দীর্ঘকায় এ লেখাটিকে যদি কেউ বিজ্ঞাপন ভেবে বসেন তাহলে বোধ করি খুব একটা অন্যায় হবে না। ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে তেমন মনে হলেও ভিন্ন কিছু বলতে চাই বলে লেখাটি খানিকটা বিজ্ঞাপনীয় অবয়ব পেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু আমার বলার ছিলো যে, গল্প-ঔপন্যাসিকের জীবনও যে তাঁর গল্প-উপন্যাসের বিষয় নয় তা অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করতে চান না।
পাঠক কিংবা লেখক হিসেবে বলতে পারি যে, গল্প বা উপন্যাসের সবগুলোই কিন্তু লেখকের ব্যক্তি জীবনের ঘটনাপুঞ্জ নয়। হয়তো বা কোনো কোনোটি। কিন্তু তাই বলে যে, প্রতিটিই লেখকের ব্যক্তিগত ঘটনা তা কী করে সম্ভব? যেমন, হুমায়ূন আহমেদের কথাই ধরা যাক। আমাদের দেশে সর্বাধিক উপন্যাসের লেখক তিনি। হয়তো দুই বাংলাতেই। কিন্তু ক’টি উপন্যাসে তাঁর ব্যক্তি জীবনের ছাপ আছে? তা আমরা কেউ ঠিক করে বলতে পারি না হয়তো। আমার মত এমন আরো অনেকেই আছেন যাঁরা হুমায়ূন আহমেদের বা ইমদাদুল হক মিলনের সবগুলো লেখা পড়েননি। হয়তো আমারই মত কোনো কোনোটি ভালো লাগেনি বা সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তাই বলে তাঁদের প্রতিটি উপন্যাসই ব্যক্তি জীবনের কাহিনী কী করে বলি! তবে এ কথা বলা যায়, কখনো কখনো দু একটি ঘটনা যা লেখকের ব্যক্তিগত জীবনেরই খানিকটা ছিটেফোঁটার মত গল্প-উপন্যাসে এসে যেতে পারে। যা কখনো লেখকের অজ্ঞাতেই ঘটে যায়। কিন্তু লেখক যদি সবগুলো উপন্যাসই ব্যক্তিগত ঘটনার আলোকে লিখতে চান, তিনি হয়তো সারা জীবনে কায়-ক্লেশে বড়জোর দশটি উপন্যাস লিখতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু তাই বলে শতাধিক? অসম্ভব!
লেখকের মূল আশ্রয় কল্পনা। হয়তো কখনো বাস্তব কোনো ঘটনার উপর দাঁড়িয়ে গল্পের জালটা বুনতে আরম্ভ করলেও কাহিনী এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর কল্পিত ঘটনাবলী বেরিয়ে আসতে থাকে। যে বাস্তবতার উপর তিনি গল্পটি শুরু করেছিলেন তা হয়তো এক দেড় প্যারাতেই হারিয়ে যায়। কিংবা গল্পটি শুরু করে দিলেও তিনি যা বলতে চান বা যে ঘটনার উপর ভিত্তি করে কাহিনী আরম্ভ করেছেন তা কখন সংযোজন করবেন কাহিনীতে সেই উপযুক্ত পরিবেশটির প্রতীক্ষায় থাকেন।
ই-স্নিপসের সংরক্ষণশালা থেকে আমার লেখাগুলো পড়ে অনেক পাঠকই ব্যক্তিগত ইমেইল করে জানতে চান নানা কথা। কেউ বলেছেন যে, এগুলো এভাবে না রেখে গ্রন্থাকার দেয়া যায় না বা কোনো ঈদসংখ্যায় ছাপানোর ব্যবস্থা করা যায় না? তখন আমি সবদিক বাঁচিয়েই কখনো কখনো ফিরতি মেইলে জবাব দিতে চেষ্টা করতাম।
পাঠকের কি আর দোষ? তাঁরা তো ভাবতেই পারেন যে, লেখক একটি উপন্যাস লিখলেই তা ঈদসংখ্যার সম্পাদকরা ছাপানোর জন্য মুখিয়ে থাকেন। কিন্তু অন্ধকারের পেছনেও যেমন অন্ধকার থাকে। অনেক সময় সাধারণ ঘটনার পেছনেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আড়াল হয়ে যায়। তেমনিই সব লেখকের লেখাই ঈদসংখ্যায় জায়গা পায় না। আবার দেশীয় পত্রিকার সম্পাদকীয় বৃত্তের কেউ না হলেও লেখা ছাপানোর সম্ভাবনা থাকে না। এমনি অনেক হ্যাপা।
যাই হোক, নিক্কণ উপন্যাসটি পড়ে একজন ক্ষুব্ধ পাঠক (মনে হয়েছে নারী) লিখেছিলেন, রহিমুদ্দির যা বয়স এ বয়সে কুলসুমির সঙ্গে প্রেম দেখানোটা ফাজলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তব জীবনে এমন ঘটনার কথা তিনি দেখেননি বা শোনেননি। পরে আরো কি না কি লিখে পাঠাবেন সে ভয়ে তার মেইলের কোনো জবাব দেইনি। অথচ আমারই ভাই প্রায় ষাট বছর বয়সে যার প্রথম সন্তানের বয়স ত্রিশ ছাড়িয়ে গেছে, ত্রিশের কোঠার রমণীর সঙ্গে প্রেম করে বিয়েও করে ফেললেন, অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদ-শাওন তো পুরো দেশই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই ক্ষুব্ধ পাঠক এমন ঘটনার কথা জানেন না তা কি করে সম্ভব?
আবার কম্পেন্ডার উপন্যাসটি পড়ে তার পরের পর্ব আপন-পর পড়ার পর একজন পাঠক জানালেন যে, কম্পেন্ডারকে কেন আরেকটি ভিন্ন ফাইলে নিয়ে গেলাম। তা তো একটি ফাইলেই সংকুলান হয়ে যেতে পারতো। যেহেতু পিডিএফ করতে কাগজ কালি খরচের সমস্যা নেই বা আয়তনের কারণেও পরিত্যক্ত হওয়ার ভয় নেই। এভাবে আরো কয়েকজন পাঠক দুটোকেই একত্রে গ্রন্থিত করতে অনুরোধ করেছেন বলে, সেটা করে দিয়েছি। কিন্তু কেউ কেউ যখন সোভানের সঙ্গে আমাকেও গুলিয়ে ফেলেন বা বাঁধের সে ঘটনাপুঞ্জ বা বন্যাপরবর্তী ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ্য করেছি কিনা জানতে চান, তখন সত্যিই আমি অসহায় বোধ করি। মনে মনে আনন্দিতও হই এই ভেবে যে, কোনো কোনো পাঠক সত্যিই মন দিয়ে আমার হাবিজাবি পড়েন।
কম্পেন্ডার উপন্যাসটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুটো পর্বই কাল্পনিক। অথচ পাঠকের মনে হয়েছে কম্পেন্ডারের জীবন বুঝি আমারই জীবনের আংশিক প্রতিচ্ছবি।
আমার ব্লগে পোস্টকৃত জরতী পড়ে ব্লগের সদস্য নন এমন একজন পাঠক জানতে চেয়েছিলেন যে, আমি বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরীর সঙ্গে জড়িত কিনা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, আমার জীবনে কখনো কোনো স্যুটিং দেখার অভিজ্ঞতা নেই। একবার উত্তরা নয় নাম্বার সেক্টরে হুমায়ূন আহমেদ কোনো একটা নাটক বা ছবির সুটিং করছিলেন। ঠিক আমাদের অফিসের সামনেই। এক নাম্বার রোডে। আলি জাকেরের হাতে একটি লাউ দেখতে পেয়েছিলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতবারই জানালায় এসে দাঁড়াচ্ছিলাম ততবারই দেখতে পেয়েছি হুমায়ূন আহমেদ স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো একটি ভিডিও ক্যামেরার ভেতর কিছু একটা দেখতে চেষ্টা করছেন।
আবার একজন লিখেছেন, যাতনা উপন্যাসের দীপা আর সচলে প্রকাশিত একটি বৃষ্টিমুখর প্রহর....এর মাসিতা কি একই?
আমি কী করে বলি যে তারা দুজনেই একজন কিংবা ভিন্নভিন্ন জন? একটি গল্প লিখতে গিয়ে যখন মোটামুটি দাঁড়িয়ে যায় তখন আমার মনে চরিত্রগুলো যেভাবে পরিদৃশ্যমান হয় তা আমার পরিচিত কারো মতই মনে হয় না। তাদের চেহারার সঙ্গে আমার প্রাত্যহিক জীবনে দেখা কারো সঙ্গেই মিল খুঁজে পাই না। তারা প্রত্যেকেই আলাদা। তাদের বিচরণ কেবল আমার মানস জগতেই। কিন্তু পাঠকরা যদিও জানেন যে, বেশিরভাগ গল্পই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু তবুও কখনো কখনো বর্ণনার কারণে চরিত্রটি প্রায় জীবন্ত হয়ে উঠলে স্বাভাবিক ভাবেই মনে জিজ্ঞাসা চলে আসতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, পদ্মানদীর মাঝি চলচিত্রটি দেখে কেউ কেউ নির্মাতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, কুবের সত্যিই একজন জেলে কিনা। কিন্তু আমাদের রাইসুল ইসলাম আসাদ যে চরিত্রটিতে অনবদ্য অভিনয় করতে পারেন তা প্রশ্নকর্তাদের কারো মনে হয়নি।
তবে লেখালেখির ক্ষেত্রে একজন লেখকের (আমি ছাড়া) সুবিধা এই যে, কোনো ঘটনার শুরুটাই নয়, কেবল আভাস টের পেলেই বাকিটা তিনি গল্পে বলে যেতে পারেন যা সত্যের কাছাকাছিও হয়তো হয়ে ওঠে কখনো। যেমন আগাথা কৃষ্টি তাঁর একটি উপন্যাসে (কোনো একটি ট্রেনে খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা।) মূল খুনীদের নাম নাকি আর একটু হলেই প্রকাশ করে দিচ্ছিলেন। যে কারণে একটি উপন্যাস বা গল্পকে আমরা হুবহু একই ঘটনা বা লেখকের ব্যক্তিগত জীবন ভাবলে হয়তো ভুল হবে। যদিও এতে আমাদের জীবনে বা আশপাশে ঘটে যাওয়া অনেক পরিচিত চিত্রেরই সন্ধান পাই। তবে এটুকু বলা যায় যে, কোনো গল্প-উপন্যাসের পুরো কাহিনীটিই অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো একটি ঘটনার আভাসের ওপর ভিত্তি করেই রচিত বা লেখক অনেকগুলো খন্ডচিত্রকে একই কাহিনীতে সন্নিবেশ করেন। যেখানে একটি খন্ড চিত্রের সঙ্গে আরেকটি খন্ডচিত্রের ব্যবধান হয়তো বিশ বছরেরও বেশি হতে পারে কিংবা দশজনের জীবনের দশটি ঘটনা দিয়েও তিনি লিখে ফেলতে পারেন ” মনভোলা নাট্যজন সচল নজরুলের চব্বিশঘন্টা।”
বিশেষ করে আমার কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয় যে, কোনো একটি বিশেষ বাক্য বা কয়েকটি মাত্র বাক্য বলার জন্যই একটি বিশাল গল্প ফেঁদে বসি। আমি জানি না সত্যিকার একজন লেখক কী ভেবে লেখা শুরু করেন। যদিও লেখকদের আরেকটি পরিচয় তাঁরা সমাজের চোখ। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে তেমন কিছু বুঝতে পারি না। কেবল বিশেষ বিশেষ কয়েকটি বাক্যকে গল্পের ভেতর ঢুকিয়ে দিতেই আমার আনন্দটা বেশি।
ছায়াম্লান দিন নামে একটি উপন্যাস প্রকাশায়তনের জন্য পোস্ট করবো বলে ঠিক করেছি। যেখানে বিতর্কিত কবিতা লেখার অপরাধে হত্যা করতে কোনো এক মৌলবাদী কবি প্রকাশ্যে পিস্তল হাতে কবি দাউদ হায়দারকে খুঁজে বেড়িয়েছেন কথাগুলো লিখতেই পুরোটা গল্পের আয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোন পত্রিকায় ঘটনাটি পড়েছি মনে নেই। তিয়াত্তর থেকে আটাত্তর এ সময়কালের কোনো একদিন হয়তো পড়েছিলাম। তখন আমি নিতান্তই বালক। কবির নাম মনে পড়লেও কিছুটা সন্দেহ রয়ে গেছে। তা ছাড়াও পত্রিকার নাম, সংখ্যা, তারিখ জানাতে পারবো না বলে কবির নামটা উল্লেখ করিনি। যদি কবি দাউদ হায়দার (কবির ইমেইল ঠিকানা দয়া করে কেউ দিন! জার্মান প্রবাসী সচলদের কাছে সবিনয় অনুরোধ ও দাবী।) এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিয়ে আমাকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারেন, তাহলে সেটাকে প্রামাণ্য হিসেবে ব্যবহার করে পরবর্তীতে কখনো কবিটির(!) নাম উপন্যাসে উল্লেখ করবো।
পরিশিষ্ট:
এ লেখাটি সচলায়তনে পোস্ট করবো বলে লগইন করার আগে জিমেইলে দেখি একজন পাঠক জানতে চেয়েছেন, মানুষের মন কেন শেষ করছি না? তাই আবারও সময় নিয়ে খানিকটা দেখে পুরোটাই পিডিএফ করে আমার ই-স্নিপসের সংরক্ষণশালায় তুলে সচলদের জন্যও পরিমার্জিত মানুষের মন-এর লিংক এখানে দিয়ে দিলাম। বাকিটুকু পোস্ট করার দীর্ঘসূত্রীতার ঝামেলা থেকেও বাঁচলাম মনে হয়!
http://www.esnips.com/doc/40d13f09-c77a-4f3d-880d-2d4d839c8595/Manusher-Mon_Juliansiddiqi
মন্তব্য
আপনার গদ্যের প্রভূত উন্নতি হয়েছে।
সচলায়তন ও অন্যান্য জায়গায় আপনার অনেক উপন্যাস বা গল্প দেখেছি। কিন্তু নেটে ঠিক এরকম লেখা পড়ি না বলে পড়া হয় নাই। কিন্তু অন্যান্য ব্লগারের মন্তব্য থেকে বুঝেছি আপনি খুবই পাঠকপ্রিয় একজন লেখক।
আপনার লেখা ঈদ সংখ্যায় প্রকাশ না সত্যিকার হওয়ার কারণ সন্ধান করুন।
যদি ইস্নিপে হামলা দিয়ে আপনার কোনো লেখা পড়েই ফেলি তবে নিশ্চই একটা সমালোচনা লিখবো।
শুভেচ্ছা।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন... ...সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
ধন্যবাদ। কিন্তু লক্ষনে মনে হচ্ছে কোথাও একটু ঘাপলা করে ফেলেছি। সমালোচনা পেলে আবার ধন্যবাদ
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
লেখাটা ভালো লেগেছে।
পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন