কামরানকে হাসপাতালে ভর্তি করানো থেকে তার আত্মীয় স্বজনকে সংবাদ দেয়া নিজের জন্য কেনাকাটা নিয়ে দিন তিনেক খুবই ব্যস্ততায় কাটলো রাহুলের।
যদিও হেনা বলেছিলো সে সময় দিতে পারবে না। কিন্তু সে কাজে যাওয়া বন্ধ রেখেই বলতে গেলে সেঁটে রইলো রাহুলের সঙ্গে। যদিও রাহুল এতে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু মনের কোথাও যেন একটু অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে বিঁধছিলো।
হেনা হয়তো জেনে বুঝেই তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে সর্বান্তকরণে। তবুও তার মনে হচ্ছিলো বেচারা কামরান এর কিছুই জানে না। তার স্ত্রী কখন অন্যের অধিকারে চলে গেছে, কখন তার বাহু বন্ধন থেকে খসে পড়েছে। এ দু’বছরে যেমন তার কিছুুই উপলব্দি করতে পারেনি, তেমনি তাকে ঘুম পাড়িয়ে সে অবসরে হেনা কোন জগতে চলে যাচ্ছে তাও উপলব্ধি করতে পারছে না। কামরানের জন্য খুবই খারাপ লাগছিলো রাহুলের। হেনা এভাবে এতটা মুখিয়ে ছিলো সেই বা কী করে আগে থেকে অনুমান করবে?
দু’তিনদিনে হেনাও যেন তার পুরোনো খোলস ছেড়ে নতুন হয়ে উঠেছে। এতদিনকার হারিয়ে যাওয়া ছন্দ যেন সে আবার ফিরে পেয়েছে। কিন্তু তার নবরূপ দেখে কামরান ভাবে অন্যটা। সে ধরে নেয় তার চিকিৎসা করানোর আনন্দে কিংবা সে আবার সুস্থ হয়ে হাঁটাচলা করতে পারবে ভেবেই হয়তো ফের উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছে হেনা। তাই তার মুখাবয়বও ছিলো বেশ প্রসন্ন। একটি বারের জন্যও সে প্রশ্ন করেনি যে, তার চিকিৎসার জন্য এতগুলো টাকা কিভাবে ম্যানেজ হলো? কে দিলো? কেনই বা দিলো?
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দিন কামরান যেন অন্য মানুষ। হয়তো সে ধরেই নিয়েছিলো যে, তার ভবিষ্যত হুইল চেয়ারেই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু যখন জানলো সে সত্যিই সুস্থ হয়ে উঠতে যাচ্ছে, তখনই জেগে উঠলো তার স্থবির হয়ে পড়া কাব্য প্রতিভা। খুব ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই সে একটানা লিখে চললো। সবাই জেগে ওঠা অবধি সে লিখলো। মিথিলার পুরোনো চার নাম্বার খাতা দু’টো কবিতা লিখে ভরিয়ে ফেলেছে। রাহুলকে দেখতে পেয়ে সে বলে উঠলো, জেগে উঠছি। যেন বেঁচে উঠছি আবার! ভাবতে পারিনি আর কখনো কবিতা বের হবে আমার মাথা থেকে!
রাহুল বললো, একজন কবির বেঁচে থাকাই হচ্ছে কবিতার মাঝে। সে যখন কবিতা লেখা ভুলে যায় কিংবা থেমে যায় তার সৃষ্টিশীলতা, তখনই একজন কবির প্রকৃত মৃত্যু হয়। তখন বেঁচে থাকে তার কায়া।
কামরানের দাড়ি-গোঁফে পূর্ণ মুখাবয়বে যেন আলোর দ্যূতি চমকাচ্ছে বারংবার। হেনাকে ডেকে সে বললো, হেনা, আমি আবার বেঁচে উঠছি মনে হয়!
একজনের আবেগ অনেক সময় তার পার্শ্ববর্তী বা সম্মুখের জনকেও কখনো কখনো ছুঁয়ে যায়। হেনাও যেন প্রাণ চাঞ্চল্যে অভিসিক্ত হয়ে বলে উঠলো, আমরাও চাই তুমি বেঁচে ওঠো। পুরানো দিনগুলার মত টিএসসির মঞ্চ আবার তোমার কবিতার ছন্দে কাঁইপা উঠুক!
রাহুল কেমন মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো হেনার মুখের দিকে।
হেনা আবার বললো, তুমি কি নিজে নিজে দাড়ি-গোঁফগুলো কাটতে পারবা? নাকি নাপিত আসতে বলবো?
কামরান হেসে উঠে বললো, কষ্ট করে যদি ব্লেড-রেজর, সাবান আর পানি এনে দিতে পারো তাহলে দশ মিনিটেই চেহারা পাল্টে ফেলবো।
তোমাকে আর কিছুুক্ষণ পরই হাসপাতালে নিয়ে যাবো। অ্যাম্বুলেন্স আসতেছে।
এ পর্যন্ত হেনার পরিবর্তনটা কারো চোখে না পারলেও কাজে যাওয়ার সময় মিথিলা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, আপু তোমারে আজকে খুবই সুন্দর লাগতেছে!
হেনা কেমন চমকে উঠে তাকালো রাহুলের দিকে। রাহুলের চোখে চোখ পড়তেই তার মুখাবয়ব আরক্ত হয়ে উঠলো একই সাথে।
সে নিজকে আড়াল করতে বা লজ্জা ঢাকতেই হয়তো কামরানের দাড়ি-গোঁফ কাটার সরঞ্জামের যোগাড়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে কামরানের সামনে সেগুলো রেখে হেনা রাহুলকে বললো, তুমি বলতেছিলা না যে, তোমার গ্রামের বাড়ি যাওয়া দরকার?
হেনার কথা শুনে কামরান আর রাহুল দু’জনই চমকে উঠে ফিরে তাকায়।
হেনা এতটাই টগবগ করছে, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সে কি করছে বা বলছে তাও হয়তো খেয়াল করতে পারছে না। একই উচ্ছ্বাসে আবার বললো, আমাদেরে হাসপাতালে দিয়াই তুমি চইলা যাও! তেইশ তারিখে এখানে চইলা আসবা আর এয়ারপোর্টেও এখান থাইকাই যাইবা!
এতক্ষণে কামরান কৌতুহলী হয়ে উঠলো রাহুলের ব্যাপারে। বললো, হঠাৎ করে এয়ারপোর্ট কেন?
আরে তুমি তো কিছুুই জান না! বলে, খানিকটা কামরানের দিকে এগিয়ে গিয়ে হেনা আবার বললো, ওর শ্রীলঙ্কায় চাকরি হইছে! আমাদের আগের মালিক নাকি সেখানে একটা ফ্যাক্টরি ভাড়া নিছেন। চব্বিশ তারিখ ফ্লাইট!
কামরানের মুখের উজ্জ্বলতা নিমেষেই যেন ম্লান হয়ে যায়। বিষাদ কন্ঠে বলে, একেই হয়তো ছাপ্পড় ফেড়ে পাওয়া বলে। রাহুল সাহেবের সব অপূর্ণতাই পূর্ণ হয়ে উঠছে!
রাহুল কামরানের কথা শুনেই মনে মনে কেমন শক্ত হয়ে উঠলো। কামরান কি তাহলে সবই ধরতে পেরেছে? হেনার উচ্ছ্বলতা, কাজে না গিয়ে রাহুলের সঙ্গে নানা ছুতোয় লেপ্টে থাকা! এমন কি তার সামনেই হঠাৎ করে দীর্ঘদিনের পরিচিতের মত তুমি তুমি করে বলা!
তখনই সে ঠিক করে ফেলে যে, গ্রামের বাড়িই যাবে। যদিও সে ভেবেছিলো কামরানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরই যাবে। কিন্তু মানুষের মনের ভেতরটা যদি গোপনে গোপনে রঙিন হয়ে ওঠে তা সে কোনোভাবেই আড়াল করতে পারে না। আর নিজের অজান্তেই কথায় আর কাজে স্ফুরিত আবেগ উচ্ছ্বাসের কারণেই প্রকাশ হয়ে যায় তার গোপনে কিছু ঘটে যাবার ব্যাপারটা। কিন্তু ঘটনা যদিও সবাই আঁচ করতে পারে না, তবুও আড়ালে আড়ালে কিছু একটা ব্যাপার যে ঘটেছে বা ঘটছে তা নিশ্চিত হয়ে যায়। হেনার জীবনে তেমনি কোনো নতুন একটা কিছু হয়তো আঁচ করতে পেরেছে কামরান। আর সে কারণেই তার উজ্জ্বল মুখ হঠাৎ করেই যেন বিষাদে ছেয়ে গেছে।
রাহুল বললো, অ্যাম্বুলেন্স আসবে দশটার দিকে। আপনারা সব দিক সামাল দিতে পারবেন তো?
হেনা ঝলমলিয়ে উঠে বললো,অসুবিধা নাই! আম্মা আর শান্তাও যাইতেছে!
ঠিক আছে। তাহলে দেরি করে লাভ নেই। হাসপাতালে নামিয়ে দেয়া যে কথা, এখান থেকে চলে যাওয়াও একই কথা।
তা অবশ্য ভুল বল নাই! বলে, তখনই হেনা আবার রাহুলের একটি বাহু ধরে বলে উঠলো, তেইশ তারিখে এখানে আইসাই উঠবা কিন্তু!
রাহুল একবার কামরানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, চলি!
তারপরই সে ব্যাগটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়।
কামরান পেছন থেকে বলে উঠলো, হাসপাতালে আমাকে দেখতে আসবেন কিন্তু!
রাহুল পেছন ফিরে তাকাতে পারে না কামরানের দিকে। তার ভয় হয় কামরানের চোখে সে পানিই দেখে কি না। সে পেছন না ফিরে একবার মাথাটা কাত করে শুধু।
(সমাপ্ত)
মন্তব্য
শেষটা কেমন জানি হয়ে রইল। মনে হচ্ছে শেষ হয়নি সবেমাত্র শুরু।
এস হোসাইন
----------------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"
তবুও তো জানা গেল। অনেকে তো তা বলতেও ...
পাঠের জন্য ধন্যবাদ।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
আগেরগুলোই এখনো পড়তে পারি নাই... পুরোটা একবারে পড়বো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
কী আর করা!
ধন্যবাদ।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন