বেলা প্রায় ডুবুডুবু। এমন সময় তড়িঘড়ি ফিরে আসে রবিউল। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। ঘন হয়ে কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ।
নূরী কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো পথের দিকে।
রবিউল এখনও আসছে না। আকাশে মেঘের তোড়জোর দেখতে পেয়ে আগে থেকেই দোয়া ইউনুস পড়তে অরম্ভ করেছে সে। হঠাৎ রবিউলকে দেখতে পেয়ে হাফ ছেড়ে বললো, 'তুই আইছস ভাই? আসমানে ম্যাঘ জমতে দেখলে আমার কইলজায় পানি থাকে না! মায় তখন আমারে কাঁথা দিয়া জাবড়াইয়া ধইরা রাখে! অখন ঝড়-তুফান শুরু হইলে কোই যামু?'
বাচ্চা মেয়েদের মত কাঁদতে থাকে নূরী।
রবিউল এগিয়ে এসে বললো, 'আর কোনো ডর নাই! চল তড়াতড়ি কিছু ডাইল-ভাত রান্দনের কাম কইরা ফালাই!'
নূরী কান্না ভুলে যায়। বলে, 'আসমান কালা হইতাছে দেইখ্যাই রান্দনের কাজ সাইরা ফালাইছি!'
'আমি হাত-পাও ধুইয়া আইতাছি। তুমি হ্যারিকেনডা বাইর কইরা রাইখো!'
'আমিও হাত-পাও ধুমু!' বলে, নূরীও বাইরে বেরিয়ে আসে।
হাত-পা ধোওয়া হয়ে গেলে নূরী আগে আগে দৌঁড়ে ঘরে চলে আসে। আর তা দেখে হেসে কূল পায় না রবিউল।
তারপর ঘরে এসে নিজেই হ্যারিকেন বের করে চিমনি মুছতে বসে।
নূরী বলে, 'বেশি কইরা ত্যাল ভইরা রাখিস! রাইতের কাল কওন যায় না!'
রবিউল আলো জ্বালিয়ে নিরাপদ জায়গায় রেখে আকাশের অবস্থা দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে আসে। আর তখনই হঠাৎ ধূলো উড়িয়ে বাতাস ছোটে।
নূরী কেঁদে উঠে বলে, 'আইস্যা পড়! আল্লারে! লা ইলাহা ইল্লা আন্তা...'
ধূলার কারণে চোখ মেলতে পারে না রবিউল। কোনোমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ঘরে উঠে দরজায় খিল দেয়।
তারপর পরনের লুঙ্গির প্রান্ত তুলে চোখ-মুখ মোছে।
নূরী চোখ বন্ধ করে সম্মোহিতের মত ক্রমাগত দোয়া পড়ে চলেছে। তার ভয়ার্ত চেহারা দেখে রবিউলের ভয় হয়, পাছে না আবার নতুন করে কোনো অঘটন ঘটে যায়। সে নূরীর একটি হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলে, 'বুবু! ঝড় তো শুরু হয় নাই, এমনেই বাতাস ছুটছে!'
কিন্তু নূরী চোখ খোলে না। একই ভাবে দোয়া পড়তে থাকে। রবিউল ভেতরে ভেতরে অসহায় হয়ে পড়ে। এমন সময় বাইরে অকস্মাৎ বজ্রপাত হলে নূরী কেবল 'আল্লাগো!' বলতে পারে। তারপরই যেন ভেঙেচুড়ে পড়ে যায় মেঝেতে।
অচৈতন্য নূরীকে নিয়ে এখন কী বা করতে পারে রবিউল? তবুও বিভ্রান্ত না হয়ে সে নূরীকে কোনোরকমে টেনে ছেঁচড়ে বিছানায় নিয়ে তোলে। তারপর নূরীর চোখে-মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়। ততক্ষণে টিনের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে।
দু'চারবার পানির ছিঁটা দিতেই নূরী চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু প্রবল বৃষ্টির শব্দ পেয়ে ভূতগ্রস্থের মত রবিউলকে জাপটে ধরে। বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ টিনের চালে দ্বিগুণিত হয়ে প্রতিহত হতে থাকলে নূরীর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।
নূরীর অবস্থা দেখে রবিউলের কান্না পায়। অবুঝ শিশুর মত এই নারীকে সে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? হঠাৎ তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে জয়নাবের উপর। কেন যে সে নূরীকে নিয়ে আসতে গেল! তা ছাড়া একা থাকলে তার কী এমন অসুবিধা হতো? সামান্য খাওয়ার কষ্টই তো! প্রতিদিন কত মানুষই তো না খেয়ে থাকছে। সেই তুলনায় দু'এক বেলার খাওয়ার কষ্ট নিতান্তই নগণ্য।
সে নূরীকে বললো, 'বুবু, আমারে ছাড়ো! তোমারে কাঁথা দিয়া ঢাইক্যা দিতাছি!'
কিন্তু নূরীর মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। সে জোর করে নূরীর হাতের বেষ্টনী থেকে নিজকে ছাড়ালে নূরী হাতের তালু দিয়ে দু'কান চেপে ধরে।
রবিউল একটি কাঁথা নামিয়ে এনে তা দিয়ে নূরীর নাকে-মুখে পুরো শরীর ঢেকে দিলেও কাঁপুনি বন্ধ না হয়ে বরং বাড়তে থাকে। সে কাঁথার উপর দিয়ে নূরীকে জাপটে ধরে রাখে। সেই সাথে নূরীর কারণে আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় তার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। একদিকে প্রকৃতির ভয়ে কাঁপে নূরী। অন্যদিকে তারই বিপদাশঙ্কায় কাঁপে রবিউল।
এক সময় ঝড় থামে। সেই সাথে থামে রবিউলের বুকের কাঁপুনিও। কিন্তু নূরীর কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে কাঁথার প্রান্ত তুলে সে আবিষ্কার করে যে, অঘোরে ঘুমাচ্ছে নূরী।
সে নূরীকে ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। দরজা খুলে একবার বাইরে উঁকি দেয়। কিন্তু ঠাহর করতে পারে না কিছুই। হ্যারিকেনের আলো হাতে সে বাইরে বেরিয়ে আসে। উঠোনের এখানে ওখানে পানি জমে আছে। বাড়ির নামার দিকের মরিচের জমিগুলোতে হয়তো আরো বেশি পানি জমেছে। সময় মত পানি না সরালে চারাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। সবার আগে উঠোনের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি সরানোর জন্য নালা কেটে দিতে হবে। নয়তো আবার বৃষ্টি হলে কোনোখান দিয়ে বাড়ির মাটি ধ্বসে যেতে পারে।
আকাশ এখনও ভারী আর গুমোট মনে হয়। যে কোনো সময় আবার বৃষ্টি আরম্ভ হতে পারে। তার আগেই রাতের খাওয়া আর নালা কাটার কাজগুলো সারতে হবে।
রবিউল ঘরে এসে নূরীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে।
ঘুম ভাঙতেই কেমন অবাক চোখে রবিউলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে নূরী।
নূরীর অবাক দৃষ্টি লক্ষ্য করে রবিউল জিজ্ঞেস করে, 'কি দ্যাহো বুবু?'
'তুই রবিউল না?'
'হ! আমারে চিনতে পারতাছো না?'
'কহন আইলি?'
রবিউল বুঝতে পরে যে, নূরীর ঘুম পুরোপুরি ভাঙেনি। হ্যারিকেনটা উঁচিয়ে নূরীর মুখে আলো ফেলে বলে, 'ঝড়-বাদল অনেকক্ষণ হয় থাইম্যা গেছে!'
নূরী কাঁথা সরিয়ে বিছানায় উঠে বসে। একবার শব্দ করে হাই তুলে বলে, 'মনে করছিলাম আমাগো বাইত্যেই আছি!'
তারপর দু'হাত পেছনে নিয়ে এলোমেলো চুলগুলো টেনে খোঁপা বাঁধে। সে সময় তার গলায় আর বুকে বিন্দুবিন্দু ঘাম চিক চিক করতে দেখে রবিউল।
গায়ে আঁচল জড়িয়ে নূরী বিছানা থেকে নেমে বলে, 'তুই ভাত খাইছস?'
রবিউল খোলা দরজা পথে উঠোনের দিকে তাকিয়ে বললো, 'তোমারে ফালাইয়া ভাত খামু এইডা ক্যামন কথা কইলা?'
নূরী শরীর টেনে টেনে এগিয়ে আসে। বলে, 'তুই বাইরে কি দেখস?'
'তুমি ভাত বাড়ো! আমি উঠানের পানিগুলা ছাইড়া দিয়া আইতাছি!'
নূরী রবিউলের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, 'বাতিডা একটু ধর, আমি বাইরে যামু!'
রবিউল হ্যারিকেন হাতে দরজার সামনে দাঁড়ালে নূরী বদনি হাতে করে সামনের অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর নূরীকে ফিরে আসতে দেখে রবিউল হ্যারিকেনটাকে দরজার পাশে রেখে কোদাল হাতে উঠোনে জমে থাকা পানি সরানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
নূরী উঠোনে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রবিউলের কাজ পর্যবেক্ষণ করে। তার মনে হয় হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে রবিউলের পাশে দাঁড়ালে তার কাজের সুবিধা হবে। এই ভেবে সে হ্যারিকেন নিয়ে রবিউলের সামনে দাঁড়ালে রবিউল উচ্ছ্বাস প্রকাশে কার্পণ্য করে না। বলে, 'এতক্ষণে সব পরিষ্কার হইছে!'
নূরী রবিউলের উচ্ছ্বাসকে পাত্তা না দিয়ে বলে, 'তাড়াতাড়ি কাজ শেষ কর দেহি!'
'তাইলে তুমি ঘরে গিয়া ভাত বাড়! আমি অক্ষনই আইতাছি!'
নূরী কিছুক্ষণ দেরি করে হ্যারিকেন নিয়ে ঘরে চলে যায়। অন্ধকারে কাজ করতে রবিউলের তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। উঠোনের নালা কেটে দিয়ে সে এগিয়ে যায় বাড়ির নামার ক্ষেতের দিকে।
নূরী ভাত বেড়ে রবিউলের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তার জন্য এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। এ পর্যন্ত কারো জন্য ভাত বেড়ে অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন পড়েনি তার। এমনকি জীবনের এতটা সময় পার করে দিয়ে এসেছে, অথচ কখনও কারো জন্য প্রতীক্ষার ক্ষণ তার জীবনে আসেনি। তাই এখন সামনে ভাত নিয়ে রবিউলের জন্য অপেক্ষা করার ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অদ্ভূত এক আনন্দের উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
রবিউল খেতে বসে হঠাৎ নূরীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, 'বুবু, তোমার মুখটা ফুলাফুলা লাগে ক্যান?'
'এইডা কিছু না!' নূরী হাসে। 'ডরাইলে আমার এমন হয়!'
রবিউল অবাক না হয়ে পারে না। তার মন অজানা আশঙ্কায় ফের দুরুদুরু করে।
নূরীর রান্না খুব একটা খারাপ না হলেও তেমন ভালো লাগে না। তবে খাওয়া চলে। কোনো একটি মসলার উপাদান কম হয়েছে মনে হয়। কিন্তু সে অভাবটা সে ধরতে পারে না। এ রান্নার তুলনায় জয়নাবের রান্না তার কাছে অমৃত। কোথাও গেলেও সে অন্যের হাতের রান্না খেয়ে তৃপ্তি পায় না। যে কারণে অন্যের বাড়িতে পেট পুরে খেয়ে এলেও নিজের ঘরে না খেলে তার খাওয়ার অতৃপ্তি দূর হয় না। এ নিয়ে জয়নাবের অনুযোগের শেষ নেই। সাথে কিছুটা গর্ব আর আনন্দও তাকে আন্দোলিত করে হয়তো। রবিউল সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু এখন রান্না সম্পর্কে নূরীকে সে কিছুই বলে না। তবে নূরী হয়তো বুঝতে পারে রান্না খুব একটা ভালো হয়নি। বলে, 'রান্দা ভালা হয় নাই?'
'হইছে। খুবই চমৎকার! তয় জনুর কাছে আরো ভালা রান্দন শিখতে পারবা!'
নূরী নিজের পাতের ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, 'বুঝতে পারছি তেমন ভালা হয় নাই! তয় কয়দিন পরে ঠিক হইয়া যাইবো। আমি তো রান্দন শিখছি বেশি দিন হয় নাই! তা ছাড়া তরকারিতে রশুন দিতে পারি নাই। কই আছে তাও খুঁইজা পাই নাই!'
রবিউলের কাছে মনে হচ্ছিলো তরকারিতে কোনো একটা জিনিস নেই। এখন সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বললো, 'কাইল খুঁইজ্যা দেখমুনে! নাইলে হাটের থাইক্যা আইন্যা দিমু!'
খাওয়ার পরপরই প্রচন্ড ঘুম পায় রবিউলের। সে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। বলে, 'আমার অনেক ঘুম পাইছে বুবু! তুমি ঘুমানের আগে তোমার দিকের সিটকিনি লাগাইয়া দিও!'
'আইচ্ছা, তুই ঘুমা! আমার শুইতে দেরি আছে!'
নূরীর থালা-বাটি গোছানোর কাজ শেষ হওয়ার আগেই রবিউলের নাক ডাকার মিহি শব্দ শোনা যায়।
ঘুমুতে যাওয়ার আগে জয়নাবের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় নূরী। সমস্ত চুলকে তিন ভাগ করে একটার উপর আরেকটা গোছা দিয়ে বেণি পাঁকায়। গলায় বুকে জয়নাবের সুগন্ধী পাউডারের কৌটা থেকে পাউডার লাগায়। কি মনে করে আয়নার গায়ে লাগানো লাল টিপ থেকে একটি নিয়ে কপালের মাঝখানে লাগিয়ে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের মুখ দেখে। পুরো মুখ দেখা যায় না। তবে তাকে অসুন্দর মনে হয় না। টিপটা আলতো করে খুলে আবার আয়নার গায়ে বসিয়ে দিয়ে বিছানা ঝাড়ে।
তারপর হ্যারিকেনটা রবিউলের খাটের পাশে রেখে নিজের বিছানায় এসে বসে নূরী। কিছুক্ষণ চুপচাপ সে ভুতের মত অন্ধকারে বসে থাকে। শুয়ে পড়লেও অনেকটা সময় তার ঘুম আসে না।
টিনের চালে টিপটিপ করে আবার বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। ঝাঁপের ওপাশে হ্যারিকেন জ্বললেও এপাশের অন্ধকার খুবই গাঢ় মনে হয় নূরীর। মনে হয় চোখ বন্ধ করলেই অন্ধকার এসে তাকে গ্রাস করে নেবে। তার কেমন ভয়ভয় করে। একাএকা সে কখনোই ঘুমাতে পারে না। এতদিন ঘুমিয়েছে মায়ের সঙ্গে। আজ তাই একা শুয়ে কেমন অসহায় বোধ করে।
বাইরে কোলাব্যাঙ অথবা সোনাব্যাঙের অনবরত ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ ডাক নূরীর ভয়কে ত্রাসে পরিণত করে। সে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে। নিজের ছাঁয়া দেখে অকস্মাৎ নিজেই চমকে ওঠে। ঝাঁপের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত রবিউলকে উঁকি মেরে দেখে। কেমন কুঁকড়ে-মুকরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে মানুষটা। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ বেশ দীর্ঘ আর ভারী বলে মনে হয়।
হ্যারিকেনের দিকে চোখ পড়লে আলোটা হঠাৎ করেই যেন তীব্রতর হয়ে তার চোখের মণিতে আঘাত করে। আলোটাকে পছন্দ করতে পারে না সে। এগিয়ে গিয়ে সলতেটা নামিয়ে আলোর আঁচ কমিয়ে দেয়। আরো খানিকটা কমাতে চাইলে আলোটা হঠাৎ করেই নিভে যায় আর সঙ্গেসঙ্গেই যেন সমস্ত অন্ধকার এসে একযোগে হামলে পড়ে তার উপর।
অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে নূরী এগিয়ে যায় রবিউলের বিছানার দিকে। অসাবধানে হঠাৎ রবিউলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ার মত হলে সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কিন্তু রবিউলের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দের উঠানামায় কোনো হেরফের হয় বলে মনে হয় না। তবুও নিশ্বাস বন্ধ করে খুবই সাবধানে রবিউলের বিছানায় উঠে পাশে শুয়ে পড়ে নূরী আর তারই সঙ্গেসঙ্গে কেমন অপার্থিব এক প্রশান্তি যেন ঘিরে ধরে তাকে। সেই সঙ্গে অনাস্বাদিত এক পুলকে আচ্ছন্ন হয়ে যায় সে।
সেই যে জন্মের পর থেকেই মায়ের সঙ্গে ঘুমোনো আরম্ভ করেছে তার ব্যতিক্রম ঘটতো কেবল অসুস্থতার সময়ই। কিন্তু যখন সে সুস্থ থাকতো তখন মায়ের পাশে শুয়ে থেকেও কেমন একটি অব্যক্ত যন্ত্রণা আর নিদারুন অস্থিরতায় সে বিদ্ধ হয়েছে রাতের পর রাত। তার কারণ অনুসন্ধানেও ব্যাপৃত থেকেছে আরো দীর্ঘ সময়। কিন্তু সে পারেনি দূর্জ্ঞেয় সেই রহস্যের জাল ছিন্ন করতে। কারো কাছে সেই অনুভূতির কথা ব্যক্ত করবে এমন কাউকে সে পায়নি। অথচ রবিউলের পাশে শোওয়ার পর আপনা আপনিই যেন খুলে গেল সেই রহস্যের রুদ্ধ দ্বার।
অথচ কতবারই তার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে নানা দিক থেকে। এ পর্যন্ত কেউ অপছন্দ করেনি তাকে। কিন্তু বিয়ে হবে হবে করে নানা ধরনের ভয় শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা এসে ভর করতো মাথায়। খুব ছোট বেলায় হরেন মাস্টারকে দেখেছিলো তার নতুন বউয়ের গলাটিপে ধরতে। নূরী ছোট বলে তাকে হয়তো খেয়াল করেনি। কিন্তু চোখের সামনেই হরেন মাস্টারের বউ কেমন ছটফট করে নিথর হয়ে যেতে দেখেছিলো নূরী।
ধিরেন কাকা প্রায়ই তার বউকে মারতো। মারতে মারতে উঠোনে ফেলে দিতো। পা দিয়ে পেটে লাথি মারতেও দেখেছে সে।
তারপর যৌবনে প্রথম যখন তার বিয়ে ঠিক হয়, তখনই অকস্মাৎ চোখের উপর ভেসে ওঠে হরেন মাস্টার আর ধিরেন কাকার মুখ। যদি বিয়ের পর তার সঙ্গেও লোকটি এমন ব্যবহার করে? এসব ভাবতে ভাবতে প্রথম সে পাগল হলো। এভাবেই কোনো বিয়ের সম্বন্ধ এলেই তার মনের ভেতর প্রবল হয়ে উঠতো ঘটনা দুটো। নিজকেই মনে হতো যেন হরেন মাস্টারের মৃত বউ। কিংবা ধিরেন কাকার বউ। এমন ভাবনাগুলো এলে তার ঠিক ক’দিন পরই সে ভুলে যেতো সব কিছু। মাঝে মাঝে হুঁশ ফিরে এলেও সে দেখতে পেতো তার কোমরে শেকল বাঁধা। সেও আরেক রহস্য। জিজ্ঞেস করলেও জবাব পেতো না কারো কাছে।
বৃষ্টির রাত বলে কিছুটা শীতশীত বোধ হয় নূরীর। পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা টেনে কোমর অবধি টেনে দেয় আর তখনই তার কেন জানি মনে হয় যে, রবিউলেরও শীতশীত বোধ হচ্ছে। কাঁথার একাংশ রবিউলের গায়ের উপর টেনে দিতেই সে আরো গুটিয়ে এসে মুখ গোঁজে নূরীর বুকে।
রবিউলের জন্য ভীষন মায়া হয় নূরীর। অস্তিত্বের ভেতর থেকে রবিউলের জন্য অনুভব করে নিবিড় মমতা। সেই মমতা থেকেই হয়তো বুকের সঙ্গে রবিউলকে জড়িয়ে নিতে তার দ্বিধা হয় না। ঠিক তখনই রবিউল ঘুমের ঘোরে জয়নাবের বুকের মিষ্টি আর পাগল করা গন্ধটা পায়। কি ঘুম, কি জাগরণে সে বিড়বিড় করে বলে, 'জনু! জনু! আমার জয়নব!'
কিন্তু নূরী নূরীই। জয়নাব হয়ে রবিউলকে বুকে নিতে চায় না। সে চায় রবিউল জানুক সে নূরী, জয়নাব নয়। তাই সে রবিউলের কানের কাছে মুখ রেখে ফিস ফিস করে বলে, 'আমি নূরী! তর নূরী বু!'
রবিউলের চোখ থেকে হঠাৎ ঘুম উধাও হয়ে যায়। স্বাভাবিক বিবেক বোধ আর সংকোচ থেকে তড়িতাহতের মত নিজকে নূরীর বন্ধন থেকে বিযুক্ত করতে চাইলেও তাকে আরো নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরে নূরী বলে, 'জয়নাব কইছে না আমারে কষ্ট না দিতে?'
(চলবে...)
মন্তব্য
হুমম, চলুক।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
চলতে পারে! অসুবিধা নাই। ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
যেমন বলেছি, এখন মন্তব্য নয়, জুলিয়ান ভাই আমি মুগ্ধ
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
মন্তব্য আর কবে? কাহিনী শেষই তো বলতে গেলে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
জানাই গেলাম লিখতে থাকেন.. একবারেই পড়ুম ! আগাম অভিনন্দন জুলিয়ান ভাই ।
ধন্যবাদ আকতার আহমেদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
আচ্ছা, অন্তত একটা করে পরিচ্ছদ পুরোটা দেওয়া যায় না?
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
দাদারে! একটা করেই তো দিচ্ছি!
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন