আদম, ঈভ ও আন্তর্জাতিক জিনচর্চায় উপমহাদেশকে উপেক্ষা

কৌস্তুভ এর ছবি
লিখেছেন কৌস্তুভ (তারিখ: রবি, ০৪/০৭/২০১০ - ১২:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(১)
মানুষ সহ অধিকাংশ উচ্চশ্রেণীর বহুকোষী জীবেই চলে যৌনজনন। এবং এতে যে দুটি কোষ মিলিত হয়, তারা অপূর্ণ – একটি সম্পূর্ণ দেহকোষের অর্ধেক – এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসমান, যেমন শুক্রাণু ও ডিম্বাণু। এই অসমানতার প্রয়োজন কি, তা এই আলোচনার বিষয় নয়, বিষয় তার অনেকগুলি তাৎপর্যের একটি – মানবজাতির ইতিহাস সন্ধানে তার ভূমিকা।

(২)
একটু ছোট অবতরণিকা সেরে নেওয়া যাক। মানুষের দেহকোষে থাকে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম, যার ২২ জোড়াকে বলা হয় দৈহিক, আর অবশিষ্ট এক জোড়াকে বলা হয় যৌন ক্রোমোজোম - ওই এক জোড়াই স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্য এনে দেয় বলে। নারীর ক্ষেত্রে দুটি একই ক্রোমোজোম থাকে - X - তাই তাদের ক্ষেত্রে ওই জোড়াকে বলা হয় XX । আর পুরুষের ক্ষেত্রে দুটি ক্রোমোজোম হয় আলাদা – X আর Y – তাই ওই জোড়াটিকে বলা হয় XY। এই X আর Y নামকরণ তাদের দেখতে ওই অক্ষরগুলির মত বলে।

জননকোষ তৈরীর সময় যখন কোষগুলি বিভাজিত হয়ে দুভাগ হয়, তখন ওই জোড়াগুলিও ভেঙ্গে যায়। মা’য়ের থেকে তখন কোনো একটি জননকোষে যেতে পারে শুধুই X। কিন্তু বাবা দিতে পারে X বা Y, এবং সেটাই নির্ণয় করে দেয় তার সন্তান ছেলে হবে কি মেয়ে। কন্যাসন্তান জন্মানোর ক্ষেত্রে কিন্তু দায় মায়ের নয়, কোনোভাবেই।

তার অর্থ, আপনি যদি পুরুষ হন, তবে আপনার Y ক্রোমোজোমটি নিশ্চিতভাবেই আপনি পেয়েছেন আপনার বাবার কাছ থেকে, যিনি পেয়েছেন তাঁর বাবার থেকে, বা, অন্যভাবে বলতে গেলে, আপনি পেয়েছেন আপনি পেয়েছেন আপনার ঠাকুর্দার থেকে, বাবার মারফত। এর মূল অর্থ, এই বিশেষ ক্রোমোজোমটি বংশানুক্রমে পুরুষদের মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে চলেছে। কখনও কখনও অবশ্য হিসাবের কড়ি বাঘে খেয়ে যায়, যেমন রামবাবুর খোকা পাশের বাড়ির শ্যামবাবুর মত কপালে জড়ুল নিয়ে জন্মালে, বা কুন্তী যখন মন্ত্রবলে ইন্দ্রকে আহ্বান করেন... কিন্তু সাধারণভাবে, এটি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ‘ক্লু’, মানবজাতির বিকাশের ইতিহাস নির্ধারণে।

বংশলতিকা ধরে আমরা নামি নিচে, আর বিজ্ঞানীরা হাঁটেন পেছনের দিকে - সময়ের বিপরীতে – পূর্বপুরুষের সন্ধানে। মনে করুন, আমার ঠাকুর্দার মোট দশজন নাতি, সব ছেলেদের মিলিয়ে। তাহলে, দু’ঘর পেছনে গেলে পাব, যে এই দশজনের একজনই পূর্বপুরুষ, যাঁর কাছ থেকে এরা সবাই Y ক্রোমোজোমটি পেয়েছে। এইভাবে, ধরুন, বহু যুগ পিছিয়ে গেলে দেখতে পাব, যে সমগ্র চাকমা জাতির একই পূর্বপুরুষ, এই Y ক্রোমোজোমের সাপেক্ষে। এমন অনেক হাজার বছর পিছিয়ে গেলে আফ্রিকায় খুঁজে পাব সেই ভাগ্যবান পুরুষটিকে, যার Y ক্রোমোজোম এখন আমরা সবাই বয়ে বেড়াচ্ছি। এই আদিম মানবকেই জীববিজ্ঞানে নাম দেওয়া হয়েছে আদম – বা আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, ‘Y-ক্রোমোজোম আদম’। বলে রাখা ভাল, এই নির্ণয় অবশ্যই তাত্ত্বিক, সে প্রাচীন কালের শত শত আদিম মানবের ভিড়ে এরকম কারো ফসিল আলাদা করে শনাক্ত করার দুরাশা বিজ্ঞানীরা রাখেন না।

এইখানে শভিনিস্টরা হয়ত উল্লাসে লম্ফ দিয়ে উঠবেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ‘বৈজ্ঞানিক ভিত্তি’ খুঁজে পেয়ে। তাঁদের বলে রাখা ভাল, প্রকৃতিতে কিছুই একপেশে নয়, এমন উত্তরাধিকার-নির্ণায়ক নারীদেহকোষেও দিব্যি আছে। একটু অন্যভাবে।

(৩)
আমাদের কোষে ক্রোমোজোমের ধারক হল নিউক্লিয়াস। আর শক্তি-উৎপাদন কেন্দ্র হল মাইটোকন্ড্রিয়া, এক ধরণের অঙ্গাণু। এই মাইটোকন্ড্রিয়ার জীবনকথা বেশ চমকপ্রদ। মনে করা হয়, সৃষ্টির আদিকালে, যখন রীতিমত উত্তপ্ত পৃথিবীর উপরিতলে তৈরি হয়েছে প্রাণ-সমর্থক ছোট ছোট পুকুর, যার জলে মিশে রয়েছে নানা সুবিধাজনক যৌগ যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি, তখন প্রথম এককোষী জীবের উদ্ভব হয়েছিল। এই সরল কোষগুলি ছিল নানারকমের - বিভিন্ন রকম যৌগের থেকে শক্তি আহরণে উপযুক্ত।

তখন মাইটোকন্ড্রিয়া ছিল একধরণের স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র কোষ, এবং যাকে এখন আমরা সম্পূর্ণ জীবকোষ বলে জানি, তা আরেক প্রকারের বড় কোষ। এক সময় মাইটোকন্ড্রিয়া কোনোভাবে ঢুকে পড়েছিল এই জীবকোষের ভিতর, হয়ত এই যেমনভাবে এককোষী অ্যামিবা তার খাদ্য অন্য এককোষী জীবদের দেহের ভিতরে টেনে নেয়। সে-ও বিনষ্ট হয়ে যেতেই পারত, কিন্তু ভাগ্যক্রমে হল না। বরং দেখা গেল, যে সুলভ কার্বন-হাইড্রোজেন-অক্সিজেনের জৈব যৌগগুলির থেকে শক্তি আহরণে মাইটোকন্ড্রিয়া বেশ পটু। তখন বড় কোষটি তাকে আত্তীকরণ করে নিল। স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ফুরালো তার, সে হয়ে উঠল এক জটিলতর জীবনযন্ত্রের অঙ্গ।

তা নতুন দেশে আসার সময় মাইটোকন্ড্রিয়াও সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তার নিজের জিন-সম্ভার। বড় কোষের মধ্যে অঙ্গাণু হিসাবে থাকলেও, কখনও তার নিউক্লিয়াসের সঙ্গে জিন দেওয়া-নেওয়া করে নি সে, কোষ বিভাজনে নতুন কোষ সৃষ্টির সময় সে স্বাধীনভাবে সৃষ্টি দেয় অপত্য কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার। এইভাবে পরম্পরায় বয়ে চলে সে-ও।

মজার ব্যাপার, আমরা মাইটোকন্ড্রিয়া পাই কেবলমাত্র মায়ের থেকেই। ছিমছাম শুক্রাণুর মাত্র দুটি অংশ – মাথা, যাতে রয়েছে জনন-পিতৃকোষ থেকে পাওয়া অর্ধেক ক্রোমোজোম-সম্ভার, আর লেজ, যা তার চালক বা প্রপেলার। তুলনায় ডিম্বাণুর মধ্যে একটি সম্পূর্ণ কোষের সবই রয়েছে, অর্ধেক ক্রোমোজোম বাদে। তাই অপত্যকোষে মাইটোকন্ড্রিয়া দিতে পারে কেবল সে-ই।

এবার বুঝতেই পারছেন, Y ক্রোমোজোমের মতই, মাইটোকন্ড্রিয়ার জিন বংশপরম্পরায় রক্ষিত হয় কেবলমাত্র নারীদের মধ্য দিয়েই। তাই বহু যুগ পিছিয়ে আমরা পৌছে যেতে পারি সেই আদি মাতার শরণে, সমগ্র মানবজাতির ভ্রুণ একদা নিহিত ছিল যার গর্ভে। একে আমরা ডাকতেই পারি ঈভ, বা আরো ভালোভাবে, ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভ’ বলে।

(৪)
এর অন্তর্নিহিত যুক্তিকে বলা হয় ‘সংযুক্তি তত্ত্ব’। তার বক্তব্য খুব সোজা – যেহেতু দশজন মানুষের এগারো জন পূর্বপুরুষ হতে পারে না, তাই বর্তমানের একটি জনগোষ্ঠীর অতীতে গেলে তার লোকসংখ্যা হয় কমবে নয় সমান থাকবে। প্রায় নিশ্চিতভাবেই, যথেষ্ট পিছনে গেলে কমবেই। এখানে উল্লেখ্য, হয়ত অতীতে মোট জনসংখ্যা বেশীই ছিল, কিন্তু তাহলে তাদের অনেকের জিন বংশধরের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই তাদের হিসাবে ধরার প্রয়োজন নেই।

অতএব, যথেষ্ট অতীতে গেলে আমরা পাব, এক জনগোষ্ঠীর এক ‘সাধারণ পূর্বপুরুষ’। এবার মনে করুন, সাদা/ককেশিয়ানদের একজন পূর্বপুরুষ পেলাম, চৈনিকদের একজন, আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের একজন। এখন যদি আবার পেছাতে শুরু করি, তাহলে এই তিনজনেরও এক জনই ‘সাধারণ পূর্বপুরুষ’ পাওয়া যাবে, যাকে বলা যেতে পারে সমগ্র মানবজাতির আদিপুরুষ।

এমনভাবে, স্ত্রী-পুরুষ সব মিলিয়ে, দৈহিক ক্রোমোজোমগুলিকে ধরেও আমরা পৌঁছতে পারি আমাদের আদিপুরুষে। এবং যেহেতু এদের সংখ্যা বেশি, এবং সবার মধ্যেই আছে বলে এদের নিয়ে গবেষণা করাও বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ, তাই অধিকাংশ ‘সংযুক্তি তত্ত্ব’-সংক্রান্ত গবেষণাই হয় এদের নিয়েই।

(৫)
এই দৈহিক ক্রোমোজোমগুলিকে নিয়ে নানাভাবে ‘জিনলিপি’ গঠনের চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরে। এমন একটি বিখ্যাত উদ্যোগ হল ‘হ্যাপম্যাপ’, যা বিশ্বের চারটি জনজাতি থেকে জিনের নমুনা নিয়ে একটি রেফারেন্স তালিকা গঠনের চেষ্টা করে। নতুন কারো ডিএনএ পেলে এই তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে বলা যেতে পারবে, তার জিনের কত শতাংশ কোন জনজাতির সঙ্গে মেলে, এবং আরো বহু তথ্য। তাদের নেওয়া চারটি জনজাতি হল – ইউরোপিয়ান/ককেশিয়ান, আফ্রিকান/নাইজেরিয়ান, চৈনিক এবং জাপানী। এদের প্রত্যেকের থেকে কমবেশি প্রায় পঞ্চাশ জন লোকের নমুনা নেওয়া হয়েছে।

বস্তুত, এই প্রকল্পের লোকেরা যে নিজেরা গিয়ে ওই মানুষদের থেকে কোষ সংগ্রহ করেছে এমন নয়, এই ধরণের নানা জনগোষ্ঠীর দেহকোষের নমুনার সংগ্রহ থাকে নানা জিন-গবেষণাকেন্দ্রগুলিতে। এদের মধ্যে কিছু কিছু জনজাতি গবেষণায় বেশি জনপ্রিয়, কারণ তাদের ‘প্রাচীন’ বা ‘বিশুদ্ধ’ বলে মনে করা হয়, বা অনেক ক্ষেত্রে, নমুনা পাওয়া সহজ বলে, কিংবা স্রেফ অন্য সবাইও তাদেরই নিচ্ছে বলেই।

হ্যাপম্যাপ-এর পরে আসে ‘১০০০ জিনোম প্রজেক্ট’, যার উদ্দেশ্য ছিল আরো বেশি সংখ্যক লোকের ক্ষেত্রে আরো বেশি গভীরতায় তথ্য সংগ্রহ। এরা লোক নিল, চিন+জাপান+ভিয়েতনাম, আফ্রিকা/কৃষ্ণাঙ্গ, ইউরোপিয়ান/ককেশিয়ান, আমেরিকা এবং মধ্য আমেরিকার কিছু দেশ থেকে।

এই দুটি বিশ্ববিখ্যাত, প্রচুর অর্থ সম্বলিত বড় মাপের প্রকল্পেই কিন্তু দেখা গেল, উপমহাদেশ বাদ!

(৬)
আমাদের বাদ পড়ার কারণ হিসাবে একটি ছোট যুক্তি হল, এখানে নমুনার সহজলভ্যতা কম। কথাটা সম্পূর্ণ ভুল না হলেও, এখন কিন্তু দেশের নানা গবেষণাগারে এমন কাজ ছোট মাপে চলছেই। অতএব ইচ্ছা থাকলে অসম্ভব ছিল না।

দুষ্টু লোকে বলে, ওনারা ভয় পেয়েছেন, আমাদের ইতিহাসের কথা জেনে। এখানে হাজার হাজার বছর ধরে সব জনগোষ্ঠীর লোক এসেছে, বসতি করেছে, মিশেছে অন্য মানুষদের সঙ্গে... সবার জিন ঘেঁটেঘুঁটে একাকার। কিছু পার্থক্য আছেই, যেমন, যেহেতু জাতপাত ভেদে বিয়ের বিরুদ্ধতা করে লোকজন, তাই শূদ্র এবং ব্রাহ্মণ সাম্প্রতিক অতীতে ছোট ছোট স্থানভিত্তিক গোষ্ঠী হিসাবে রয়ে গেছে, বেশি মেলামেশা ছাড়াই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এক বিরাট সমন্বয়ের এই দেশে ‘বিশুদ্ধ’ মিশ্রণহীন জনজাতি পাওয়া মুশকিল। এত জটিল যাদের জিন-ইতিহাস, সে দেশ নিয়ে কাজ করতে ওনারা পারবেন না।

তাই এধরণের প্রজেক্টের কর্তারা বলেন, যে আমাদের লক্ষ্য যেহেতু ‘প্রাচীন’ ‘বিশুদ্ধ’ জনজাতি, তাই ভারত থেকে আমরা লোক নিই না; বরং প্রাচীন জাতিগুলির জিনলিপি নথিভুক্ত কররে নিলে, সেগুলির সমন্বয় করলেই ভারতের জিনসম্ভারও আয়ত্তে চলে আসবে। এটাই এঁদের উপমহাদেশকে উপেক্ষার মূল কারণ।

(৭)
এই প্রচলিত বিশ্বাসের তীব্র বিরোধিতা এসেছে সম্প্রতি, ভারত আর আমেরিকার এক যৌথ গবেষণা থেকে। এঁদের একদল হায়দরাবাদের জৈবরসায়ন-জীববিদ্যা কেন্দ্রের, আরেকদল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। এঁদের গবেষণার প্রাথমিক আবিষ্কার প্রচলিত ধ্যানধারণারই অনুকূল – ভারতের আদিম বসবাসকারী গোষ্ঠী এসেছিল আফ্রিকা থেকে, যারা প্রাথমিক বসবাসের পর উত্তর ভারতে আগত ‘আর্য’ জনগোষ্ঠীর চাপে দক্ষিণে সরে যেতে বাধ্য হয়। এদেরই এক অংশ দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী নামে পরিচিত, যদিও তাতে কিছু মিশ্রণ আছেই; তুলনামূলক বিশুদ্ধ ছোট ছোট গোষ্ঠী পাওয়া যায় উপজাতিগুলির মধ্যে, যেমন সাঁওতাল, আন্দামান ও নিকোবরের বাসিন্দা ইত্যাদি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পূর্ব-এশিয়ান/চৈনিক জনজাতি, যেমন নাগা ইত্যাদি, এদেরও রাখা হয়েছিল গবেষণায় এবং প্রত্যাশামতই ফলাফল পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় ফলাফলটি বেশি আকর্ষক। ভারতের এই আফ্রিকান জনসমাগম এক বারে হয় নি, হয়েছে একাধিক বারে। এঁরা স্পষ্ট দুটি প্রধান গোষ্ঠী পেয়েছেন – একটি আন্দামানের উপজাতি গোষ্ঠী, আরেকটি ‘দক্ষিণ ভারতীয়’ গোষ্ঠী। এগুলিরও আবার বিভাগ রয়েছে, যেমন ‘দক্ষিণ ভারতীয়’ দলের দুটি ভাগ – অস্ট্রো-এশিয়াটিক এবং দ্রাবিড়ীয় – মধ্য ভারতের আদিবাসীরা অস্ট্রো-এশিয়াটিক এবং দক্ষিণের আদিবাসীরা দ্রাবিড়ীয় জনজাতির বিশুদ্ধতর উদাহরণ। এরা সম্ভবত আন্দামানের আদিবাসীদের থেকে ভিন্ন এক সময়ে পৌঁছেছিল ভারতে।

তৃতীয় ফলাফলটি সর্বাধিক চমকপ্রদ। যখন বিশুদ্ধ ‘উত্তর ভারতীয়’ গোষ্ঠী, যেমন কাশ্মীরী পন্ডিতরা, ইউরোপীয় জনজাতির বেশ কাছাকাছি, তখন দেখা যাচ্ছে, এই ‘দক্ষিণ ভারতীয়’ গোষ্ঠী কোনো বর্তমান আফ্রিকান জনজাতিরই কাছাকাছি নয় জিন-বৈচিত্রের সাপেক্ষে, যেহেতু বহু হাজার বছর আগে এরা আফ্রিকা ছেড়ে চলে আসে এবং স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। বস্তুত, অন্য কোনো জনজাতির সঙ্গেই এদের মিল নেই। তাই অন্যান্য জনজাতিগুলির জিনলিপি একত্র করলে তার সম্ভারের মধ্যেই উপমহাদেশের জিনবৈচিত্রও অন্তর্ভুক্ত থাকবে, এ ধারণা সঠিক নয়।

(৮)
এরপর আবারও দাবী ওঠে, অবিলম্বে এই প্রকল্পগুলিতে ভারতীয় উপজাতিগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কিন্তু এখন কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে, অতিরিক্ত নমুনার উপর কাজ করার মত অতিরিক্ত টাকাও নেই, ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে তা আর করা হয় নি। তা সত্যি কথাই বটে, কিন্তু মানতেই হবে, উপমহাদেশকে বাদ দিয়ে গোড়াতেই গলদ করা হয়েছে।

অবশ্য, এত জিনচর্চার টাকা ঢালছে যারা, তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য তো বটেই উত্তর আমেরিকান ও পশ্চিম ইউরোপের ধনী দেশগুলির লোকেদের জন্য ওষুধ ইত্যাদি আবিষ্কার করে জীবনযাত্রা উন্নত করা। তারপর সেই ওষুধগুলোই ভালভাবে বিজ্ঞাপন করে ভারত-চীনের বিশাল বাজারে ছেড়ে দেওয়া যাবে, তাতেই যথেষ্ট বিক্রি হবে... ওই তৃতীয় বিশ্বের হাতে পরিবর্ত আর কিই বা আছে?

এমতাবস্থায় উচিত আমাদেরই এগিয়ে আসা। জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রের দিক থেকে উপমহাদেশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। একে বিশ্লেষণ করে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ভার আমাদেরই নিতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল, এখান থেকে কাজ করে তা নামী আন্তর্জাতিক জার্নালে ছাপানোর ঘটনা তুলনামূলক অনেক কম। এক্ষেত্রে হায়দ্রাবাদের গবেষকদের সাফল্য দেখে আমি বেশ উৎসাহিত হয়েছি। খুব সম্প্রতি কলকাতার কাছাকাছি এমন আরো একটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে, আশা রাখি।


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির জন্য পাঁচতারা ।

তবে আমি এখনো বুঝলাম না এই উপমহাদেশকে বাদ দিলে সমস্যাটা কোথায় । আমরা তো হেটেরোজেনাস অরিজিনের জাতিগোষ্ঠি । সাউথ ইন্ডিয়ানদের মধ্যে আমি সবচেয়ে ইউনিফর্মিটি দেখেছি চেহারা বা আকার আয়তনে ।

আরো একটু বিস্তারিত বললে ভালো হতো আমার জন্য ।

কৌস্তুভ এর ছবি

এই সেরেছে, এই মূল প্রতিপাদ্যটাই যদি ভালোভাবে না বোঝাতে পেরে থাকি, তাহলে তো লজ্জার একশেষ!

আচ্ছা এইভাবে চেষ্টা করা যাক। মানুষের উদ্ভব হয় আফ্রিকায়, সেই জনজাতিকে মনে করুন ক। তারপর একাধিক বার তাদের এক এক অংশ আফ্রিকার বাইরে অভিবাসন করে, যেমন পূর্ব এশিয়া-চীনে গেছে খ দল, যারা বর্তমানে মঙ্গোলয়েড, আর মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপে গেল গ দল, যারা বর্তমানে ককেশিয়ান। তেমনই, ক-এর থেকে আরেক দল, ঘ, এক সময় ভারতে এসেছিল, যারা আলোচ্য অংশে 'দক্ষিণ ভারতীয়'। আরেক দল, ঙ, এসে আন্দামানে বসতি গাড়ে।
পরে গ দলের এক অংশ, 'আর্য'রা - ধরুন গগ, ভারতে অনুপ্রবেশ করে। তেমনই খ দলেরও অনেকেই আসে।

(৭) অংশের দ্বিতীয় প্যারায় যেটা বলতে চেয়েছি, সেটা এই - ঙ দলের গঠন পিগমিদের মত, ছোট চেহারা, কোঁকড়া চুল। আর দক্ষিণ ভারতীয়দের উচ্চতা মাঝারি, চুলও তেমন কোঁকড়া নয়। তাই অনুমান করা হচ্ছে, ঘ আর ঙ দল আলাদাভাবে ভারতে এসেছিল।

আপনার প্রশ্নটা (৭) এর তৃতীয় প্যারা সম্পর্কিত। সেখানে ব্যাপারটা এইরকম - বর্তমান উপমহাদেশে, চীনা খ দলের মিশ্রণ বাদ দিলে, যে মিশ্র জনজাতি সর্বত্র, সেটা গগ আর ঘ জাতির মিশ্রণে, শুধু অনুপাতভেদ কেবল। উত্তর ভারতের মিশ্ররক্তে গগ এর ভাগ বেশি, দক্ষিণে ঘ এর।

বিলাতি বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মিশ্র জনজাতিদের নিয়ে কাজ কেন করব? আমরা বিশুদ্ধ ক, খ, গ নিয়ে কাজ করি, তাতেই হবে।

সেখানে তৃতীয় প্যারার প্রতিপাদ্য এই, যে ক এবং ঘ দল এত আগে দুভাগ হয়ে যায়, এবং তারপর স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হয়, যে বর্তমানে দুদলের মধ্যে অনেক ফারাক। ক এখন বিবর্তিত হয়ে যে কক দলে পরিণত হয়েছে আফ্রিকায়, তাদের সঙ্গে ঘ দলের বিশাল মিল কিছু নেই। তাই ঘ কে কক দিয়ে অ্যাপ্রক্সিমেট করার চেষ্টা ঠিক নয়।

আপনার ভাষায় উত্তরটা দিতে গেলে, হ্যাঁ, আমরা হেটেরোজেনাস অরিজিনের জাতিগোষ্ঠি, কিন্তু সেই অরিজিনগুলো তো পেতে হবে। অর্ধেক অরিজিন গগ, সেটা ঠিক আছে, কিন্তু বাকি অরিজিন ঘ এর কাজ কক দিয়ে চালানো যাবে না। এইটাই বক্তব্য।

কিছু বোঝাতে পারলাম কি?

হাসিব এর ছবি

হমমম । ধন্যবাদ ।

হিমু এর ছবি

আমার এতদিন ধারণা ছিলো, দক্ষিণ ভারতে একটি আদি দল ঘ এসেছিলো, যাদের একটি অংশ ঘঙ আইল্যান্ড হপিং করে আন্দামান-নিকোবরে আড্ডা গাড়ে। মূল দল ঘ এবং এই বিচ্ছিন্ন ঘঙ, দু'জনেই স্বতন্ত্রভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। যেহেতু আন্দামান-নিকোবর দূরদ্বীপ, তাই দ্বীপের পরিপার্শ্ব অনুযায়ী বিবর্তিত হতে থাকে ঘঙ [বিচ্ছিন্ন দ্বীপে সাধারণত প্রাণী আকারে ছোটো হতে থাকে, যাকে বলে দ্বৈপবিবর্তন], আর দক্ষিণ ভারতীয় পেনিনসুলায় বিবর্তিত হতে থাকে ঘ।



বুকে BOOK রেখে বন্ধু চলো আজ যাবো বরাহশিকারে মোরা ধার ধার ধার দিও বল্লমে ♪♫

কৌস্তুভ এর ছবি

সেইটাই আমিও এতদিন জানতাম। এঁরা বলছেন, এই 'দক্ষিণ ভারতীয়' আদি গোষ্ঠীটির সঙ্গে আন্দামানের উপজাতির বেশ খানিকটাই তফাত, তাই সেটি আলাদা একটি মাইগ্রেশন হলেও হতে পারে। নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না। আরো তথ্য দরকার, বিশেষ করে Y ক্রোমোজোম আর মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ থেকে তথ্য নিয়ে।

কৌস্তুভ এর ছবি

কিছু বিজ্ঞানীর এইরকম সন্দেহের কারণটা আরেকটু বিশদে বলি। আন্দামানের উপজাতিদের ধরা হয় ‘পিগময়েড’ জাতির মধ্যে, যার উদাহরণ আফ্রিকার পিগমি ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী। অন্যদিকে, ‘দক্ষিণ ভারতীয়’ গোষ্ঠীর উদাহরণ মূলভূমি ভারতের যে সব আদিবাসীরা, তারা কিন্তু ঠিক পিগময়েড নয়। এবার দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে –

এক, আপনি যেমন বললেন, বহু হাজার বছর আগে ভারতে আসে আফ্রিকার একটি দল, যার অধিকাংশ মূলভূমিতে রয়ে যায় এবং একটি ছোট অংশ দ্বীপগুলিতে পৌঁছয়। তারা সেখানে আকারে আরো ছোট হতে হতে পিগমিসুলভ আকৃতি পায়, মূলভূমির লোকেরা ততটা ছোট হয় নি। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতে ঠিক কি ধরণের লোক এসেছিল? কারণ আফ্রিকায় পিগমিসুলভ উপজাতিও আছে, মাঝারি উচ্চতার উপজাতিও, আবার লম্বা উপজাতিও। লম্বারা এদেশে আসে, তারপর একদল দ্বীপে গিয়ে হ্রস্বতর হয়, নাকি বেঁটেরা এদেশে আসে, তার একদল মূলভূমিতে থেকে গিয়ে উচ্চতর হয়?

আরেকটা হতে পারে, যে মাঝারিরা মূলভূমিতে এসে বসতি গেড়েছিল, আর পিগমিরা পৌঁছেছিল আন্দামানে। বিস্তারিত গবেষণা না হলে কিছু বলা মুশকিল।

এই গবেষণা থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য এইজন্যে পাওয়া সম্ভব নয়, যে তাঁরা আফ্রিকানদের সঙ্গে ভারতীয় নমুনা তুলনা করার সময় নিয়েছেন কেবল সেই নাইজিরিয়ান গ্রুপটিকে, যাদের হ্যাপম্যাপ-এ ব্যবহার করা হয়েছিল। পিগময়েড দলের কোনো নমুনা নেওয়া হয়নি। তাই আন্দামানের আন্দামানের উপজাতিদের ঠিকভাবে ক্লাসিফাই করা মুশকিল তাঁদের পক্ষে।

তারাপ কোয়াস [অতিথি] এর ছবি

ভাল লাগলো। চলুক

কৌস্তুভ এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

দময়ন্তী এর ছবি

খুবই ভাল লাগল ৷
জিনতত্ত্ব চর্চার সাথে জড়িত বেশকিছু কনস্পিরেসি থিওরি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম কিছুদিন আগে৷ তো, তখন এই ব্যপারটা চোখে পড়েছিল৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

কৌস্তুভ এর ছবি

খুবই ধন্যবাদ হাসি

কনস্পিরেসি থিওরি তো খুব মুচমুচে জিনিস, একটা লেখা ছাড়ুন না! অন্তত এখানেই বলুন, কি ধরণের কনস্পিরেসি থিওরি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল...

কেমন সুর [অতিথি] এর ছবি

ভালো লাগলো; জটিল কথাগুলো খুব সহজ ভাষায় উপস্থাপনের জন্য

-- কেমন সুর

কৌস্তুভ এর ছবি

ধন্যবাদ, কেমন সুর।

নৈষাদ এর ছবি

কৌস্তুভ, খুব ভাল লাগল আপনার লেখাটা। বিজ্ঞানের ব্যাপার গুলো খুব সহজভাবে বুঝিয়ে বলেছেন। (যদিও আরও কিছু জানার ছিল আমার।)

ভাল লাগল যে বিজ্ঞানীরা ‘বৈজ্ঞানিক’ উপায়ে ইতিহাসটি বের করে আনতে চেষ্টা করছেন। আশা করা যায় যথার্থ ইতিহাসটা বের হয়ে আসবে।

যদিও নিশ্চয়ই সেই প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা ‘সেম্পলিং’ এর প্রক্রিয়াটাও ‘বৈজ্ঞানিক’ উপায়ে করেছেন, তবুও উপমহাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে আপানার সাথে আমিও একমত। ‘মিশ্র-জনজাতিদের’ আর কোন ‘আদি’ আছে কিনা জানা প্রয়োজন এবং ‘বিতর্কিত’ বিষয়ের বিতর্ক শেষ করতে হলে ‘ইনক্লুসিভ’ হওয়ার পক্ষে আমি।

কলেজে উঠার পরেই ‘আর্যদের’ বিভিন্ন ‘থিওরি’ নিয়ে খুব ইন্টারেস্ট ছিল। শেষে নিরোদ চোধুরীর ‘কন্টিনেন্ট অভ সার্সি’ পড়ার পর ‘ইন্টারেস্ট’ তখনকার মত শেষ হয়ে গেছল...।

কৌস্তুভ এর ছবি

নৈষাদ, আপনার আরো কি শোনার ইচ্ছা ছিল বলুন না, দেখি কিছু আলোচনা হয় কি না। এখানে তো আরো অনেকেই এই নিয়ে কাজ করেন।

নীরদ চৌধুরীর লেখার ভঙ্গি নিয়ে তো অনেক বিতর্ক, তাই ওনার লেখাগুলো একচিমটে নুনের সঙ্গে পড়ি আমি... এক্ষেত্রে আপনার বলা বইটি পড়া হয়নি।

পুতুল এর ছবি

খুব ভাল লাগলো কঠিন বিষয়ের সরল উপস্থাপনা। এই ধরণের লেখা সচলায়তনে খুব বেশী লেখা হয় না।

তবে কেউ কেউ মনে করে মানুষের জন্ম আলাদা আলাদা জায়গায় স্বাধীন ভাবে হইসে। একজায়গায় হইসে সেটা আমি বিস্বাশ করি্। বছর তিনেক কাজ করেছিলাম এক ভারতীয় অতিথি প্রফেসারের সাথে, তিনি পপুলেশন জেনেটিকের গবেষক। আলাদা আলাদা জায়গায় স্বাধীন ভাবে মানুষের উৎপত্তি হইসে এই কথাটা কেবল তাঁর কাছেই শুনি। এদের পক্ষে শক্ত কোন যুক্তি আছে?
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কৌস্তুভ এর ছবি

ধন্যবাদ। আর ধুগোদারও ধন্যবাদ প্রাপ্য, উনিই আমাকে আমার কাজের বিষয়ে বেশি করে লিখতে পরামর্শ দেন। অবশ্য পপুলেশন জেনেটিক্স ঠিক আমার কাজের বিষয় না।

কোন ভারতীয় অতিথি প্রফেসর, সেটা কি একটু বলতে পারেন?

আলাদা আলাদা ভাবে মানুষের উৎপত্তি, এটাই তত্ত্ব হিসাবে সবচেয়ে সোজা নয় কি? আমার জানা মতে এটাই প্রাচীনতর থিয়োরি। আর তা ছাড়া, সাদা সায়েবরা আমাদের মত ডার্টি নিগারদের থেকে আলাদা ভাবে বিবর্তিত হয়েছেন, এটা ভাবতেই কি ওনাদের বেশি ভাল লাগত না আগে?

তানভীর এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা। তবে আপনার এই খেদের সাথে আমারো একটু খেদ যুক্ত করি। আপনি যেমন বলেছেন আন্তর্জাতিক জিনচর্চায় উপমহাদেশকে উপেক্ষা করা হয়, তেমনি ভারতীয় নানা গবেষণায় সবসময়ই বাংলাদেশকে উপেক্ষা করা হয়। আমার ধারণা, ভারতীয় নিজস্ব জিন গবেষণা যথেষ্ট অগ্রসর, অন্তত ভারত সরকারের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এই কনসোর্শিয়াম দেখে তাই মনে হয়। অথচ ম্যাপ দেখে বুঝতে পারছেন আমরা প্রায় একইরকম জনজাতি হওয়া সত্ত্বেও এখানে বাংলাদেশ উপেক্ষিত (আমাদের তিন পাশেই ভারত রয়েছে)। বলতে পারেন, এখানে বাংলাদেশকে যেমন রাখা হয় নি তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশকেও রাখা হয় নি। কিন্তু উইকির এই নিবন্ধে দেখবেন তারা পাকিস্তান, শ্রীলংকার বিভিন্ন জাতি নিয়েও গবেষণা করেছে (বাংলাদেশের কথা হালকাভাবে এসেছে)। আমার কাছে সবচেয়ে অবাক লাগে ঘূর্ণিঝড়, বঙ্গোপসাগর ইত্যাদি নিয়ে ভারতীয় গবেষক এবং সরকারী সংস্থার প্রচুর গবেষণা আছে। কিন্তু উপমহাদেশে সবচেয়ে ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ও ঘূর্ণিঝড়-দুর্গত হওয়া সত্ত্বেও কোন এক রহস্যজনক কারণে বাংলাদেশ উপকূলকে বাদ দিয়ে এসব গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয় (দু'একটা ব্যতিক্রম আছে অবশ্যই)।

কৌস্তুভ এর ছবি

ভারতীয় জিনচর্চায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ কেন উপমহাদেশের অন্যান্য দেশগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয় না... নাকি বলব করা যায় না? অন্য দেশগুলি থেকে তথ্য পাওয়া অনেক কঠিন, নিজেদের দেশ হলে লালফিতের ফাঁস অনেক কম, আর সেখানে তাছাড়া পরিকাঠামোরও অভাব থাকে। তবে ব্যাপারটা খেদের তো বটেই।

আমার একটা ব্যক্তিগত মতামত বলি। জিনগত ভাবে সম্পূর্ণ নতুন কোনো সিনারিও যখন উঠে আসার সম্ভাবনা নেই বাংলাদেশের থেকে, তখন সেখানের তথ্য না পাওয়াটা এই মুহূর্তে ততটা উদ্বেগজনক নয় সেই গবেষকদের জন্য যাঁরা সামগ্রিক ছবিটা পেতে চাইছেন।

এনকিদু এর ছবি

তৃতীয় ফলাফলটি সর্বাধিক চমকপ্রদ। যখন বিশুদ্ধ ‘উত্তর ভারতীয়’ গোষ্ঠী, যেমন কাশ্মীরী পন্ডিতরা, ইউরোপীয় জনজাতির বেশ কাছাকাছি, তখন দেখা যাচ্ছে, এই ‘দক্ষিণ ভারতীয়’ গোষ্ঠী কোনো বর্তমান আফ্রিকান জনজাতিরই কাছাকাছি নয় জিন-বৈচিত্রের সাপেক্ষে, যেহেতু বহু হাজার বছর আগে এরা আফ্রিকা ছেড়ে চলে আসে এবং স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। বস্তুত, অন্য কোনো জনজাতির সঙ্গেই এদের মিল নেই। তাই অন্যান্য জনজাতিগুলির জিনলিপি একত্র করলে তার সম্ভারের মধ্যেই উপমহাদেশের জিনবৈচিত্রও অন্তর্ভুক্ত থাকবে, এ ধারণা সঠিক নয়।

যদ্দূর জানতাম, ভারতীয় উপমহাদেশের আমরা সবাই (দুই একটা বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী বাদ দিয়ে) মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিচারে M5 হ্যাপলোগ্রুপের লোক। Y ক্রমোজম নিয়ে তেমন নির্দিষ্ট রেখা টানা সম্ভব হয়নি। কারন সম্ভবত বহির্বিশ্ব থেকে যখন মাইগ্রেশন ঘটে, বেশিরভাগ সময় পুরুষেরাই আসে। যোদ্ধা, বনিক ইত্যাদি পেশার লোকেরা।

চীনাদের উপরেও এধরনের গবেষণা হয়েছিল। দক্ষিনে পাওয়া গিয়েছিল উত্তরের Y ক্রমোজম বহনকারী পিতার সন্তানদেরকে । অনেক প্রজন্ম ধরে উত্তর চীন থেকে দক্ষিনে মাইগ্রেশনের ট্রেন্ডটা তখন ধরা পড়ে। কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ টেস্টে দেখা যায় উত্তর আর দক্ষিন চীনের জনগোষ্ঠী মাতৃধারায় একেবারেই আলাদা। হাজার হাজার বছর ধরে মেয়েরা মাইগ্রেশনে যায়নি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষেরাই মাইগ্রেট করেছে।

এই ফলাফলটা সম্ভবত কয়েক বছর আগের, তারপর সম্ভবত আরো নতুন আবিষ্কার হয়েছে কিন্তু আমার তেমন জানা নেই। আপনার কাছে নতুন তথ্য থাকলে আরেকটা লেখা দেয়ার অনুরোধ থাকল।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

কৌস্তুভ এর ছবি

"ভারতীয় উপমহাদেশের আমরা সবাই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিচারে M5 হ্যাপলোগ্রুপের লোক..." তাই কি? আমি তো জানতাম M হ্যাপ্লোগ্রুপের অনেকগুলি বিভাগই দেখা যায় এখানে, যেহেতু M হ্যাপ্লোগ্রুপই প্রাচীনতম আফ্রিকার বাইরে আসা মাইগ্রেশন বলে ধরা হয় এবং তারপর তা নানা ভাগ হয়েছে। এবার সব 'দক্ষিণ ভারতীয়' গোষ্ঠীর উৎপত্তি M5 হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে কিনা তা আমার জানা নেই, তবে মনে হয় না। ওই গবেষণাটি তো দৈহিক ক্রোমোজোম নিয়ে। উইকিও তাই বলছে, M এর অনেকগুলি ভাগ এখানে। একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন না।

"সম্ভবত বহির্বিশ্ব থেকে যখন মাইগ্রেশন ঘটে, বেশিরভাগ সময় পুরুষেরাই আসে। যোদ্ধা, বনিক ইত্যাদি পেশার লোকেরা।"
এটা সত্যি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যেটা মাইটোকন্ড্রিয়াল আর Y ডিএনএ থেকে বেরিয়েছে; শুধু দৈহিক ক্রোমোজোম থেকে এটা পাওয়া যেত না। তবে এই বিষয়টা আর এই লেখায় আনিনি, আপনি তুলে ভাল করলেন।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

খুব ইন্টারেস্টিং! সেদিনই ডকিন্সের 'দ্যা অ্যানসেস্টরস টেইল' অডিও বইটি শুনে শেষ করলাম। অনেক প্রসঙ্গ আপনিও এখানে আলাপ করেছেন। মজা লাগল খুব।

আশা করি এই সমস্ত গবেষণা ধর্মীয় গোঁড়ামির রোগগুলো সারাতে সাহায্য করবে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

কৌস্তুভ এর ছবি

সত্যিই এই বিষয়গুলো খুব ইন্টারেস্টিং, সহজ ভাষায় ভালো ভাবে বলতে পারলে বাইবেলের গল্পের থেকেও বেশি ইন্টারেস্টিং হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

ডকিন্সের অনেক বই পড়লেও 'দ্যা অ্যানসেস্টরস টেইল' পড়া হয়ে ওঠেনি। শিগগিরই পড়ে ফেলব আশা করি। শুনেছি বেশ নতুন ভঙ্গীতে লেখা।

আপনার আশায় সহমত।

হিমু এর ছবি

এটা ডকিন্সের ম্যাগনাম ওপাস তো বটেই, বিজ্ঞানবিষয়ক যত গ্রন্থ আমি পড়েছি [খুব বেশি নয়], তার মধ্যে মহাকাব্যিক। ক্যান্টারবারি টেইলসের কাঠামোটি ঋণ করে বিবর্তনের পথে বিভিন্ন পথিকের যাত্রার গল্প বলা হয়েছে এতে, বর্তমান থেকে অতীত অভিমুখে। বিবর্তনের গল্পে বিভিন্ন বাঁক, সাঁকো, চড়াই-উৎরাই নিয়ে লেখা। এখনও পড়ে না থাকলে পড়ে ফেলুন। সুলভ সংস্করণ না কিনে শোভনটা কিনুন, বিজ্ঞানবিষয়ক একটা বই কত সুন্দর করে ছাপানো সম্ভব, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।



বুকে BOOK রেখে বন্ধু চলো আজ যাবো বরাহশিকারে মোরা ধার ধার ধার দিও বল্লমে ♪♫

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

বইটা পুরোটাই অসাধারণ তো বটেই। তবে মানুষের বিবর্তনে কিকরে আগের স্পিসিস থেকে আমাদের স্পিসিসের বিবর্তনের পার্থক্য করা যায় সেটা ব্যাখ্যাটা এই মুহুর্তের তুলে ধরতে চাইছি।

একজন আইনবিদ প্রশ্ন তুলেছিলেন:
সহজভাবে দুটো প্রাণীকুলকে স্পিসিস বলা যায় যদি তাদের মধ্যে ইন্টারব্রীড সম্ভব না হয়। যেমন: আফ্রিকান মানুষ আর ককেশিয়ান মানুষের মধ্যে ইন্টারব্রিড সম্ভব। তাই তারা ভিন্ন স্পিসিস না, ভিন্ন রেইস। একইভাবে কুকুর আর বানরের মধ্যে ইন্টারব্রিড সম্ভব নয়, তাই তারা স্পিসিস। এখন যদি একজন বানর আর একজন মানুষের মধ্যে ইন্টারব্রিড সম্ভব না হয় তাহলে কী করে বানর থেকে মানুষের বিবর্তন সম্ভব?

এর ব্যাখ্যাটা হচ্ছে এমন। অনেকে মনে করে স্পেসিয়েশন একটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া প্রক্রিয়া। কিন্তু আসলে সেটা তা নয়। দুটো স্পিস শুরুতে প্রায় একই রকম থাকে এবং তাদের মধ্যে ইন্টারব্রিড সম্ভব। সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে দুরত্ব বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে এসে তাদের মধ্যে আর ইন্টারব্রিড সম্ভব হয় না।

ধরা যাক, বর্তমান মানুষ একটা টাইম মেশিন তৈরী করেছে। এই টাইম মেশিনে যদি পেছনের দিকে যাওয়া যায় তাহলে ১০০ বছর পূর্বে গিয়ে দেখা যাবে তখনকার এক বিপরীত লিঙ্গের সাথে ব্রিড করা সম্ভব হচ্ছে। তখনকার একজনকে টাইম মেশিনে সঙ্গী করা হল। এরপর আরও একশত বছর আগে গিয়ে দেখা যাবে, টাইম মেশিনের দুজনেই ব্রিড করতে পারছেন। এবার তৃতীয় আরেকজনকে টাইম মেশিনে তুলে পুনরায় যাত্রা শুরু করা হল।

এভাবে একে এক যেতে যেতে দেখা যাবে এক পর্যায়ে বর্তমান মানুষ আর ব্রিড করতে সক্ষম হচ্ছেন না। কিন্তু সেই সময়ের একশত বছর নতুনতর একজন ব্রিড করতে পারছেন। ঠিক সেই সময়টাকেই বলা যাবে আমাদের তুলনায় এক স্পিসিস আগের প্রজাতি।

এই রকম আরো অনেক অনেক মজার মজার বৈজ্ঞানিক তথ্যে ভরপূর বইটি।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

কৌস্তুভ এর ছবি

স্পিশিয়েশন ব্যাপারটা সংক্ষেপে সুন্দর বললেন। এ বিষয়ে একাধিক তত্ত্ব আর তাই নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ, যার সুযোগটা নিয়ে ক্রিয়েশনিস্টরা (এর বাংলাটা কি যেন?) লোকের কান ভাঙাচ্ছে...

কৌস্তুভ এর ছবি

হ্যাঁ, ফিরে গিয়েই এটা লাইব্রেরি থেকে তুলে পড়ব। আশা করি তাদের কাছে শোভন সংস্করণটা থাকবে। আসার আগের দিনই শেষ করে এলাম এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ বইটি।

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন। অনেকটাই অবশ্য মাথার ওপর দিয়ে যায়। হয়তো আপনার কাছে ভালোই লাগবে। মোটের ওপর আমার খারাপ লাগে নি।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

কৌস্তুভ এর ছবি

লিঙ্কটার জন্য ধন্যবাদ। বিশাল লেখা, আর প্রচুর তথ্যে ভরা। খানিকটা সময় বের করে পুরোটা পড়তে হবে। লেখক দেখলাম বিষয়ের বেশ ভিতরে গিয়ে তথ্যাদি দিয়েছেন, নিশ্চয়ই উনি এই পেশারই লোক। আমি তো আবার ঠিক এই লাইনে নই, সাইডলাইন থেকে যেটুকু শেখা যায় আর কি।

পৃথিবী [অতিথি] এর ছবি

কৌস্তুভ লিখেছেন:
স্পিশিয়েশন ব্যাপারটা সংক্ষেপে সুন্দর বললেন। এ বিষয়ে একাধিক তত্ত্ব আর তাই নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ, যার সুযোগটা নিয়ে ক্রিয়েশনিস্টরা (এর বাংলাটা কি যেন?) লোকের কান ভাঙাচ্ছে...

ক্রিয়েশনিজমকে সৃষ্টিবাদ বলাটাই মনে হয় শ্রেয় হবে।

বাই দ্যা ওয়ে, আপনি বোষ্টনে থাকেন দেখে একটু কৌতূহল বোধ হচ্ছে। যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত, একটু বলবেন কি?

কৌস্তুভ এর ছবি

ভাল মনে করিয়ে দিয়েছেন। ধন্যবাদ।

আমি হার্ভার্ডে আছি, বায়োস্ট্যাটিস্টিক্স ডিপার্টমেন্ট। আপনিও কি ওদিকে নাকি? তাহলে তো ভালই...

পৃথিবী [অতিথি] এর ছবি

না, তবে হার্ভার্ড-এমআইটির দিকে ইচ্ছা আছে। একারণে বোষ্টনে থাকে এবং পেশায় গবেষক, এরকম কারও নাম শুনলে কৌতূহল হয়।

আপনি কি হার্ভার্ডে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করেছেন? আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্তরে পূর্ণ বৃত্তি আমি আশা করি না কিন্তু ঠিক কতটুকু দেয়, সে সম্পর্কে কিছু কি বলতে পারবেন? বিশেষ করে ২০১২ সালের দিকে যদি আবেদন করি?

কৌস্তুভ এর ছবি

ও, আচ্ছা। ভালই তো।

না, আমি ডক্টরেট করছি। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্তরের সম্পর্কে আমি খুব কমই জানি, এটা শুনেছি যে বৃত্তি খুব কম। আর আন্তর্জাতিক ছাত্র হলে তো আরো মুশকিল। আপনি যে বিষয়ে আছেন তার ডিপার্টমেন্টের হর্তাকর্তা কাউকে মেল করে জিজ্ঞেস করতে পারেন। বেশি তথ্য দিতে না পারলেও, অন্তত কথাবার্তা বলার বিষয়ে এরা বেশ ফ্রি হয়, আমাদের দেশের মত অত স্যার, স্যার করার দরকার পড়েনা।

আমার ব্যক্তিগত মত, এখানে ব্যাচেলর করার খরচ এবং পরিশ্রম দুটোই অত্যন্ত বেশি, তাই দেশ থেকে থেকে সেটা সেরে এখানে সরাসরি ডক্টরেট করার জন্য আবেদন করলে (৪ বছর ব্যাচেলর করলে আর মাস্টার্সের প্রয়োজন হয় না) ফান্ডিং পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

আর্থিক মন্দার পর থেকে এরা অনেক সতর্ক হয়ে গেছে। এখন মন্দা থেকে উন্নতি শুরু হলেও ফান্ডিং এর ব্যাপারে আগের মত উদার হবার সম্ভাবনা কম। এই হার্ভার্ড যেমন, যা লস স্বাভাবিকভাবে হত তার থেকে অনেক বেশি লস করে ফেলেছে লগ্নির ভুলে। যার জন্য কয়েকজন হর্তাকর্তাকে পদও খোয়াতে হল।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা বেশ ভাল লেগেছে। মানব বিবর্তনের মত বিষয় নিয়ে লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এইসব নিয়ে আমার জ্ঞান খুব-ই কম(কিছু ডকু আর ডকিন্স-কোয়েনের বই পর্যন্ত ভরসা) তবু একটু আলাপ করি।

অতএব, যথেষ্ট অতীতে গেলে আমরা পাব, এক জনগোষ্ঠীর এক ‘সাধারণ পূর্বপুরুষ’। এবার মনে করুন, সাদা/ককেশিয়ানদের একজন পূর্বপুরুষ পেলাম, চৈনিকদের একজন, আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের একজন। এখন যদি আবার পেছাতে শুরু করি, তাহলে এই তিনজনেরও এক জনই ‘সাধারণ পূর্বপুরুষ’ পাওয়া যাবে, যাকে বলা যেতে পারে সমগ্র মানবজাতির আদিপুরুষ
।০

বিবর্তন মনে হয় ঠিক এইভাবে ঘটে না। একজন বা একজোড়া কমন এ্যান্সেস্টর খুঁজে বের করা মনে হয় সম্ভব না। একটা প্রজাতির ঠিক একটা বা একজোড়া প্রাণী অন্য প্রজাতিতে পরিণত হওয়া বিবর্তনের নিয়মবিরুদ্ধ। বিবর্তন প্রজাতির একক সদস্যের উপর না হয়ে পুরো প্রজাতির জিন ফ্রিকোয়েন্সিতেই হয়। শিমাঞ্জিদের মধ্য থেকে একটী কাপল মানুষ হয়ে যায় নি বরং শিপাঞ্জি ও মানুষের কমন অ্যান্সেস্টরদের মধ্যে ভৌগলিক বিছিন্নতা ঘটাতেই তারা স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হতে শুরু করে ছিল।

এ্যাডাম এবং ইভ মিতোলজিকাল ক্যারেক্টারের নামে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ইভ এবং ওয়াই ক্রোমোজম আড্যামের নামকরণ করা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে বাইবেলিক আড্যাম-ইভের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া গেছে! কিছু ক্রিয়েশনিস্ট এসব অপব্যাখ্যা চালানোর চেষ্টা করেন। এইসব পুরাই যুক্তিহীন- মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভের বয়সের সাথে ওয়াই- ক্রোমোজম এড্যামের ৮৪০০০ বছরের ডিফারেন্স!
আফ্রিকাতে আদিম মানুষের আবির্ভাব আর একাধিকবার বহির্গমন এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে। উপমহাদেশের জিন গবেষণায় আসলে আমাদের নিজেদের-ই এগিয়ে আসতে হবে। সার্ক জিন গবেষণা কেন্দ্র টাইপ কিছু থাকলে ভাল হত মনে হয়। সার্ক তিন দশকে কি কাজ করেছে সেটাই এখন বড় মজার প্রশ্ন! তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের দেশেই এই কাজ হবে- কারণ জিনোম সিকোয়েন্সিং আগের চেয়ে অনেক সহজে, অল্প ব্যয়ে আর অল্প খরচে করার পদ্ধতি আসছে প্রতিনিয়ত-ই।
বিদ্র; আপনি হাভার্ডে পড়েন জেনে ভাল লাগল এবং কমেন্ট করতে বেশ ভয় পেলাম! জিন সিকোয়েন্সিং পদ্ধতি নিয়ে আপনার কাছ থেকে একটা লেখা দাবি করছি। শটগান নিয়ে রেডি হয়ে যান প্লিজ!

পৃথিবী [অতিথি] এর ছবি

বিবর্তন মনে হয় ঠিক এইভাবে ঘটে না। একজন বা একজোড়া কমন এ্যান্সেস্টর খুঁজে বের করা মনে হয় সম্ভব না। একটা প্রজাতির ঠিক একটা বা একজোড়া প্রাণী অন্য প্রজাতিতে পরিণত হওয়া বিবর্তনের নিয়মবিরুদ্ধ। বিবর্তন প্রজাতির একক সদস্যের উপর না হয়ে পুরো প্রজাতির জিন ফ্রিকোয়েন্সিতেই হয়। শিমাঞ্জিদের মধ্য থেকে একটী কাপল মানুষ হয়ে যায় নি বরং শিপাঞ্জি ও মানুষের কমন অ্যান্সেস্টরদের মধ্যে ভৌগলিক বিছিন্নতা ঘটাতেই তারা স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হতে শুরু করে ছিল।

ওই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে যারা মানুষ(মানুষ বলতে সাধারণত যা বোঝানো হয়, বিবর্তনের ধারায় সাধারণ পূর্বপুরুষের দিকে এগুতে থাকলে কাকে মানুষ আর কাকে অমানুষ বলব তা ঠিক করা কিন্তু প্রায় অসম্ভব) হয়েছে, তারাই আজকের শ্বেতাঙ্গ-কৃষাঙ্গ-চৈনিকদের পূর্বপুরুষ। অর্থাৎ, "মানুষ" হওয়ার পরই তারা বিভিন্ন এথনিসিটিতে বিভক্ত হয়েছে। আমার তো মনে হয় লেখক তাই বলছেন।

এ্যাডাম এবং ইভ মিতোলজিকাল ক্যারেক্টারের নামে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ইভ এবং ওয়াই ক্রোমোজম আড্যামের নামকরণ করা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে বাইবেলিক আড্যাম-ইভের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া গেছে! কিছু ক্রিয়েশনিস্ট এসব অপব্যাখ্যা চালানোর চেষ্টা করেন। এইসব পুরাই যুক্তিহীন- মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভের বয়সের সাথে ওয়াই- ক্রোমোজম এড্যামের ৮৪০০০ বছরের ডিফারেন্স!

লেখক কিন্তু ওদিকে যাননি!

অতিথি লেখক এর ছবি

পৃথিবী,
আমার কোট করা অংশটা খেয়াল করুন। সমগ্র মানবজাতির আদিপুরুষ পয়েন্টটার কথা আমি বলেছি। এথনিসিটির ক্ষেত্রে আমার কোন দ্বিমত নাই লেখকের সাথে।
আর এ্যাডাম-ইভ নিয়ে লেখকের লেখার সাথে আমার কোন দ্বিমত নেই। তবে আমি একটু ব্যাখ্যা দিলাম এ কারণে যে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা যেন এ থেকে ফায়দা লুটতে না পারে। বাংলা ব্লগেও এরা আছে। আমার পয়েন্টটা কিছু সৃষ্টিতত্ত্ববাদীর উদ্দেশ্যে, লেখকের উদ্দেশ্যে তো কোনভাবেই নয়।
পথিক রহমান

কৌস্তুভ এর ছবি

হ্যাঁ, এ্যাডাম-ঈভ নিয়ে একটুখানি সুযোগ পেলেই যে ওরা তার ফায়দা লুটবেনা এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। যাহোক, এ বিষয়ে আপনাদের সহমত দেখে প্রাণে বল পেলাম।

অতিথি লেখক লিখেছেন:
বিবর্তন মনে হয় ঠিক এইভাবে ঘটে না। একজন বা একজোড়া কমন এ্যান্সেস্টর খুঁজে বের করা মনে হয় সম্ভব না।

পথিক রহমান, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনি যে ভাবে এ্যান্সেস্টর দেখছেন, সংযুক্তি তত্ত্ব (coalescent theory) সেইভাবে দেখে না। এই থিওরিটা পেছন দিকে যায়, এটা ধরে সামনের দিকে এগোলে এর বক্তব্য এইরকম - মনে করুন একটা জনজাতি, যার ১০০০ লোক, তারা ইচ্ছামত ছানাপোনা পয়দা করছে কিন্তু এমনভাবে যাতে জনসংখ্যা একই থাকে সবসময়। তাহলে সুদূর ভবিষ্যতে এমন একটা সময় আসবে যখন উপস্থিত সব ১০০০ মানুষের মধ্যে এই এখনকার ১০০০ জনের কোনো এক ভাগ্যবানের, ধরুন ক, জিন থাকবে।
অর্থাৎ একজন সাধারণ পূর্বপুরুষ থাকবে, যিনি হচ্ছেন এই ক-বাবু। এবার উলটে দেখতে গেলে, তখনকার কোনো গবেষক বলবেন, হ্যাঁ, অতীতের এই ক-বাবুই আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ।
তার মানে, এখনকার অনেকের জিনই ভবিষ্যতে বিলীন হয়ে যাবে, তাঁর বা তাঁর বংশধরদের সন্তানোৎপাদনের অক্ষমতায়।

আপনি ঠিকই বলছেন, যে সুদূর অতীতে যে ক-বাবু একাই ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে বেড়াতেন এমন নয়। তিনি একটা গোষ্ঠীরই অংশ ছিলেন। কিন্তু এই তত্ত্ব অনুযায়ী শুধু তাঁকে নিয়ে কাজ করলেই চলে। বুঝতেই পারছেন, এনার অস্তিত্ব হল তাত্ত্বিক, তাই এমন কাউকে শনাক্ত করার কথা আসে না।

পৃথিবী অতিথি লিখেছেন:
অর্থাৎ, "মানুষ" হওয়ার পরই তারা বিভিন্ন এথনিসিটিতে বিভক্ত হয়েছে।

এটা আউট-অফ-আফ্রিকা তত্ত্ব বলে। কিন্তু পুতুল যার উল্লেখ করেছেন, সেই আলাদা আলাদা উৎপত্তি তত্ত্ব এর উলটো কথা বলে, যে আগে ভাগ হয়েছে তারপর মানুষে বিবর্তিত হয়েছে। তবে সেটা আজকাল তেমন কলকে পায় না।

অতিথি লেখক লিখেছেন:
বিদ্র; আপনি হাভার্ডে পড়েন জেনে ভাল লাগল এবং কমেন্ট করতে বেশ ভয় পেলাম!

কেন, তাতে কি আমার দুটো শিং গজিয়েছে, যে আপনি এটাসেটা বললে তেড়ে আসব? এরকম বলে দয়া করে বিড়ম্বিত করবেন না।

অতিথি লেখক লিখেছেন:
জিন সিকোয়েন্সিং পদ্ধতি নিয়ে আপনার কাছ থেকে একটা লেখা দাবি করছি। শটগান নিয়ে রেডি হয়ে যান প্লিজ!

ওটা তো বেশ টেকনিকাল ব্যাপার হয়ে যাবে, তাই ওধরনের পথে যেতে চাইছি না। মুখরোচক সহজতর বিষয় নিয়ে লেখা পর্যন্তই আমার এলেম... আপনি একটা চেষ্টা দেন না বরং। আর সত্যি বলতে কি, ওটা আমার লাইন না আদৌ, সাইডলাইন বড়জোর...

a00achalaina এর ছবি

আপনি কি হিউম্যান হ্যাপ-ম্যাপ প্রজেক্টের কথা বলছিলেন? হ্যাপ-ম্যাপ সম্ভবত সবচেয়ে বেশী ফ্রিকোয়েন্ট এমন ৩০টি হ্যাপ্লোটাইপ সিকোয়েন্স করবে বা এমন একটা কিছু শুনেছিলাম। তবে, এর মধ্যে কোন উপমহাদেশীয় হ্যাপ্লোটাইপ নেই এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।

কৌস্তুভ এর ছবি

হ্যাঁ, হিউম্যান হ্যাপ-ম্যাপ প্রজেক্ট নিয়েই বলছিলাম।

হ্যাপ-ম্যাপ সম্ভবত সবচেয়ে বেশী ফ্রিকোয়েন্ট এমন ৩০টি হ্যাপ্লোটাইপ সিকোয়েন্স করবে বা এমন একটা কিছু শুনেছিলাম।

আমার জানা প্ল্যান এইটা নয়। বিস্তারিত বলতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে, সাঁটে বলছি।
ওঁরা যাঁদের নমুনা নেবার জন্য নির্বাচিত করেছেন, তাঁদের সব কটি ক্রোমোজোম থেকেই অন্ততঃ প্রতি ৫০০০ বেস-এ একটি এইরকম ঘনভাবে স্নিপ (SNP) নিচ্ছেন। এটা হল জিনোটাইপিং পর্যায়।

এই জিনোটাইপ গুলি থেকে এবার হ্যাপ্লোটাইপ নির্ণয়, এবং বহু ক্ষেত্রে আন্দাজ, করতে হয়েছে। যথাসম্ভব সম্পূর্ণভাবে। মাত্র তিরিশটি, এমন নয়।

এই কাজটার উদ্দেশ্যই ছিল এই হ্যাপ্লোটাইপগুলো জানা। জানা তিরিশটা হ্যাপ্লোটাইপ সিকোয়েন্স করবে এদের ক্ষেত্রে, এমন নয়।

জিনোটাইপ জানা সোজা, হ্যাপ্লোটাইপ জানা কঠিন। এই হ্যাপ্লোটাইপগুলো জানা থাকলে পরবর্তীকালে লোকেদের জিনোটাইপ থেকে হ্যাপ্লোটাইপ আন্দাজ করা যাবে। এইটা হল প্ল্যান।

আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল ট্যাগ-স্নিপ নির্বাচন করা। কিন্তু সে অন্য ব্যাপার।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।