কন্থৌজম হয়তো রাখবেন না, তবু বলি

যূথচারী এর ছবি
লিখেছেন যূথচারী (তারিখ: বুধ, ০২/০১/২০০৮ - ১২:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কন্থৌজম সুরঞ্জিত-এর "মণিপুরিদের শানাম্যাহি ধর্ম ও 'রিভাইভেলিজম'(১)" শীর্ষক ব্লগিং-এর প্রেক্ষিতে এই লেখা। কন্থৌজম হয়তো বিরক্ত হতে পারেন, কেন গত দশ বছর যাবৎ আমি তার পেছনে লেগে আছি। তিনি কিছু লিখলেই কেন আমি তার বিষয়ে কিছু সমালোচনা লিখি? হাসি পাচ্ছে, কিন্তু এর সাফ জবাব হলো, বাঙালি মুসলমান হিসেবে সংখ্যাগুরু জাতিসত্তার সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে এই ধরনের সমালোচনা করা খুবই নিরাপদ। কন্থৌজম যে সমাজে থাকেন, যে মানসিক পরিমণ্ডল ধারণ করেন- আমি তার থেকে অনেক দূরবর্তী। আমার জন্য যা খেলা, কন্থৌজমের জন্য তা হয়তো জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কন্থৌজমের যতগুলো লেখা আমি পড়েছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি তার সাথে একমত হয়ে গেছি। আর এর সমালোচনা যখন লিখেছি, দেখা গেছে, আমি কন্থৌজমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। এবং আমি আশঙ্কা করছিম আজকের লেখাটিও ওই ধরনেরই কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।

কন্থৌজমের লেখার একদম প্রথম লাইনটিতে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে, "বাংলাদেশকে মোটামুটিভাবে জাতিরাষ্ট্রই বলা হয়।" জাতি এবং জাতিরাষ্ট্রের সংজ্ঞা কন্থৌজম ভালোভাবেই জানেন, এটা আমি নিশ্চিত। জাতির সবচেয়ে নিম্নমানের সংজ্ঞা হলো- কিছু মানুষ যে বিষয়কে কেন্দ্র করে একাত্ম বোধ করেন, সেই বিষয়টিই জাতিত্ব। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, এই ভয় সত্ত্বেও, সিয়ান জোন্স এবং আমার কাজ ছাড়া, জাতির সংজ্ঞা নির্ধারণে কোনো বড় কাজ হয়নি বললেই চলে। এবং আমরা দুজনেই এই বিষয়ে একমত, জাতি নির্ধারণে কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নাই। না ভাষা, না সীমানা, না ধর্ম, না সংস্কৃতি, না গায়ের রঙ, না অর্থবিত্ত, না সামাজিক অবস্থা, না ইতিহাস- কোনো কিছুই জাতির সংজ্ঞা নির্ধারণে মানদণ্ড হতে পারে। একমাত্র একাত্মবোধ ছাড়া জাতি হওয়ার আর কোনো সাধারণ বিষয় আমাদের কারো গবেষণাতেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবং সম্ভবত আর পাওয়া যাবেও না।

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। অধুনা, বাংলাদেশকে ৬০-৭০টি জাতির এক বহুজাতিক রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা সমাজবিজ্ঞানীরা করছেন, আর রাজনৈতিকরা করছেন, ১ টি জাতি, ৩-৪টি উপজাতির চেষ্টা। আসলে বাংলাদেশে জাতির সংখ্যা কমসেকম দুশো।

ঠিক এইসব প্রসঙ্গে কন্থৌজমের সঙ্গে আমার গোলমাল লাগে না। গোলমালটা লাগে, একই (!) জাতিসত্তার বিভিন্ন অংশ বিষয়ে কন্থৌজমের দ্বিবিধ ভাবের কারণে। কন্থৌজম মণিপুরি শব্দটির ঘোর বিরোধী। শব্দটি নিয়ে নানা রাজনীতি এবং ব্যবসা হয়েছে, এটা মেনে নিয়েও কেবল মেইতেইদেরকে মণিপুরের মূলধারা মেনে নেয়া প্রশ্নসাপেক্ষ, যেখানে মণিপুরের বেশিরভাগ ইতিহাসই রচিত হয়েছে কঠোর রাজকীয় প্রভাবে। এবং এই আলোচনায় ইতোমধ্যেই কন্থৌজম সে প্রশ্ন টেনেছেন এই বলে যে, "রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর সাথে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগে সেসব উঠতি 'আধুনিক' বিদ্বত্সমাজ শব্দটাকে প্রমিতকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।"

আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ধরনের সংযুক্তির বিরুদ্ধে, যদিও আমার সম্পাদকেরা প্রায়শই তা সংযুক্ত করে দেন। আমি আরো এক্সট্রিমিস্ট। আমি মেইতেই, পাঙন এবং বিষ্ণুপ্রিয়া-এই তিন সম্প্রদায়কে একই সঙ্গে কেবল মণিপুরি বলতেই বেশি ভালোবাসি।

কন্থৌজমের সঙ্গে এখানে আমার একটা পরিষ্কার বিরোধ তৈরি হয়, তিনি বলছেন, বাংলাদেশি বলতে যেমন মূলত বাঙালিকে বোঝানো হয়, তেমনি মণিপুরি বলতে মূলত মেইতেইদেরকে বোঝানো যেতে পারে।

আমি বলছি, যখন মণিপুরি শব্দবন্ধটি তৈরি হচ্ছে (যেটা কন্থৌজম-ও বলেছেন, প্রধানত ইংরেজ গবেষকদের হাত ধরে, ঔপনিবেশিক আমলে), ঠিক সেই সময়টিতে মণিপুরে অনেকগুলো জাতিসত্তা ছিল, যাদের একটা অংশ বাংলাদেশে অভিবাসনের পর এই তিনটি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। (মনে রাখবেন, এই বিভাজন আগেই ছিল, তবে সংখ্যাটা বাংলাদেশে কমে যায়)।

আমি মণিপুরি শব্দবন্ধটি যে কারণে ব্যবহারের পক্ষে, ঠিক একই কারণে কন্থৌজম তা ব্যবহারের বিপক্ষে। কারণটি হলো, ব্যবসা। কন্থৌজম যেমন বলছেন, "'মণিপুর' বললেই মনে পড়ে মণিময় প্রকৃতিশোভিত ও নারীশাসিত সমাজের জৌলুস!" এবং তাতে ফরহাদ মজহারের ব্যবসা ভালো হয়, মণিপুরি শালের বিক্রি বাড়ে। আড়ং-এ মণিপুরি শাড়ির জন্য মেয়েদের লাইন পড়ে যায়। বিবি রাসেল মণিপুরিদের এইডস দমনের নামে কনডম বিলি করার এজেন্সি পেয়ে যান, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আর কন্থৌজম এই ক্রেডিট ছাড়তে চান না, শুভাশিস সিনহা-ও চায় না। কন্থৌজম চীনা কবিতা অনুবাদ করলেন, তো শুভাশিস ইংরেজি কবিতার অনুবাদ ছাপলেন, মেইতেই মেয়ে শানরৈ লাক্স সুন্দরী হলো, তো বিষ্ণুপ্রিয়া মেয়ে বর্ণালী ঢাকার মঞ্চ কাঁপিয়ে দুর্দান্ত অভিনয় করে গেল।

আমার যুক্তি খুবই পরিষ্কার, ক্রেডিট ছাড়ুন অথবা সবাইকেই আপাতত ক্রেডিট দিন। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ছাড়া মণিপুরের খাটি ইতিহাস রচনা অসম্ভব। ভারত সরকারকে বলুন, একটি স্বাধীন প্রত্নতাত্ত্বিক দলকে মণিপুরে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিক।

তার আগ পর্যন্ত আমি পাঙন, বিষ্ণুপ্রিয়া এবং মেইতেই- এই তিনটি জাতিকেই মণিপুরি বলতে চাই।

*খুবই তাড়াহুড়ো করে লেখা, বানান ভুল এবং তথ্যগত ভ্রান্তি থাকলে ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।


মন্তব্য

নজমুল আলবাব এর ছবি

বিষ্ণুপ্রিয়াদের ভাষা আন্দোলন নিয়া একবার দুই কলম লিখে কিযে বিপদে পড়ছিলাম... পারলে আমারে মারতে আসে!

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

আরিফ জেবতিক এর ছবি

কন্থৌজম এর লেখার সূত্র ধরে নয় , এ বিষয়ে আপনার একটা পূর্ণাঙ্গ লেখা পেলে বেশি ভালো লাগবে ।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ভালো। আরো ডিটেলসে লেখ।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।