“ঠিক এক বছর আগে এই সময়টাতে একটানা ১৫ দিন আমরা মাঠে তাবু টানিয়ে কাটিয়েছি! প্রতিটা মূহুর্ত গিয়েছে রুদ্ধশ্বাসে। এরমধ্যেও আসছিল নানান মজার মজার খবর” এভাবেই বর্ননা করছিল ইকো।
১২ মে, ২০০৮ রিকটার স্কেলে ৮মাত্রার এক ভূমিকম্পে ধ্বংশ হয়ে গেছে শিচুয়ান প্রভিন্সের এর ওয়েনচুয়ান সিটি। ধ্বংশযজ্ঞের মধ্য থেকে জীবিত, মৃত মানুষদের উদ্দ্বার ও নানা রকম সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার উদ্ধার কর্মীরা। ধ্বংশযজ্ঞ থেকে বের হয়েই এক মহিলা দেখলো কিছু রাশিয়ান উদ্ধার কর্মী তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে, ওদের দেখেই মহিলা চিৎকার করে উঠলো-“ও মা! কি ভূমিকম্প হয়েছে!! চীন থেকে আমাকে একেবারে রাশিয়া নিয়ে আসলো!”। ১৯৯৬ এ লিজাং ভূমিকম্পে প্রাণে বেঁচে এক মহিলা সব কিছু ছেড়েছূড়ে গিয়ে আবাসন গড়ে তুলেন জাওতং শহরে। ২০০৬ সালে আবার ভূমিকম্প হয় ওখানে। বেঁচে গেলেন তিনি আবারও এরপর এসে আবাসন গড়েন শিচুয়ানের ওয়েনচুয়ানে। ২০০৮ এ এসে ভুমিকম্প আঘাত হানলো এখানেও।
এক বছর পরও শহরটি দেখলে মনে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংশ হয়ে গেছে পৃথিবীর আধুনিক কোনো শহর। ইকো’র কাছ থেকে গল্প শোনে মনে হচ্ছিল জায়গাটা দেখে আসতে পারলে মন্দ হতো না!
ইকো বললো, “তুমি যেতে পারো, কাছাকাছি আরো কিছু ট্যুরিস্ট স্পট আছে, পৃথিবীর প্রথম ‘ইরিগেশন সিস্টেম’ দেখে আসতে পারো, কাছাকাছি একটা টাও উপসনালয় আছে পাহাড়ী জঙলের ভিতর। কবে যেতে চাও?”
“কালই”- বললাম আগ্রহ নিয়ে।
সে বললো “কাল দুপুর পর্যন্ত তো আমি ব্যস্ত থাকবো!”
বললাম, “তুমি বরং লিখে দাও কিভাবে কিভাবে যেতে হবে, আমি এবার একটূ একা একা ঘুরে আসি”
সে কিছুক্ষন ভেবে বললো, “আচ্ছা! এখানে কিছু লোকাল ট্রাভেল এজেন্সি আছে, ওরা বিভিন্ন জায়গায় গ্রুপ নিয়ে ঘুরতে যায়, সাথে একজন গাইডও থাকে। চলো ওদের সাথে কথা বলে দেখি, ওদের আগামী কাল কোনো ট্রিপ আছে কিনা”
বেশ কিছুক্ষন ঘুরোঘুরি করে একটা ট্রাভেল এজেন্সী পাওয়া গেল, ট্যুরও আছে ওদের, সমস্যা হলো একটাই, যে গ্রুপ যাচ্ছে ওদের গ্রুপে কোনো বিদেশী ছিল না বলে ওরা কোনো ইংরেজী জানা গাইড দিচ্ছে না। আমি ইকোকে বললাম “কোনো সমস্যা নেই, মাত্র একদিনের ট্রিপ, দিনে দিনেই ফিরে আসছি, আর বডি ল্যাংগুয়েজ তো আছেই!”
যাই হোক সে আমার জন্য একটা A4 কাগজে কি কি হাবিজাবি কিছুক্ষন লিখলো। কি করতে চাইলে কোন লাইনটা দেখাতে হবে সেটা আবার পাশে ইংরেজীতে লিখে দিয়েছে। প্রথম লাইনেই পরদিন সকালে কি করে ট্যাক্সিতে করে এখানে বাস এর কাছে আসতে হবে তা লেখা। আপাতত যথেষ্ট, বাকীটা প্রয়োজন পড়লে দেখা যাবে।
পরদিন সকালে ঠিক ঠাক এসে পৌছেছি ট্যাক্সি থেকে নেমেই দেখি সাইকেল নিয়ে ইকো দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বুঝতে উঠতে পারলাম না! সে কি আমার সাথে যাচ্ছে!? তাহলে সাথে সাইকেল কেন!
বাস যখন ভূমিকম্প বিদ্ধস্থ শহরে প্রবেশ করছে, আমি উৎসাহ নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলাম। এটা অষ্ট-রসের কোন রসের মধ্যে পড়ে? সম্ভবত বিভৎস রস। ঠিক যেন বোমা দ্বারা বিদ্ধস্থ পুরো শহরটা। এক পাশে সারি সারি তাবু। এখনো হাজার হাজার মানুষ ওই তাবুতে বাস করে।
এমন একটা বাড়ি দেখলাম না যেটা অক্ষত আছে।অথচ কত সুন্দর করে মাত্র কিছু বছর আগেই এই শহর টা গড়ে উঠেছিল! রাস্তার আসে পাশে দেখলে বোঝা যায়, রাজধানী ছংদু’র চাইতেও অনেক বেশি পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল ছোট্ট এই শহরটি। শহরের প্রধান সড়কের মাঝখানে একটি সচ্ছ জলধারা, ওটার দুপাশে নানারকম ছোট ছোট গাছগাছালি তাঁর দুপাশে রাস্তা।
ছবিঃ সঙ্গে থাকা গাইড, হাতের নোটস দেখে দেখে গন্তব্য ঠিক করছে
এবারকার গন্তব্য ‘দুজিয়াঙ্গিয়াং ইরিগেশন সিস্টেম’ খ্রিস্ট জন্মের ২৫৬ বছর আগে গড়ে উঠেছে এই ইরিগেশন সিস্টেম। পাহাড়ি চঞ্চলা নদীকে নিয়ন্ত্রন করে শস্য ফলানোর এমন আধুনিকতম কলাকৌশল খুব সম্ভবত এটাই পৃথিবীতে প্রথম। শিচুয়ান এমনিতেই জমির উর্বরতার জন্য বিখ্যাত চীনে। এবার ঝটপট কিছু ছবি দেখে নেয়া যাক।
এ জায়গাটি সংরক্ষিত করে একটি ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে গরে তুলেছে ওরা। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর একটি সাইট এখন এটা।প্রবেশ পথ এটা।
ইরিগেশন সিস্টেম এ এভাবে বাঁশ দিয়ে পাথর আটকে নদীকে নিয়ন্ত্রন করা হতো।
ঘন সবুজে ছেয়ে আছে পুরো জায়গাটা।
একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন, ইরিগেশন সিস্টেম এর আবিষ্কার কর্তা।
কিছু মজার গাছ।
এই দীর্ঘ শান্ত সুনিবিড় পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় নদীটির কাছে।
এই সেই মিন নদী, যাকে কেন্দ্র করে ইরেগেশন সিস্টেমটি গড়ে তোলা হয়েছিল। যা বদলে দিয়েছিল শিচুয়ানের ভাগ্য।
মিন নদীর পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি সবুজ পাহাড়।
নদীকে এখানে কৃত্রিমভাবে দুভাগ করে দুই দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মানব কল্যানে
যেদিকেই তাকাই দুই হাজার তিনশত বছরের স্মৃতিচিহ্ন। এই ঝুলন্ত ব্রিজটি কত পুরোনো জানা হয় নি!
এবারকার গন্তব্য কিংচেংশান-দুজিয়াং ন্যাশনাল পার্ক। এ জায়গাটা শিচুয়ান প্রদেশের আরও এক উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় জায়গা। এটাও ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর অন্তর্ভুক্ত। সমতল থেকে শুরু করে হাজার বছরের বন বনানী পার হয়ে পাহাড়ের চুড়ো পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টাও অথবা তাও মন্দির। ‘তাও’ মানে হলো ‘পথ’। তাওইজম ঠিক ধর্ম নয়, বৌদ্ধধর্মের মতো এক ধরনের জীবনের পথ চলার নিয়ম কানুন, আদর্শ, বিশ্বাস। দর্শন-আলোচনায় আপাতত না যাই। পাঠকদের আগ্রহ থাকলে, একসময় এ নিয়ে ব্লগর ব্লগর করা যাবে।
আসুন দেখি কেমন এই ন্যাশনাল পার্ক যা জড়িয়ে আছে হাজার হাজার বছরের প্রকৃতি, বিশ্বাস, আচার এবং সংস্কৃতিকে।
যেমন বলেছি, পাহাড়ের গায়ে গায়ে জীর্ণ শরীর নিয়ে খুব সুন্দর এই মন্দিরগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে।
পথ চলতে চলতে এরকম একটা দুটো মন্দির।
কিছু মন্দির এর ডিজাইন সত্যি মন কাড়া।
চারপাশে উচু উচু গাছ, পাহাড়ী আকা বাকা রাস্তা।
মন্দিরগুলো কোনায় কোনায় চাইনিজ লন্ঠন
পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে উঠার সময়, মাঝে মাঝে এমন সুন্দর সুন্দর বিশ্রাম স্থল।
হঠাৎ পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার মাঝখানে এই গাছদুটো। এই গাছ দুটর আছে গল্প। সংক্ষেপে তা এমন- অনেক অনেক আগে এক তরূনী ছিল যার নাম ছিল নানজিয়ান, সে চা উৎপাদন করতো। আর এক রাখাল ছিল যার নাম ছিল শিনান। ওরা একে অপরের প্রেমে মশগুল হয়ে বিয়ে করে। বিয়ের দিন কনে নিয়ে যাওয়ার পথে ডাকাত নানজিয়ান কে নিয়ে যায়। শিনান আপ্রান চেষ্টা করে তাঁর ভালোবাসার মানুষকে রক্ষার জন্য। পারে না, আহত হয়ে পড়ে থাকে পথের মধ্যে। মধ্যরাতে ডাকাতের আস্তানা থেকে নানজিয়ান পালিয়ে আসে, এসে দেখে শিনান এর মৃতশরীর পথের মধ্যে পড়ে আছে। এরপর এখানেই সে আত্মহত্যা করে। বৃষ্টির রাতের শেষে ওদের দুজনের শরীরই অদৃশ্য হয়ে যায়। পরদিনই তাদের মৃত্যস্থলে হঠাৎ আবির্ভুত হয় এই গাছ দুটি, একটী ক্ষতবিক্ষত, অন্যটি অর্ধনগ্ন।
বিকেল হয়ে এসেছে। এবার ফেরার পালা।
চীনের রাজপথ দিয়ে ফিরছি। নিতান্তই গ্রামের মধ্যে এরা এমন প্রসস্ত রাস্তা করে রেখেছে দেখে হিংসে হলো।
ওহ ইকো আসতে পারেনি আমার সাথে। সাইকেল নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, আমি ঠিকভাবে বাসে উঠতে পারি কিনা এই চিন্তা করে। ফিরছি ছংদুতে ফিরে প্রথমেই একটা ফোন করতে হবে ওকে।
(আপাতত চলবে। জোর করে লিখতে চাইনি বলে একটু দেরি হলো এই পর্ব দিতে। আগামী পর্বে সমাপ্য)
অচিন চীন দেখা (ছবি ব্লগ – পর্ব-৩)
মন্তব্য
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
ঠিকাছে চলুক, ভালো লাগছে
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
ব্যস্ততার জন্য মন্তব্য-উত্তর দিতে পারিনি সময় করে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
আপনার সাথে দুজিয়াংগিয়ান ঘুরতে বেশ ভাল লাগলো।
মূর্তিটি কি লি বিং এর হতে পারে?
খুব সম্ভবত এটাই লিং বিং! আপনি তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন নাকি? জানলে তাকে নিয়ে একটা পোস্ট দেন।
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
খুব সুন্দর। চলুক।
কুটুমবাড়ি
আপনার লেখা কম পাই। অথবা আমি ব্যস্ত থাকি বলে কোন ফাকে হোম পেইজ থেকে চলে যায় দেখি না। এনি ওয়ে পড়ছেন জেনে ভালো লাগলো।
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
এখানে ক্লিক করুন- বানানায়তন- ৪ | 'অনুস্বার' বনাম 'ঙ', সাথে 'এ' বনাম 'অ্যা' |
কুটুমবাড়ি
লেখা ও ছবি দেখে ভালো লাগলো । কিন্তু অন্য একটা কারণে খুবই হতাশ ! এজন্য লেখায় প্লাস দিলেও ছবিতে মাইনাস...
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
হা হা হা! বুঝতে পারছি। ছবি দেবো নেক্সট পর্বে। হতাশ হওয়ার কিছু নাই!
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
ইকোটুরিজম দেখে টেখে আমাদের চঞ্চল চিত্তে আর ভূমিকম্প-ধম্মকম্ম ভাল্লাগবে কেন?
অষ্ট রস না, রস নয়খানা...
বানানের দিকে একটু নজর দেন দাদা, নইলে পড়তে বড় কষ্ট...
একেবারে খাঁটি কথা !
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
রস নয়টা নাকি? আমি তো সবগুলার নামও ভুলে গিয়েছি!
একটু হেল্প করেন যদি!
ইকোট্যুরিজম পরের পর্বে আবার ফিরে আসবে, একটু ব্রেক নিলাম...
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
হাস্য, বীর, রুদ্র, করুণ, বিভৎস, ভয়ানক, শৃঙ্গার, অদ্ভুত দিয়ে শুরু হলেও পরে শান্ত যোগ হয়ে এখন নটা রসই স্ট্যান্ডার্ড। উইকি দেখেন http://en.wikipedia.org/wiki/Rasa_%28aesthetics%29
নয় এর পর দেখি আরো দুই- বাৎসল্য, আর ভক্তিও আছে সংযোজন অপেক্ষায়!
লিঙ্ক এর জন্য ধন্যবাদ, আপডেটেড হইলাম!
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"
নতুন মন্তব্য করুন