একটি সর্বৈব মিথ্যের ওপর নির্ভর করে এতটা পথ চলে আসা সত্যি সত্যিই চরম বোকামী হয়তো। হয়তো কারো কারো কাছে নিতান্তই ছেলেমানুষী কিংবা পাগলামীও মনে হতে পারে। কিন্তু শহিদুলের কাছে এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিলো। ঠিক ছিলো ঢাকা শহর থেকে এই উখিরচর অবধি চলে আসাটাও। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে অগ্রিম টিকেটের জন্য যখন সে গতকাল সকাল সাড়ে ন’টা দশটার দিকে গাবতলী বাস-কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছিলো তখনও ব্যাপারটা নিয়ে এতটা ভাবনা হয়নি। আর তখন কিংবা তার আগেও যদি মনের আনাচে কানাচে ভাবনাটা এক দু’বার হানা দিয়ে যেতো বা উঁকিঝুকি মারতো তাহলে হয়তো কিছু একটা করার সুযোগ থাকলেও থাকতে পারতো। কিন্তু এখন এতদূর চলে এসে পুরোপুরি ব্যর্থ হওয়ার পর নিজকে তিরস্কার করার চাইতে হয়তো বা ব্যাপারটা মেনে নেয়াই ছিলো বিগত কালের অনেক বিখ্যাত আর প্রাতঃস্মরণীয় বুদ্ধিমানদের মত নেয়া সিদ্ধান্তসমূহের একটি। নিজের ওপর প্রচণ্ড রেগে থাকলেও কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছিলো সে।
কথায় বলে না যে, চোর পালিয়ে গেলে তখন নানারকম কৌশলগত চিন্তা-ভাবনা আর যতরকম উদ্ভট বুদ্ধিসুদ্ধি এসে মগজের কোষে কোষে কিলবিল করতে থাকে। তেমনি শহিদুলের মনে হচ্ছিলো যে, মায়ের কথাটা যদি সে কানে তুলতো তাহলেই এই ধূলিময় চরে ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় অযথা হয়রান হয়ে মরতে হয় না তাকে। মায়ের কথাটা শুনলে হয়তো এতক্ষণে সে আরিচা ফেরতে থাকতো। পাশে হয়তো ফেরির উপরকার কেবিনের পাশের রেলিং ধরে পানির দিকে দৃষ্টি ফেলে আনমনা হয়ে থাকা অথবা দৃষ্টিতে অপার মুগ্ধতা নিয়ে দূরের ছোট-বড় নৌকাগুলো বা প্রায় ধূসর গ্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো লিজা অথবা লিসা জমজ বোনদের কেউ একজন। সময়টা হয়তো খারাপ কাটতো না তখন। এমনিতেই সে দুবোনকে বেশ পছন্দ করে। আহামরি সুন্দরী না হলেও একবারে কুৎসিত বা দৃষ্টিকটু বলা যাবে না। কিন্তু দুজনের একটি ব্যাপারে বেশ মিল আছে। আর তা হলো দুজনেই খুব হাসতে পারে। হাসতে হাসতে কখনো কখনো তাদের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। নয়তো বা পেট চেপে ধরে বসে পড়ে মেঝেতে। তাদেরই কেউ একজন যদি পাশে থাকে তাহলেই সময়টা কেমন যেন ঝরঝর করে কেটে যায়। মনেই হয় না যে, একঘেয়েমী বলে একটি শব্দ আছে। নদীতে চলমান ফেরির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লিজা বা লিসার চুলগুলো জল সাঁতরে আসা দুরন্ত হাওয়ায় এলামেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তো মুখের ওপর। মেহদী ছোপানো হাতের একটি বা দুটো আঙুলে চুল সরাতে যেয়ে মুখটাকে তুলে ধরতো খানিক, হয়তো তখন নদীর ঢেউয়ে বিচ্ছুরিত সূর্য্যকণা প্রতিফলিত হয়ে এসে আছড়ে পড়তো তার মসৃন গালে। আর তা দেখে সে হয়তো বা মুগ্ধ হতো। হয়তো তাকাতেই লজ্জা পেতো। তবুও এখনকার মত এমন যন্ত্রণাকাতর আর অনিশ্চিত সময়গুলোর চেয়ে ঢের ভালো কাটাতে পারতো সে সময়টা। কেন যে উখিরচর নামের চরটিতে আসার মত এমন দুর্বুদ্ধি তার হয়েছিলো তাই বুঝতে পারছে না এখন।
রূপকথায় যেমন মায়া-মরীচিকার পেছন পেছন বিভ্রান্ত পথিক ছুটে চলে উদ্দেশ্যহীন, তেমনি তার কাণ্ডটাও বলতে গেলে তেমন একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হচ্ছিলো টেনেটেনে মাথার চুল ছিঁড়তে। এমনই একটি এলাকায় এসে সে পৌঁছেছে যে, এখন কেমন করে যে ফিরবে তাই প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
নদীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে সে নৌকা অনুসন্ধান করছিলো। যে ক’টি নৌকা পাড়ে লাগানো দেখতে পেয়েছে সবগুলোরই কোনো না কোনো কারণে ওপার যাওয়ার সম্ভাবনাটা ভেস্তে গেছে। বেশির ভাগ নৌকাতেই লোকজন নেই। কোনোটাতে দু একজন থাকলেও তারা সাফ মানা করে দিয়েছে- এমন ভর-দুপুরে নদী পেরোনোর ঝুঁকি নেবে না। বেলা যখন আরো পশ্চিমে হেলে পড়বে তখনই তারা ফের নৌকা ভাসাবে। এর আগে নয়। সে ইচ্ছে করলে মাছের ট্রলারেও চড়তে পারে। তারা যদি মাছ নিয়ে বা কোনো কারণে এমন সময় ওপার যায় তো সেও যেতে পারবে। নয়তো সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। কথা শুনে তার মন খারাপ হয়ে যায়। এত দীর্ঘ এলাকা জুড়ে সামান্যতম ছায়া নেই। সে কি দুপুরের চড়া রোদে রোদে ঘুরে মরবে? একটি ছইঅলা নৌকা থাকলেও সে ছইয়ের নিচে খানিকটা সময়ের জন্য আশ্রয় পেতো। কিন্তু সবগুলো নৌকাই খোলা। যে লোকগুলো নৌকায় বসে আছে বা বসে বসে বিড়ি টানছে তাদের প্রত্যেকের মাথায়ই একটি করে গামছা নয়তো লুঙ্গি কারো কারো মাথায় আবার শাড়ির মতও কাপড় দেখা যাচ্ছে। যে কারণে রোদের উত্তাপ হয়তো তাদের ততটা স্পর্শ করছে না। বা শৈশব থেকেই রোদে চড়ে বেরিয়ে বড় হয়ে উঠেছে বলে রৌদ্রতাপ তাদের তেমন একটা কাবু করতে পারে না।
শহিদুল বিস্তৃত মেঘনার দিকে তাকায় কাছাকাছি কোনো জেলে নৌকা দেখতে পাওয়া যায় কি না। কিন্তু যেগুলো দেখা যাচ্ছে সবগুলোই এতটা দূর যে, তার চিৎকারও তারা শুনতে পাবে না। এমনকি এখান থেকে হাত নাড়ালেও তাদের চোখে পড়বে কি না সন্দেহ। মাথাটাও যেন ঘামছে একটু একটু করে। জুলফির পাশ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে শরীরও ঘামছে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে নিচের দিকে যাচ্ছে। একটি হাত পেছনে নিয়ে সার্টের অংশ যতটুকু নাগাল পায় ততটুকুই চেপে ধরে পিঠের ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘামে ভেজা চামড়ার ওপর লেপ্টে যায় সার্টের খানিকটা। একটু একটু করে যেন তেষ্টাও পাচ্ছিলো। কিন্তু এখানে সে পানি পাবে কোথায়! আশপাশে কোনো চাপকলও নেই যে ব্যাগের ভেতর পড়ে থাকা শূন্য বোতলটায় পানি ভরে নেবে। নৌকার লোকগুলো কি পানি খায় না? তারা তো আর পানি না খেয়ে থাকছে না। প্রয়োজনে তাদের থেকে চেয়ে এক আধ ঢোক পানি খেয়ে নেবে। তৃষ্ণা এখনও ততটা দুর্নিবার হয়ে ওঠেনি। তখনই তার মনে পড়ে যে, একবার বৈশাখে ময়নামতির মেলায় গিয়েছিলো। সেখানেও এমনি পানির সমস্যায় পড়েছিলো সে। কোথাও পানি ছিলো না। সময়মত বৃষ্টিবাদল হয়নি বলে, মেলা সংলগ্ন একমাত্র পুকুরটিও ছিলো প্রায় পানিশূন্য। তার ওপর পানিতে শ্যাওলা ছিলো অনেক। আঁজলা ভরে পানি তুলে গুঁড়ো গুঁড়ো সবুজাভ শ্যাওলা দেখতে পেয়ে সেখানেই পানি ফেলে উঠে এসেছিলো। আইসক্রিম কিনে খেলো। শরবত কিনে খেলো। এমনকি ডাবের পানিও বাদ পড়েনি। কিন্তু তৃষ্ণা আর দূর হয় না। নাকি এখানেও তেমন কঠিন দশায় পড়তে যাচ্ছে কে জানে! কেবল পানিই যে কত অসাধারণ স্বাদের হতে পারে তৃষ্ণায় বুক ফাটার মত না হলে অনুভব করা যায় না।
এখন তার সব রাগ গিয়ে পড়লো শুভাশীষের ওপর। ব্যাটা চাপাবাজিতে হয়তো কদিন পর আসল চাপাবাজদের হারিয়ে দিয়ে নিজেই ওস্তাদ সেজে বসবে। বলেছিলো উখিরচর ও চলে আসবে আগে আগে। শহিদুল যেন পরদিন যায়। সেখান থেকে ট্রলারে করে কিশোরগঞ্জ যাবে। এখন এসে দেখে কোথাকার শুভাশীষ কোথায় গিয়ে ট্রলার ভাড়া করছে কে জানে! মনে হয় এমনিই মজা করেছে। আর এ কথা মনে হতেই শহিদুল গরম আর তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকে। খানিকটা দূরেই একটি নৌকার দিকে ছুটে যায়। বলে, ভাই পানি আছে?
নৌকার একমাত্র বৃদ্ধটি হাসে। নদীর দিকে আঙুল তুলে বলে, আপনে কি কানা? কত্ত পানি দেখেন না?
খাবার পানি। খাবার পানি চাচ্ছি। পিপাসায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে!
বৃদ্ধ কেমন রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো, আমরা এই পানিই খাই। এই পানিতেই আমাগ জীবন, মরণ, হাগা-মুতা, গাও-গোসল সব!
বৃদ্ধের কথা শুনে পানির দিকে তাকিয়ে কেমন ঘিন ঘিন লাগে তার। তবুও খানিকটা হেঁটে গিয়ে সে জুতো খুলে প্যান্ট গুটিয়ে পানিতে নামে। আঁজলা ভরে পানি তুলতেই সেই ঘিনঘিনে ভাবটা ফের ফিরে আসে। হাত থেকে পানি ফেলে দিয়ে সে তাকায় নদীর দিকে। সব যেন ধোঁয়াশা মনে হয়। সে অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়ায় পানির ওপর। চরের সারি সারি ঘরগুলোর দিকে তাকায়। সেখানে যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে তার? যদি দৌঁড়ে যায়? সে কি পারবে? ঠিক তখনই তার পা দুটো নরম কাদার ভেতর দেবে যেতে থাকে। পা দুটোকে টানাটানি করতে গিয়ে সে পানিতে পড়ে যায়। তার ভীষন ভয় হয়। সে তো সাঁতার জানে না। তাহলে উপায়? সে কোনোরকমে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ডাঙায় উঠতে চায়। কিন্তু সে ডুবে যেতে থাকে। চারদিক কেমন অন্ধকার আর নিকষ কালো মনে হতে থাকে। একটু বাতাসের জন্য যেন বুকের ভেতরটা ফেটে যাবে মনে হয়। কোনোরকমে মাথা জাগিয়ে শ্বাস নিতে চায় সে। কিন্তু পারে না। সে তলিয়ে যেতে থাকে পানির নিচে। পায়ের নিচে হঠাৎ মাটির পরশ পেতেই দু পায়ে লাফ দেবার ভঙ্গীতে নিজকে পানির উপর ঠেলে দিতে চেষ্টা করে। আর তখনই টের পায় কিসের সঙ্গে যেন শরীরটার জোর সংঘর্ষ হলো। ভোঁতা একটি বেদনাবোধের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের নাগাল পাওয়া যায় শেষপর্যন্ত। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে চোখ খুলতেই সে আবিষ্কার করলো যে, অন্ধকার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। পুরো শরীর ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে আছে। ফ্যানটা ঘুরছে না। কখন বিদ্যুৎ গেছে কে জানে!
১৮/৪/২০১০
মন্তব্য
ভালু। তয় আমার নামের উপ্রে চ্যাতলেন কেনু?
---------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
ওইটা শুভাশীষ ভদ্র। আপনের নাম এইটা হইলে ওই নামটা কার?
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
টানটান স্বপ্ন
আজ্ঞে। লেখার সময় বুঝতে পারিনাই।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
বাঃ স্বপ্নের এমন বিস্তারিত বর্ণনা! এমন প্রাঞ্জলতায়! ভালু পাইলাম।
কিছু টাইপো-
নিজকে > নিজেকে
সূর্যাকণা> সূর্য্যকণা
ফাটর> ফাটার
---- মনজুর এলাহী ----
ধন্যবাদ। এখনি মেরামত করতেসি। তবে "নিজকে" শব্দটি এমনই থাকুক।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
দারুণ বর্ণনা! দারুণ লাগলো পড়ে!
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন