মেয়েরা যতটা স্বল্প পরিসরে গুছিয়ে রান্না করতে পারে, ছেলেরা হয়তো তার দ্বিগুণ পরিসরেও তেমন সুবিধা করতে পারে না।
রান্নার প্রায় শেষের দিকে হাতেম আলি চুলোর ভেতর একই সঙ্গে অনেকগুলো শুকনো পাতা আর খড়কুটো ঠেসে দিলে আগুন নিভে গিয়ে প্রচুর ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। সেই সময় চোখ জ্বালা করে উঠলে মানিক কেঁদে ওঠে। একই সঙ্গে হাতেম আলির চোখও জ্বালা করছিলো বলে ছেলের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার বদলে বিরক্ত হয়ে ধমক লাগালে, ভয় পেয়ে সে আরো জোরে কেঁদে ওঠে।
হাতে-পায়ে পোড়া ক্ষত নিয়ে ঘরে শুয়েছিলো ময়না। রান্নাঘরে তার ছোটো বোন কুলসুম রান্নার কাজে বাবাকে টুকটাক সাহায্য করছিলো। কিন্তু সামলাতে পারছিলো না মানিককে।
ছোট ভাইয়ের কান্না শুনে ময়না বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাইরে দাঁড়িয়েই সে কুলসুমের উদ্দেশ্যে বলে, ‘কুলসুম, মানিকরে দিয়া যা!’
হাতেম আলি রান্নাঘর থেকে বলে, ‘মানিকরে তুই লইতে পারবি না!’
‘হ্যায় যে কানতাছে!’
‘কান্দুক! তুই ঘরে যা!’
কিন্তু ময়না ঘরে যায় না। মানিক কাঁদলে তার সহ্য হয় না। পৃথিবীতে মনে হয় মানিককেই সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মানিকও তা অনুভব করতে পারে বলেই ময়নার কন্ঠস্বর শুনে কান্নার বেগ কমিয়ে দেয়। গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর রান্নাঘরের পৈঠা থেকে ছেঁচড়ে নেমে একছুটে চলে আসে বোনের কাছে।
হাতের অসুবিধার কারণে ভাইকে কোলে নিতে না পারলেও ময়না নিচু হয়ে অন্য হাতে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নেয় মানিককে। ভাইয়ের কান্না থামানোর জন্য ময়না বলে, ‘আমার ভাইডা কান্দে ক্যানরে! তুমি অখন বড় হইয়া গেছ না! তুমি কানবা ক্যান? সারাদিন হাসবা! হাসতেই থাকবা!’ বলে, সে মানিকের পেটে সুড়সুড়ি দেয়।
মানিক কান্না ভুলে হেসে ওঠে।
তারপর মানিকের হাত ধরে ঘরের দিকে যেতে যেতে ময়না আবার বলে, ‘আব্বায় মারছে তোমারে?’
মানিক পুরোপুরি কথা বলতে না পারলেও মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।
মানিককে বিছানায় বসিয়ে ন্যাকড়া দিয়ে পা মুছিয়ে দিতে দিতে ময়না আবার বলে, ‘আব্বাডা পচা! সবতেরে মারে! আমরা আব্বার কাছে আর যামু না!’
মানিক মুখে ডান হাতের আঙ্গুল পুরে বলে, ‘আম্মা!’
ময়না বুঝতে পারে ভাইয়ের মনোভাব। ক'দিন ধরে সে তার মাকে দেখতে পাচ্ছে না। শিশুমন সেই শূন্যতা ঠিকই অনুভব করতে পারছে। তাই ময়না বলে, ‘আম্মা যাইবা?’
মানিক আবার মাথা দোলায়।
‘আম্মায় দুদু আনতে গেছে। আব্বারে দুদু দিমু না!’
মানিক পা দোলাতে দোলাতে বলে, ‘আব্বা পচা!’
ভাইয়ের কথা শুনে ময়নার মন খারাপ হয়ে যায়। তার বয়স বার হলে কি হবে, সংসারের সমস্যা, বাবা-মার মধ্যকার সংকট সবই বুঝতে পারে। কিন্তু মুখ ফুটে কখনোই কিছু প্রকাশ করে না। তার মতে বাবাই সব সংকটের মূলে। কাজ-কর্ম না করে বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই শুয়ে বসে থাকে। কাজে যাওয়ার কথা বললেই তার মাথা ঘোরে নয়তো শুরু হয় পেট-কামুড়! এর সবই যে কাজে না যাওয়ার ছুতো, সে ঠিকই বোঝে। অথচ রহিমার বাবার হাঁপানি রোগ হলেও কাজ করতে তার কোনোই অলসতা নেই। যেদিন কাজে যাওয়ার জন্য কেউ ডাকতে আসে না, সেদিন রহিমাকে নিয়ে পড়াতে বসে। বাড়ির উঠোন-বার ঝাঁট দেয়। ঘরের ময়লা কাপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে দেয়। কখনও বা ঘরের খুঁটি বা বেড়া মেরামত করে। নিদেন পক্ষে ঝাড়–টা নতুন করে বাঁধে। সেই তুলনায় তার বাবা হাতেম আলি লোকটা যেন কেমন। বাবা হলেও কেন জানি অন্য কোনো বাড়ির মানুষ বলে মনে হয়।
রান্না শেষ হয়ে গেলে হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে ঘরে আসে হাতেম আলি। ছেলেটা হাতের মুঠোয় ময়নার জামার প্রান্ত— আঁকড়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। মানিকের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতেম আলি। মনেমনে বলে, ক্যান যে মাথাডা এত গরম হইয়া যায়, এই কয়দিনে পোলাপানের চেহারা-সুরত কী হইছে!
ঘুমন্ত মানিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে হাতেম আলি, বাঁইচ্যা থাকলে গয়নার গায়ে আর একটা টোকাও দিমু না! এখন থাইক্যা কাজ-কর্মের চেষ্টা-তদ্বিরও কিছু করতে হইবো।
পরক্ষণেই কিছুটা উদ্বিগ্ন ভাবে উঠোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ভাবে, রবু কি কাইল যায় নাই? অখনও তো কোনো খবর-বার্তা নিয়া আইলো না!
সে উদ্বিগ্ন ভাবেই ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটে। মনেমনে ঠিক করে যে, বাচ্চাদের খাওয়া হয়ে গেলে, একবার নিজেই যাবে রবিউলের কাছে। গয়না রবিউলকে খুবই মান্য করে। তার কথা ফেলতে পারবে না।
বাবাকে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে দেখে ময়না বললো, ‘মানিক ঘুমে থাকতে থাকতে তুমি গোসল সাইরা আসো আব্বা! তুমি আইলে তার বাদে আমি যামু!’
‘না। তর গোসল করতে হইবো না। ঘাও শুকানের আগে পানি লাগলে ডর আছে!’
‘ঘাও শুকাইতে লাগবো একমাস। এই একমাস কি আমি গোসল করতে পারমু না?’
‘এতদিন লাগবো না!’
‘চাচি যে, কইলো!’
‘তর চাচি কিছু জানে না! তর রবু কাকা যেই মলম আইন্যা লাগাইছে, আমি আইজই একটা আইন্যা দিমু। আল্লায় করলে তাড়াতাড়িই ভালা হইয়া যাইবো!’
ময়না শংকিত ভাবে বলে, ‘দাগ যাইবো তো?’
এত কষ্টের ভেতরও মেয়ের কথা শুনে হাসি পায় হাতেম আলির। কিন্তু সে হাসে না। বলে, ‘ঘাও ভালা হইয়া গেলে দাগে কি করবো?’
‘দেখতে খারাপ লাগবো না!’
‘বড় হইলে ঠিক হইয়া যাইবো!’
ময়নার মন তবুও খুঁতখুঁত করে। আজগর নানার মেয়ে জুনি খালার পায়ে একটা দাগ ছিলো। আগুনের পোড়া দাগ। সেই দাগ দেখার পর কেউ আর বিয়ের তারিখ নিয়ে ফিরে আসতো না। এভাবে জুনি খালার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিলো। পরে বাচ্চা-কাচ্চা আছে এমন একজনের সাথে বিয়ে হয়েছে।
হাতেম আলি সেই ঘটনার কথা জানলেও ময়নার মত এমন বাচ্চা একটা মেয়ের মাথায় এত জটিল একটা ভাবনা আসতে পারে বলে মনে করে না সে। কিন্তু সবারই ভালো করে জানা উচিত যে, এগারো-বার বছরের একটি শিশু এত বেশি শিশু নয়।
‘কুলসুম, কুলসুম!’
হাতেম আলির ডাক শুনে রান্নাঘর থেকে সাড়া দিয়ে কুলসুম বললো, ‘আইতাছি আব্বা!’
কিছুক্ষণ পর একটি ছোটো হাঁড়ি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে কুলসুম।
হাতেম আলি বললো, ‘তাড়াতাড়ি গাও-গোসল দিয়া আয়, আমি একটু বাইর হমু।’
‘তুমি আগে সাইরা আসো।’ বলে, কুলসুম হাঁড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।
‘তাইলে মা তুই ঘরডা ঝাড়ু দিয়া ফালাইস!’
‘আইচ্ছা।’
হাতেম আলি ঘরের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে পুকুর ঘাটে যায়।
ঘাট একেবারেই জনশূন্য। হাতেম আলি ঘাটের খুঁটিতে লুঙ্গি-গামছা রেখে হেঁটে হেঁটে বুক সমান পানিতে গিয়ে পরপর দুটো ডুব দেয়।
তারপর পরনের লুঙ্গি দিয়েই শরীর হাত-মুখ ডলে-ডলে ময়লা আর ঘাম পরিষ্কার করে। তার মনে হয় যে, এভাবে যদি ডলে-ডলে ভাগ্যটাকেও পরিষ্কার রাখা যেতো, তাহলে তার জীবনের যাবতীয় দুর্গতি আর দুর্ভাগ্যকেও ডলে-ডলে ভাগ্যের শরীর থেকে তুলে ফেলতে পারতো।
এমন সময় তার বড় ভাই কাশেমের স্ত্রী কমলা হাতে করে একটা হাঁড়ি নিয়ে ঘাটে আসে। পানির পাশে শুকনোতে বসে হাঁড়িটাতে কাদা মেখে খড় দিয়ে ডলতে ডলতে নিজে নিজেই বলে, ‘মাইয়া মানুষ যদি নিজের মর্জি মত ঘর ছাইড়া যায়, তাইলে হ্যায় নিজেই মাথা নিচা কইরা ফিরা আসন উচিত। কেউ ফিরাইয়া আনতে গেলে দেমাক বাইড়া যায়!’
কমলাকে পছন্দ করে না হাতেম আলি। খুবই দুষ্টু আর হিংসুটে প্রকৃতির মেয়ে মানুষ সে। রাতের বেলা স্বামী-স্ত্রীতে কী কথা হয় তা শুনবার জন্য ঘরের পেছনে বেড়ায় কান পেতে রাখে। কয়েকবার হাতেনাতে ধরেছেও হাতেম আলি। কিন্তু কমলার স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
হাতেম আলির সাড়া না পেয়ে কমলা কন্ঠস্বর উঁচিয়ে বলে, ‘আমার দ্যাওরা কি কানে তালা দিছে? ও হাতেম ভাই!’
হাতেম আলি কমলার দিকে ফিরলে, সে আবার বলে, ‘আপনের ভাই কইছে, ময়নার মায় আপনের ইচ্ছায় ফিরা না আইলে, কেউ জানি তারে আনতে না যায়!’
‘আ্যঁহ্, গায়ে মানে না আপনে মোড়ল!’
কমলা হাতেম আলির কথা বুঝতে না পেরে বলে, ‘কিছু কইলা?’
‘কাশেম ভাই এই কথা কইলো বুঝি?’
‘কইলো তো।’
কমলা তার হাঁড়িটা পানিতে ধুয়ে, দাঁড়িয়ে বলে, ‘আরো কইলো কি জানো?’
‘কি কইলো?’
‘কইলো, দ্যাশে কি মাইয়ার অভাব? অখনও মুখ দিয়া বাইর করলে তের-চৈদ্দ বছইরা মাইয়াগো বাপ-ভাইয়েরা দৌঁড় পাইড়া আইবো। তোমার বউয়ের দেমাক বেশি। মাইয়া মানুষের বেশি দেমাক ভালা না!’
হাতেম আলি জানে, কমলা গয়নাকে ঈর্ষা করে। কমলার গায়ের রঙ এতটাই কালো যে, গয়নার পাশে তাকে গোবর লেপা বেড়ার মতই মনে হয়। তাই সে গয়নার পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, যে রাস্তায় গয়না থাকে কমলা সেদিকেও যায় না। কমলা যেমন গয়নাকে ঈর্ষা করে তেমনি গয়নাও তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কম করে না। কমলার হাতের কিছু খেতে পারে না গয়না। না জেনে কিছু খেলেও পরে জানতে পারলে বমি করতে আরম্ভ করে দেয়। গয়নার এ ব্যাপারটা কমলাও জানে।
একবার ডুব দিয়ে উঠে হাতেম আলি বললো, ‘এইবার দেমাক ছুটামু! পরতেক বারই কিছু হইলে দৌঁড় পাইড়া বাপের বাড়ি যায় গিয়া। এইবার কয়মাস বাপের বাড়ি থাকতে পারে দেখি!’
কমলা কেমন উজ্জ্বল মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে দেবরের প্রতি।
হাতেম আলি আবার বলে, ‘এইবার গিয়া খালি কমু যে, বাপের বাড়ির ভাত যদ্দিন মজা লাগে তদ্দিন পইড়া থাক! আমি কিছু কইতে আমু না!’
কমলা সঙ্গে সঙ্গেই বলে, ‘লগে আননের কথা কিন্তু স্বীকার হইবা না!’
‘দেখি চিন্তা ভাবনা কইরা!’
হাঁড়িতে পানি ভরে নিয়ে পাড়ে উঠে যায় কমলা।
হাতেম আলি কমলার চলে যাওয়া দেখে আর মনেমনে হাসে। বিড়বিড় করে বলে, ‘তোমরা মনে কইরো না যে, তোমরাই চালাক! তাই বইল্যা আমি কাশেমের মতন রামছাগল না!’
গোসল সেরে হাতেম আলি ফিরে আসতেই কুলসুম তাকে পাশ কাটিয়ে পুকুরের দিকে ছুটে যায়।
‘বেশি পানিতে যাইস না কইলাম!’
মেয়েকে সাবধান করলেও হাতেম আলি ঝুপ করে একটা শব্দ শুনতে পায়। কুলসুম হয়তো পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে।
মন্তব্য
পড়ছি....
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
রাফি,
আপনার সঙ্গে আমি আছি। ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন