প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে গান শুনি। একগান বারবার শুনি। আলগোছে, আগুণ, আগুণের পরশমণি, চেরুবিক, মুক্তির মন্দির, সন্ধ্যার মেঘমালা, বন্যা এগুলো হলো উইন্ডোজ মিডিয়া প্লেয়ারে সেভ করা কয়েকটা প্লে-লিস্টের নাম। ভীষণ পছন্দের সব গান এতে। ল্যাপটপে আর কতই বা জোরে শব্দ হয়! তবুও গান বাজানো শুরু করি যখন সাউন্ড একদম সবচেয়ে জোরে দিইনা। শুনতে শুনতে যখন হঠাত কোন ক্ষণে মনে হবে আরেকটু সাউন্ড বাড়ালেই বোধহয় গানটা আরো দূরে বা কাছে কোথাও ছুঁয়ে যাবে তখনকার সুযোগটা নেবার জন্যেই এই আবেগময় সংযম।
আজও গান শুনছিলাম আর একটা বই পড়ছিলাম। পড়ছিলাম না ঠিক, সামনে ছিলো আর কি। এটা আমার প্রথম একাডেমিক বই যার কাভার মডেল দুর্দান্ত সুন্দরী। মঙ্গোলিয়ান তরুণীর পরনে সবুজ ফতুয়া, হৃদয়পানে ভয়াবহ আক্রমণাত্মক ধরনের ওষ্ঠটার নিচে একহাত চিবুক ছুঁয়ে হলুদ পেন্সিল ধরে আছে আরেক হাত দিয়ে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছেন। ভাবছি অনেক রোমান্টিক গান তো একের পর এক শুনে যাই কিন্তু গান চলার সময় এমন কোন সুন্দরীর কথা কেন মনকে একটু আক্রমণ করে বসেনা? বেশি গান শোনাতে মনের সংবেদনশীলতাই বোধহয় আর ঠিকঠাক বসে নেই।
এই দুপুরে সাউন্ডটা যখন বাড়িয়ে দিতে গেলাম তখন মনে হলো যুদ্ধাপরাধীর বিচারকাজ শুরুর পর থেকেই বিচার বানচালের জন্য যে বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে সেটার মাত্রাও এই বাড়ছে এই কমছে। রায় ঘোষণার পর যে পৈশাচিকতা বেরিয়ে পড়লো এটাই কি সবচেয়ে বেশি? নাহ। তা কি করে হয়! একাত্তরের ভয়াবহতা মনে উঁকি দেয় তখন। ফাঁসি কার্যকরের সময় তাহলে কি ঘটতে চলেছে? তখনো কি সরকার, আওয়ামী লীগের লোকজন ঘটনার কয়েকদিন দিন পরে পত্রিকায় নাম না প্রকাশের শর্তে মত প্রকাশ করবেন যে যা ঘটেছে তা ভাবনার বাইরে ছিলো, ঘটনায় আমরা হতভম্ব।
মন কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে আসে। ‘মুক্তির মন্দির’ নামের প্লেলিস্ট চালিয়ে দেশের গান শুনতে থাকি। সচরাচর অজস্র গান আমার ভরদুপুরকে কেবলই বিকাল করে দেয়, বিকালকে সন্ধ্যা করে। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলন শুরুর পর থেকে বয়সটা বেড়ে গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এখন কে কি বলবে আগে থেকেই টের পায়। এখন একেকটা দেশের গান শুধু যেন সময়কে এগিয়ে নিয়ে যায়না, মুহূর্তেই পেছনে টেনে একাত্তরে নিয়ে যায়, শুধু লক্ষ শহীদের ও শহীদ জননীর দিকে অজস্র মোমজ্বালিত প্রণতিতে ভাসায় না, নিয়ে যায় সামনে যেখানে দেখি মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ, নিকৃষ্ট রুচির শাহবাগবিরোধী শক্তি পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
বারবার ঘুঘু এসে খেয়ে যেতে দেবো নাকো আর ধান,
বাংলার দুশমন তোষামোদি চাটুকার
সাবধান সাবধান সাবধান।
এইদিন-
সৃষ্টির উল্লাসে হবে রঙিন
তাই মানি না মানি না কোন সংশয়।।
জয় সহজসাধ্য ভাবার কারনেই হয়তো নানা সংশয় আসছে। কোন বাধা আসলেই, আন্দোলনের রুপ কিছুটা পরিবর্তন করলেই, মিডিয়াতে খবর পেছনের দিকে গেলেই অনেকে শক্তি কমে যাচ্ছে কথাটা বলে ও ছড়িয়ে আমোদ পাচ্ছেন। শক্তি বাড়ছে বা কমছে যাই ভাবুন না কেন শক্তিটাকে যারা আপন শক্তি ভাবেন তাদেরকেই নিজের অংশগ্রহণ আরো বেশি নিশ্চিত করে প্রমাণ করতে হবে যে গভীর মানবিকবোধ থেকে উন্মেষিত এই শক্তি অসীম, এই শক্তি দুর্বার।
(লেখাটা শেষ করবো বলে ভাবছি যখন তখনই জানতে পারলাম এই কঠিন সময়ে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। লেখাটি তার সংগ্রামী জীবনসত্ত্বার প্রতি উৎসর্গ করা হলো।)
মন্তব্য
এই অংশটা পড়তে গিয়ে হেসে ফেললাম।
ডাঃ এম.এ.হাসানের যুদ্ধ ও নারী পড়তে গিয়ে রেখে দিয়েছি সেদিন। এইসব বই পড়তে গেলে, কিংবা ঢাবিতে নারকীয় হত্যা ভিডিওগুলো... মনের জোরে কুলোয় না।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ। মনের জোর কমাতে পারি কিনা ভাববো
__________________
জানি নিসর্গ এক নিপুণ জেলে
কখনো গোধূলির হাওয়া, নিস্তরঙ্গ জ্যোৎস্নার ফাঁদ পেতে রাখে
নতুন মন্তব্য করুন