শ্রীমতী এমা ওয়েজউডের বয়স তখন তিরিশ পেরিয়েছে। বাড়ির দাদা ও দিদিরা সবাই বিয়ে-থা করে অন্যমুখো। কেবল এক দিদি বাড়িতেই থাকেন, তাঁর হাড়ের অসুখ, বিয়ে হয়নি; এই দিদি, শয্যাশায়ী মা আর বুড়ো বাপের দেখাশোনা এমা’কেই করতে হয়। তাঁর নিজেরও এই বয়সে আর বিয়ের আশা নেই বললেই চলে।
এমন সময় হঠাৎ করেই তাঁর পিসতুতো ভাই চার্লস ডারউইন তাঁকে প্রপোজ করে বসলেন। ১৮৩৮ সালের ১১ই নভেম্বর। অবস্থা বিবেচনায় এমা রাজি হয়ে গেলেন, যদিও চার্লস তাঁর চেয়ে বয়সে খানিক ছোটই। দ্রুতই মাখো-মাখো মিঠে-মিঠে প্রেমপত্র আদানপ্রদান হতে লাগল, এরই মাঝে ডারউইন একদিন এমাকে নিয়ে এসে লন্ডনে একটা ভাল বাসা দেখে গেলেন নবদম্পতির জন্য। তড়িঘড়ি বিয়ে করার জন্য ডারউইনের ভারি উৎসাহ।
নববর্ষের আগের দিন, ৩১শে ডিসেম্বর ডারউইন বাড়ির চাবি হাতে পেলেন। দুজনে মিলে দোকানপাট ঘুরে ঘুরে বাড়ির আসবাবপত্র পর্দাটর্দা সব কেনা হল, রঙের বাহার দেখে বাড়িটিকে ‘ম্যাকাও কটেজ’ নাম দিয়ে ফেললেন তাঁরা। অতঃপর নতুন বছরের ২৯শে জানুয়ারি ওয়েজউড পরিবারের এস্টেট, মেয়ার হল’য়ের গীর্জায় শুভকর্ম সমাধা হল। এমা’রই এক তুতো-ভাই সেখানকার পাদ্রী, তিনিই বিয়ে পরিচালনা করলেন।
বীগল থেকে যাত্রা সমাপ্ত করে ডারউইন ইংল্যান্ডে এসে নামেন ১৮৩৬ সালে। এরপর ক্রমে ক্রমে তাঁর সংগ্রহ করা পাথর এবং জীবজন্তু যেমন তিনি জিওলজিকাল ও জ্যুলজিকাল সোসাইটিতে ছাড়তে থাকেন সবার মুগ্ধ বিস্ময়ের মধ্যে দিয়ে, তেমনই তাঁর অভিজ্ঞতার কথা নানারকম জার্নাল, পেপার ও বই হিসেবে লিখতে থাকেন। এবং ডারউইন ছিলেন বেশ সামাজিক উচ্চাকাঙ্খী, যাকে বলে সোশাল অ্যানিম্যাল। প্রথম তিনি ঢোকার সুযোগ পান জিওলজিকাল সোসাইটিতে, এবং সেই যোগাযোগ ভাঙিয়ে অ্যাথেনিয়াম ক্লাব ইত্যাদি এলিট’দের সমিতিতে জায়গা করে নিতে থাকেন। আর গর্বের সাথে F.R.S. ইত্যাদি পরিচয়গুলো নিজের কার্ডে/লেখায় সর্বত্র ছাপাতেও থাকেন। অতএব সোশাল লাইফের সেন্টার এই লন্ডন শহরে একখানা বাসা ডারউইনের খুবই দরকার ছিল।
লন্ডন শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে ইউস্টনে তখন গড়ে উঠেছে শহরের প্রথম রেল স্টেশন, সেখান থেকে খোলা কামরার ট্রেন পাঁচ ঘন্টায় পৌঁছে যাচ্ছে বার্মিংহামে, যার কাছেই ডারউইনের পারিবারিক আবাস। ওই অঞ্চলটা এমনিতেও ডারউইনের পরিচিত, বীগল থেকে ফিরে কাছেই এক গলিতে এক ভাইয়ের বাসায় কিছুদিন থেকেছিলেন তিনি। অতএব স্টেশনেরই লাগোয়া ভদ্রপল্লী, গাওয়ার স্ট্রিটে ডারউইন খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলেন ওই বাসা’খানা, যার কথা আগেই বলেছি।
তবে ওই বাসায় তাঁরা ছিলেন মাত্র চার বছর। ধুলো-ধোঁয়া আর ভিড়ভাট্টায় ভরা লন্ডন শহর এমা’র ভালো লাগছিল না। নিজের পরিবার থেকে এই প্রথমবার এত দূরে এসে, একদম অপরিচিত একটা ব্যস্ত শহরে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তিনি। এর মাঝে পরিবারের সংখ্যাও বেড়েছে, দুইজোড়া কচি কচি পা এইটুকু বাড়িতে আর আঁটছে না। এমন অবস্থায় ১৮৪২ সালের শেষদিকে কাছেই কেন্ট’য়ে ডাউন হাউসে চলে যান তাঁরা সপরিবারে।
(ডারউইনরা চলে যাবার পর বারকয়েক হাতবদল হয়ে ওই বাড়িটা হয়ে ওঠে গরীব শ্রমিকদের আবাস, এক সময় শ’য়ের উপর লোক থাকত সেখানে। তারপর UCL ওরফে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন তাদের ক্যাম্পাস বাড়াবার সময় নিয়ে নেয় বাড়িখানা, সেখানে ছাত্রাবাস করে। এর মধ্যে লন্ডন পৌরসভা ‘এখানে ডারউইন বাস করিতেন’ বলে একটা নীল ফলক লাগিয়ে দিয়েছে সেটার গায়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাড়িটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটাকে পুরো ভেঙে ফেলতে হয়, নতুন ওঠা বাড়িতে তাদের বায়োলজি ডিপার্টমেন্ট বসায় ইউনিভার্সিটি। আর তারই তিনতলায় আপাতত তিনবছরের জন্য একখানা ঘর পেয়েছে এই অধম।)
নতুন বাড়িতে ওঠার অল্পদিন পরেই তাঁদের একটি মেয়ের জন্ম হয়। কিন্তু এক মাস বাদেই মেয়েটি অসুখে মারা যায়। অবশ্য তার পরেও আরো সাতটি সন্তান হয়েছিল তাঁদের, যার মধ্যে সবচেয়ে ছোটোটি ছাড়া সবাই দীর্ঘদিন বেঁচেবর্তে ছিল।
অল্পবয়সী শিশুদের জন্মের পরে কোনো এক সময় আচার-অনুষ্ঠান করে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা দিতে হয়, তাকে বলে ব্যাপ্টিজম। এতদিন প্রচলিত ধারণা ছিল যে, লন্ডনে জন্ম হওয়া দুটি ছেলেমেয়েকে ব্যাপ্টাইজ করা হয়েছিল বাড়ির কাছেই বিখ্যাত এবং (তৎকালীন) নবনির্মিত সেন্ট প্যানক্রাস চার্চে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারির ডারউইন ডে সেমিনারে আমাদের ইউনির এক বিজ্ঞানের-ইতিহাস গবেষক আমাদের শোনালেন, সে ধারণা ভুল।
বইপত্রে তেমনটিই লেখা থাকলেও, সেন্ট প্যানক্রাস কেন, আসপাশের কোনো চার্চের দলিল-দস্তাবেজেই ডারউইন পরিবারের কারো ব্যাপ্টিজমের উল্লেখ পাওয়া যায় না। বরং সেই উল্লেখ পাওয়া যায় সুদূর মধ্য ইংল্যান্ডে এমা’দের পারিবারিক গীর্জা মেয়ার হল’য়ে।
ডাউন হাউসে উঠে আসার পরপরই জন্ম হওয়া শিশু মেরী’র ব্যাপ্টিজমের জন্য যথেষ্ট সময় ছিল না, তাই তাকে অসুস্থ অবস্থায় তড়িঘড়ি সেখানেই ব্যাপ্টাইজ করে ফেলা হয়। কিন্তু পরে জন্মানো আরো কয়েকটি সন্তানকে এমা নিজের বাপের বাড়ি নিয়ে গেছিলেন ব্যাপ্টিজমের জন্য। কেবল পরের দিকের সন্তানদেরই ডাউন হাউসে ব্যাপ্টাইজ করা হয়েছিল, ততদিনে সেখানেই তাঁরা থিতিয়ে গেছেন।
একটু ভেবে দেখলে, ব্যাপারটা আশ্চর্যের কিছুই না। বরং আমাদের জীবনের সঙ্গেও অনেক মিল পাওয়া যায় এমা’র আচরণের। আমরা যারা দেশ ছেড়ে পড়াশোনার জন্য বিদেশ আসি, প্রথম নেমেই বাড়িতে একটা ফোন করার জন্য উতলা হয়ে উঠি। প্রথমদিকে রোজই বাড়ির সঙ্গে কথাবার্তা চলে, তারপর ফোন করার হার ক্রমেই কমে আসে। হয়ত অল্প একটু অপরাধবোধ হয়, কিন্তু বলি, মুজতবা আলী মাসে একটা চিঠি লিখতে পারতেন মা’কে, তাতেই তাঁরা চালিয়ে নিতেন; এখন স্কাইপে রোজ মুখ দেখানোর কী দরকার?
তাও চেষ্টা থাকে বছরে একবার অন্তত দেশে যাওয়ার। পরিবারের টানে তো বটেই, পরিবেশের টানেও। যেখানে ছোটোবেলা থেকে বড় হয়েছি, সেখানের খাবারদাবার এমনকি ধুলোভরা রাস্তাগুলোও বড্ড চেনা, কেবলই মনে পড়ে। আর এই ব্যস্ত শহরগুলোকে মনে হয় অস্থায়ী আস্তানা, অচেনা খাবারগুলো সাময়িক পথ্য।
কিন্তু আস্তে আস্তে এই জায়গাগুলোতেই অভ্যস্ত হয়ে যাই। যারা চাকরীতে ঢুকে যায়, তারা দেখতে পায় যে ছুটির অভাবে ইচ্ছামত আর বাড়ি ফেরা যাচ্ছে না। মা-ও বুঝে নেয়, ছেলে বড় হয়েছে, ব্যস্ত হয়েছে, কত দায়িত্ব তার। যেটাকে অস্থায়ী বাসা মনে হয়েছিল সেটাই ক্রমে বাড়ি হয়ে ওঠে। তারপর একদিন দেখা যায়, নতুন প্রজন্ম এসে গেছে, যাদের কাছে এইটাই আপন দেশ।
**************************************
দেড়শ বছর এগিয়ে এসে নববিবাহিতা দুষ্ট বালিকা’কে এই পোস্টখানি ডেডিকেট করা গেল। তিনিও তরুণ গবেষককে সঙ্গগুণে একখানি অরিজিন অফ স্পিসিজের মত কিছু লিখতে উদ্বুদ্ধ করলে মোটেই মন্দ হয় না, কেবল এমা’র মত অতটা প্রলিফিক হবেন না এটুকুই আশা করব।
মন্তব্য
চমৎকার
বাহঃ দারুন তো !
ডারউইনের বাড়ি তে থাকার অনুভূতি নিশ্চই আনন্দের । ইতিহাসের গন্ধ পাওয়া যায় তিনবেলা ।
ঠিক অতটাও না, আসল বাড়িখানাই তো নেই আর। তবে লোকজন ডারউইনকে স্মরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে বটে।
বেশ বেশ
---------------------
আমার ফ্লিকার
ভালো লাগলো।
নববিবাহিতাটি কেহে কৌস্তভদা?
সে আছে একজন, কানে কানে কমুনে
চমৎকার কৌস্তভ। শেষটা এসে মন খারাপ দিলে, প্রায় তিন বছর হতে চলল কিন্তু এখনও ঠিক নিজের ঘরটাকে নিজের বাসা বলে বোধ হয় না।
আর দুষ্টু বালিকার জন্যে শুভকামনা। সাত-আটটি কচি-কাচা হাত-পা যেন ব্যাপটাইজ করতে হয় সেই অভিশাপ দিয়ে গেলুম। গবেষকের সাথে দুষ্টুমি জাড়ি থাকুক।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
দুষ্টবালিকাকে অভিনন্দন।
আর কৌস্তভ বালকের হটাৎ এরকম ঘর, বাড়ি, বাচ্চাকাচ্চা এসব নিয়ে লিখতে মন চাইল কেন? এরকম একজন প্রেরণাদাত্রী তারও চাই নাকি?
এহেম এহেম, ইয়ে মানে...
অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
দুষ্টু বালিকাকে অভিনন্দন ।
এটা তো মিস করে গিয়েছিলাম!
লেখা বরাবরের মতো ভালো, তবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষামূলক পোস্ট। ডারউইনের বাসার বর্তমান বাসিন্দাদের তাহলে কচি কচি একজোড়া পা আমদানী করেই ক্ষান্ত দিতে হবে, অন্তত আগামী তিনবছরের জন্য।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
ওরে পাগলা, আজকাল ডারউইনের কোনো বাড়িতেই আর কেউ থাকে না, একটা ল্যাব আরেকটা মিউজিয়াম
বাহ!!! কী দারুণ!!!
মাসুদ সজীব
নতুন মন্তব্য করুন