১
এমন অবস্থায় শহরের মেয়েদের দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে তারা শহরের কেউ নয়। অনেক প্রাজ্ঞজন যাদের নাম দিয়েছেন গ্রাম্য মেয়ে। যে কথার আড়ালে সংগোপনে ওত পেতে থাকে এক ধরনের অবজ্ঞা অথবা ঘৃণা জাতীয় কিছু। যেটিকে নিজের অজ্ঞাতেই নিজেদের কাঁধে বয়ে বেড়ায় জীবীকার সন্ধানে আসা এসব প্রান্তিক মানুষ। যাদের জীবনে খুব বড় কোনো স্বপ্ন নেই। নেই কোনো বিশাল প্রাপ্তির প্রত্যাশাও। তাদের দৈনন্দিন জীবন ঘিরে থাকে অনেক ধরনের ছোট ছোট সুখ-দুখ। সেই সঙ্গে তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবেও থেকে যায় নানা জাতের ব্যামোর মতোই কিছু কিছু অপবাদও। এসব হয়তো কারো কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও তাদের কাছে গুরুত্বহীন। যা তাদের নিত্যদিনের অন্ন-সংস্থানের যুদ্ধের মুখে তেমন একটা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।
রহিমা ডান দিকে ফুটপাতের পাশে একবার তাকায়। ওদিকেই প্রতিদিন দেখা যায় খুঁটিতে খোলা ছাতা বেঁধে রেখে তার ছাঁয়ায় বসে হেঁট মুখে এক মনে কর্মে ব্যস্ত জুতোর কারিগর। আজ বৃষ্টির দিন বলেই হয়তো কাজে আসেনি লোকটি। ছেঁড়া স্যান্ডেল হাতে পথ চলতেও ভালো লাগছিলো না রহিমার। ওগুলো কোথাও রেখে যেতে পারলে ভালো হতো হয়তো। কিন্তু কোথায় রেখে যাবে ভেবে পায় না সে। আবার ছেঁড়া স্যান্ডেল হাতে বাসে উঠতেও ভালো লাগছিলো না তার।
বাসস্ট্যান্ডের কাছেই ছোট চায়ের দোকানে বসে থাকা নজুর দিকে চোখ পড়ে রহিমার। অনেকদিন থেকেই সে লক্ষ্য করছে যে, লোকটি তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকলেও কোনো রকম অস্বস্তি বোধ হয় না। অথচ তার কর্মস্থলের সুপার-ভাইজর মনিরুদ্দিনের দিকে না তাকিয়েও সে ঠিক বুঝতে পারে চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে। মনিরুদ্দিন যখন তাকিয়ে থাকে তখন পুরো দেহজুড়ে তেলাপোকা হেঁটে যাওয়ার মতো বোধ কাজ করে তার দেহ-মনে।
স্যান্ডেল জোড়া হাতে নিয়ে সে নজুর দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। একবার চলতি পথে অকস্মাৎ সে শুনতে পেয়েছিলো, কেউ বলছে, পরিষ্কার কাপে একটা চা দিস তো নজু! কথাটা যেমন শুনতে পেয়েছিলো, তেমন করেই গেঁথে আছে আর শ্রবণ যন্ত্র। এখনও মনে করতে চাইলে একই কথনের প্রতিধ্বনি শোনে সে।
আরো এগিয়ে গিয়ে দোকানের নিচে স্যান্ডেল জোড়া নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে রহিমা, নজু ভাই, আমার ছিঁড়া স্যান্ডেল জোড়া রাইখ্যা গেলাম!
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেও হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না নজু।
ফিরা যাইতে নিয়া যামু! বলে, ঘুরে দাঁড়িয়ে রহিমা বাসের উদ্দেশ্যে হেঁটে চলে। বাস ধরার উদ্দেশ্যে তার স্টেশনের দিকে যাত্রা বলে তার যাবতীয় মনোযোগ সেদিকে ছিলো সে দেখতে পায় না দেহটিকে বাঁকিয়ে দোকানের দরজা দিয়ে মাথা বের করে স্যান্ডেল জোড়া হাতে তুলে নিয়ে দোকানের ভেতরে কোথাও রেখে দেয় নজু।
২
আজ কিছু একটা নিয়ে সবার ভেতরেই কেমন এক ধরনের চাঞ্চল্য দেখা যায়। কিন্তু ব্যাপারটার অন্তরালে কী এমন আছে তার কিছুই জানে না রহিমা। প্রতিদিন সকালে এসে হেঁট মুখে কাজ শুরু করলে বিনা প্রয়োজনে ঘাড় ফেরায় না রহিমা। মুখ তুললেই দেখতে পায় মনিরুদ্দিনের অশ্লীল চকচকে দৃষ্টি। অথচ তাকে ছাড়াও এ ফ্লোরে আরো কতো সুন্দরি মেয়ে আছে নানা বয়সের। লুৎফা বলে মেয়েটাকে তো পরী বললেও কম বলা হবে। যে তার সৌন্দর্যের জোরে লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতায় দু রাউন্ড পর্যন্ত টিকেও গিয়েছিলো। বিদ্যার জোর কম বলে অল্প ক’দিনেই বুঝে গিয়েছিলো যে, তেমন জায়গায় তার মতো মূর্খ মেয়ের ঠাঁই হবে না। নাটকের এক অভিনেত্রী তো বলেই দিয়েছে যে, আর কিছুটা পড়াশুনা থাকলে সে সেখানে না টিকলেও অভিনয়ে ভালো করতে পারতো। ক্যামেরা-ফেসও তার ভাল। কিন্তু মেয়েটার আরো নানা ভয় তাকে ফিরিয়ে এনেছিল পুরোনো পেশায়।
লুৎফার কথা মনে হতেই সে রহিমা ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় লুৎফা যেখানে বসে কাজ করে। বসার জায়গাটা ফাঁকা। মেশিনটা বন্ধ। ঠিক তখনই যেন প্রথম সে সচেতনতা অনুভব করে লুৎফার জন্যে। মেয়েটা কেন আসেনি? গতকাল তো এমন কিছু বলেওনি। শরীর খারাপ হলো না তো? গরিবের তো এই একটাই বড় বাধা, কিছু একটা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ থেকে অসুখ নামক পিছুটান তাকে থামিয়ে দেয় জীবনের নানা পথে। কখনো বা পেছনে ঠেলে দেয় যেখান থেকে শুরু করেছিলো সেখানেই।
সে ঠিক করে লাঞ্চ ব্রেকের সময় কাটিং সেকশনের ববিতার সঙ্গে দেখা করবে। লুৎফা আর ববিতার মেস পাশাপাশি। সে কিছু জানে কিনা জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে।
বাইরের শোরগোলের শব্দ কিছুটা উচ্চ বলে মনে হয়। আজও হয়তো শ্রমিকরা তাদের বেতন বাড়ানোর দাবি নিয়ে পথে নেমেছে। মালিকগুলো অতিরিক্ত সময়ের বেশিও খাটাবে শ্রমিকদের অথচ বেতন পাঁচশ টাকা বেশি দিতে বললে শুরু হয়ে যায় জ্বলুনি। বছরে কোটি কোটি টাকা কামাই করে শ্রমিকের রক্ত চুষে চুষে, সে শ্রমিকেরা যখন বেতন বাড়ানোর কথা বলে তখনই তারা হয়ে যায় বিদেশি এজেন্ট। আরে, কাজ করেই তো পয়সা বেশি তিতে চাচ্ছে, বসে বসে বেতন নেওয়ার কথা তো কেউ বলছে না।
কাটিং সেকশনে গিয়ে দেখা গেল সেখানে কোনো লোকজন নেই। এখন ববিতাকে কোথায় পাবে সে রহিমা? কিছুক্ষণ বসতে হলে কতক্ষণ বসতে হবে তারও নিশ্চয়তা নেই।
আসাদুল্লা কাটিং সেকশনের টি-বয়। তাকে দেখতে পেয়ে রহিমা বলল, ববিতা আপায় কই, আজকে আসছিলেন?
-আসছিল। আসাদুল্লা জানায়।
-এখন কই গেছে বলতে পারেন?
-মনে হয় সেলিম স্যারের লগে বাইরে খাইতে গেছে।
-ও। আমি তাইলে যাই।
-আপারে কিছু বলতে হবে?
-তেমন বেশি কিছু না। লুৎফা আজকে আসে নাই, তাই জিগাইতে আইছিলাম আপারে।
-আপা আসলে আপনেরে খবর জানাবো।
-আইচ্ছা।
কাটিং সেকশন থেকে ফিরে এসে রহিমা ব্যাগ থেকে খাবারের বাটিটা বের করে নেয়। সবাই যার যার বাটি থেকে খাবার খাচ্ছে। কে কী খায় তা নিয়ে তা নিয়ে ভাবে না রহিমা। তবে নিজের খাবার নিয়ে সব সময় মন ছোট করে রাখতে বাধ্য হয়। তার ধারণা যে, এ ফ্যাক্টরিতে সব চেয়ে খারাপ খাবার সেই-ই খায়। আজ সে রুটির সঙ্গে এনেছে কাঁচা পেঁয়াজ। এখনও বেতন হয়নি বলে তার বেশ টানাটানি যাচ্ছে। কোনোদিন একটু বাসি তরকারি আনলে খেয়ে তৃপ্তি হয়। কখনো বা লুৎফা ভাতের সঙ্গে আনা ভাজি বা তরকারির এক আধটু দিতো। তবে ব্যাপারটি তার ভালো না লাগলেও চুপ করে থাকতো। কিছু দিতে না পারলে কারো কাছ থেকে কিছু নিতে মন সায় দেয় না।
হঠাৎ সেকশনের দরজায় ববিতাকে দেখা যায়। ববিতাকে দেখলে তার একটি কথাই মনে হয় সব সময় যে, চার হাজার টাকা বেতন পেয়ে কদিন পরপর নতুন কাপড় পায় কোথায়? এমন আরো কয়েকটি মেয়ে আছে, যাদের বেতন কম হলেও পোশাক আর খাওয়া ভাল।
-রহিমা আমারে খুঁজো ক্যান? বলতে বলতে পাশে এসে দাঁড়ায় ববিতা।
খাবার লুকিয়ে রহিমা জানায়, লুৎফা আজকে আসে নাই। আপনে তার কিছু জানেন কিনা জানতে গেছিলাম।
-আমি তো কালকে রাত্রে মেসে ফিরি নাই। তাই বলতে পারি না লুৎফা কেন আসে নাই। তোমারে কালকে জানাবো। আর দেখ, কালকে আসতেও পারে।
তারপরই সে রহিমার লুকানো বাটির দিকে ইঙ্গিত করে বলে, কী খাও?
ববিতার কৌতূহল দেখে ববিতার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। বলে, এইটারে খাওন বলে না আপা। কাঁচা পেঁয়াজ দিয়া কে শুকনা রুটি খায়?
রহিমার কথা শুনে ম্লান মুখে ববিতা জানায়- আমার সেকশনে একটা বিহারি মেয়ে কাজ করতো। তারে প্রত্যেক দিনই দেখছি কাঁচা পেঁয়াজ নাইলে কাঁচা মরিচ দিয়া রুটি খাইতে। তুমি খাও, আমি এখন যাই। বলে ববিতা সোজা বেরিয়ে যায় সেকশন থেকে।
ববিতা চলে গেলে রহিমা ফের খাওয়া আরম্ভ করে। রুটি ছিঁড়ে এক টুকরো মুখে দিয়ে পেঁয়াজে এক কামড় দেয়।
লাঞ্চের পরপরই কারো কারো মুখে শোনা যায় আশপাশের কয়েকটি ফ্যাক্টরি নাকি দু একদিনের ভেতরই বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের ফ্যাক্টরিও নাকি বন্ধ হয়ে যাবে।
বাবুলের মাকে উদ্দেশ্য করে রহিমা বলে, আমরা তো মিছিল-মিটিঙ করি নাই। আমাদেরটা ক্যান বন্ধ অইবো?
বাবুলের মা বলল, মালিকরা সবটি একখানে বইয়া ঠিক কইরা লইছে!
বাবুলের মায়ের কথা শুনে রহিমা আরো শংকিত হয়ে পড়ে। বেতন হওয়ার আগে ফ্যাকটরি বন্ধ হয়ে গেলে পাওনা বুঝে পাওয়া পর্যন্ত হয়তো কয়েকদিন তাকে না খেয়ে থাকতে হবে। হাতেও তেমন টাকা পয়সা নেই। নিষ্ঠুর আর নির্বান্ধব শহর কাউকে বিমুখ না করলেও মানুষ মানুষকে বিমুখ করতে পারলে খুশি হয়।
৩
কাজ শেষ করে বের হতে হতে রাত এগারোটা বেজে যায় রহিমার।
বাস থেকে নেমে নজুর দোকান বরাবর আসতে আসতে দেখা যায় দোকানে একা বসে বসে চায়ের কাপ পরিষ্কার করছে নজু। তাই চুপচাপ রেখে যাওয়া স্যান্ডেল নেওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটু মুড়ে বসে দোকানের নিচে উঁকি দিলে আবছা অন্ধকারে স্যান্ডেলের অস্তিত্ব টের পায় না। ইটের টুকরোকে স্যান্ডেল ভেবে হাত দিয়েও হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ালে নজু তাকে জিজ্ঞেস করে, দোকানের নিচে কী খোঁজেন?
রহিমা হতাশ কণ্ঠে জানায়, সকালের দিকে যাওনের সময় আমার ছিঁড়া স্যান্ডেল জোড়া রাইখ্যা গেছিলাম, ভুইল্যা গেলেন?
পরিষ্কার কাপের পানি ঝাঁকি দিয়ে ঝরিয়ে রাখতে রাখতে নজু ফের বলে, স্যান্ডেল পায়ে দেওনের জিনিস, দোকানের নিচে রাখনের কী হইল?
-আইতে আইতে ছিঁড়া গেল একটা, জুতার কারিগর পাইনাই দেইখ্যা এখানে রাইখ্যা গেছিলাম!
-ছিঁড়া স্যান্ডেল দিয়া করবেন কী? আরেক জোড়া কিন্যা লইতেন!
-আপনের যা কথা!
-আইচ্ছা বইয়া লন কিছুক্ষণ। হাতের কাজডা সাইরা লই। আপনের স্যান্ডেল খুঁইজা দিমু।
সারাদিন টানা পরিশ্রম করার পর মেসে ফেরার আগে কোথাও থামে না রহিমা। যন্ত্রচালিতের মতো ঘরে ফিরে কোনো রকমে নাকে-মুখে দুটো গুঁজে দিয়েই ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। এখন বেঞ্চিতে বসতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে যেন জাপটে ধরতে চায় তাকে।
নজু এক কাপ চা বানিয়ে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, চা-ডা খান! আমি দেখি আপনের স্যান্ডেলের কী হইল?
চায়ের কাপ হাতে তুলে নিতে আগ্রহী হয় না রহিমা। সঙ্গে পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা নেই বলে, চায়ের মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তাই সে কাপ না ধরেই বলে ওঠে, চা খামু না এখন। ঘরে গিয়া ভাত খামু। সঙ্গে টাকা-পয়সাও নাই।
-ট্যাকা-পয়সা নাই, বেতন পাইলেই তো হইবো। খান, ভালো লাগবো!
রহিমা অনিচ্ছায় চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়ায়। সেই অবসরে নিজু একটি ছোট প্লাস্টিকের প্লেটে দুটো নোনতা বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে বলে, বিস্কুট দুইডাও খান, ঘরে গিয়া কতক্ষণে পাকাইবেন, খাইবেন ঠিক নাই।
পাশের বেঞ্চে আরো ক’জন বিরক্তিকর লোক এসে বসে। তারা উচ্চস্বরে দুর্বোধ্য আলোচনা করতে করতে দ্বিগুন মূল্য পরিশোধের শর্তে দ্বিগুণ দুধ-চিনি দিয়ে চায়ের অর্ডার দেয়। চা খাওয়া হয়ে গেলে তারা চলেও যায়। কিন্তু স্যান্ডেল খোঁজার দিকে নজুর কোনো আগ্রহ না দেখতে পেয়ে রহিমা কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে, ভাইরে, আমার তো দেরি হইতাছে, আরো কতটা পথ হাঁটতে হইবো।
-শান্তি মতন কি চা-ডাও খাইতে পারেন না!
নজুর কণ্ঠস্বর রহিমার কানে তিরস্কার হয়ে যেন প্রবেশ করে। দ্রুত চুমুক দিতে পারে না গরম চায়ে। চা খাওয়ার অভ্যাস নেই তার। ঠিক কত মাস আগে সে এক কাপ চা খেয়েছিলো বা আদৌ কোনো চা খেয়েছিলো কিনা মনে করতে পারবে না। তাও যেটুকু মনে করতে পারে, একবার তার মামার বাড়ির এক চা দোকানে, চা খেয়েছিলো সে কতকাল আগে, ভালো করে তখন কথা বলতে পারে না সে। মামার কোলে চড়ে গিয়েছিলো সেখানে। মামা চায়ে ফু দিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা করে দিয়েছিলেন, সেই চা সে শরবতের মতোই গিলে খেয়েছিলো।
কোনো রকমে চা-বিস্কুট শেষ করে সে উঠে দাঁড়ালে নজু কাত হয়ে প্রায় শুয়ে পড়ে পেছনের দিকে। তারপর হাতে স্যান্ডেল জোড়া নিয়ে সোজা হয়ে বসে বাড়িয়ে ধরে রহিমার দিকে। সেই সঙ্গে বলে, পিন্দা লন!
বিরক্ত রহিমা স্যান্ডেল জোড়া হাতে নিতে নিতে বলে, ছিঁড়া স্যান্ডেল পিন্দুম কী?
কিন্তু তখনই সে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে যে, ছেঁড়া অংশটুকু সেলাই করা। চকিতে নজুর দিকে দৃষ্টি তুললে দেখতে এক জোড়া চোখ যেন অপার সাহসের দ্যুতি ছড়িয়ে সম্মতি সূচক ভঙ্গীতে মাথা দোলাচ্ছে। রহিমার বিস্ময় কাটার আগেই সে বলে ওঠে, পায়ে দিয়াই যান, আমি ঠিক করাইয়া রাখছি।
রহিমা কি তাকে কিছু বলা উচিত? ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা সূচক কিছু? কিন্তু তার মাথায় ঘুরছে, মেসে ফিরে যেতে দেরি হলে, চুলায় ভাত চড়াতে তাকে অনেকের পেছনে পড়ে যেতে হবে। কিন্তু স্যান্ডেল জোড়া নিচে নামিয়ে তাতে পা গলাতে গলাতে কেন যেন তার চোখ দুটো ভিজে আসতে চায় বার বার। আর তা দেখে নজু আবার হেসে ওঠে কিনা সেই ভয়ে সে কাঁদতেও পারে না। তবে, অদ্ভুৎ এক স্বস্তি বোধ হতে থাকে তার দেহ মনে। অবশেষে ভয় তাড়িয়ে নজুর চোকের দিকে তাকালেও সে দৃষ্টির ভাষা পড়তে পারে না সে। পুরুষের দৃষ্টি এতটা নির্বিকার হতে পারে দেখেও যেন বিশ্বাস হতে চায় না তার।
৪
মেসের গেট দিয়ে বের হতে হতে রহিমার মনে হয়, যে মানুষ পয়সা ফেরত পাবে কিনা বা নিজের কোনো লাভালাভের ব্যাপার নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই পরের জন্য হীতকারী কাজ করে, সেধরনের মানুষের কাছ থেকে উপকার গ্রহণ করার পর তাকে ধন্যবাদ না জানানোটা অন্যায় হয়তো। আর তা না হলে সৌজন্য প্রকাশটাও কর্তব্য। কিন্তু পরপর তিনদিন আসা-যাওয়ার পথে নজুর দোকান বন্ধ দেখতে পেলে মনের ভেতরটা কেমন কেমন করে। একবার মনে হয় পাশের দোকানের লোকটির সঙ্গে কথা বললে হয়তো নজুর ব্যাপারে খানিকটা জানা যেত। কিন্তু মন থেকে তেমন কোনো জোরালো সাড়া পায় না বলে ও কাজটি আর করা হয়ে ওঠে না।
বেশির ভাগ মানুষই ভেতরে ভেতরে কৌতূহলি মন নিয়ে ইঁদুর শিকারী বিড়ালের মতই ওৎ পেতে থাকে। ঘটনার আড়ালে তেমন কোনো ঘটনা খুঁজে না পেলেও নিজেদের ইচ্ছে মতো ঘটনা সাজিয়ে নিতে বা আবিষ্কার করে ফেলতেও দ্বিধা করে না। এমন কি আবিষ্কৃত বা প্রচার পাওয়া কাহিনীটি মিথ্যে বলে প্রতিষ্ঠা পেলেও তা নিয়ে তাদের অনুশোচনা বা অনুতাপ প্রকাশ করতে দেখা যায় না। দেখা যায় না কোনো রকম লজ্জা-শরমের ধার ধারতেও।
নজুর সঙ্গে দেখা না হওয়ার কারণে মনের ভেতরে কোথাও যেন খানিকটা কষ্ট কষ্ট বোধ নড়া চড়া করে রহিমার। সেই সঙ্গে নানা রকম শংকা আর উদ্ভট গাল-গল্প শিকড় ছড়াতে থাকে তার বিক্ষিপ্ত মনের ভেতর। তৃতীয় দিন চললেও লুৎফাকে দেখা যায় না বা কোনো সংবাদ ও কারো কাছ থেকে শোনা যায় না। একটি মানুষ এতদিন ছিলো। কাজ করেছে, কথা বলেছে, হেসেছে। কারো কারো সঙ্গে সুখ দুখের গল্পও করেছে। অথচ সেই মানুষটিকে আজ তিনদিন হতে চললো দেখা যাচ্ছে না, এ নিয়ে যেন কারো কোনো ভাবনা নেই। নেই সামান্য কৌতূহলও। মানুষ কি দিন দিন পাষাণ-প্রাণ হয়ে যাচ্ছে? নাকি উদর পূর্তির প্রতিযোগীতায় কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় বা সুযোগ পাচ্ছে না?
চলিষ্ণু জগতের নানা জটিল নিয়মের ফলে বেঁচে-বর্তে থাকার বাধ্য-বাধকতার ফলে মানুষও বাধ্য হয় পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে। রহিমাও তার ব্যতিক্রম হবে কীসের বলে? তাকেও বেঁচে থাকতে হবে। আর দশজন মানুষের সঙ্গে চলতে হবে। সৃষ্টির নিয়মকে সম্মান জানাতে তাকেও জীবন ধারন করতে হবে। বাঁচতে হবে খেয়ে পরেই। তাই লাঞ্চের সময় রুটির সঙ্গে খাওয়ার জন্য অন্য কিছু না পায়ে পাশের রুমের মেয়েদের কাছ থেকে দুটো কাঁচা মরিচ চেয়ে এনেছিল।
বাসটি যতই ইপিজেড এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, রহিমা দেখতে পাচ্ছিল লোকজনের ভীড় আর নানা রকম শ্লোগানের শব্দও বাড়ছে। হঠাৎ রাস্তার পাশে বাস থামিয়ে ড্রাইভার দরজায় দাঁড়ানো হেলপারটিকে বলল, দেইখ্যা আয় তো খোকন, সামনে কী হইতাসে?
খোকন নামের লোকটি সামনের দ্রুত পায়ে ছুটে যায়। কিছুক্ষণ পর আরো দ্রুত বেগে ফিরে এসেই জানায়, গাড়ি ঘুরান ওস্তাদ! বলেই সে বাসের দরজায় উঠে দাঁড়িয়ে ভীষণ জোরে জোরে বাসের গায়ে আঘাত করতে করতে বলে আবার, গার্মেন্স শ্রমিকরা গাড়ি ভাঙতাছে হমানে!
তাগো নেতা আমিনুলরে নাকি মাইরা হালাইছে মালিকরা!
খুবই দ্রুত আগে পিছে করতে করতে ঘন ঘন ব্রেক কষতে কষতে ড্রাইভার চিৎকার করতে থাকে, যারা নামনের তারা নাইম্যা যান, গাড়ি যাইবো না!
কেউ কেউ নামার সময় বলে, তাইলে বাকি টাকা ফেরত দাও!
নির্বিকার চিত্তে ড্রাইভার জানায়, কন্টাকটার থাইক্যা লইয়া লন!
কিন্তু সে মুহূর্তে কন্ডাকটর বা হেলপার কাউকেই দেখা যায় না।
রহিমা কী করবে তা ভাবতে ভাবতেই বাসটি ইপিজেড এলাকা থেকে বেরিয়ে আসে দ্রুত এবং কিছুক্ষণের ভেতরই রহিমা নেমে যেতে বাধ্য হয় যে স্ট্যান্ড থেকে উঠেছিলো সেখানেই। বাস থেকে নেমে, ব্যাপারটা কেমন হল, এমন একটি বিভ্রান্তি ভেতর আচ্ছন্ন হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে কিচ্ছুক্ষণ। মাঝখান থেকে তার পাঁচটা টাকা নষ্ট হয়ে গেল বলে কিছুটা মন খারাপ নিয়ে সে ফিরে চলে মেসের উদ্দেশ্যে। তখনই হঠাৎ নজুর দোকান খোলা দেখতে পেয়ে খানিকটা দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে যায় দোকানের দিকে। কিন্তু দোকানের ভেতর নজুর জায়গায় অন্য এক যুবককে বসে থাকতে দেখে ভেতরে ভেতরে হতাশ হলেও উৎসাহ ধরে রাখতে চেষ্টা করে। যে কারণে যুবকটিকেই সে জিজ্ঞেস করে ফেলে, নজু ভাই কই?
-হ্যায় তো দ্যাশে গেছে! বলেই যুবকের কপালের মাঝখানে একটি ভাঁজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পালটা জিজ্ঞাসা বের হয়ে আসে তার মুখ দিয়ে, আপনে জানেন না?
-আমি তো তিনদিন ধইরা দোকান বন্ধ দেখতাছি!
-হ্যার ভইনেরে কারা জানি গলা টিপ্যা মাইরা ফালায় রাখছিল, গুদামের পিছে। কাগজে খবর বাইর হইছে তো! লাশ নিয়া দ্যাশে গেছে নজু।
রহিমা কী করবে বা কী বলবে কিছুই যেন বুঝে উটতে পারে না। নজু সম্পর্কে তো তার কিছুই জানা নেই। তা ছাড়া বিস্তারিত জানলেই বা সে কী এমন করতে পারতো?
দোকানের লোকটি পত্রিকা বের করে একটি যুবতীর লাশের ছবি দেখায়। পরনে তার সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ। যদিও সংবাদে মৃত যুবতীর নাম লুৎফা লেখা আছে, তবু যেন নিশ্চিত হতে পারে না রহিমা। দু বছরের ভেতর লুৎফাকে কখনো শাড়ি ভিন্ন অন্য কোনো পোশাকে দেখেনি সে।
(সমাপ্ত)
মন্তব্য
সুপাঠ্য। দু'একটা বানান বা দু'একটা পেঁচিয়ে যাওয়া বাক্য ছাড়া কোথাও আটকাতে হলো না।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
ধন্যবাদ শিশিরকণা। দুটো চোখে পড়েছিলো।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
খুব ভাল লিখেছেন দাদা।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
পাহাড়ের রাজা, পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ভালো লাগলো অনেক !
গার্মেন্টস কর্মীরা এত কম বেতনে কিভাবে দিনযাপন করে জানিনা। একই অবস্থা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গুলোর শ্রমিকদেরও, এরা তাও দুপুরের খাবার টা পায়, ওরা তো তাও পায়না
বিষয়টা খুব কষ্টদায়ক।
কবে যে অবস্থার একটু বদল হবে???
@সাফিনাজ আরজু
পাঠের জন্য ধন্যবাদ। মালিকপক্ষ যদি আর খানিকটা মানবিক দৃষ্টিতে ব্যাপারটি নিয়ে ভাবেন, তাহলেই শ্রমিকরা আর একটু ভালো খেতে পারে, হয়তো মরিচ বা পেঁয়াজের বদলে কিনে নিতে পারবে একটি-দুটি কলা, নয়তো বা ঘর থেকে নিয়ে আসতে পারবে একটু ভাঁজি কিংবা বাসি তরকারি।
খুব ভালো থাকুন আপনি।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
খুব ভালো লেগেছে লেখা।
পাঠের জন্য ধন্যবাদ অনেক।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন