এই জীবনে

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/১০/২০০৮ - ৬:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হায়দার আলি এই কিছুক্ষণ আগেই প্রথম মনোযোগ দিতে পেরেছিলো নিজের প্রতি। হয়তো চিনতে চেষ্টা করছিলো নিজকে। কিছুটা হলেও আবিষ্কার করতে চেষ্টা করছিলো আপন চরিত্রটিকে। কিন্তু এ কথাও তার মনে হয় যে মৃত্যুর আগে নাকি মানুষ খুব বেশিই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। খুব সামান্য স্মৃতিরাও বাঙময় হয়ে উঠতে চায় মানসপটে।

চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে যে, আজ কি বুদ্ধ পূর্ণিমা? আজকের রাতটাও কি মাঘী পূর্ণিমার রাত? এমন একটি রাতেই তো জীবের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর মমতা নিয়ে জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন বুদ্ধ। এমনি নানা কথা ভাবতে ভাবতে সে ক্রমান্বয়ে স্মৃতির ভারে নূয়ে পড়ছিলো।

বুদ্ধের জন্মতিথীর প্লাবিত জোছনার কারণেই বোধকরি আকাশটা পূর্ণিমার আলোয় ক্রমাগত হাসছিলো খলবল করে। আর অদৃশ্য ভারী শিশির পতনের মতই জোছনা চুইয়ে পড়ছিলো তার আশপাশের ঘাসে। জোছনা সিক্ত প্রকৃতি যেন জানান দিয়ে দিয়েছিলো তাকে যে, এখনই যদি সে নিজকে চিনতে না পারে তাহলে সে চিরদিন অচেনাই থেকে যাবে নিজের কাছে। অধরা থেকে যাবে আপন চরিত্রের রহস্য। কিন্তু সে কখনোই আজকের মত এমন গভীর দৃষ্টিতে তাকায়নি চাঁদের দিকে। দেখেনি জোছনা সিক্ত রাতের প্রকৃতিকে। একটি জন্তু যেমন তার খাওয়া আর রেচন-জননের পাশাপাশি জৈবিক তাড়নায় ব্যস্ত থাকে, তেমনিই সে কাল কাটাচ্ছিলো। অথচ তার ছত্রিশ বছর বয়সের দীর্ঘ জীবনে এই কিছুক্ষণ আগেই প্রথম তার পরিপূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় চাঁদের দিকে। তাকায় তার চারপাশের প্রকৃতির দিকে এবং সহসা সে অপার বিস্ময় আর মুগ্ধতায় নির্বাক হয়ে যায়। ভুলে যায় যে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। র‌্যাব নামের ইঁদুর-বিড়াল বা চিতা কিংবা অজগর দলের সামনে পড়লে নির্ঘাৎ মৃত্যু ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। সরকারের অতিরিক্ত এই বাহিনীটিকে মানুষ হত্যা করা ছাড়া আর কোনো প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে মনে হয় না। তবুও হায়দার আলি নিশুতি রাতে খানিকটা সময়ের জন্য হলেও বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলো তার পিছু ধেয়ে আসা কালো মৃত্যুর বিস্তার করা থাবাটিকে।

এতদিন সে কেবলই ভেবেছে যে, আসলে সে কী ধরনের মানুষ। যদিও তার সহচর সবাই তাকে জানোয়ারের বেশি কিছু মনে করে না। আর করবে নাই বা কেন? সে তো সত্যিকার অর্থে একটি জানোয়ারই। জানোয়ার না হলে কি তার দেড় বছরের ছেলেটিকে নিয়ে নিলুকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছিলো উপর্যুপরি অত্যাচারের নির্মম কষাঘাতে? অথচ কি না দু'জন ভালোবেসেই পরস্পর যুথবদ্ধ হয়েছিলো। সামাজিক রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এখলাস কাজীর ঘরে গিয়ে কাবিন নামায় সই-সাবুদ করে শুরু করেছিলো নতুন জীবন।

বিয়ের প্রথম ক'টিবছর সন্তান না হওয়াতে সে বায়না ধরেছিলো আরেকটি বিয়ে করার জন্য। তখনও তার উপর খলিল চেয়ারম্যানের খবরদারী ছাড়া এমন কোনো ঝামেলা এসে পতিত হয়নি। স্বামীর পাথরের মত গম্ভীর মুখে দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনে শঙ্কিত চিত্তে নিলু মুখ তুলে তাকিয়েছিলো একবার। কিন্তু কিছুই বলেনি। হায়দার আলি তখন নিলুর মুখের নীরব ভাষাটিকে পড়তে চেষ্টা করছিলো। চেষ্টা করছিলো তার দৃষ্টির গভীরতায় ফুটে থাকা অব্যক্ত প্রশ্নটিকে অনুধাবন করতে। কিন্তু সে তখন স্ত্রীর দৃষ্টিতে সমুদ্রের বিশাল গভীরতাই দেখতে পেয়েছিলো শুধু। দেখেনি কোনো অবাধ্য ঢেউয়ের বিদ্রোহ বা সমুদ্র জলে ভেসে আসা আবর্জনার মত কোনো ঘৃণাও। তাহলে কি নিলু বোধশূন্য? তাই বা হয় কি করে? তেমন হলে তো তার আচরণে কখনোই প্রকাশ পেতো না তাকে উপেক্ষা করে যাওয়ার মত ধৃষ্টতা। এমনকি কখনো বলতো না যে, তুমি ক্যান বিয়া করলা? তোমার মতন মানুষরা বিয়া করে ক্যান?

সেদিন অবশ্য কোনো জবাব দিতে পারেনি হায়দার আলি। কিন্তু জবাব দিতে না পারার ব্যর্থ আক্রোশে সে চুলের মুঠি ধরে মেঝেতে আছড়ে ফেলেছিলো নিলুকে। নিলু কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারতো মুখে মুখে। কিন্তু তা করেনি। এমনকি একটু কাঁদেওনি। চুপচাপ উঠে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলো বিছানায়।

এর পর দীর্ঘদিন সে কাটিয়ে দিয়েছে কেবল নীরব থেকেই। কোনো কথাই বলেনি তার সঙ্গে। সময় মত সবই করেছে। এমন কি তার জৈবিক তাড়নায়ও কোনো বাধা দেয়নি। খাওয়ার সময় ঠিক মতই দিয়েছে সব। কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। হায়দার আলিও এ নিয়ে তেমন গা করেনি কোনো। কিন্তু রক্ত-মাংস আর বোধ-বিবেচনার অধিকারী নিলু অস্তিত্বহীন ভাবে কাটাতে পারেনি হায়দার আলির ঘরে।

হয়তো এতটা দিন সে অপেক্ষায় ছিলো যে, কৃতকর্মের ভুল স্বীকার করে ফের তাকে বুকে টেনে নেবে হায়দার আলি। কিন্তু ব্যাপারটি তলিয়ে দেখার সুযোগ পায়নি সে। বেশ কিছুদিন ধরে তাকে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। থাকতে হচ্ছে গা ঢাকা দিয়ে। আশপাশের মানুষকেও এখন বিশ্বাস করার মত অবস্থা নেই। কে কখন কালো পোশাক পরা লোকগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বসে থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। এখনও যে কেউ ওত পেতে বসে নেই তারই বা নিশ্চয়তা কতটুকু!

ক'টা দিন পালিয়ে থেকে থেকে অনুতপ্ত আর অনুশোচনাদগ্ধ হায়দার আলির মন অকস্মাত ছুটে গেছে নিলুর কাছে। তারই আরেকটি প্রাণ নিলুর গর্ভজাত নজর আলি। কোনো কোনো ফুল কিংবা ফলগাছ যেমন আপন অস্তিত্ব বীজের মধ্যে নিহিত রেখে নিজে ফুরিয়ে যায় পুনরায় নতুন হয়ে জন্ম নেবে বলে। তেমনি হায়দার আলি পুনরায় নিজেই জন্ম নিয়েছে তার সন্তানের মাঝে- ভিন্ন একটি অস্তিত্ব নিয়ে। এখন সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই। সে বেঁচে থাকবে আরো অনেক দিন তারই সন্তানের মাঝে। নজর আলির মাঝে।

দীর্ঘদিন পর স্ত্রী-সন্তানের জন্য মন-প্রাণ কেঁদে উঠলেও হায়দার আলি তাদের দেখা পায়নি। গোপনে বাড়ি গিয়ে শুনতে পেয়েছিলো যে, ওরা বাড়ি নেই। নজর আলিকে নিয়ে নিলু চলে গেছে বাপের বাড়ি।

চন্দ্রালোকিত রাত্রির অদ্ভূত আর মোহময় আলোতে হায়দার আলি তাকিয়েছিলো দূর আকাশের পানে। চাঁদটা কী সুন্দর গোল রূপার থালার মত ভেসে আছে। তার মনে পড়ে এমনি একটি রাত্রিতে সুলেমান খনকারের উসকানিতে প্রচন্ড ঘৃণা আর আক্রোশের বশবর্তী হয়ে সে গিয়েছিলো নিলুর সর্বনাশ করতে। কিন্তু সেদিন একটুও ভয় পায়নি মেয়েটি। প্রথমটায় খানিক সংকোচ থাকলেও একবার হায়দার আলির চোখের দিকে দৃষ্টি ফেলতেই যেন উবে গিয়েছিলো তাও। তারপর একটি হাত ধরে বলেছিলো, 'আপনের মতন মানুষ ক্যান গুন্ডা-বদমাইশ অয়?'

সেদিনও কোনো জবাব দিতে পারেনি হায়দার আলি। কোনো এক অদৃশ্য নিয়ন্তা যেন চেপে ধরেছিলো কন্ঠ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিলুর প্রতি প্রগাঢ় এক অনুভুতিতে বিবশ হয়ে এসেছিলো তার দেহমন। এমন নিষ্পাপ একটি মেয়ের সর্বনাশ করতে কেন সে রাজি হলো? নিলুর চাচা সুলেমান খনকার কেনই বা এমন একটি নোংরা পরিকল্পনা করলো? কী অপরাধ মেয়েটির? নিলুর অপাপবিদ্ধ মুখটির দিকে তাকিয়ে অকস্মাৎ মনটা কেমন হুহু করে উঠেছিলো তার। আর প্রথমেই সে জানতে চেয়েছিলো, 'সুলেমান খনকার তর কি লাগে?'

বোকার মতই হেসে উঠেছিলো নিলু। প্রতিদিন স্কুলে যাবার পথে হোসেনের দোকানে বসে থাকা দলটির মাঝে একমাত্র এই মানুষটির চোখই কেবল নির্বিকার থাকতে দেখেছে সে। দীর্ঘদিন দেখতে দেখতে মানুষটিকে কেমন আপন আপন মনে হয় তার কাছে। আর তাই অতি পরিচিতের মতই হেসে উঠে নিলু বলে উঠেছিলো, 'এহ্ জানে না বুঝি! আমার চাচা!'

'কেমন চাচা?'

ক্রুদ্ধ ফণা তোলা সাপের মতই ফোঁসফোঁস করে বলে উঠেছিলো হায়দার আলি।

'আপন চাচা। বাবা আর সুলেমান কাকা দুইজনেই এক মায়ের প্যাডের ভাই!'

তখনই প্রচন্ড রাগে শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মাথায় চড়ে গিয়েছিলো হায়দার আলির। যাবতীয় রাগ আর ঘৃণা গিয়ে পড়েছিলো সুলেমান খনকারের উপর। নিরীহ এ মেয়েটি কী এমন ক্ষতি করেছে লোকটার? তার মেয়ে নয়নও তো নিলুর প্রায় সমবয়সী। পরের মেয়ের সর্বনাশ ঘটানোর পরিকল্পনা করার আগে নিজের মেয়ের কথা একটিবারও কি ভাবলো না লোকটি?

রাগ হলেও সুলেমান খনকারের সামনে মনোভাব ব্যক্ত করেনি সে। কিন্তু পরদিন সুলেমান খনকারের প্রশ্নের মুখে বলেছিলো, 'কাইল রাইতে কেউ বাইত্যে আছিলো না। অনেক রাইত পর্যন্ত বইয়া থাইক্যাও কারো একটা কাশের আওয়াজ পাইলাম না!'

সুলেমান খনকার নির্নিমেষ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো হয়দার আলির মুখের দিকে। তার কথা বিশ্বাস হরেছিলো কি না কে জানে। কিন্তু সুলেমান খনকার কিছু না বললেও তার চাহনি সুবিধার ছিলো না। কেমন ক্রুর মনে হয়েছিলো।

তার কিছুদিন পরই যখন চারদিকে নির্বাচনের হাওয়া ঘূর্ণির মত নেচেনেচে এক গ্রাম পেরিয়ে আরেক গ্রামের ভেতর দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলো, তখনই একদিন হাটফেরত লোকজন বিলের মাঝে হাত-পা আর মাথা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবিষ্কার করে সুলেমান খনকারকে। যদিও এ খুনের ঘটনার যাবতীয় দায় গিয়ে পড়েছিলো দু'টি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় দু'জন নেতার উপর। কিন্তু কোনো দলই এ হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করেনি। থানার ওসি বা দারোগাও এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি।

দিনদিন তবুও কেমন করে যেন বরফপানি রাখা গ্লাসের শরীর ঘেমে চুইয়ে পড়া শিশিরের ফোঁটার মত জনমনে নানা ধরনের সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে। সেই সঙ্গে কেমন করে যেন সুলেমান খনকারের খুনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলো হায়দার আলির নামও। কিন্তু ততদিনে নির্বাচিত চেয়ারম্যান তার নামে দায়ের করেছে সুলেমান খনকার সহ আরো দু'টো খুনের মামলা। যদিও এলাকার লোকজন নেজারত মোল্লা আর হারেস মুন্সির মৃত্যুতে খুশিই হয়েছিলো। কিন্তু তারপর থেকেই নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে নানা ঘটনা।

নেজারত মোল্লা আর হারেস মুন্সি নিহত হওয়ার পর কিন্তু সেই বিপদের দিনে, যখন তার পা দু'টো ক্রমশ দেবে যাচ্ছিলো নিরাপত্তাহীনতার চোরাবালিতে, তখন নিলুই যেচে সহযোগীতার দু'টো হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো পরম মমতায়। ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো বিশ্বাসযোগ্য আর নিরাপদ আশ্রয়ের। পারস্পরিক নিরাপত্তা প্রদানের ব্যাপারটিই তাদেরকে আবদ্ধ করেছিলো কৃতজ্ঞতাপাশে। গভীর এক বিশ্বাসবোধ এমনি কোনো এক পূর্ণিমা রাত্রিতে তাদের দু'জনকে এক করে দিয়েছিলো। দূর করে দিয়েছিলো পারস্পরিক সংকোচ আর সামাজিক শাসনের কঠিন দেয়াল।

এত বিপদ মাথায় নিয়ে শুধুমাত্র নিলুর কথায় বিয়ে করলেও মাস কয়েক পর কী এক কারণে আচমকা থাপ্পড় দিয়েছিলো নিলুকে। শান্ত নদীতেও কখনো জলোচ্ছ্বাস ঘটে। নিয়মের সঙ্গেই অনিয়মের সখ্য আছে বলেই ভালোবাসর ঘরেও কখনো উঁচিয়ে উঠতে পারে অশান্তির ফণা। হায়দার আলি নিলুকে থাপ্পড় মারতে পারে এমন একটি ব্যাপার যেন তার স্বপ্নাতীত। আর তাই হয়তো চরম দুঃখে আর অপমানে কিংবা পরম বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো নিলু।

কিন্তু হায়দার আলি সেদিন সারা রাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি। নিদারুণ এক বেদনায় ক্লিষ্ট হতে হতে যেন মিশে যাচ্ছিলো মাটির সঙ্গে। যদিও পাশেই শুয়েছিলো নিলু, তবুও তার দিকে ফিরতে কিংবা তাকে ছুঁতে খুবই সংকুচিত বোধ করছিলো। অথচ তার খুবই ইচ্ছে হচ্ছিলো নিলুকে বুকের ভেতর টেনে নিতে। ইচ্ছে হচ্ছিলো ভুল স্বীকার করে নিতে। আদরে আদরে স্ত্রীর যাবতীয় কষ্ট ভুলিয়ে দিতে। কিন্তু সে কিছুই পারেনি।

বেশিক্ষণ শুয়েও থাকতে পারেনি। অসহ্য বোধ হচ্ছিলো নিলুর নিরব উপেক্ষা। মনে হচ্ছিলো মরে পড়ে থাকা ভাগাড়ের কোনো জন্তু। যার মৃত্যু সংবাদ এখনও শেয়াল-কুকুর কিংবা কাক-শকূনের দৃষ্টিগোচর হয়নি।

নিলু যদি খানিকটা অনুযোগ করতো কিংবা বলতো কেন মারলো? তাহলেও হয়তো একটি আপস রফার সুযোগ সৃষ্টি হতো। কিন্তু নিলুর নিরবতা তখন ভুবন মাস্টারের লিকলিকে বেত্রাঘাতের চাইতেও আরো যন্ত্রণাময় হয়ে ক্রমাগত বিদ্ধ করছিলো তাকে। তাকে ডুবিয়ে দিচ্ছিলো হতাশা আর অনুশোচনার গহন অন্ধকারে।
একান্ত প্রিয় মানুষটির কাছে উপেক্ষিত, অপমানিত আর নিজের কাছেই ধিকৃত হায়দার আলি বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো বাইরের অন্ধকারে। বেরিয়ে এসেছিলো খানিক দম ফেলার প্রত্যাশায়। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে খানিকটা এগোতেই দেখতে পেয়েছিলো মন্নাফ মিয়ার বউ শাহেদাকে। রাতের বেলা শাহেদাকে বাইরে দেখে খুবই অবাক হয়েছিলো সে। এত রাতে বাইরে করছে কি?

সে তখন অন্ধকারেই নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরই দেখতে পাওয়া যায় আরেকটি নারীমূর্তি এগিয়ে আসছে। দু'জনে একই সঙ্গে নিচু স্বরে কিছু বলাবলি করে হাসতে হাসতে বাড়ির সামনের ক্ষেত ছাড়িয়ে প্রশস্ত মাঠের দিকে যায়। তাদের পিছু নিলেও হায়দার আলি বেশি কৌতুহল প্রকাশ করেনি। মাঠের অন্ধকারাচ্ছন্ন কাশ ঝোঁপের আড়ালে নারী পুরুষের সম্মিলিত চাপা হাসি আর কথাবার্তা শুনে সে ফিরে এসেছিলো। বাড়তি কৌতুহল তার নেই। নারী-পুরুষ যদি তাদের স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত না থাকতে পারে তাহলে কারো সাধ্য নেই তাদের পাহারা দিয়ে রাখে। কিন্তু এ ভেবে হায়দার আলি কষ্ট পেয়েছিলো যে, অভিসারের পাঁকে নিমগ্ন নারী-পুরুষগুলো প্রত্যেকেই বিবাহিত। তার মনে হয়েছিলো, এইই যদি করবে মনে ছিলো, তাহলে ঘটা করে বিয়ের কী প্রয়োজন? কী প্রয়োজন এমন একটি মিথ্যা আর অর্থহীন বন্ধনের? অনেক ভেবেও কোনো জবাব পায়নি সেই জিজ্ঞাসার। কিন্তু পরদিনই কাশের ঝোপটিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো সে। দূর থেকে অনেকেই দেখেছে আগুন লাগানোর বিষয়টি। সাদা আর কালচে ধোঁয়া পাক খেতে খেতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আকাশের পানে। কিন্তু আশ-পাশের ক্ষেতে কর্মরত লোকজনের তাৎক্ষণিক কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি তাকে। তবে ফিরে আসার সময় শাহেদা অস্ফুটে বলেছিলো, 'বাতার মুড়াডা পুইড়া ফালাইলা?'

মনের ভাব গোপন রেখে হায়দার আলি হেসে বলেছিলো, 'বাতা আর শনে আগুন দিলে পরের বছর ডবল অয়। তা ছাড়া চোর ডাকাইত নয়তো হিয়াল-কুত্তা মুড়ার মইদ্যখানে কেমন গোল কইরা বাতা ভাইঙ্গা থুইছে তুমি মনে কয় দেহ নাই!'

'কত ঘন একটা মুড়া!'

শাহেদার বিষন্ন মুখের কথাগুলো যেন কান্না হয়ে প্রবেশ করেছিলো হায়দার আলির কানে।

'বাইরে দিয়াই ঘন! ভিতরের দিগে বাতা ভাইঙ্গা সব্বনাশ কইরা থুইছে! তিনচাইরজন মানুষ হুইয়া থাকতে পারবো।'

হায়দার আলি একদৃষ্টে তাকিয়েছিলো শাহেদার মুখের দিকে।
শাহেদার চোখ দুটো কি কেঁপে উঠেছিলো? মুখটাও যেন কেমন পাংশু হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ।

মন্নাফ মিয়া খুলনা যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলো, 'তর ভাবির কিছু লাগলে খ্যাল রাখিস। মাইয়া মানুষ বাজারে গ্যালে আমাগ গ্যারামের পরধানরা অপমান হয়!'

তারপর হায়দার আলি মাঝে মধ্যে বাজার থেকে মাছ কিংবা তরিতরকারি, কখনো তেলটা নুনটা, কিংবা অষুধ-পথ্যও এনে দিয়েছে শাহেদাকে। একদিন হায়দার আলিকে ঘরে ডেকে নিয়ে শাহেদা হঠাৎ আঁচল সরিয়ে ডান দিকের স্তনটি তুলে ধরে বলেছিলো, 'দ্যাহ দেহি হায়দার, এইডার ভিতরের দিগে কেমুন একটা চাকা চাকা লাগে। আগে তো এমুন আছিলো না!'

হায়দার আলি ছুঁয়ে দেখেনি শাহেদার স্তন। ফিরেও তাকায়নি। বলেছিলো, 'ডাক্তারের কাছে যাও। নাইলে পরিবার পরিকল্পনার সাজেদা বুবুরে দ্যাখাও!'

হায়দার আলি শাহেদার উদ্দেশ্য যে একেবারেই বুঝতে পারেনি এমন গর্দভ সে নয়। কারণ তিন-চারমাস ধরে মন্নাফ মিয়া বাড়ি আসে না, সে শূন্যতা পূরণে শাহেদা তার দিকে হাত বাড়াতেই পারে। এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। ক্ষুধায় অন্ন না জুটলে মানুষ চুরি করতেও বাধ্য হয়। কিন্তু মানুষ খারাপ হলেও হায়দার আলি নারী-পুরুষের শারিরীক শূচীতায় বিশ্বাস করে। প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে জীবনের শুদ্ধতার। সামান্য একটু জৈব-লালসার কারণে দীর্ঘকাল ধরে লালন করা তার শারিরীক শুদ্ধতা কোনোভাবে নষ্ট করতে চায়নি। তার মতে যে নারী তার স্ত্রী হবে, তাকে ছাড়া ভিন্ন নারী স্পর্শ করা অনুচিত। এমন কি পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হওয়াও উচিত নয়। কিন্তু বাসুদেব বলে, 'যার মন যা চায় করুক না। তর ইচ্ছা না করলে তুই করিস না!'

হায়দার আলি বিস্মিত হয়ে বলেছিলো, 'তাইলে কুত্তা-বিলাই আর মানুষে ফারাক থাকলো কি?'

বাসুদেব হেসেছিলো। বলেছিলো, 'তাইলে তুই সইন্ন্যাসী হ! বনে-জঙ্গলে গিয়া থাক!'

হায়দার আলি বাসুদেবের বাঁকা কথা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ক'দিন পরই শাহেদা আবুলকে দিয়ে খর্চাপাতি আনানো শুরু করেছিলো। এবং শেষ পর্যন্ত কাশের ঝোঁপে মেতে উঠেছিলো নৈশ অভিসারে।

আসলে সে এখন নিজকে একটি গর্দভ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না। কারণ এ জীবনে অনেক নারীই তাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু সে বুঝেও কেন যে সাড়া দেয়নি বুঝতে পারে না। যেমন, রিতা যখন একা থাকতো, অনেক দিনই তার অনুরোধে কাচারি ঘরে ঘুমোতো হায়দার আলি। মাঝে মধ্যে সকালের কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও সে বিছানায় পড়ে থাকতো এমনি এমনিই। তখন আধো অন্ধকারে দেখেছে, রিতা তার পায়ের সঙ্গে উরুর ঘষা লাগিয়ে জানালা খুলে দিচ্ছে কিংবা চৌকির নিচে কিছু দেখার জন্য উবু হয়েছে। কখনো ইচ্ছে করেই পিঁপড়া কিংবা মশা তাড়ানোর ছলে হাত বুলিয়ে দিতো বুকে, গালে। তা ছাড়া প্রায়ই তাকে খবর দিয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়ে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়তো ঘর ঝাঁট দিতে। তখন অযাচিত ভাবেই যেন কাঁধ থেকে আঁচল খসে পড়তো ঘনঘন। তখন নিজের লোভী দৃষ্টিকে সংযত করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ ফেরাতো হায়দার আলি। তাকিয়ে থাকতো অন্যদিকে। যদিও রিতা ভান করতো ব্যাপারটি বেখেয়ালে ঘটেছে। কিন্তু হায়দার আলি ঠিকই বুঝতে পারতো। কিন্তু কখনো আগ্রহ দেখায়নি।

অনাগ্রহের ব্যাপারটি সত্য নাও হতে পারে। সাহসের অভাবের কারণেই হয়তো তার মনে নিরাসক্ত বা নির্বিকার ভাবটির জন্ম হয়ে থাকতে পারে। জন্ম হয়ে থাকতে পারে শুদ্ধতার মত মনগড়া এক অসার দর্শন। পরে গঙ্গাধর পালের সঙ্গে যখন রিতার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল তখন সপ্তাহ খানেক আগে একদিন ভর সন্ধ্যায় তাকে একা পেয়ে বললো, 'আমার লগে পলাইতে পারবি?'

অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো হায়দার আলি। যেন এই জীবনে এর চেয়ে আশ্চর্যজনক কথা সে আগে কখনো শোনেনি। তবুও সে বিস্ময়ের ঘুর্ণি থেকে উজিয়ে উঠে বলেছিলো, 'কই যাইবা?'

'অনেক দূর! যেই গ্যারামে বিজলি বাতি নাই। টিভি-ভিসিআর নাই। সুরুজ ডুইব্যা গেলে মানুষ কেরসিনের বাত্তি জ্বালাইয়া রাইতে ভাত খায়। এমন একটা জাগায়!'

বলার সময় রিতার দু'চোখে যেন সত্যি সত্যিই দূরলোকের এমন কোনো একটি গ্রামের ছবি ভেসে উঠেছিলো। যে অন্ধকার গ্রামের কোনো একটি ঘরের জানালা দিয়ে টিমটিম করতে দেখা যাচ্ছে কুপি বাতি কিংবা হ্যারিকেনের আলো।

তারপরই অকস্মাৎ রিতা তার হাত চেপে ধরে বলেছিলো, 'যাবি? তুই রাজি থাকলে কাইল বিয়ানেই আমি রঞ্জিতা মাসীর বাইত্যে যামু গিয়া। সন্ধ্যার সময় ইস্কুলের সামনে থাকবি। দুইজনে এক লগে মেলা করমু!'

হায়দার আলি রিতার স্বপ্নাতুর উজ্জ্বল দু'চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, 'কী কও পাগলের মতন? তুমি না আমার দিদি!'

রিতা হঠাৎ কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েও ফের ঝলমলে হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে বলে উঠেছিলো, 'ধুরো পাগল! এমনিই তর লগে মজা করলাম! আমার তো কাইল-পরশু বাদেই বিয়ার সাজন শুরু অইবো!'

রিতা তখন ফিরে গিয়েছিলো হাসিমুখেই। কিন্তু সেই রাতেই সে বিষ খেয়ে মারা গেল। রিতার আকস্মিক আত্মহত্যার কারণ খুঁজে না পেয়ে সবাই কেমন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো হায়দার আলি নিজেও।

চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে হায়দার আলি নিঝুম খালপাড়ে বসেবসে ভাবে যে, আসলেও সে খুবই অন্যায় করেছে রিতার সঙ্গে। হয়তো তার অবজ্ঞা সে সহ্য করতে পারেনি। তা ছাড়া সময় মত বিয়ে না হওয়ার কারণে কোনো নারীর আসক্তি বা ভালোবাসার স্রোত অপাত্রে গড়িয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। সেও মনে হয় কম ভালোবাসতো না রিতাকে। কিন্তু রিতা বেঁচে থাকতে ব্যাপারটা কখনোই অনুধাবন করতে পারেনি। মনে মনে রিতার আত্মার উদ্দেশ্যে বলে, 'দিদি, তুমি আমারে মাপ কইরা দিও। আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পারি নাই!'

আর হঠাৎ করেই রিতার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দু'চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে। এতদিন এত কষ্ট সে কিভাবে মনের ভেতর লালন করে এসেছে, তা তো টের পায়নি কখনো!

রিতার জন্য কাঁদতে কাঁদতে তার মন অকস্মাৎ ধাবিত হয় নিলুর দিকে। নিলুকে যে এত কষ্ট দিয়েছে, অত্যাচার করেছে, সেই কারণে যদি নিলুও বিষ খায় বা গলায় দড়ি দেয়? না, সে কোনো কিছুর বিনিময়েও নিলুকে হারাতে চায় না। নিলুর জন্যই সে এখনো বেঁচে আছে। নিলুই তার যাবতীয় স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা আর আনন্দের উৎস। আর যদি বাঁচতে হয়, তাহলে তাকে নিলুর জন্যেই বাঁচতে হবে। বাঁচতে হবে তার নিজেরই দেহ-প্রাণের আরেকটি সংস্করণ নজর আলির জন্যে।

সে মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে যে, নিলু আর নজর আলিকে নিয়ে এমন কোনো এক গ্রামে চলে যাবে, যেখানে এখনো মানুষ সন্ধ্যার পর কেরসিনের আলো জ্বালিয়ে ভাত খায়। আর এ কথা মনে হতেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে খালের পাড় ধরে দ্রুত পদক্ষেপে হাঁটতে থাকে সে। এখনই যত দ্রুত সম্ভব তাকে পৌঁছুতে হবে নিলুর কাছে। এ ক'দিনে ঘটনা কোন দিকে মোড় নিয়েছে তাও তার অজানা।

কিন্তু নানা কথা ভেবে এলোমেলো পদক্ষেপে হাঁটতে হাঁটতে সে খেয়াল করে না পেছন পেছন কালো পোশাকে আবৃত কতিপয় অস্ত্রধারী চাঁদের আলোয় ভূতের ছায়ার মত হালকা পদক্ষেপে নৃত্য করতে করতে ধাওয়া করছে তাকে।

খালের উপর বাঁশের সাঁকোটির কাছে পৌঁছুতেই অকস্মাৎ পেছন থেকে কর্কশ কন্ঠে ভেসে আসে, 'হায়দার আলি!'

নিজের নাম শুনে চমকে একবার মাত্র ফিরে তাকাতে পারে হায়দার আলি। আর তখনই দেখতে পায় ঠাঠা বিকট শব্দে তার দিকে ছুটে আসছে বিন্দু বিন্দু আগুনের টুকরো। কিন্তু সেই আগুনের টুকরো তার দেহের কোথায় আঘাত হানে টের না পেলেও অকস্মাৎ তার শরীর কেমন ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ে খালের পানিতে। প্রায় বোধহীন শরীরে সে প্রাণপণ চেষ্টা করে সাঁতরে খাল পেরিয়ে যেতে। না হলে নিলু কিংবা নজর আলি কারো মুখই হয়তো দেখতে পাবে না আর।
(সমাপ্ত)


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আপনার গল্পগুলোতে মানুষের মনের ভেতরের যে দ্বন্দ, সেগুলো খুব চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে।
ভালো লাগলো।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

সুপাশিমুল, পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অনুভূতির খেলাগুলো ভাল্লাগলো।
_______________
বোকা মানুষ মন খারাপ

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

অপ্র, পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।