হাতেম আলি চলে গেলে তাদের ব্যাপারটা নিয়েই ভাবছিলো রবিউল। খোলা জানালা পথে হঠাৎ দৃষ্টি পড়তেই সে দেখতে পায় নূরী আর জয়নাব আসছে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে দুজনেই হাসছে।
বহুদিন পর নূরীকে দেখলো রবিউল। আগের চেয়ে অনেক ভালো দেখাচ্ছে। মুটিয়েছেও কিছুটা। তবে তার পান খাওয়া লাল দুটো ঠোঁট সবার আগে দৃষ্টিগোচর হয়।
ওদের দেখতে পেয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে রবিউল। মুগ্ধ চোখে সে দুজনকেই দেখে। যেন দুই সখি। নূরীর বয়স বেশি হলেও সৌন্দর্যের কিছুই হারায়নি বলতে গেলে। আসলে সোনা যতই পুরোনো হোক না কেন, তার রঙ কখনওই ফিকে হয়ে যায় না। বয়সের তুলনায় নূরীর চেয়ে জয়নাবের স্থূলত্বই চোখে পড়ে বেশি। যদিও জয়নাবের বয়স নূরীর প্রায় অর্ধেক, তবুও আকৃতিগত ভাবে দুজনকে একই মনে হয়।
এতক্ষণ রবিউলকে খেয়াল করেনি জয়নাব। কিন্তু তাকে দেখতে পেয়েই হাঁটার ভঙ্গি কেমন রাজেন্দ্রানীর মত হয়ে উঠলো হঠাৎ। তার এই আকস্মিক পরিবর্তনের হেতু রবিউলের বোধগম্য হয় না। আরো কাছাকাছি হয়ে জয়নাব বললো, 'কার কথা ঠিক হইলো?'
রবিউল প্রশ্নের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না।
জয়নাব কেমন বিজয়িনীর মত করে বলে, 'তুমি না কইছিলা বুবু আইবো না? অখন সারা জীবনের লাইগ্যাই নিয়া আইলাম!'
রবিউল কেমন চোখ পিট পিট করে তাকায়।
নূরী এগিয়ে এসে রবিউলের চুলের মুঠি ধরে বললো, 'বউয়ের কথা বুঝতে পারতাছো না, না? আর আমি পাগল থাকলেই বুঝি তোমার সুবিধা হয়!'
তারপর চুল ছেড়ে দিয়ে রবিউলকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বললো, 'কেমন আছস তুই? এই কয় বছরের মইদ্যে বুবুরে তো একবারও দেখতে গেলি না! না কি মনে করছিলি পাগল অইলে মানুষ আর মানুষ থাকে না?'
রবিউল কিছুটা আতঙ্কিত কন্ঠে বললো, 'তোমার কাজ-কারবারের কি ঠিক ঠিকানা আছে?'
রবিউলকে ছেড়ে দিয়ে নূরী বলে, 'আমি তো ভালো হইয়া গেছি পরায় এক বছর!'
'তাও তোমারে ক্যান জানি ডর লাগে!'
নূরী রবিউলের দুহাত চেপে ধরে বলে, 'এইবার সব ডর ভাঙ্গাইয়া দিমু!'
রবিউল কি বলবে, তেমন কোনো কথা খুঁজে পায় না। তার আগেই নূরী আবার বলে, 'তার আগে তুই জয়নাবের সামনে কথা দে, আমারে রাখবি কিনা? একবারেই আইয়া পড়ছি কইলাম!'
'তুমি থাকলে তো আমাগই লাভ! জনুরে একলা ঘরে পইড়া পইড়া আর কানতে হইবো না!'
নূরী হঠাৎ রবিউলের হাত ছেড়ে দিয়ে জয়নাবের দিকে ফিরে বলে, 'তুই সাক্ষী, আমারে রাখবো কিনা এই কথা হ্যায় অখনও কয় নাই কিন্তু!'
রবিউল অস্থির ভাবে বলে উঠলো, 'আইচ্ছা, আইচ্ছা! তোমারে রাখমু!'
নূরী মুখ ভার করে বলে, ’অ্যাক্কবারে হামিদ!'
পাশের গ্রামের কঞ্জুস হামিদ আলি নাকি তার বউকে নারকেল তেলের বোতলে করে একবার পুকুরের পানি এনে দিয়েছিলো। সেই দুঃখে আর অপমানে তার বউ খোঁপা কেটে ঘরের বেড়ায় ঝুলিয়ে দিয়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলো। তাই এলাকার মানুষ কাউকে কিপটে বোঝাতে হামিদ বলে।
রবিউল প্রতিবাদ করে বললো, ‘আমারে তুমি হামিদ কইলা?
‘কমু না!’ নূরীর চোখ সরু হয়ে আসে। ’কয়ডাদিন থাকমু খামু রাজী হইতে ডরাস ক্যান? আরে ছ্যারা বছরে দুইবার বেড়াইতে আইলেও যদি তিনদিন কইরা থাকতাম, তাইলে এই পাঁচ-সাত বছরে কতদিন হইতো?’
জয়নাব নূরীকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, 'ঘরে চল বুবু, বেলা বেশি নাই!'
নূরী জয়নাবের কান্ড দেখে বললো, 'তুই এত অস্থির হইছস ক্যান?'
জয়নাবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, 'তিন বছর ধইরা বাপের বাড়ি যাই না! অহন যাও একটা সুযুগ হইছে, তা হারাইলে আর কোনোকালেই যাওন হইবো না!'
নূরী ঘরে প্রবেশ করে বলে, 'তাইলে ঘর পাহারায় আনছস আমারে?'
'না বুবু, মানুষটা নিজে রান্দন জানে না! কি খাইবো, কোই খাইবো? হ্যার খাওনের অসুবিধা হয় দেইখ্যাই তো কোনো দিক যাইতে পারি না!'
নূরী ফের রহস্যময়ীর মত হাসে। বলে, 'তাইলে তো মাজেদা ঠিকই কইছে!'
'ছি বুবু!'
এমন সময় রবিউল ঘরে ঢুকে জয়নাবের কথাটা শুনতে পেয়ে বলে, 'কি নিয়া এমন ছিছি হইতাছে?'
জয়নাব অভিযোগের সুরে বললো, 'দ্যাহ না, বুবু কি সব হাবিজাবি কইতাছে!'
তারপর সে নূরীকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলে, 'তুমি না আমাগো বুবু! আদর দিয়া, ভালোবাসা দিয়া তোমার আঞ্চল দিয়া আমাগোরে ঢাইক্যা রাখবা!'
কথা শুনে নূরীর চোখ ভিজে আসে। সে জয়নাবের কপালে চুমু খেয়ে বলে, 'কথাডা তর মনের তো, নাকি পরে আবার মাজেদা হইয়া যাস?'
জয়নাব নূরীর বুক থেকে মাথা তুলে বললো, 'বুবু, একটা কথা মনে রাইখ্যো, আমার নাম কিন্তু শুরু হইছে জয় দিয়া! তোমার লাইগ্যা আমার কিছুতেই আপত্তি নাই!'
তারপর রবিউলের দিকে তাকিয়ে বলে, 'বুবু থাকলো! বুবুর জানি কোনো কষ্ট না হয়! অখন তুমি আমারে গাড়িতে তুইল্যা দিয়া আইবা!'
'কিন্তু...'
'আর কিন্তু কইরো না! আমার কইলাম কান্দন আইতাছে!'
'বুবু এইমাত্র আইলো, আর তুই...'
'আমি জানি তুমি হাতেম ভাইরে নিয়া এদিক ওদিক দৌঁড় পারবা। কিন্তু আইজ-কাইলের ভিতর না যাইতে পারলে আমার আর কোনোদিনই যাওনের কাম নাই!'
নূরী রবিউলের পিঠে হাত রেখে বললো, 'বউরে কান্দাইতে নাই! তুই তারে দিয়া তাড়াতাড়ি আইয়া পড়িস। নাইলে একলা ঘরে আমি ডরাইয়াই মইরা থাকমু!'
নূরীকে আশ্বস্ত করতেই যেন জয়নাব বলে, 'বেশিক্ষণ লাগে না বুবু! বাস থাইক্যা নাইম্যা আমারে রিকশা কইরা দিলেই হইবো!'
'এতদিন পরে যাবি, একলা গেলে মানুষে কইবো কি?'
জয়নাব হাসে। 'বাইত্যে যাইয়া কিছু কমু না! অন্যরা মনে করবো আমি রাগ কইরা গেছি!'
তারপর স্বর নিচু করে আবার বলে, 'রাগ কইরা না গেলে বাপের বাইত্যে বেশিদিন থাকন যায় না!'
নূরী শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বলে, 'তুই কত বিটিশ লো!'
জয়নাব রবিউলকে তাড়া দিয়ে বলে, 'তুমি একটা রিকশা ঠিক কর না, আমি ততক্ষণে বুবুরে সব দেখাইয়া-বুঝাইয়া দিয়া যাই!'
'তুই সাজতে দেরি হইবো না?'
'না, সাজমু না!'
রবিউল রিকশার সন্ধানে বেরিয়ে গেলে, নূরীকে সঙ্গে নিয়ে জয়নাব তাকে রসুই ঘর দেখায়। কথার ফাঁকে ফাঁকে একটি গ্লাসে পানি নিয়ে তাতে চিনি গুলিয়ে শরবত বানায়।
তারপর নূরীর হাতে দিয়ে বলে, 'শরবতটা খাও বুবু! আমার বাইত্যে তুমি আইজই পরথম আইলা!'
নূরী কিছুটা অভিমানী কন্ঠে বলে, 'তাইলে যে, আমিও পান-মিষ্টি আনন লাগে!'
'কী যে কও না বুবু! তুমিইতো আমার পান-মিষ্টি!'
নূরী জয়নাবের মুখের কাছে গ্লাসটা তুলে ধরে বলে, 'তাইলে তুই এক চুমুক খাইয়া দে।'
জয়নাব আপত্তি জানিয়ে বলে, 'না, তুমি খাও!'
'তাইলে খামু না কইলাম!'
কপট রোষে গ্লাস রেখে দেওয়ার ভয় দেখায় নূরী।
'আইচ্ছা, তুমি আগে খাও, আমি পরে খামু!'
'না, তুই আগে মুখে দে!'
'জয়নাব এক চুমুক শরবত মুখে নিলে নূরী বলে, 'আরেক চুমুক!'
জয়নাব বাধ্য হয়ে তাই করে।
নূরী বাকি শরবতটুকু নিঃশেষ করে গ্লাসটা জায়গা মত রেখে দিলে জয়নাব তার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ধান-চাল-গমের মটকা দেখায়। কোথায় তেল-নুন মশলাপাতি রাখা আছে, কোথায় কোন ধরনের বীজ রাখা আছে, সবই দেখিয়ে দেয়। সবশেষে কাঁঠাল কাঠের আলমারি খুলে বিভিন্ন রঙের শাড়ি-ব্লাউজ-পেটিকোট দেখায়। কোনদিকের কাপড়গুলো নতুন আর কোনদিকের কাপড়গুলো পুরোনো তাও দেখায়।
তারপর নূরীর জন্য বেছে বেছে দু'টো করে ঘরে পরার শাড়ি বের করে। সাথে মানানসই রঙের ব্লাউজ-পেটিকোট। জয়নাব অন্তর্বাস পরতে না পারলেও বেশ ক'টিই আছে। নূরীকে দেখিয়ে বলে, 'তোমার যেইটা ইচ্ছা হয় নিবা। মনে কর নতুন যা কিছু সবই তোমার!'
ঘরের ভেতর ঝাঁপের দু'দিকে দু'টো খাট পাতা। জয়নাব নূরীকে খাট দু'টো দেখিয়ে বললো, 'তুমি এইদিকেই ঘুমাইও। যদিও তোমার ভাই ইচ্ছা কইরা এদিকে আইবো না, তাও যদি মনে কর দরজার ছিটকিনি লাগাইয়া দিও!'
নূরী জয়নাবের কথা শুনে হাসে।
তারপর বলে, 'রবু আমার ভাই! তার লগে আমি ঘুমাইলে অসুবিধা কি?'
জয়নাব বোকার মত হেসে বলে, 'তোমার তো অসুবিধা নাই, তয় আমার আছে!'
নূরী জয়নাবের মুখ তুলে বলে, 'খুইলা ক দেহি, ঘটনা কি?'
'তুমি না হয় বুড়ি! কিন্তু তোমার ভাই তো আর তোমার মতন না! মাথা গরম হইলে আমার কাছে দৌঁড় পাইড়া যাইবো। তহন আর ওষুধ খাওনের সুযোগ থাকবো না!'
'রবুরে কস নাই?'
'আগে তো নিজেরে পরীক্ষা করাইতে রাজি হই নাই! অখন অষুধ খাইতে বাপের বাড়ি যাইতাছি, এই কথা কোন মুখে কমু?'
'তাইলে তো কিছু দিন বাছতে হইবো!'
'আঠারো দিন!'
নূরী জয়নাবকে বলে, 'তুই নিচ্চিন্তি থাক! আমি বুঝাইয়া রাখমু!'
রবিউল রিকশা নিয়ে এসে হাঁক-ডাক আরম্ভ করে দিলে জয়নাব নিচু স্বরে বলে, 'তোমার ভাইয়েরে সামনে বইসা ভাত খাওয়াইও! বিয়ান বেলা ঘুম ভাঙলে এক গেলাস পানি দিও! ঘুমাইয়া থাকলে ডাক দিয়া জাগাইয়ো না!'
রবিউল বাইরে থেকে ফের তাড়া দিয়ে বলে, 'জনু, তর হইলো?'
জয়নাব ঘরের ভেতর থেকে সাড়া দিয়ে বলে, 'হ, হইছে!'
তারপর নূরীকে ছুঁয়ে ফের বলে, 'দোয়া কইরো বুবু!'
জয়নাব বাইরে গিয়ে রিকশায় উঠলে রবিউল পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, 'ট্যাকা-পয়সা লগে কিছু নিছস?'
জয়নাব অবাক হয়ে তাকায়। 'ট্যাকার কাম কি?'
'পাগল আর কারে কয়!' বলে, একশ টাকার একটি নোট জয়নাবের আঁচলে বেঁধে দেয় রবিউল।
(চলবে...)
মন্তব্য
পিডিএফ করে দিলে পুরোটা এক সাথে পড়ে আবার কিছু লিখব!
তিতিক্ষা ভাল করে চলুক।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পিডিএফ দিতে পারবো কি। আমার অ্যাক্রেব্যাট ডিস্টিলার খুবই ঝামেলা করছে। কী উল্টাপাল্টা করেছি বুঝতে পারছি না। তবু চেষ্টা করবো। না হলে অনলাইন সুবিধা তো পাবোই মনে হয়। ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
মাঝখানে কয়েকটা পর্ব না পড়ায় বোধ করি পেছনের সূত্র ধরতে পারি নাই। পরে একসময় পড়ে ফেলবো। তবে জুলিয়ান ভাই, যখনি পর্ব হিসেবে পোস্ট দেবেন এমন জায়গায় বিরতি টানতে হবে যেন একটা সাসপেন্স তৈরি হয়ে থাকে। যেমন এ পর্বে যদি আপনি উদ্ধৃত অংশের পরেই বিরতি দিতেন, তাহলে কেমন হতো ?
অবশ্য আমার ব্যক্তিগত অভিমতের সাথে একমত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। এখানে লেখক সার্বভৌম।
চলুক।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
একহাজার ধন্যবাদ!
আপনার অভিমত ঠিক আছে। কিন্তু আমার মতলবটা এমন নয়। তুলির টানটা একটু লেজের মত কেন টেনে নিলাম পরের পর্বে পরিষ্কার হবে। তবুও আপনার অভিমতটাকে আন্তরিক ভাবেই স্বাগত জানাই।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন