খালেক মামু বাড়িতেই ছিলেন। উঠোনে একটি জলচৌকিতে বসে গায়ে রোদ লাগাচ্ছিলেন। জয়নাবের পায়ের শব্দে অন্ধ খালেক মামু হঠাৎ সচকিত হয়ে বললেন, 'ক্যাডারে?'
জয়নাব খালেক মামুর পাশে গিয়ে বললো, 'মামু, আমি জয়নাব!'
'ভালা আছস মা?'
'হ মামু।'
'রবু কথা কয় না ক্যান?'
'আমি একলাই আইছি মামু!'
খালেক মামু বিরক্ত হয়ে বললেন, 'মাইয়া মানুষ একলা চলা ফিরা করন ঠিক না। পরে সংসার করনের মন থাকে না!'
সম্পূর্র্ণ আজগুবী একটি কথা শুনে জয়নাব হঠাৎ কি করবে বুঝতে পারছিলো না। সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।
খালেক মামু বুঝতে পারেন যে জয়নাব এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, 'রৈদে বেশিক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিস না। ঘরে যা!'
'মামি কোই?' বলে, জয়নাব উঠোন থেকে গিয়ে ঘরে ঢুকলো।
বড় লাল রঙের কাঁথায় সাদা আর হলুদ সূতো মিশিয়ে ফুল তুলছিলো নূরী। 'কেমন আছ নূরীবু?' বলে জয়নাব কাঁথার উপর বসতেই নূরী তাকে ঠেলে তুলে দেয়।
জয়নাব বিস্মিত হয়ে বলে, 'আমি আইলাম তোমার খোঁজ-খবর করতে আর তুমি আমারে সরাইয়া দিলা?'
নূরী উঠে জয়নাবকে জড়িয়ে ধরে বলে, 'নারে বইন, যেই ক্যাঁথায় সূঁইয়ের কাজ চলে হেই ক্যাঁথার উপরে বইতে নাই!'
'কী হয় বইলে?'
জয়নাবের চোখে কৌতুহল চকচক করে যেন।
'মাঞ্জা বিষ করে।'
নূরীর কথা শুনে জয়নাব মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে উঠলো।
তা দেখে নূরী বললো, 'তুই হাসতাছস ক্যান?'
জয়নাব হাসি থামিয়ে বললো, 'তাইলে সিলাইন্যা ক্যাঁথা গায়ে দিলে তো পুরা শইল বিষ করনের কথা!'
'আমি কি জানি, মুরুব্বীরা কয় দেইখ্যা না আমি কইলাম!'
'তাইলে তুমিও মুরুব্বী হইয়া গ্যাছো?'
নূরী রাগ দেখিয়ে বলে, 'ওই ছেড়ি, বেশি ফাজিল কথা কইবি না! আয়, আমার লগে আইয়া বয়!'
নূরী কাঁথাটাকে ভাঁজ করে একপাশে সরিয়ে পাটির উপর বসে।
জয়নাব পাটিতে বসে নূরীর দুহাঁটুতে হাত রেখে বলে, 'তুমি কেমন আছ বুবু?'
নূরীর একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বলে, 'কেমন আর থাকুম! বাপ-ভাইয়ের কান্দে বোঝা হওনের মতন পোড়া কপাল আর নাই!'
সকালের দিকে ফালুর বউ মাজেদার সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছে নূরীর। মাজেদা তাকে বাপ-ভাইয়ের কাঁধের বোঝা বলেছে। সেই থেকে তার মন খারাপ।
জয়নাব সকালের ঘটনার কথা জানে না। কিন্তু কোনো কারণে যে, নূরীর মন ভালো নেই সেটা বুঝতে পেরে সে বলে, 'তোমার কি মন খারাপ বুবু?'
'এই ছাড়া আমি আর কি করতে পারি ক? যাগোরডা খাই-পিন্দি, এর লাইগ্যা যদি আমারে খোঁটা শুনতে হয় তাইলে কি হ্যাগোরে আমি পিডাইতে পারমু? না ভাত-কাপড়ের মায়া ছাইড়া কোনোদিকে চইলা যাইতে পারমু?'
কথার পিঠে কথা আসে বলেই জয়নাব বলে ফেলে, 'খাওয়াইয়া পিন্দাইয়া যদি খোঁটাই দিতে পারে, তো এমন ভাত-কাপড়ের মায়া ক্যান করবা?'
হঠাৎ উঠোন থেকে মাজেদার কন্ঠস্বর ভেসে আসে, 'ভাত-কাপড়ের মায়া ছাড়লে তুই নিয়া পালবি নাকি হ্যারে?'
জয়নাব বুঝতে পারেনি যে, মাজেদা আঁড়ি পেতে কথা শুনতে পারে। প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও কথা শুনে তার গায়ে আগুন ধরে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, 'আমি পালন লাগবো ক্যান, নূরীবুর কি কেউ নাই? নাকি বাপ-মায়ের ঘরে হ্যায় পয়দা হয় নাই? তুমি এই কথা কওনের কে? দুইদিনের বৈরাগনী না, ভাতেরে কয় পরসাদ!'
'দুইদিনের বৈরাগনী হমু ক্যান, গাঙ দিয়া কি ভাইস্যা আইছি? বিয়া বইয়া আই নাই?'
'বিয়া বইয়া আইছো দেইখ্যাই দুইদিনের বৈরাগনী! নাভির নিচের কুটুম্ব! তিন কথা কইলে যে পথের ফকিন্নি, তার আবার বড় কথা!'
মাজেদা আরো দ্বিগুণ তেজে বলে, 'তিন কথা কইয়া বিদায় দ্যাওনের দিন কুত্তায় খাইছে, দুনিয়া অখন অত সোজা না!'
নূরী জয়নাবের মুখে হাত চাপা দিয়ে থামাতে চেষ্টা করে। কিন্তু জয়নাব থামে না। সে বলে, 'এই সংসারে ফালু ভাইয়ের যেটুক হক, নূরীবুরও সমান হক। তুমি মনে কইরো না যে নূরীবু তোমার বাপেরডা খায়-পিন্দে!'
জয়নাবের কথা শুনে মাজেদার গলার স্বর আরো চড়া হয়। বেজায় শ্লেষের সঙ্গে বলে, 'জমিদার হইলে আলাদা খায় না ক্যান?'
'নূরীবু আলাদা হইলে তোমরা দুইজনে ভিক্ষায় নামতে হইবো! তোমার জামাইর ভাগের জমি আগেই বেইচ্যা শেষ করছে! অখন যা জমি আছে সবই নূরীবুর!'
এই কথা শুনে মাজেদা হঠাৎ থ হয়ে যায়। সেই সুযোগে জয়নাব চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, 'তোমার উচিত নূরীবুর পাও ধুইয়া পানি খাওন!'
'কী, আমারে তুই এত বড় কথা কইলি?'
মাজেদা আবার সরব হয়ে ওঠে। 'বাঞ্জা, অলক্ষইন্যা মাইয়া! আমার বাইত্যে আইয়া আমারেই ধমক দেয়!'
'বাড়ি তোমারে কেউ লেইখ্যা দেয় নাই। তোমারে অখন তালাক দিলে তুমি এই বাড়ির কেউ না!'
জয়নাবের সঙ্গে কথায় না পেরে মাটিতে বসে বিলাপ শুরু করে মাজেদা। ঠিক তখনই কোত্থেকে যেন ছুটে আসেন মামি। কোমরে দু'হাত রেখে উঠোনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, 'আমি কই ঘটনা কি?'
মাজেদা বিলাপ করতে করতে যা বলে, তার কিছুটা বুঝলেও বাকিটা তিনি অনুমান করে নেন। তবে এর মূলে যে জয়নাব আর নূরী তা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারেন। তিনি জয়নাবের দিকে ফিরে রাগত স্বরে বললেন, 'তুই কোন কামে আইছিলি?'
'নূরীবুরে আমাগ বাইত্যে নিয়া যাইতে!'
'ক্যান?'
' বুবুরে ঘরে দিয়া মনে করছিলাম বালুকান্দি যামু!'
'থাকবি কয়দিন?'
'পোনরো-বিশদিনের কম না!'
মামি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে খানিকটা এগিয়ে এসে নূরীকে বললেন, 'জয়নাবের কথা হুনছস?'
'হুনলাম তো!'
'তর কি মত?'
'আমি না থাকলেই ভালা হইবো! তোমার পোলার বউয়ের কামুড় আর সহ্য হয় না!'
তারপরই অকস্মাৎ চোখে আঁচল চাপা দিয়ে নূরী বিনবিন করে বললো, 'মরতে যদি না ডরাইতাম তাইলে কবেই বিষ খাইয়া মরতাম!'
মাজেদা হঠাৎ কান্না থামিয়ে বলে উঠলো, 'তাইলে তুই মরস না ক্যান নাগিনী!'
মামি মাজেদার দিকে ফিরে বললেন, 'বউ, তুই ঘরে যা! আইজ ফালুর লগে আমার বুঝ আছে। সম্পদ ভাগ কইরা যার যার মতন আলাদা কইরা দিমু। কাইজা ফসাদের কাম নাই!'
মাজেদা কিছু বলতে যেন ভুলে যায়। কিন্তু ফণা তোলা সাপিনীর মত তাকিয়ে থাকে নূরীর দিকে। নূরী কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।
মামি বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে নূরীর মাথায় বুকে ফু দিয়ে দেন।
তারপর আদর করে বলেন, 'রবুরে মন্দ-সন্দ কইস না! ঝগড়া-ফসাদ করিস না! ঘর-ছাইড়া এহানে ওহানে ঘুইরা বেড়াইস না! আর পরতেক দিন একবার গিয়া তরে দেইখ্যা আমু!'
এখানকার মত একটি বিরুদ্ধ পরিবেশে বাস করে ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠেছিলো নূরী। জয়নাবের আহ্বান আর মায়ের সম্মতি যেন তাকে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য একটু খোলা বাতাসের পথ করে দেয়। বিপুল উৎসাহে সে তার কাপড়-চোপড় পুটলি বাঁধতে থাকলে জয়নাব বলে, 'এইসব পুরান ত্যানা-ছ্যাঁচা ফালাও তো! কিছু নিতে হইবো না তোমার!'
নূরী অবাক হয়ে বলে, 'তাইলে আমি কি পিন্দুম?'
'নতুন অনেক আছে, কয়ডা পিনবা তুমি?'
নূরী হাসে। 'তর চাইয়া আমার শইল মোটা বেশি না!'
মামি বললেন, 'কে কইছে মোটা? এক রকমই!'
মাজেদা ফোঁড়ন দেওয়ার মত বলে, 'যাও, পরের বাইত্যে বাইন্দালি কর গিয়া!'
নূরী মাজেদার কথায় রাগ করে না। বলে, 'তর তিতা কথার চাইয়া তাও অনেক ভালা!'
নূরী আর জয়নাব একই সঙ্গে উঠোনে নামলে মামি বললেন, 'নূরী, তর বাপের দোয়া নিয়া যা!'
উঠোনে বসে থাকা খালেক মামু সবই শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রসঙ্গে কিছু বলেননি। নূরী কাছে গিয়ে বাবার পায়ে হাত দিতেই তিনি নূরীকে বললেন, 'রবু খুব ভালা পোলা! এমন কিছু করিস না যেন আমার অসম্মান হয়!'
নূরী বললো, 'আব্বা, আপনে খালি দোয়া কইরা দেন, আমারে জানি আর কোনো কষ্ট পাইতে না হয়!'
'মারে, তর কষ্টের দিন বুঝি শেষ হইছে! জয়নাবরে দুখ দিস না। মনে যত কষ্টই হউক, কারো কাছে কইস না! জয়নাব তর বইন, মনে রাখিস!'
তারপর তিনি জয়নাবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ' মা জয়নাব, নূরীরে যা কইলাম তরেও একই কথা কইলাম মনে করিস!'
বিদায় নেওয়ার পর পথে নেমে জয়নাব বললো, 'বুবু, তুমি আর এই খাটাস বাইত্যে আইবা না। বাকি জীবন আমাগো লগেই থাকবা!'
নূরী জয়নাবের দিকে একবার ফিরে তাকায়।
তারপর বলে, 'রবু কি আমারে জাগা দিবো?'
'ক্যান দিবো না?'
'রবু আমারে অনেক ডরায়।'
'তোমারে ডরানের কি আছে?'
'আছে, অনেক কিছুই আছে!' বলে, হাসে নূরী।
তারপর আবার বলে, 'যদি মাথা খারাপ হইয়া হ্যার গলা টিপ্যা ধরি? যদি কই আমারে বিয়া করতে হইবো!'
জয়নাব হেসে উঠে বলে, 'এমন কথা কইছিলা নাকি?'
'তাইলে কইতাছি কি?'
জয়নাব বিস্মিত হয়ে বলে, 'হাচা?'
'রবু একবার পাঞ্জাবি পিন্দা আমাগো বাইত্যে গেছিলো। লাল রঙের পাঞ্জাবি। হেইদিন কেমন কইরা জানি আমার মাথাডা ঠিক আছিলো। রবুর একটা হাত ধইরা আস্তে কইরা কইলাম, তরে ছাড়া আর কাউরে বিয়া করুম না! তুই আমারে বিয়া করবি? এই কথা হুইন্যা রবু এমন এক দৌঁড় মারলো, মনে হইলো তার পিছে জানি কেউ আগুন দিছে! হেইদিনের পর থাইক্যা রবু আমাগো বাইত্যে আর যায় নাই!'
জয়নাব হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মত অবস্থা হয়। বলে, 'আইজ যদি তোমারে দেইখ্যা আবার দৌঁড় দেয়?'
নূরীও হাসে। হাসতে হাসতে বলে, 'এইবার দৌঁড় দিতে দিতে দিমু না! ধইরা কমু, আমারে বিয়া না করলে তর কান দুইডা কাইট্যা দিমু!'
জয়নাব আরো হাসে।
নূরী বিরক্ত হয়ে বলে, 'এত হাসিস না মাগি! কপালে তাইলে কান্দন আছে তর!'
'ক্যান রবুরে নিয়া যাইবা?'
নূরী হাসে। মুখে একটা দুষ্টু দুষ্টু ভাবও ফুটে ওঠে। বলে, 'বিয়া কি জিনিস জীবনে তো বুঝলাম না! দুই একবার কি চুরি করনের চেষ্টা করমু না!'
জয়নাব তেমনি হাসতে হাসতে বলে, 'চুরি করলে ধরা পইরো না জানি! হাত-পাও ভাইঙ্গা মটকায় ভইরা থুমু!'
হাসতে হাসতে জয়নাবের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। মনেমনে সে শঙ্কিত হয়ে পড়ে, নূরীবুর মাথা কি পুরাপুরি সারছে?
তারপরই যেন জোর করে চিন্তাটাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে চোখ মোছে। যা ঘটার ঘটুক। এ নিয়ে ভাবতে চায় না সে।
জয়নাব চোখ মুছলে নূরী বললো, 'কইছিলাম না কানবি?'
জয়নাব আবারও হাসতে থাকে।
(চলবে...)
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন