দূর থেকে রবিউলকে ছাতা মাথায় আসতে দেখে মুখ কালো করে দাওয়ায় বসেছিলো জয়নাব। কিন্তু তার মুখের ভাবটা ঠিকভাবে ফুটে উঠে না কখনোই। তবু চেষ্টা করে অন্তত গম্ভীর হয়ে থাকতে।
রবিউল ছাতাটা বন্ধ করে দরজার চৌকাঠে ঝুলিয়ে দিয়ে বললো, 'উত্তর দিক দিয়া আসমান ম্যাঘে ম্যাঘে এক্কবারে কালা হইয়া গেছে! কহন জানি বান-বাতাস শুরু হয়, আমারে তাড়াতাড়ি ভাত খাইতে দে!'
রবিউলের কথার জবাব না দিয়ে জয়নাব অন্যদিকে মুখ ফিরালে, রবিউল ফের সামনে গিয়ে বলে, 'ঝরি শুরু হইতে বুঝি আর দেরি নাই!'
জয়নাব হঠাত হেসে উঠলে তার মুখের মেঘও সরে যায়। স্বামীর সঙ্গে রাগ করে মুখ ভার করে রাখবে কোন অছিলায়? তেমন সুযোগ কি রবিউল দেয়, না দিতে পারে?
জয়নাবের পাশে বসে রবিউল বললো, 'কারণডা কি কইয়া ফালাইতে পারস না?'
'কতবার কমু?'
রবিউলকে উল্টো মুখ ঝামটা দেয় সে।
কিন্তু রবিউল হেসে বলে, 'যা পারস না, তা করতে যাইস না। তুই কি কোনো দিন যাত্রা দ্যাহস নাই? তগো গ্যারামে আগে হুনছি গুনাই বিবি হইতো!'
জয়নাব হাসে। 'কেবল দেখলেই হয় না, কিছুডা মনেও থাকন লাগে!'
রবিউল জানে, জয়নাব আবার বাপের বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরবে। তাই আগে আগেই সে বলে, 'বউ, তুই বাপের বাড়ি যাওনের নাম নিলেই আমার ক্ষিদা বাইড়া যায়। মনে হয়, তুই না থাকলে আমি না খাইয়াই মইরা যামু!'
জয়নাব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রবিউলের মুখের দিকে। তারপর হঠাত বলে, 'জন-কামলা নিয়া জমি-ক্ষেতি করতে পারো আর দুইডা ভাত রাইন্দা খাইতে পারবা না?'
'অনেক চেষ্টা করছি! তাও এইবার সত্যিই রান্দন শিখমু। তুই আরো কয়ডা দিন পরে যা। ময়নার মায় ফিরা আইলেই তরে নিয়া যামু!'
জয়নাব এবার সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে বলে, 'ময়নার মায় আইলে তোমার কি সুবিধা হইবো?'
'তুই যেই কয়দিন তগো বাইত্যে থাকবি, হেই কয়দিন আমি হ্যাগো ঘরে খামু।'
'তাইলে তো হইছেই!' বলে, জয়নাব ঠোঁট উল্টায়।
'ক্যান, অসুবিধা কি?'
'কমলারে তো চিন নাই! তার মুখ যহন খুলবো, তহন টের পাইবা যে, কয় ভাপে ধান সিদ্ধ হয়!'
রবিউল বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে থাকে।
তা দেখে জয়নাব আবার বলে, 'কমলার কথা হুনলে কুত্তায়ও ঘেউ-ঘেউ বন্ধ কইরা দেয়!'
রবিউল বুঝতে পারে না জয়নাবের কথা। বলে, 'পরিষ্কার কইরা ক!'
'কমলা কথা বানাইয়া বানাইয়া পুরা গ্যারাম ছাইয়া ফালাইবো। পরে তোমরা তিনজনের কেউই আর গ্যারামে মুখ দ্যাখাইতে পারবা না!'
রবিউল বলে, 'কি কথা বানাইবো?'
'হেইডা তুমি বুঝবা না। ব্যবস্থা যা করনের আমিই করতাছি!'
'তুই আবার কি ব্যবস্থা করবি?'
রবিউলের কন্ঠে তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে।
'খালেক মামুর মাইয়া নূরীবুরে আইন্যা দিয়া যাই। যেই কয়দিন আমি থাকমু না, হেই কয়দিন তোমার রান্ধন-বাড়নের কাম হইয়া যাইবো!'
'হ, হ্যায় আইবো না তর বাইন্দালি করতে! তা ছাড়া, হ্যায় হইলো গিয়া মাথা খারাপ মানুষ, কহন কি করবো তার কোনো ইস্টিশন আছে?'
জয়নাব অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে রবিউলের কাঁধে হাত রেখে বলে, 'নূরীবু তো অখন ভালো হইয়া গেছে! তা ছাড়া বিয়ার কথা শুনলেই না বুবু পাগল হইয়া যাইতো! অখন তার বয়স পরায় চল্লিশ। এই বুড়িরে কে বিয়া করতে কইবো, কও?'
'কিন্তু...'
রবিউলের মনে নতুন করে ভাবনা চেপে বসে। জয়নাব তাকে যতই ভালোবাসুক, যতই বিশ্বাস করুক, সত্যি কথা শুনলে তারও মন ঠিক থাকবে না। শত হলেও মেয়ে মানুষ। স্বামীর গোপন বিষয় জানতে পারলে কিছুটা হলেও সমস্যার সৃষ্টি করবে।
বছর পাঁচেক আগে, আসমা বেগমের বাতের সমস্যার কারণে আধপাগল নূরীকে কয়েক দিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। আধপাগল হলেও সংসারের যাবতীয় কাজে কোনো সমস্যা হতো না। তাই তখন নূরীই পুরোটা সংসার আগলাচ্ছিলো।
একদিন খুব সকালের দিকে ঘর ঝাঁট দিতে আসে নূরী। তার কিছুক্ষণ আগেই বাইরে থেকে এসে আবার শুয়েছিলো রবিউল। ঘরের ভেতরকার আবছা আলোয় রবিউলের চোখ খোলা কি বন্ধ বোঝা যায় না। নূরী ঝাঁড়ু হাতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রবিউলের দিকে। হয়তো বা বুঝতে চেষ্টা করে যে, রবিউল ঘুমে না জাগরণে। তারপরই কি মনে করে হাত থেকে ঝাড়ুটা মেঝেতে ফেলে দিয়ে একহাত ব্লাউজের নিচে আর অন্যহাত পেটিকোটের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে বিচিত্র রকমের একটি শব্দ করতে লাগলো। বিস্মিত এবং ভীত রবিউল বিছানায় উঠে বসলে নূরী লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যাবার কথা থাকলেও উল্টো এগিয়ে এলো বিছানার কাছে। কিন্তু সেই সময় আসমা বেগম নূরীকে ডাকতে আরম্ভ করলে রবিউল নূরীকে বলেছিলো, 'অখন তুমি যাও!'
নূরী রবিউলের কথায় কি বুঝেছিলো কে জানে! তখনকার মত নূরী শান্তভাবে বেরিয়ে গেলেও রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়ার পর সে পুকুর থেকে গোসল করে আসে। অতি যত্নে চুলে তেল দিয়ে আঁচড়িয়ে রঙিন ফিতেয় বেণি বাঁধে। আসমা বেগম পাগলীর কান্ড-কারখানা অবাক হয়ে দেখেন।
এক সময় তিনি জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারেন না। 'তুই অত সাজা-গুজা করতাছস ক্যান?'
দু'বেণির প্রান্ত মাথার পেছন দিকে ঘুরিয়ে বাঁধতে বাঁধতে নূরী বলেছিলো, 'কাইল বিয়ানে দূর্গারে ফালায় দিবো। এইবার ত দেখনের সুযুগ পাইলাম না! রবু আমার লগে যাইবো আর আইবো, বেশি দেরি হইবো না!'
আসমা বেগম মাথা খারাপ নূরীকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। কিংবা তার কাজ-কর্ম স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। যে কারণে রবিউলকে তার সঙ্গে যেতে দিলেন না। বললেন, 'রাইতের কালে এক গ্যারাম ছাইড়া আরেক গ্যারামে গিয়া দূর্গা দ্যাখনের কাম নাই!'
নূরী একবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো রবিউলের দিকে। হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলো যে, মায়ের কারণেই আজকের অভিসার পন্ড হয়ে গেল!
তারপর হঠাত দুপদাপ পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো সে।
পরদিন অনেকেই দেখলো যে, গ্রমের পুরোনো বটগাছের ডালে বসে পা ঝুলিয়ে গান গাইছে নূরী।
নূরীর সেই পাগলামী সেরেছে এক বছরও হয়নি। ফের যদি নূরী এমন কিছু করে? অবশ্য এখন তার বয়সও বেড়েছে। কিন্তু রবিউল জানে না যে, একজন নারীর বয়স কত হলে তার শরীরের চাহিদা শূন্য হয়ে যায়।
জয়নাব রবিউলকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে, 'আরে, কার ধ্যানে মজলা?'
রবিউল হেসে বলে, 'নূরীবুর ধ্যানে। তার পাগলামী সারছে এক বছরও পুরা হয় নাই!'
'হেই চিন্তা তোমার করতে হইবো না! আগে আমরা কথা কইয়া দেখি!'
'তুই কথা কইস, আমি যাইতে পারমু না!'
জয়নাব উঠে পড়ে বলে, 'তোমার যাইতে হইবো না! অখন হাত মুখ ধুইতে যাও, আমার অনেক ক্ষিদা পাইছে!'
(চলবে...)
মন্তব্য
জুলিয়ানভাই,
আমার মনে হয় আপনার উপন্যাস শেষ হলে পরেই একেবারে পড়বো, না হলে খুব টেনশনে থাকি রোজ। এই কি হয় আর এই কি হয়। নষ্ট সময় পড়ার সময় তো আরো খারাপ অবস্হা।
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
আরে ভাই থোন ফালাইয়া আমার উপন্যাস! আগে আমারে নিয়াই কিছুদিন টেনশন কইরা লন। কী যে বিপদে আছি!
আপ্নের আবার কি হইলো ? সত্যিই কি কোনো সমস্যা আছে নাকি ? এ তো দেখি আমারে টেনশনে ফালায়া দিলেন। খুইলে কন নাইলে ঘুমাইতে পারুম না।
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
জুলিয়ান ভাই, সব ঠিক আছে তো?
যতো যাই হোক লেখা থামায়েন না।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
নতুন মন্তব্য করুন