ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে জংশন পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে এর সঙ্গে সঙ্গে রেলওয়ে ওয়ার্কসপটিও বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরপরই বলতে গেলে এটির মৃত্যুই হয়। কিন্তু কোনো কিছুর মৃত্যু হলেও আদৌ কি মৃত্যু পুরোপুরি ঘটে? মানুষ যদি হয় তাহলে সে বেঁচে থাকে তার প্রিয়জনদের মনে। কিংবা কোনো সরণীর মাঝে বা আশেপাশের কোনো প্রতিষ্ঠানে স্মৃতিস্তম্ভের আকারে। কখনো বা সমাধির এপিটাফের লেখায়। তাই মৃত্যুকে কখনোই হয়তো বা পুরোপুরি মৃত্যু আখ্যা দেয়া সম্ভব হবে না। এই যে বললাম, রেলওয়ের ওয়ার্কসপটির মৃত্যু হয়েছে। সত্যিকার অর্থে তারও কিন্তু পুরোপুরি মৃত্যু ঘটেনি বলা যায় নির্দ্বিধায়।
কারণ ওয়ার্কসপের নানা খোপে বা কলকব্জার ফাঁক-ফোকরে বাস করতো অনেক কবুতর। যেগুলোকে কেউ কেউ জালালি কবুতর বলেও জানতো। মাঝেমধ্যে চালু হতে দেখা যেত ওয়ার্কসপের নানাবিধ যন্ত্রপাতি। দূর থেকে শোনা যেতো সেখানকার ভারী ভারী মেশিন পত্রের চাকা ঘুরবার ঘড়ঘড় বা ঘটাং ঘটাং শব্দ। তারও আগে মেশিন চালু হওয়ার শব্দে আকস্মিক ভাবে শতশত পায়রা ঝাঁক বেঁধে উড়াল দিতো আকাশে। যেন পাখা দিয়ে ঢেকে দেবে আকাশের ললাট।
স্বাধীনতার পরপরই শহর ত্যাগী মানুষেরা ফিরে আসতে থাকে আস্তে ধীরে। লোকালয় থাকলেই সেখানে লোকজন থাকবে কথাটি বলা নিতান্তই বাহুল্য মনে করি। লোকজন নিয়েই তো গড়ে ওঠে লোকালয়। আর লোকালয় আছে বলতেই বলতে হয় এখানে আছে প্রায় সব পেশাজীবীর বাস। ফলে পরিত্যক্ত রেল লাইনগুলোর নিচে পেতে রাখা ভারী কাঠের স্লিপারগুলো দিনকে দিন কমতে লাগলো এক এক করে। সেই সঙ্গে আলগা হয়ে যাওয়া রেলের পাত বা রেলের লাইনগুলোও কমতে থাকে একই নিয়মে। রাতের বেলা কারা এসে সেগুলোকে খুলে বা ইস্পাত কাটার করাত দিয়ে কেটে নিয়ে যায়। এ জন্যে কেউ কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করে না। কিংবা দিনের বেলা কয়েকজন খাকি প্যান্ট আর খাকি হাফ-সার্ট পরা লোকজন ট্রলিতে করে কখনো ঠেলায় করে কখনো বা কয়েকজন মিলে একটি রেলপাত কাঁধে করে নিয়ে যায়। এ দেখেও কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করে না। রাস্তায় তেমন একটা মানুষজনেরও গতগম্য নেই। যাও মাঝে মধ্যে দু একজন পথচারী দেখা যায়, তাতেও তাদের চেহারায় যেন ফুটে থাকে রাজ্যের তাড়া বা সমগ্র জীবনের দুশ্চিন্তা ভর করে আছে মাথায়। কাজেই কেউ কারো দিকে দৃষ্টি তুলে তাকাবারও হয়তো অবসর নেই। পাহারা দেবার জন্য দিনরাত আছে ওয়াচম্যান। তবুও তাদের যেন কোনো হাঁকডাক নেই। বাঁশি থাকলেও তাতে ফুঁ দেবার আগ্রহ যেন নেই। যে যাই করুক ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অথবা একটি পরিত্যক্ত অফিস (স্থানীয় রেলওয়ের অয়্যারলেস বিভাগের একজন ছোটখাট কর্মকর্তার নামে বরাদ্দ হলে সেটির পরিচয় হয় এল বাই এক’শ ত্রিশ) এর টিনশেডের নিচে পরিত্যক্ত কাঠের বেঞ্চে বসে ঝিমোনো ছাড়া যেন ভিন্ন কিছু করবার নেই। এমন নির্বিকার ভাবে দিনগুজরান করা খুব কঠিন হলেও ওয়াচম্যানদের মাঝে কোনো বিকার লক্ষ্য করা যায় না।
দেখতে কালো মত একজন বুড়ো বয়সের ওয়াচম্যান ছিলেন। গালভাঙা মুখে সাদা দাড়ি থাকলেও মাথায় কোনো চুলের অবশিষ্টও ছিলো না। সেই বুড়ো ওয়াচম্যান ভদ্রলোকের নাম কে জানতো কে জানে। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো দুষ্টু ছেলে বা মেয়ে দূর থেকে ’কালাবেল’ বা ’কালাতেল’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেই বুড়ো ভদ্রলোক হাতের ব্যাটন নিয়ে মুখে বিচিত্র ধরনের খিস্তি করতে করতে তেড়ে যেতেন। বলতে গেলে তার ডিউটির বাকি সময়টুক যেন বাতাসের সঙ্গেই খিস্তি করে কাটতে থাকতো। তারপরও রেলওয়ের নাটবোল্ট, জংধরা চাকা, নিদেন পক্ষে এক টুকরো লোহার জন্য হলেও অনেকে অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকে দিনের বেলা।
এভাবেই রেলের লাইন স্লিপার নাটবোল্ট উধাও হয়ে গেলেও এখানে মানুষজনের আনাগোনা ফুরোয় না। থামে না শতশত ধূসর পায়রার উড়াউড়ি। কখনো বা শখের শিকারী আসে এয়ারগান হাতে নিয়ে। দু’একটি পায়রার মৃত্যু বা আহত হওয়াকে কেন্দ্র করে ঝাঁকেঝাঁকে পায়রা উড়ে গিয়ে ঢেকে ফেলে আকাশের নীলচে চেহারা। আর এভাবেই কারণে অকারণে সকাল-সন্ধ্যা ভীত-চকিত পায়রার উড়াউড়ি সত্ত্বেও আরো একদল মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। তাদের গায়ের পোশাক আশাক যেমন শতচ্ছিন্ন আর মলিন, গায়ের রঙ বা চেহারাও অনেকটা তেমন। তাদের স্থায়ী কোনো আশ্রয় নেই। পরিত্যক্ত রেল লাইনের পরিত্যাক্ত ভূমিতে তারা যার যেমন কাগজ-পলিথিন টিন বা তর্জা দিয়ে ঘর উঠিয়ে নিয়েছে। ঘরগুলোকে দেখতে গ্রামাঞ্চলের গোয়ালঘরের চাইতেও ছোট আকৃতির মনে হয়। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ সে ঘরগুলোর ভেতর সোজা হয়ে দাঁড়াবার আগেই হয়তো পিঠ স্পর্শ করবে চালে। তেমন ঘরেই গাদাগাদি করে রাত পার করে দিয়ে ভোরের দিকে বালতি, চট কিংবা প্লাস্টিকের বস্তা আর তা না হলে নিদেনপক্ষে কেরসিনের পুরোনো টিন হাতে দলে দলে ঢুকে পড়ে ওয়ার্কসপ এরিয়ার ভেতর। দুপুর অবধি তারা সেখানে থাকে। ফিরে যাওয়ার সময় তাদের কাঁধে, কাঁখে বা মাথায় থাকে কালো রঙের কয়লা ভর্তি-কেরসিনের টিন-বস্তা বা বালতিগুলো। তাদের ম্লান চেহারাগুলো ঘাম-মাটি আর কয়লার কালি মাখামাখি হয়ে দেখায় আরো মলিন। কালচে। শ্রান্ত আর ক্ষুধায় চিমসানো। যাদের কয়লা সংগ্রহের পরিমাণ বেশি, তাদের ম্লান মুখে তখনো হাসি ফুটে থাকতে দেখা যায়। শোনা যায় তাদের উৎফুল্ল কণ্ঠের কলগুঞ্জন।
রেলওয়ের পরিত্যক্ত ওয়ার্কসপে কি কয়লার খনি থাকে? তাতো অবশ্যই না। কিন্তু কয়লা কুড়োনো মানুষগুলো কয়লা খনির সন্ধান ঠিকই করে নিয়েছে। যার ফলে কয়লাই ওদের স্বপ্ন আর ধ্যান-জ্ঞানও। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে চলতে থাকা ওয়ার্কসপে এসে থামতো কয়লা দিয়ে চালানো বাষ্পীয় ইঞ্জিন। আর ইঞ্জিনের অব্যবহৃত কয়লাগুলো ছুঁড়ে ফেলতো নিচে। যেগুলো দীর্ঘকাল ধরে আবর্জনা হিসেবে পরিত্যাক্ত হলেও আজ তা কুড়িয়েই জীবিকা নির্বাহ করছে এই কয়লা কুড়োনো মানুষগুলো।
ছোট ছোট খুন্তি বা খুরপি হাতে ওরা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে চালায় অনুসন্ধান। ঠিক যেখানটায় এসে থামতো ইঞ্জিনগুলো। কিংবা যেখান থেকে কয়লা নিয়ে প্রস্তুত হতো ইঞ্জিন বা ঠিক যেখানটায় গিয়ে দাঁড়াতো ইঞ্জিনের বয়লারে পানি ভর্তি করে নিতে। এমন বিশেষ বিশেষ কতগুলো জায়গায় দেখা যায় অপরিকল্পিত ছোট ছোট গর্ত।
সবুজ ঘাস ছাওয়া জায়গাটিতে খোঁড়া গর্তগুলোকে দেখলে হঠাৎ শরীরের ক্ষত বলেই ভ্রম হবে হয়তো। লাল দগদগে মাটি যেন সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। কয়লা কুড়োনো মানুষগুলোর কেউ কেউ টিনশেডটির নিচে এসে খানিক জিরোতে বল্লও তাদের সুখ-দুখের আলাপের ভেতরও ঠাঁই করে নেয় কয়লার গল্প। কিন্তু বেশিদিন আর হয়তো কয়লা কুড়োনো যাবে না। আগের মত তেমন একটা কয়লা মেলে না দিনভর মাটি খুঁড়েও। তদুপরি ওয়ার্কসপ এলাকাটি রেলওয়ে বিভাগ বিক্রি করে দিচ্ছে সি এন্ড বি’র কাছে। তখন হয়তো এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সংরক্ষিত হয়ে যাবে। আর সত্যি সত্যিই কিছুদিন পর এলাকাটি জুড়ে দেয়াল তোলার কাজ আরম্ভ হয়। তবুও দেয়াল টপকে চলে কয়লার সন্ধান। কিন্তু এক সময় দেয়াল উঠে পড়ে মানুষের মাথারও আরো উপরের উচ্চতায়। বন্ধ হয়ে যায় কয়লা কুড়ানো দলটির জীবিকার পথ। হয়তো তারাও বেঁচে থাকার তাগিদে খুঁজে নিতে বাধ্য হয় ভিন্ন কোনো পেশা। আর এভাবেই থেমে যেতে দেখি একটি কর্মচঞ্চল দলের আনাগোনাও।
মন্তব্য
৫ দিলাম। আর কী দিব ...
: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: :
'Cinema is over' - Master Godard
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
আমি ও পাঁচালাম।
বস্, কিছু বানান একটু ঠিক্করেদিয়েন। বানানের কথা কইলে কেউ রাগ করে কিনা কে জানে ?
কেবল বানান না বস, আমার কোনো দোষও যদি কেউ ধরে, তাইলে তারে মনে মনে খুবই মহব্বত করি। তবে উপর দিয়া ভাব দেখাই যে, আমার ইজ্জত ফুটা কইরা দিলো।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ নিবিড়।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
আপনি কতদিন ধরে ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলেন তো? এত্ত ডিটেইল, যেন চোখের সামনে দেখছি কিভাবে দৃশ্যপট থেকে একেকটা এলিমেন্ট মুছে মুছে যাচ্ছে।
একটা জীয়ন-কাঠি নিয়ে ছুঁইয়ে দেওয়াটাই বুঝি এখন বাকি ঐ লোকালয়ে...?
==========================================
পরদেশী বঁধু, ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি।
যদি গো নিশিথ জেগে ঘুমাইয়া থাকি,
ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি।।
সময়টা চুয়াত্তর-পঁচাত্তর সাল।
ক্লাস ফোর-ফাইভের পোলাপান যতটুকু পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
লেখা ভাল লেগেছে।
কয়েকটি অপ্রচলিত শব্দ পেলাম- গতগম্য, তর্জা।
ধন্যবাদ।
আজকাল শব্দগুলো কেউ তেমন একটা ব্যবহার করে না। তবে প্রাচীনদের মুখে এখনও কিছুটা শোনা যায়।
গতগম্য=চলাফেরা বোঝাতে এবং
তর্জা= বাঁশ বা মূলীর বেড়া-চাটাই বোঝাতেও এগুলো ব্যবহৃত হয় না। লেখায় তো নয়ই। তবে সময়টার কারণে ব্যবহার করেছি।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
আপনার চোখ আছে রে ভাই !!! লাল সালাম কবুলান আর খালি লিখা যান। হা কইরা বইসা থাকলাম।
সালাম আপ্নেরো।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
একটা রেলওয়ে-ওয়ার্কশপের জীবনের শেষটার এক অদ্ভূত বর্ণনা দিলেন!
----------------------------------
~জীবন অনেকটা জড়ই, কিন্তু অনন্য!~
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
চমৎকার লাগল।
==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
ধন্যবাদ কবি।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
জ্যন্ত একটা বর্ননা, যেন ভিডিও ক্যামেরার চোখে দেখলাম.....
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ। জেনে ভালো লাগলো।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
অভ্যাসটা নতুন, ছাড়ার চেষ্টাও করছিনা, বদ অভ্যাস হলে করতাম। - ছাড়পত্র...
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন