তিতিক্ষা-১১

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/০৯/২০০৮ - ৫:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঘরে কি বিয়ান বেলাই চান্দ নাইম্যা আইছে?

রবিউল কবি বা সাহিত্যিক নয়। নিতান্তই সাধারণ এক কৃষক-সন্তান। বিদ্যার জোর বেশি না থাকলেও বিদ্যা বা জ্ঞানার্জনের প্রতি রয়েছে বিপুল আগ্রহ। তবে কবিতা এমনই একটি অদ্ভূত ব্যাপার যে, একজন নিরক্ষর বা অন্ধ মানুষও অকস্মাৎ কবি হয়ে উঠতে পারেন। এজন্য তাকে সুরা বা সাকীর দ্বারস্থ হতে হয় না। কিংবা আত্মগোপন করতে হয় না নিজের ছাঁয়ার আড়ালে। আর সেই কারণেই কবিত্ব কোনো অহংকারের বিষয় নয়। শিল্পের জন্য শিল্পীর মমতা থাকবে, ভালোবাসা থাকবে। চর্চার অহংকার নয়। তাই সব সুন্দরের জন্যই মুগ্ধতা অপরিহার্য বলেই আমরা সুন্দরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার চাইতে মুগ্ধ হতেই বোধ করি ভালোবাসি। আর সেই মুগ্ধতা থেকেই হয়তো ডোম পরিবারের ছেলে হয়েও নেতাই এক সময় কবি হয়ে উঠতে পেরেছিলো।

ঘুম থেকে জেগে রবিউল যখন বিছানায় উঠে বসলো, তখনই ফুল তোলা একটি কাচের গ্লাসে করে পানি নিয়ে এগিয়ে আসে নূরী। আর তাকে দেখে প্রথমেই চাঁদের কথাটা মনে আসে রবিউলের।

চাঁদ নিয়ে মানুষ অনেককাল ধরেই বাড়াবাড়ি করে আসছে। বিশেষ করে কবি এবং সাহিত্যিক, এই দুয়ে মিলে চাঁদের সৌন্দর্যকে এতটাই কচলেছে যে, এখন চাঁদের দিকে তাকালে তার ছাল-বাকল ওঠা ঘেঁয়ো শরীর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। সেই কারণেও হয়তো কবি-সাহিত্যিকরা খুবই সাধারণ মানুষের কাছে কখনও কখনও পাগল, নির্বোধ আর অপদার্থ বলে বিবেচিত হন।

সাধারণ মানুষের চাঁদ নিয়ে আদিখ্যেতা থাকে না। তাই তার প্রেমিকার চাইতে চাঁদও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে না। রবিউল তেমন শ্রেণীর মানুষ হলেও নূরীর এখনকার সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করার জন্য ভিন্ন কিছুর কথা ভাবতে পারলো না। তাই হঠাৎ করে নূরীকে দেখে প্রথমেই তার মনে এসেছে চাঁদের কথা।
নূরী এমনিতেই যথেষ্ট সুন্দরী। তার উপর ভোরে কখন উঠে গোসল করেছে কে জানে। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে সারা পিঠে। পরনে জয়নাবের একটি নীল সূতির শাড়ি। সাথে একই রঙের ব্লাউজ। মনে হচ্ছিলো এখনি সে ডানা মেলে উড়াল দেবে। রবিউল মুগ্ধ চোখে নূরীর সৌন্দর্যে থমকে যায়।

মানুষ যখন সুখী আর পরিতৃপ্ত থাকে, তখন তাকে ঘিরে আলাদা একটি জ্যোতি ক্রমাগত পাক খেতে থাকে। হয়তো সেই জ্যোতির প্রভাবেই সে দিনদিন আরো প্রশান্ত আর দীপ্তিময় হয়ে উঠতে থাকে। নূরীও এখন তেমনি একটি জ্যোতির্বলয়ের মধ্যমণি হয়ে ভাসছে।

নূরীর হাত থেকে পানির গ্লাস নিতে নিতে রবিউল বলে, 'তোমারে দেইখ্যা মনে হইতাছে আমার ঘরে চান্দ নাইম্যা আইছে!'

নূরী মিষ্টি করে হেসে মাথা দোলায়। ইচ্ছে হয় রবিউলকে আদর করে। কিন্তু দিনের আলোতে অনেক সমস্যা। এমন সুন্দর কথা এ পর্যন্ত কেউ তাকে বলেনি। রবিউলের কথা শুনে তার মন এতটাই উদ্বেলিত হয়ে ওঠে যে, মনে হয় সে বুঝি আবার পাগল হয়ে যাবে। কেন এত সুন্দর করে কথা বলছে রবিউল? মাজেদা আর ফালুর কথা শুনতে শুনতে তার মনে বিশ্বাস এসে গিয়েছিলো যে, পৃথিবীর যাবতীয় কথা এমনই বিরস আর তিক্ত। কথা যে, এত মিষ্টি হতে পারে, কথা শুনতে যে এত ভালো লাগে, এও এখনই সে জানলো। তবুও কেন জানি এ কথা শুনে তার মন ভরে না। আরো কিছু একটা শুনতে যেন মন উম্মুখ হয়ে থাকে। সে কেমন বিবশ চোখে রবিউলের দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে।

নূরীর দৃষ্টি লক্ষ্য করে রবিউল বলে, 'কী দ্যাখতাছো?'

রবিউলের চোখে চোখ রাখে নূরী। ভ্রু নাচিয়ে বলে,'আর কিছু মনে হয় না?'

রবিউল দু'ঢোক পানি গিলে বলে, 'আর কি মনে হইবো?'

'মনে হয় না জয়নাব এমন, আমি হ্যামন?'

'তাতো মনে হয়ই!' বলে, রবিউল হাসে।

এই হচ্ছে চিরন্তন নারী। যে সর্বদা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর। কী করে সে অন্যের চোখে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠবে, সেই প্রতিযোগীতায় যার জীবনের অনেকটা প্রাণশক্তি ফুরিয়ে যায়। যে কারণে দ্বন্দ্ব চলে, সতীনে সতীনে। দ্বন্দ্ব মাতা-কন্যায়, জায়ে-জায়ে, কখনও জায়ে-ননদে, শাশুড়ি-পুত্রবধূতে। এখনও রবিউলের কাছে কে শ্রেষ্ঠ, জয়নাব না নূরী? তারই যেন একটি সূক্ষ্ম সীমারেখায় দুলতে থাকে নূরীর জিজ্ঞাসা। আর অনাদিকাল থেকেই চতুর পুরুষ অন্যের চোখে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের ছায়াযুদ্ধে আত্মবিস্মৃত নারীকে বুদ্ধু বানিয়ে এসেছে ক্রমাগত। নির্বোধ নারী নির্দ্বিধায় তা মেনেও নিয়েছে। সব যুগে তাই বেশিরভাগ নারী মিথ্যাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করে এসেছে। যে কারণে নিরেট সত্যটা তারা স্বাভাবিক চিত্তে কখনোই মেনে নিতে পারে না।

'ক না একটু হুনি!'

নূরী রবিউলের পাশে বিছানায় বসে পড়ে।

'হুনতে চাও?' রবিউলের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি।

'হুননের লাইগ্যা আমি পাগল-পাগল হইয়া রইছি!'

নূরী যেন সহস্র রঙে ঝলমল করে ওঠে।

কিন্তু রবিউল ভাবনায় পড়ে যায়। কী যে এখন সে নূরীকে বলবে মাথায় আসছে না কিছুই। তবুও সে ভেবে চিন্তে বলে, 'জনু যদি হয় চোখের কাজল, তাইলে তুমি কপালের টিপ। তুমি যদি হও গলার হার, জনু তাইলে নাকফুল!'

নূরী কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে।

তারপর বলে, 'কথাডা কি দাঁড়াইলো?'

রবিউল গ্লাসটা নূরীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, 'একটু ভাইব্যা দ্যাহো!'

নূরীর মন খারাপ না হলেও কিছুটা হতাশ না হয়ে পারে না। দু'হাতের তালুতে গ্লাসটা চেপে ধরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ সে রবিউলের দিকে ফিরে বলে, 'দুইডার কোনোডা না হইলেও তো চলে!'

'চলে। আবার চলেও না!'

নূরী কেমন সন্দেহ মাখা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় রবিউলের দিকে। বলে, 'বুঝলাম না!'

'কাজল পিন্দলে ভালো লাগে। লগে কপালে একটা টিপ হইলে আরো ভালো।! নাকফুল সবসময় নাকে থাকলেও ওইডার কথা কেউ জিগায় না। গলায় একদিন হার পিন্দলেও ওইডার কথাই সবে কয়!'

নূরী কেমন স্থানুর মত হয়ে গভীর ভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবে। তবুও রবিউলের কথা তার কাছে কেমন হেয়ালী বলে মনে হয়। হঠাৎ সে রবিউলের হাত ছূঁয়ে বলে, 'কোনোদিন যদি এই বাড়ি থাইক্যা আমারে কাইন্দা বাপের বাড়ি ফিরা যাইতে হয়, তাইলে বিষ খাইয়া মরমু!'

তারপরই হঠাৎ উঠে যায় সে।

নূরীর কথা শুনে রবিউল একবার বিষম খায়। বলে, 'বুবু!'

নূরী ঝাঁপের দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। তার মুখ কেমন থমথম করে।

রবিউল বলে, 'নাকফুল ফকিন্নির নাকেও থাকে! কিন্তু গলার হার পিন্দনের কপাল কয়জনের হয় ভাইব্যা দেখছো?'

নূরীর মুখ সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠবার সঙ্গেসঙ্গে তার চারপাশে কিছুক্ষণ আগেকার সেই জ্যোতির্বলয় ফিরে আসে যেন। সেই সঙ্গে কেমন ঢেউয়ের মত ছন্দময় গতিতে ঝাঁপের ওপাশে আড়াল হয়ে যায় সে।

বিমুগ্ধ রবিউল ভাবে যে, এতদিন সে একভাবে জয়নাবের দিকেই ঝুঁকে ছিলো। নূরী এসে যেন তাকে নিক্তির কাঁটার মত সোজা ও স্বাভাবিক হতে সহযোগীতা করলো। এ না হলে বোধ হয় সে কখনোই বুঝতে পারতো না যে, জয়নাব তাকে কতটুকু অধিকার করে রেখেছিলো আর কত গভীর ভাবেই না সে জয়নাবে নিমজ্জিত হয়েছিলো। নূরী এসে যেন তাকে জয়নাবের হৃদয়ের কারা প্রকোষ্ঠ থেকে উদ্ধার করে আলো বাতাসের সংস্পর্শে এনে স্বাভাবিক জীবনের সন্ধান দিল।

ভাবতে ভাবতেই রবিউল বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। পাকঘরের মাটির চুলা থেকে এক চিমটি ছাই নিয়ে দাঁত ঘঁষতে ঘঁষতে পুকুরের দিকে যায়। পথে ঝাঁকা হাতে তসলিমকে দেখে রবিউল জানতে চায়, ‘ঝাঁকা লইয়া যাস কই?’

‘কয়ডা গাব পাইড়া আনি। আমার জালডা কেমুন জানি ধোয়া ধোয়া মনে হইতাছে।’

তসলিম তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলে তার মনে পড়ে যে, লুঙ্গি-গামছা সঙ্গে করে আনা হয়নি। বাড়ির দিকে ফিরে আসতে গিয়েও আর না ফিরে পুকুরের দিকেই যায়। গোসল সেরে সে ভেজা কাপড়েই ফিরে এসে দরজায় দাঁড়ায়। 'বুবু, গামছা আর লুঙ্গিডা দ্যাও দেহি!'
নূরী গামছা আর লুঙ্গি এগিয়ে দিয়ে বলে, 'লুঙ্গিডা এমনেই চিপ্যা থুইয়া দে! পরে সাবান দিয়া ধুইয়া দিমু!'

নূরীর কথাটা রবিউলের কাছে একেবারেই আনকোরা মনে হয়। বিস্মিত ভাবে একবার মুখ তুলে তাকালেও কিছু বলে না।

নূরী হয়তো রবিউলের এই আকস্মিক পরিবর্তনটা খেয়াল করে না। ঘুরে ঘরের ভেতর আড়াল হয়ে যায়। রবিউল বিয়ের এতগুলো দিন পার করে দিলেও জয়নাবের মুখে কখনও এমন ধরনের কথা শুনতে পায়নি। তা ছাড়া নিজের কাপড় সে নিজেই ধূয়ে আসছে সব সময়। কেউ যে তার কাপড় ধূয়ে দিতে পারে বা তার কাপড় ধূয়ে দেওয়ার মত হতে পারে, এ ভাবনাটাই তার মনে কখনো উদয় হয়নি।

একবার ধান কাটার সময় কাস্তের টান লেগে তার হাত কেটে গিয়েছিলো। তখন জয়নাব তার মুখে মাখাভাত তুলে দিলেও কখনও বলেনি যে, লুঙ্গিটা ঘাটে ফেলে আসতে বা রেখে দিতে। যা পরে ইচ্ছে করলেই ধূয়ে দিতে পারতো সে। হয়তো বা জয়নাবের সেই মানসিকতাই নেই বা এমন একটা ব্যাপার সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।

রবিউল নূরীর কথায় খুশি হলেও কথা মত কাজ করে না। সে নিজেই লুঙ্গিটা সাবান দিয়ে ভালোমত ধূয়ে রোদে ছড়িয়ে দিয়ে ঘরে আসে। 'বুবু, দুইডা মুড়ি দ্যাও দেখি!'

ঠিক তখনই বাইরে হাতেম আলির কন্ঠস্বর শোনা যায়।
রবিউল ঘর থেকেই বলে, 'ক্যাডা, হাতেম ভাই?'

হাতেম আলি ঘরে প্রবেশ করতেই রবিউল বলে, 'এত বিয়ানে কি মনে কইরা?'

'তুই অখনও তৈয়ার হস নাই?' হাতেম আলির চোখ দুটো কেমন বড় বড় মনে হয়।

রবিউল হাতেম আলির কথা বুঝতে পারে না। বলে, 'তৈয়ার হই নাই মানে?'

'নূরপুর যাইতে হইবো না! দেরি হইলে কি গাড়ি পামু?'

রবিউল চুপ করে থাকে। সে ভেবে পায় না যে, হাতেম আলির সঙ্গে এমন কথা কখন হলো।

নূরী একটি থালায় করে গুড়-মুড়ি নিয়ে রবিউলের দিকে এগিয়ে এলে হাতেম আলি চমকে উঠে বলে, 'নূরী তুই?'

নূরী থতমত হয়ে বলে, 'জয়নব এত কইরা ধরলো...'
নূরীর পিঠময় ভেজা চুল দেখতে পেয়ে হাতেম আলি আবার বলে, 'তর চুল ভিজা দ্যাহা যায়, গোসল করছস নাহি?'

রবিউল কেমন বোকার মত হা করে তাকিয়ে থাকে নূরীর মুখের দিকে। নূরীর কথা বানাতে দেরি হয় না। বলে, 'গোসল না কইরা কি শইল্যে ক্যাঁদা মাইখ্যা রবুরে খাইতে দিমু কন? আর বাড়িও মাশাল্লা এমন যে, এহান দিয়া পিছল তো ওহান দিয়া খানা-খন্দ! এমন বাইত্যে আইয়াও তো বেইজ্জত হইতে হয়!'

হাতেম আলির চেহারা দেখে মনে হয় কথাগুলো ঠিক বিশ্বাস হয়নি তার। কেমন কাঁটা-কাঁটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নূরীর মুখের দিকে।

হাতেম আলির অদ্ভূত দৃষ্টির সম্মুখে নূরীর কেমন ভয়ভয় করে। সে রবিউলের সামনে থালা রেখে দ্রুত আড়ালে চলে যায়।

রবিউল থালা থেকে মুড়ি নিয়ে চিবোতে চিবোতে হাতেম আলিকে বলে, 'মুড়ি খাও!'

হাতেম আলি মুড়ি নেওয়ার বদলে বিরক্ত হয়ে বলে, 'তর কি যাওনের ইচ্ছা নাই?'

রবিউল মিটমিট করে হাসে। বলে, 'কহন যাইতে চাও?'

হাতেম আলি অস্থির ভাবে বলে, 'কইছিলাম তো অখনই!'

'তোমার বুদ্ধিও দেহি বুড়া হইয়া গেছে লাগে!'

তারপরই সে নূরীকে ডাকে। 'বুবু, বুবু!'

নূরী ঝাঁপের দরজায় মুখ বাড়ায়, 'কি কইবি?'

রবিউল হাতেম আলিকে দেখিয়ে বলে, 'হুনো বুইড়ার কথা! হ্যার বউ রাগ হইয়া গেছে বাপের বাড়ি! আমরা গিয়া ওই বাইত্যে কহন খাইতে পাই, নাকি খাওনই না দেয়, তার কি ঠিক আছে? নিজের বাইত্যে খাইয়া যাওন ভালা হইবো না?'

নূরী বলে, 'এমন তো নাও হইতে পারে!'

নূরীকে সমর্থন করতেই যেন জিহ্বায় ঠোঁট ভিজিয়ে হাসে হাতেম আলি।

রবিউল বললো, 'তাইলে বুবু চাইরডা ভাত বসাইয়া দ্যাও! আমরা একলগে খাইয়াই বাইর হমু!'

নূরীর ভাই ফালুর সঙ্গে হাতেম আলির সম্পর্ক বেশ ভালোই বলতে গেলে। রবিউলের ঘরে নূরীর অবস্থানটা ভালো মনে মেনে নিতে পারে না সে। যদিও বলতে গেলে সারাটা বছর কোনো না কোনো ভাবে রবিউলের সাহায্য ছাড়া তার চলে না, তবুও রবিউলকে সে কম ঈর্ষা করে না। রবিউলের বিভিন্নমুখী সৌভাগ্যের কারণে তাকে কিছুটা ঘৃণাও করে। কিন্তু অর্থ-বিত্তের দিক দিয়ে প্রায় পঙ্গু বলেই স্বার্থহানির ভয়ে মনোভাব প্রকাশ করতে পারে না হাতেম আলি। ভেতরে ভেতরে তাই নূরীর বিষয়টা ফালুর সঙ্গে আলাপ না করে সে শান্তি পাচ্ছে না। কিছুটা ব্যস্ততার সঙ্গেই উঠে পড়ে সে বললো, 'তুই তাইলে তৈয়ার হ। একটা কাজ সাইরা আমি অখনই আইতাছি!'

রবিউল বললো, 'তুমি যেহানেই যাও, আমার লগে দুই মুঠ ভাত খাইও!'

'পরে হইবোনে!'

হাতেম আলি বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই নূরী এসে বললো, ’হাতেম ভাইরে আইজ বেশি সুবিধার মনে হইতাছে না। কেমন জানি মাজেদার মত মনে হইলো!'

নূরীর কথা রবিউল আমলে না এনে বললো, 'তুমি এমন ভালা একটা মানুষরে কার লগে জোড়া দিতাছ?'

'তাও, চোখ দুইডা জানি কেমন দেখলাম!'

রবিউল নূরীকে আশ্বস্ত করতে বলে, 'গরিব আর অভাবী মানুষ মনেমনে হিংসা করন আর গাইল পারনের বেশি কিছু করতে পারে না। হাতেম ভাইরে নিয়া তুমি আজাইরা চিন্তা কইরো না!'

তবুও নূরী কিছুটা শঙ্কিত চিত্তেই রান্না ঘরে এসে ঢোকে।

এদিকে রবিউলের ঘর থেকে বের হয়ে প্রায় উড়ে এসেও ফালুর দেখা পায় না হাতেম আলি। মাজেদার কাছে জানতে পারলো যে, সে গেছে টুকনা মুচির কাছে। 'ফালুর আইতে কি দেরি হইবো?'

'মনে হয় না!' মাজেদা জলচৌকি এগিয়ে দিয়ে বলে, 'কিছুক্ষণ বইয়া দেখেন!'

হাতেম আলি জলচৌকি টেনে বসতেই মাজেদা বললো, 'একটা কথা হুনলাম, ঘটনা কি সত্য?'

হাতেম আলি অবাক হয়ে তাকায় মাজেদার দিকে।

তারপর বলে, 'কোন ঘটনা?'

'ময়নার মায় নাকি আর আইবো না?'

'কার কাছে হুনলা?'

মাজেদা মুখ টিপে বলে, 'যার কাছেই হুনি, কথাডা সত্য না মিছা?'

হাতেম আলি সরাসরি জবাব না দিয়ে বললো, 'মানুষ চেতলে কত কিছুই কয়! সব সময় সব কথা ধরলে কি চলে?'

নিজের ব্যাপার অন্যের মুখে শুনতে ভালো লাগে না হাতেম আলির। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে সে বললো, 'নূরীরে দেখলাম রবুর ঘরে! পিন্দনে নয়া কাপড়। মাথার চুলও ভিজা! বিয়া হইছে নাহি?'

মাজেদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে জানায়, 'কাইল জয়নাব আইয়া নিয়া গেছে! রবুর লগে নূরীর অখন বিয়া না হইলেও কয়দিন পরে ঠিকই হওন লাগবো!'

হাতেম আলি তবুও কথাটাকে নিয়ে প্যাঁচায়। বলে, 'রবুর বউ বাইত্যে নাই, একই ঘরে নূরী আর রবু। ব্যাপারডা জানি ক্যামন! নাইলে নূরী বিয়ান বেলা গোসল করলো ক্যান? রবুর ভিজা লুঙ্গিও দেখলাম রৈদে ছড়াইন্যা!'

মাজেদা বিরক্তি নিয়ে তাকায় হাতেম আলির দিকে। বলে, 'কত কারণেই গোসলের কাম লাগতে পারে! আপনে যা সন্দ করতাছেন তা আমার বিশ্বাস হয় না! নূরী এই জাতের মাইয়া না!'

'তয় যাই কও ভাবি, কামডা তোমাগো ঠিক হয় নাই!'

'ঠিকই হইছে! আমি খুশি হইছি!' মাজেদা হাসে।

তারপর আবার বলে, 'আপদ বিদায় হইছে!'

'কিন্তু গ্যারামের মানুষে কি কইবো? তারা কি দশজনের বাইরে?'

হাতেম আলি প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে মাজেদার মুখের দিকে।

কিন্তু মাজেদা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, 'দশজনে কইবো কি? বেশি হইলে শাইল্যাস কইরা হ্যাগো বিয়া দিবো। তহন নূরীর সম্পদের মালিক হইবো রবু। দশজনে কি ওই সম্পদ আমাগরে দিয়া যাইতে পারবো?'

'বিয়া হইলে তোমার খুশি হওনের কি আছে?'

'আছে, আছে!'

মাজেদার মুখ ঝলমল করে ওঠে।

তারপর সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, 'জয়নাবের অনেক দেমাক হইছে! আমারে কয় পাগলনীর পাও ধুইয়া পানি খাইতে! হ্যাগো বিয়া হইলে আমি দূরের থাইক্যা দুই সতীনের কামড়া-কামড়ি আর চুলাচুলি দেখমু!'

মাজেদার এখানে সুবিধা করতে না পেরে উঠে পড়ে হাতেম আলি। এখানে বসে মাজেদার কথা শুনতে ভালো লাগছে না তার। বিরক্তি গোপন করে সে বললো, 'অনেকক্ষণ তো বইলাম, ফালুর আইতে মনে কয় আরো দেরি আছে। আমি তাইলে যাই!'

মাজেদা পেছন থেকে বলে, 'আপনের ভাই আইলে কিছু কমু?'

'না, থাউক!'

হাতেম আলি ফের দ্রুত পা চালিয়ে রাস্তায় নামে।

মনেমনে রবিউলের উদ্দেশ্যে বলে, 'আগে বউডারে ফিরা পাই, তার বাদে তোমারে আমি সম্পদের মালিক হওয়াইতাছি! ট্যাকার গরমে তুমি আমারে বুইড়া কও!'

বিরস আর ব্যর্থ হয়ে রবিউলের কাছে আবার ফিরে এলেও মনের ভেতরকার ঈর্ষা আর পাপ বোধের কারণে সকালের মত সহজ হতে পারে না হাতেম আলি। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ তাকে চোখ তুলে তাকাতে বাধা দেয়।

রবিউল নূরীকে ভাত দিতে বললেও হাতেম আলি বলে, 'তুই খাইয়া ওঠ, আমার ক্ষিদা নাই!'

'আরে ভাই বও তো!' বলে, রবিউল হাত ধরে টেনে পাশে বসায় হাতেম আলিকে।

নূরী দুজনের পাতেই গরম গরম ভাত আর তরকারি ঢেলে দিলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খাওয়া আরম্ভ করে রবিউল। কিন্তু রবিউলের পাশে খেতে বসে ভাত মুখে দিয়েও খেতে পারে না হাতেম আলি। বিয়ে হলে নূরীর যাবতীয় সম্পদের মালিক হয়ে যাবে রবিউল। আর এ কথা মনে হতেই খাবার তার মুখে আরো বিস্বাদ লাগে। তবুও আস্তে আস্তে মুখের ভিতর খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে মনেমনে নূরীর প্রাপ্য সম্পদের হিসেব কষতে থাকে সে। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী সম্পদের মূল্য হিসেবে মোটামুটি একটি অংক নির্ধারণ করতেই তার হঠাৎ হেচকি উঠতে থাকে।

রবিউল খাওয়া থামিয়ে হাতেম আলির পিঠে হাত রাখে।

নূরী পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে হাতেম আলি পানি মুখে দেয়। পানি গেলার পর হেচকি বন্ধ হলেও সে আর খেতে পারে না। পেটের ভেতরটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠতে থাকে।

(চলবে...)


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।