি সব আউলাইয়া ফালাইতাছে!'
খাবে না বললেও খেতে বসে রবিউল বুঝতে পারে যে, বেশ ক্ষিদে পেয়েছে তার। ভাতের থালা সামনে নিয়ে পাটির উপর জোড় আসন হয়ে বসে বললো, 'নাকের জিনিস হারাইলে এমন কি ক্ষতি? দাম তো বেশি না!'
রবিউলের পাতে ভাত তরকারি ঢেলে দিয়ে গয়না বললো, 'দাম কম বেশি কথা না, এইডা একটা কু-লক্ষণ!'
'ঠিক বুঝলাম না।'
মুখের সামনে ভাতের গ্রাস থামিয়ে জানতে চায় রবিউল।
'নাকের জিনিস হারাইলে সোয়ামীর আয়ূ কমে। কোনো কোনো বউ বিধবাও হয়!'
গয়নার কথা শুনে রবিউল জোরে হেসে উঠে বলে, 'নাকের জিনিসের লগে সোয়ামীর আয়ূর কি সমন্দ! যারা নাকে কোনোদিন জিনিসই পিন্দে নাই, তারা কি কইবো?'
গয়না কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, 'হেইডা আপনে বুঝবেন না!'
'আমার বুইঝ্যা কামও নাই' বলে, রবিউল খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে রবিউলের পাতে এক চামচ ভাত, কখনো একটু তরকারির ঝোল ঢেলে দিয়ে গয়না বলে, 'রান্দা কেমুন হইছে?'
'ভালাই!'
তারপর ভাত খেতে খেতে রবিউল খুব সাবধানে তাদের ঝগড়ার প্রসঙ্গ এড়িয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই ঝগড়ার প্রসঙ্গই উঠে আসতে চায় বারবার। রবিউল চায় না প্রসঙ্গটা এখনই উঠুক। তাই সে বলে, 'আইজ তো রাইত হইয়া গেল। আমি চইলা গেলে আপনে রাইতটা চিন্তা-ভাবনা করেন। আর আমি যাইয়া কাইল হাতেম ভাইরে পাঠাইয়া দেই। আপনে কিন্তু দেরি কইরেন না!'
গয়না রবিউলের পাতে দুটো ট্যাংরা মাছ তুলে দিয়ে বলে, 'আমার চিন্তা-ভাবনা শ্যাষ!'
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গয়নার নাকের পাটা দুটো কেমন ফুলে উঠলো। 'আমি ঠিক করছি ময়নার বাপের লগে আর সংসার করমু না! এই তের বচ্ছরে মানুষটা আমারে জ্বালাইতে জ্বালাইতে আঙরা কইরা ফালাইছে!'
রবিউল আস্তে-ধীরে খায়। সেই সঙ্গে কিছুটা ভেবে নিয়ে বলে, 'আপনের এত বচ্ছরের সংসার, হেইডা কি একদিনেই ভাইঙ্গা ফালাইবেন? সংসারডারে গুছাইয়া লইতে কি আপনের কষ্ট হয় নাই?'
গয়না কিছুটা পিছনের দিকে সরে বসে।
তারপর বলে, 'এই সংসারডায় তো খালি কষ্ট কইরাই গেলাম! কিন্তু কী পাইলাম, কইতে পারেন?'
রবিউলের সেই কথা জানবার কথা নয়। কিন্তু গয়না থেমে থাকে না। 'না পাইলাম ঠিক মতন খাওন-পিন্দন, না পাইলাম অসুখ-বিসুখে অষুধ-পথ্য! কোন আশায় এমন একটা অভাবের ঘরে ফিরা যামু?'
'ভাবি, আপনে ভাইব্যা দ্যাখেন যে, এমন একটা মানুষের লগে আপনের বিয়া হইবো, এইডাই আপনের নসিবে আছিলো! আর নসিবের লেখন কি কেউ খন্ডাইতে পারে?'
'আপনে এইডা কি কইলেন? কিসের নসিব আর কপাল?'
গয়না উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। 'এইসব তার খাসলতের দোষ! বিয়ার সময় বাপ-মা আমারে পাঁচভরি সোনার জিনিস দিয়া দিছিলো, আলিস্যা মানুষটা একেএকে সব নিয়া বেচলো। আইচ্ছা মাইন্যা নিলাম যে, জিনিস ব্যাচনের ট্যাকা আমারে আর পোলাপানরে নিয়াই খাইছে। কিন্তু ব্যবসা করনের লাইগ্যা যেই সত্তুর হাজার ট্যাকা নিয়া দিছিলাম, হেইডি কারে নিয়া শ্যাষ করলো? মানুষ তার কপাল বদল করনের লাইগ্যা নিজেও তো কিছু চেষ্টা করে, নাকি? ঘরে শুইয়া বইসা থাকলে কি নসিব বদলায়, না ব্যবসা হয়? আপনে অনর্থক নসিবরে দুইষ্যেন না!'
গয়না একবার নাক টেনে আঁচলে চোখ মোছে।
রবিউল গয়নার দিকে চোখ তুলে বলে, 'আপনে কি কন হাতেম ভাই চেষ্টা করে নাই?'
'হ! এমন চেষ্টাই করছে যে, আমারে পিডাইয়া ট্যাকা আদায় করনের ফন্দি বাইর করছে! মনে করছিলো এইবারও ট্যাকা নিয়া হ্যার হাতে তুইল্যা দিমু আর হ্যায় ফুটানি মারাইবো!'
গয়না এক হাত কোমরে রেখে আরেক হাত নিজের বুকে রেখে ফের বলে, 'আমার ভাইয়েরা কি ট্যাকার ক্ষেতি করছে, না আমার বাপ ট্যাকার গাছ লাগাইয়া গেছিলো?'
গয়না হাত নেড়ে তার বক্তব্যকে যেন আরো খানিকটা জোরালো করতে চায়। 'দরকার হইলে ভাইয়েগো লাথি-উষ্ঠা খাইয়া এইখানে পইড়া পচমু! আতুরা-ল্যাঙড়া মানুষের সংসার করমু, তাও ওই ডাকাইতের লগে আর না! ট্যাকা দিয়াই যদি সোয়ামীর ভাত খাইতে হয়, তাইলে এমন বুইড়া আর কুঁইড়া মানুষের লগে ক্যান, আরো ভালা আর জাতের মানুষ নিয়া আমু!'
গয়নার বক্তব্য শুনে অবাক হয় রবিউল। তবুও তার দৃঢ়তায় ফাঁটল ধরাতেই বুঝি বলে, 'আপনের পোলাপাইন দিনরাইত আপনের লাইগ্যা কান্দাকাটি করতাছে! হ্যাগো লাইগ্যা কষ্ট পাইবেন না?'
'কিসের কষ্ট?'
গয়নার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হয়। বলে, 'কইলজা পাষাণ কইরা ফালামু, নয়তো মনের উপরে পাত্থর চাপা দিয়া থুমু!'
তারপরই অকস্মাৎ গয়নার মনে কি হয়, সে নিজের পরনের কাপড় হাঁটুর উপরে তুলে ফেলে। আর সঙ্গে সঙ্গেই তড়িতাহতের মত রবিউলের মাথা ঝুঁকে পড়ে ভাতের থালার উপর। সে গয়নার চিৎকার শুনতে পায়, 'দ্যাখেন, ডাকাইতে পিডাইয়া করছে কি! অ্যাহনো রক্ত শুকায় নাই!'
গয়না হয়তো উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। 'এই যে দ্যাখেন পিঠের উপরে!'
তারপরই রবিউল গয়নার ব্লাউজের হুক বা বোতাম ছেঁড়ার পটপট শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু সেই হুক বা বোতাম ছেঁড়ার শব্দ তার কানে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত হওয়া সর্বকালের নিকৃষ্ট মানুষদের সৃষ্ট বোমার শব্দের চাইতেও যেন দ্বিগুণ হয়ে বাজে, 'দ্যাখেন আমার অবস্থা! এক্কবারে ফালিফালি কইরা ফালাইছে!'
রবিউল অনুভব করতে পারে যে, গয়না ঘুরে তার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু তখনও রবিউল মাথা তুলতে পারে না। যেন বিশালাকার কোনো গ্লানির পাহাড় কেউ তার মাথায় তুলে দিয়েছে। সেই অবস্থাতেই সে শুনতে পায় গয়নার কন্ঠস্বর, 'আপনে যে কন, ওই ডাকাইতের পোলাপানের লাইগ্যা আমার কষ্ট লাগবো! ক্যান লাগবো? মানুষ যে চোর ডাকাইতরে মারে, তাগো অবস্থাও তো এমন হয় না!'
কতটা কষ্ট আর অপমানের ফলে সাধারণ একজন লজ্জাশীলা নারী এমন ধরণের কান্ডজ্ঞানহীন কাজ করতে পারে? উত্তেজনার বশে সে কী করছে, তার সেই বোধ হয়তো তখন অবশিষ্ট নেই। ভিন্ন একজন পুরুষকে নিজের শরীর উম্মুক্ত করে দেখাতে একজন বঙ্গ-নারী কখন পারে, যদি না সে উম্মাদিনী হয়ে ওঠে? প্রবল দুঃখ আর বেদনার বিষে যদি নাইবা হারিয়ে গিয়ে থাকে তার স্থান-কাল-পাত্রের ভেদাভেদ বোধ, সে কিছুতেই এতটা উগ্র হয়ে উঠতে পারে না। বঙ্গ-ললনা বলে কথা! স্বামী বা প্রেমিকের সামনেও যে লজ্জার বশে কখনো কখনো আড়াল খোঁজে, সে কেমন বিষে জর্জরিত?
কিন্তু তারপরও এমন কিছু কিছু ব্যাপার ঘটে যায়। যখন কোনো কোনো মানুষ তাঁর ব্যক্তিগত গুণপনায় পরিচিত মহলে হয়ে উঠেন আপন জনেরও বেশি। তখন তিনি অন্যের চোখে হয়ে যান অতিমানবীয় কেউ। পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিবেক বোধ আর অতিমানবীয় বোধ-বিবেচনা স্বাভাবিক ভাবেই ভিন্নতর। তাই তাঁর কাছেই হয়তো অকপটে বলা যায় সব কথা। প্রকাশ করা যায় যাবতীয় গোপনীয়তা। আর পৃথিবীতে এমন একটি ব্যাপার আছে বলেই হয়তো মানুষ তারই পরিচিত কারো মাঝে সেই অতিমানবীয় গুণটুকু আবিষ্কার করে নেয়। যাঁর কাছে যাবতীয় কষ্ট, অপমান বোধ, দুঃখ-বেদনা, পাপ আর অনুতাপ প্রকাশ করে ভার মুক্ত করে নিজকে। অন্তর্গত যাতনার বোঝা নামিয়ে দিয়ে শ্বাস নেয় বুক ভরে।
হয়তো গয়নাও তেমনি কোনো গুণের সন্ধান পেয়েছে রবিউলের মাঝে। শুধু নারী হিসেবেই নয়, বস্তুত একজন মানুষ হিসেবে তারও তো দুঃখ প্রকাশের, মনো-দৌহিক বেদনা বোধ আর অনুভূতি প্রকাশের বা রাগ অভিমান ব্যক্ত করার নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য কাউকে চাই মাধ্যম হিসেবে! এমন কিছু নির্গমন বা উদগীরণের উপায় না থাকলে মানুষ গয়না কি কষ্টে-কষ্টে, বেদনা আর অপমানের বিষে জর্জরিত হয়ে সত্যিই কোনো একদিন মানসিক ভারসাম্য হারাবে না?
যদিও গয়না তার শরীরের অংশ বিশেষ উম্মুক্ত করেছিলো রবিউল দেখবে বলে। নির্যাতনের ছাপ কতটা গাঢ় তা নিয়ে মন্তব্য করবে বলে। কিন্তু রবিউল গয়নার শরীরের উম্মুক্ত অংশের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। হয়তো চেষ্টা করলেও পারতো না। তার মনের কোনো এক অংশে দাঁড়িয়ে বিবেক বা মনুষ্যত্ব বোধ তার মাথা ঠেসে ধরেছিলো নিচের দিকে। তার তখন মনে হচ্ছিলো, এমন দৃশ্য দেখা পাপ! যেহেতু গয়না সজ্ঞানে এমনটি করেনি। শত প্রলোভনেও এমন করার মেয়ে সে নয়!
রবিউল অপেক্ষায় ছিলো গয়না কতক্ষণে শান্ত হয়ে আবার তার সামনে বসবে। কিন্তু গয়না রবিউলের সামনে আর বসে না। চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত আর আকস্মিক ভাবেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
গয়না বেরিয়ে যাওয়ার পর এক গ্রাস ভাতও মুখে দিতে পারে না রবিউল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ভাত নাড়া-চাড়া করে পানির জগ হাতে বাইরে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে। মুখের ভেতরটা কেমন তিতকুটে মনে হলে সে মুখে পানি নিয়ে কুলকুচা করে কয়েকবার। কিন্তু তার মুখের ভেতরকার স্বাদ বদলায় না। তবু সে ফিরে এসে তেতো মুখেই গয়নার প্রতীক্ষায় বসে থাকে।
(চলবে...)
মন্তব্য
আমিও অপেক্ষা করছি গয়নার জেগে ওঠার।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
গয়না জেগে উঠবে না এপাশ ওপাশ করবে এখনই বলা মুশকিল! তবে অপেক্ষার জন্য ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
চমৎকার! কতো সহজে উঠে এসেছে গল্পের আলাপচারিতা ও দৃশ্যের বর্ণনা। আপনার গদ্যের হাত সত্যিই প্রশংসনীয়।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
জলিল ভাই, প্রশংসা কে না ভালোবাসে? কিন্তু আমি কি এতটা যোগ্য? তবুও সানন্দে উপভোগ করলাম আপনার প্রশংসাটুকু। ধন্যবাদ আপনাকে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
চমত্কার!
চলবে.............অপেক্ষায় থাকলাম।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
ধন্যবাদ আবু রেজা। প্রার্থনা করি- আপনার অপেক্ষা যেন ফুরায়।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন