মহাব্যস্ত মহাসড়ক।
বাস-ট্রাক-ট্যাক্সির অভাব নেই। গাড়িগুলো ক্রমাগত মাটি কাঁপিয়ে, দাপিয়ে, কখনও বা বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে আসছে যাচ্ছে। কিন্তু ঘন্টাখানেক সময় পেরিয়ে গেলেও ওরা বাসে উঠতে পারে না। পারে না হাত দেখিয়েও কোনো বাস থামাতে।
দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ কন্ঠে রবিউল বলে উঠলো, 'আইজ মনে কয় গাড়ি পামু না!'
হাতেম আলি মুখে বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলে, 'এত অস্থির হইলি ক্যান?'
'অস্থির হমু না কও?’ বলে, রবিউল তাকায় হাতেম আলির মুখের দিকে।
তারপর আবার বলে, ’ম্যাঘ-বাদলের দিন, কোন সময় আবার ঝুরঝুর কইরা নামা শুরু করবো, তখন ভিজ্যা চুবচুব হওন ছাড়া উপায় থাকবো না!'
'একটা কামে রওয়ানা করছি, এমন চুদুরবুদুর করলে হয়? এতক্ষণ যহন দেরি করতে পারছস, আর কিছুক্ষণ দেখি!'
হাতেম আলির কথা না ফুরাতেই একটি লোকাল বাস আসতে দেখা যায়। ঠিক তখনই রবিউল বলে উঠলো, 'এইডা না থামলে আমি আর দেরি করমু না!'
হাতেম আলি কেমন ঘোলা চোখে তাকায় রবিউলের দিকে। আর তখনই তাদের অবাক করে দিয়ে বাসটি সামনে এসে থেমে যায়। দু’জনই রাস্তার নামায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো। বাস থামতেই ঢাল বেয়ে তারা সড়কে উঠে আসে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বাসে উঠতে পারে না। বাসের হেলপার এক হাত উঁচিয়ে তাদের সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে।
বাস থেকে এক দঙ্গল নারী-পুরুষ আর শিশু-কিশোর নামে। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মাত্র তিনজন। দলটা দেখে হাতেম আলি বললো, 'বৈরাতী মনে কয়!'
কিন্তু রবিউল হাতেম আলির কথা খেয়াল করে না।
নূরপুর গেলে আসন্ন অপমান আর মানসিক যন্ত্রণার আশঙ্কায় কিছুটা চাপের মুখে আছে সে।
গয়না বা তাদের পরিবারের লোকজন কি কি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে বা কোন ধরনের কথায় বিপক্ষকে না চটিয়ে কাজ উদ্ধার করে মানেমানে ফিরে আসতে পারবে, তার হিসেব নিকেশেই সে মশগুল হয়েছিলো।
অতগুলো যাত্রী নেমে গেলেও বাসে উঠার পর তারা বসার জন্য খালি আসন পায় না। উপরের দিকের রড ধরে দাঁড়িয়েই থাকতে হয়।
হাতেম আলির দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছিলো না। পা দুটো কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। একটি পেট-মোটা বস্তা দেখে সে হাত দিয়ে উপর থেকে চেপেচুপে আপন মনেই বলে, 'বস্তার ভিতরে কি আছে?'
বস্তার পাশেই আসনে বসে থাকা একজন বললো, 'তুষ!'
হাতেম আলি অনুমান করে যে, এই লোকটাই হয়তো বস্তার মালিক। বললো, 'বসা যাইবো?'
লোকটা বললো, 'ইচ্ছা করলে বইতে পারেন!'
তুষের বস্তার উপর বসে হাতেম আলি পা দু'টো সামনের দিকে মেলে দেয়। কিছুক্ষণ পর পায়ের ঝিমঝিম ভাবটা আর থাকে না। কিন্তু বেশিক্ষণ তার বসার সুযোগ হয় না। দু'টো স্টেশন পার হলে পরের স্টেশনে বস্তা নিয়ে নেমে যায় লোকটা। কিন্তু তার আগেই সদ্য শূন্য হওয়া আসনে অন্য একজন বসে পড়ে।
আসনে বসতে না পারলেও বেশি মন খারাপ করে না হাতেম আলি। সামনের তিনটা স্টেশন পার হলেই শহিদনগর স্টেশন। সেখান থেকেই যেতে হবে নূরপুর। তবে বেশ কয়জন যাত্রী দু'স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় নেমে গেলে ওরা দু'জনেই বসার জন্য জায়গা পেয়ে যায়।
কন্ডাক্টর হাতেম আলির কাছে ভাড়া চাইলে সে রবিউলকে দেখিয়ে দেয়।
রবিউল ভাড়া পরিশোধ করে হাতেম আলিকে বলে, 'যাইতাছি তোমার কাজে, ভাড়া তো দ্যাওনের কথা তুমি!'
'আমি ভাড়া দিতে পারলে আর তরে আনছি ক্যান?' বলে, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাসে হাতেম আলি।
'পরের মাথায় নুন রাইখ্যা আর কতদিন?'
রবিউল চোখ-মুখ খিঁচিয়ে কথাগুলো বললেও হাতেম আলি নির্বিকার ভাবে বলে, 'যদ্দিন চলে!'
'তার বাদে?'
রবিউলের কথায় হাতেম আলি হাত নেড়ে বলে, 'পরেরডা পরে!'
শহিদনগর স্টেশনে ওরা নেমে পড়লে কয়েকজন রিকশা নিয়ে এগিয়ে এলে হাতেম আলি বললো, 'আমরা হাঁইট্যা যামু!'
একজন বুড়ো মত লোক বললো, 'আপনেরা সবতে হাঁইট্যা গেলে আমরা কী খাইয়া বাঁচমু?'
রবিউল বুড়োর রিকশায় চড়ে বললো, 'নূরপুর হানিফ ফকিরের বাড়ি।'
হাতেম আলি রবিউলের পাশে বসে বলে, 'ইট্টুহানি পথ, রিকশায় উডনের দরকার আছে? হুদা কামে পয়সা নষ্ট!'
রবিউলের ইচ্ছে হয় বলে যে, এত হিসাবি হইয়াও ক্যান তোমার দুর্দশা যায় না? কিন্তু তা না বলে বললো, 'ট্যাকা-পয়সা তো নষ্ট করনের লাইগ্যাই। যে যত পয়সা নষ্ট করে, পয়সাপাতি তারেই তত পছন্দ করে!'
হাতেম আলি রবিউলের কথার মর্মোদ্ধারে মন দিতে পারে না হয়তো। কারণ সামনেই দেখা যাচ্ছে, খইয়া আসছে।
তাদের দেখতে পেয়ে খইয়া বললো, 'যান, দুই আসামীরেই বাইন্ধা থুইবো!'
রবিউল বললো, 'আপনে কি রশি আনতে যাইতাছেন?'
খইয়া রবিউলের কথা শুনে হাসে। রিকশা তাকে পেরিয়ে অনেকটা চলে এসেছে। হয়তো সেই কারণেও সে আর কিছু বলতে পারে না।
হানিফ ফকিরের বাড়ির কাছাকাছি রিকশা থামলে হাতেম আলি বললো, 'তুই আগাইয়া যা, আমি পরে আইতাছি!'
রবিউল হেসে বলে, 'তুমি কি চাও সব মাইর আমার উপরেই পড়ুক?'
হাতেম আলি কিছু না বলে মাথা নিচু করে একদিকে হাঁটে।
রবিউল বললো, 'কাছাকাছিই থাইক্যো!'
'আমি সামনেই আছি!' বলে, হাতেম আলি একটি খোলা জায়গা দেখায়।
বাড়ির সীমানায় ঢুকতেই উঠোনে গয়নার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় রবিউলের। কলস নিয়ে হয়তো পানি আনতেই যাচ্ছিলো কলের দিকে। দৃশ্যটা দেখে তার খনার বচন মনে পড়ে। ভরার চাইয়া শুন্য ভালা, যদি ভরতে যায়। তার চাইয়া আরো ভালা, পাছে ডাকলে মায়।
গয়নার মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো যেন। সে থমকে দাঁড়িয়ে বললো, 'কেমুন আছেন?'
'ভালা! আপনে ক্যামন?'
'আপনে ঘরে যাইয়া বসেন, আমি কলসটা ভইরা আইতাছি!'
গয়না তাকে ঘরে গিয়ে বসতে বললেও রবিউল ঘরে প্রবেশ করে না। দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর গয়না ফিরে এলে রবিউল আবার বলে, 'কেমুন আছেন, তাতো কইলেন না ভাবি!'
গয়না পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকবার আগে বলে, 'ঘরে যাইয়া বসেন। যা কওনের আইয়া কইতাছি!'
খালি ঘরে একাএকা বেশিক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হয় না। কাচের গ্লাস হাতে গয়না এগিয়ে এসে বলে, 'আগে শরবত খাইয়া মাথা ঠান্ডা করেন। কথা শুইন্যা দৌঁড় দ্যাওনের ইচ্ছাও হইতে পারে!'
রবিউল শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে বলে, 'আর কাউরে যে দেখি না!'
'না দেখলেও সময় মতন সবতেই আইসা পড়বো! আপনে কি খবর নিয়া আইলেন তা কেউ শুনবো না, এইডা কি হয়?'
রবিউল শরবতটুকু নিঃশেষ করে বলে, 'আর এক গেলাস হইবো না?'
গয়না চোখ পাকিয়ে বলে, 'খোদার কাছে শুকুর করেন!'
রবিউল কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। কারণ তার আগেই গয়না বলে ওঠে, 'একলা যে আইয়েন নাই, জানি! কিন্তু হ্যারে কোই থুইয়া আইলেন?'
'হ্যায় তো ডরাইতাছে!'
গয়নার মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। বলে, 'ডরের কাম করছে, তো ডরাইবো না? কাম করনের আগে তো উদ্দিশ থাকে না।!'
তারপর রবিউলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, 'গ্যালাশটা দেন!'
রবিউল গ্লাস এগিয়ে দিলে গয়না দ্রুত পদক্ষেপে তা নিয়ে রেখে আসে। অন্যদিনের তুলনায় তাকে আজ বেশ হাসি-খুশি দেখায়। সেই সঙ্গে কথাও বলছে পরিষ্কার আর উচ্চ কন্ঠে।
কারো মনে যদি ষোলোআনা আত্মবিশ্বাস বজায় থাকে, তাহলে কথাবার্তা বলতে তাকে ভাবতে হয় না। আত্মবিশ্বাসী মানুষের কাজ-কর্ম, ধ্যান-ধারণা সবই থাকে গোছানো আর পরিপাটি। গয়নাকেও আজ তেমনি আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী মনে হচ্ছে। গয়নার এই নতুন রূপ দেখে রবিউলের মনে হয় যে, হাতেম আলি আর ফিরে পাবে না তাকে। হয়তো তার পরিবার থেকে বিচ্ছন্নতার কথাই চূড়ান্ত হয়েছে।
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে গয়না রবিউলের সামনে প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ায়।
তারপর বলে, 'কি খবর আনছেন? আগে কন!'
রবিউল বিস্মিত হয়ে বলে, 'খবর তো আপনের কাছে! হেইদিন আমি কী কইয়া গেলাম?'
গয়না কোনো কথা না বলে শক্ত মুখে তাকিয়ে থাকে রবিউলের দিকে। রবিউল তা দেখে বিচলিত না হয়ে পারে না। বলে, 'হেই দিন কইয়া গেলাম না যে, আপনেরা দুইজনে কথা কইয়া সব ঠিক করবেন?'
কথা শুনে গয়না কিছুটা জোরে হেসে উঠলে রবিউল তিক্ত কন্ঠে বলে, 'হাসনের কথা কইলাম বুঝি?'
'হাসনের কথা না তো কি? আপনের মতন সবতেই তো আর এমন সহজ-সরল না!'
রবিউলের পছন্দ হয় না গয়নার কথা। বলে, 'সহজ-সরল হইলে আপনেগ এমন ভ্যাজাল কামে আইতাম না!'
'পাও ধইরা আনলে কি না আইসা পারা যায়?'
'ওইডা কোনো কথা না! হাতেম ভাইয়ের লগে যদি আপনের সংসার করতে ইচ্ছা না হয় তো করবেন না! হেই হক আপনের আছে! আমি কওনের কে? তাও যদি কথার মইধ্যে মিলমিশ হইয়া যায়, তাইলে কি ওইডাই ভালা না?'
গয়নার চোখ-মুখ কেমন লালচে হয়ে ওঠে। বলে, 'তাইলে আবার ক্যান আইছেন হুদা কামে সময় নষ্ট করতে?'
গয়না হয়তো রেগে যায়। আর রেগে গেলে তার কোনো হুঁশ-জ্ঞান থাকে না। কিন্তু তখন তার মতামত হয় বলিষ্ঠ। 'শুনেন রবু ভাই, আমি এত কথা বুঝি না! যদি আবার হেই ঘরে আমারে ফিরা যাইতে হয়, তাইলে আমার লগে মুখ খারাপ আর মাইরপিট করন যাইবো না! ভাত কাপড়ের কষ্ট দেওন যাইবো না! তা ছাড়া কোনো ছুতায় বাপের বাড়ি থাইক্যা একটা কুটাও আর নিতে পারমু না! আমি ওই মানুষটার কারণে নিজের মানুষের কাছে অনেক ছোডো হইছি! এর পরে যদি আবার আমারে ফিরতেই হয়, তাইলে আমি ক্যামন আছি? কি খাই? ক্যামন পিন্দি? হেইডা দেখনের লাইগ্যা আপনে পোনরো দিনে না পারেন, মাসে একবার হইলেও খোঁজ নিবেন! এই না হইলে আমি আর ফিরা যামু না!'
রবিউল ব্যস্তভাবে বলে উঠলো, 'কইলাম তো হেই হক আপনের আছে!'
গয়না বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে, 'আমার কথা এখনও শ্যাষ হয় নাই!'
'আইচ্ছা কন!'
রবিউল ফের নড়েচড়ে বসে।
'আমি যদি আর ফিরা যাইতে না চাই, নয়তো তার ঘরে গিয়া আবার অশান্তিতে পইড়া বাপের বাইত্যে ফিরা আসতে হয়, তাইলে আমার পাঁচ ভরি সোনার জিনিস, ব্যবসা করতে যেই সত্তুর হাজার ট্যাকা ক্যাশ নিয়া দিছিলাম আর আমার কাবিনের আশি হাজার মিলাইয়া এক মুঠে দেড় লক্ষ ট্যাকা বুঝাইয়া দিতে হইবো!'
রবিউল গয়নার কথা শুনে ভাবে, পাঁচভরি সোনার দামই অখন লাখ ট্যাকা। হাতেম ভাই এই কথা হুনলে এমনেই ঘরবাড়ি ছাইড়া পলাইতে চাইবো।
রবিউলকে চুপ থাকতে দেখে গয়না বললো, 'কথা কন না ক্যান?'
রবিউল গয়নার ক্রুদ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে চুপসানো কন্ঠে বলে, 'হাতেম ভাই গরিব মানুষ! এত ট্যাকা কী কইরা জোগাড় করবো?'
'বাড়ি-ঘর বেচবো। গ্যারামে গ্যারামে হাঁইট্যা ভিক্ষা করবো! তাও আমার হক পাই-পয়সা হিসাব কইরা ফেরত দিতে হইবো!'
রবিউল বললো, 'কি পাগলের কথা! মানুষে হুনলে কইবো কি?'
গয়না রবিউলের কথায় টলে না। বলে, 'মানুষের কাজই হইলো পরের দোষ খুঁইজা বাইর করন। আপনে আমারে আইজ কথা দিতেই হইবো! নাইলে আপস নাই!'
রবিউল হতচকিত হয়ে আমতা আমতা করে বললো, 'এইডা পরে দেখা যাইবোনে!'
'না-আ-আ!'
গয়নার উচ্চকিত কন্ঠস্বর আশপাশেও ছড়িয়ে যায় যেন। সে তেমনি রুদ্র কন্ঠে বলে, 'পরে কোনো কিছুই ঠিক থাকে না! আপনে ময়নার বাপেরে ডাকেন!'
রবিউল উঠে বলে, 'ওইডাই ভালা হইবো!'
হাতেম আলি বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে রাস্তার পাশে ঘাঁসের উপর থেবড়ে বসেছিলো। রবিউলকে দেখতে পেয়ে পড়িমড়ি ছুটে এসে বলে, 'অবস্থা কি?'
রবিউল চিন্তিত ভাবে বললো, 'বেশি সুবিধার মনে হইলো না! ভাবি যা কয়, ভাইব্যা-চিন্তা জবাব দিও!'
হাতেম আলির মুখের ছায়া দীর্ঘ হয়। অনিশ্চয়তার সুরে বলে, 'তুই কি করতে কস?'
'উল্টা-পাল্টা কিছু কইরা বিগড়াইয়া দিলে, বউ তালাক দিয়া পাঁচ ভরি সোনা আর দেড় লক্ষ ট্যাকা ফেরত দিয়া যাইতে হইবো!'
রবিউলের কথা শুনে হাতেম আলির চিমসানো মুখে হাসি ফুটে ওঠে। যা কান্না বললেও ভুল হবে না। সে পাঁচ-ছ দিনের না কামানো গাল চুলকে বলে, 'এইবার খুঁটি জবর পোক্ত লাগে!'
হাতেম আলিকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে রবিউল বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে ঘরের ভেতর থেকে গয়না বললো, 'রবু ভাই, আপনেও আসেন!'
ঘরের ভেতর গয়নার আশেপাশে বেশ কজন নারী-পুরুষ দেখা যায়। হাতেম আলি কেমন ফ্যালফ্যাল করে গয়নার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
রবিউল হাতেম আলির পাশে গিয়ে বসলে গয়না তার কাছে বলা কথাগুলোই কিছু কিছু হাতেম আলির কাছে পূণর্ব্যাক্ত করে। কিন্তু অকস্মাৎ সে কেমন অচেনা নারীর মত বলে উঠলো, 'তুমি যদি আমার শইল্যে আর কোনোদিন হাত উডাও, কোনো কারণে বকাবাজি কর, তো তোমারে আমি তালাক দিমু! আমার সোনার জিনিস আর কাবিনের ট্যাকা-পয়সা যা পাওনা হই সব পাই-পয়সা হিসাব কইরা ফেরত দিয়া দিবা! নাইলে রবিউল আমারে বিয়া করতে হইবো!'
হাতেম আলি অকস্মাৎ চমকে উঠে প্রচন্ড ঘৃণাভরে ফিরে তাকায় রবিউলের দিকে। যেন এক যুগের বিশ্বাস আর নির্ভরতা ভেঙে দিয়ে গয়নার সাথে ষড়যন্ত্র করে তাকে পথে বসাতে চাচ্ছে সে।
বিস্মিত রবিউল হাতেম আলির ঘৃণা মিশ্রিত দৃষ্টির সামনে মাথা তুলতে পারে না। মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুলে মাটির মেঝেতে আঁকিবুকি কাটে।
হাতেম আলি গয়নার দিকে ফিরে কাতর কন্ঠে বলে, 'দ্যাখ বউ, পোলাপানের কষ্ট দেইখ্যা এমনেই আমার মাথা ঠিক নাই! তুই মাথাডা ইট্টু ঠান্ডা কর!'
গয়না হাত নেড়ে বলে, 'তেরটা বচ্ছর আমার মাথা গরম আছিলো বইল্যা নিজের দিকে চোখ তুইল্যা চাইতে পারি নাই! আমি যে একজন মানুষ, নাকি কারো ঘরের বিছানাপাতি-হান্ডি-পাতিলের মতন তার কিছুই এতদিন বুঝতে পারি নাই! অখন মাথা ঠান্ডা আছে বইলাই নিজের কথা, দুঃখ-কষ্টের কথা চিন্তা-ভাবনা করনের সময় পাইছি! আগের মতন কথার রঙ সাজাইয়া আমারে আর ভুলাইতে পারবা না! তোমরা দুইজনেই আইজ এই মানুষগুলার সামনে কথা দিতে হইবো! কিছু কিছু কথা আর কাজের সাক্ষী থাকনেরও দরকার আছে!'
উপস্থিত সবার সামনে ওরা দু’জন যেন মাথার উপর পাহাড় নিয়ে বসে আছে। যে কারণে তাদের উঁচু মাথা ধীরেধীরে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে।
ওদের চুপ থাকতে দেখে একজন প্রবীণ পুরুষ বললেন, 'বাবারা, হ-না কিছু বলেন! একটা মাইয়া সারাজীবনই মুখ বন্ধ কইরা রাখতে পারে না! অখন মুখ যখন খোলাইছেন, আপনেরাও চুপ কইরা থাকতে পারবেন না! কিছু একটা বলেন!'
রবিউল একবার গয়না একবার হাতেম আলির দিকে তাকায়। কিন্তু কী বলবে সে? ঘটনার আকস্মিকতায় যেন স্থবির হয়ে পড়েছে তার চিন্তা-ভাবনা আর বাকশক্তি।
হাতেম আলির দু'চোখ বেয়ে হঠাৎ পানি পড়তে থাকে। আর তা দেখেই যেন গয়না প্রবল রোষে চিৎকার করে উঠে বলে, 'তোমরা পরের ধনের লোভী পুরুষরা আমাগো চোখের পানিরে কোনোদিন কিছু মনে কর নাই! দিনরাইত কাইন্দা আমার চোখের পানি শুকাইয়া গ্যাছে! অত্যাচার সহ্য করতে করতে কইলজা পাষাণ হইয়া গ্যাছে! মনের জাগায় অখন একটা পাত্থরের টুকরা ছাড়া আর কিছু নাই! নাই দয়া-মায়াও!'
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতেম আলি হঠাৎ উদভ্রান্তের মত ছুটে গিয়ে গয়নার দু'হাঁটু নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে, 'আমারে আর জবাই করিস না বউ! তুই ছাড়া আমার আর কে আছে? পোলাপানগুলারে তুই এতিম করিস না!'
কিন্তু গয়নার মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। মনে হয়, সে যেন পাথর অথবা কাঠের তৈরী কোনো এক অসামান্য ভাস্কর্য। যে নিশ্চলভাবে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে আবহমান কাল ধরে।
(সমাপ্ত)
মন্তব্য
পুরো উপন্যাস একটানে পড়লাম। গ্রামের পটভূমিতে যে চরিত্র নির্মাণ, সংলাপ, ঘটনার মোড় সৃষ্টি করেছেন তা সুন্দর। পুরোটা মেদহীন, ঝরঝরে এবং লম্বা সময় ধরে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম বলে মনে হয়েছে।
শেষটা কি আরেকটু অন্যরকম করা যেতো? আমার পড়ে মনে হল যেন আরেকটু কাহিনী যোগ হলেও ক্ষতি ছিল না।
নতুন মন্তব্য করুন