একসময় আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিলো বাবার সাথে ছেলেদের কোন আবেগপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারে না। ভাবতাম গৃহ যদি হ্য় একটা রাজ্য, বাবার ভুমিকা সেখানে কখনো শাসনকর্তার, আর কখনো বা কোতোয়ালের। আর সন্তানেরা সেখানে যখন তখন শুধুই অপরাধী। কেবল পান থেকে চুন খসার অপেক্ষা।
গম্ভীর মেজাজের বাবা যে আবার মা’র মতো তাঁর সন্তানদের অনেক আদর করেন বা করতে পারেন, এটা কোনোদিন বাস্তবে কল্পনা করা তো দূরের কথা, স্বপ্নেও ধরা পড়েনি আমার কাছে।
‘বাবাকে বলে দেবো’ কথাটা শুনলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো আমাদের তিন ভাইয়ের। মা দেদার ব্যবহার করতেন এই ব্রম্মাস্ত্রটা আমাদেরকে বাগে রাখতে। বিশেষত যখন আমাদের বাড়াবাড়ি নিজে আর সামাল দিতে পারতেন না।
তাই বলে বাবা কি কথায় কথায় আমাদের শাস্তি দিতেন! মোটেও কিন্তু না। কবে সর্বশেষ শাসনকর্তার অধিকার প্রয়োগ করেছিলেনে আমার উপর, একদম মনে করতে পারিনা। এসএসসি পরীক্ষার আগে একবার পড়ায় ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলতে লেগে গিয়েছিলাম। কোন কারণে সেদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছিলেন বাবা। ব্যাট করছি, হটাৎ দেখি দর্শকের ভিড়ে তিনি। একদৌড়ে পাশের আঁখের খেতে ঢুকে হারিয়ে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায়, কম্পিত বক্ষে বাসায় ঢুকি। নিশ্চিত ছিলাম, খবর আছে। আশ্চর্য, একটা কথাও বলেননি বাবা। (আজ নিজে বাবা হয়ে বুঝতে পারি, সেদিন রেহাই পেয়েছিলাম অন্য কোন কারণে নয়। সন্তানের ভীত সন্ত্রস্ত রূপ দেখে পুত্রবৎসল পিতার বুকটা হয়তো হাহাকার করে উঠেছিলো।)
হয়তো বাবা সন্তানদের আদর ভালোবাসা উজাড় করে দেবার সম্পূর্ণ এখতিয়ার দিয়ে রেখেছিলেন মা’কে। আর বাড়ির শৃঙ্খলা রক্ষার্থে গম্ভীর মেজাজের আড়ালে নিজের ভালোবাসাগুলো সংগোপনে লুকিয়ে রাখতেন।
মা’র কাছ থেকে দিনের পর দিন একেকটা আবদার আদায়, ঘুড়ি কেনা বা কবুতর পোষা, বগুড়ায় গিয়ে অরুন বরুণ কিরণমালা সিনেমা দেখে আসা, কি বোকা, একবারো ভাবিনি ভাইয়েরা, মায়ের প্রতিটি সন্মতির পিছনে বাবার মৌন অংশগ্রহণ ছিলো।
কি বুদ্ধুই না ছিলাম আমরা একেকটা ভাইগুলো! বুঝতেই পারিনি, ওই যে আমদের একাগ্রচিত্তে ভালোবেসে যেতেন মা, তার ভিত্তিটা তৈরী করে দিতেন আমাদের গম্ভীর মেজাজের বাবা, মা এবং আমাদেরকে ঘিরে একধরণের নিরাপত্তা বলয় নিশ্চিত করে। কি থ্যাঙ্কলেস দায়িত্ত্ব পালন করে জীবন পাড়ি দিয়েছেন আমাদের বাবা।
১৯৮০ সালে চাকরি নিয়ে বিদেশ যাবার সুযোগ হলো। এয়ারপোর্টে এসে আমাকে জড়িয়ে মা’র সে কি কান্না! ওদিকে আমাদের গম্ভীর মেজাজের বাবার নির্বিকার মুখ। ব্যস্ত রইলেন আমার বাক্স প্যাটরার তদারকিতে আর কোটের পকেটে পাসপোর্ট, অল্প কিছু ডলার আর বোর্ডিং কার্ডের ছহিসালামত অবস্থান নিয়ে।
পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার সময় আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা আরেক পশলা কাঁদলেন। বাবাকে সালাম করে উঠতেই চোখাচোখি হল তাঁর সাথে। একবারও চোখের পাতা কাঁপল না বাবার। বললেন, সাবধানে থাকবি কিন্তু। শাসনকর্তা যে শাসনের আওতা বিদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চান, বুঝে গেলাম।
তখন সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি টেলিফোন ব্যবস্থা ছিলো না। ডাক যোগাযোগই একমাত্র ভরসা। দিনদশেক পর বাড়ি থেকে চিঠি এলো। একটি খামে অনেকগুলো চিঠি। একটা বাবারও, আমাকে লেখা বাবার প্রথম চিঠি। নিশ্চয়ই শাসনকর্তার ফরমানে ভর্তি। তাই রেখে দিলাম খামেই।
মা লিখেছেন, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছিস তো বাপ। রাতে খেয়েটেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাবি। কোন অনিয়ম করবি না কিন্তু।
বড়ভাই জানিয়েছে, তোর ইস্তফা মঞ্জুর করেছে আইসিআই। নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে যা।
ছোটভাইটি লিখেছে, তোমার বিছানাটি এখন থেকে আমার দখলে। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছি।
ছোট বোনটি জানিয়েছে, বিচিত্রা ‘দুবাইওয়ালা’ প্রচ্ছদকাহিনী বের করেছে। বাসায় খুব হিট। মা বাবা পরস্পরকে ‘দুবাইওয়ালার বাবা’ এবং ‘মা’ বলে সম্বোধন করছেন। ইতিতে লিখেছে, ‘দুবাইওয়ালার বোন’।
মা আরো জানালেন, বাবা রাতে ঠিকমতো ঘুমাচ্ছেন না। না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে বিদেশে কে আমাকে জাগিয়ে দেবে, এই তাঁর চিন্তা। বোনটা লিখেছে, এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে আমরা সবাই বাবাকে চোখ মুছতে দেখেছি। ছোটভাইটিও লিখেছে, বাবার কাণ্ড দেখো, ডাইনিং টেবিলে তোমার চেয়ারটায় কাউকে বসতে দিচ্ছেন না।
মনটা আনমনা হয়ে গেলো। বাবার চিঠিটা বের করলাম। কল্পনায় তখনও চশমা পরা বাবার গুরুগম্ভীর প্রতিচ্ছবি।
প্রথম লাইনটা শুধু পড়তে পারলাম। বাকিটা ভেসে গেলো চোখের জলে। অনেক অনেক আদর জানিয়েছেন বাবা আমাকে। আমার সেই গম্ভীর মেজাজের বাবা।
ইন্দোনেশীয় সহকর্মীটা সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এলো। বললো, নিশ্চয় মাদার’স লেটার, রাইট?
ইট ইজ ফ্রম মাই ফাদার, বললাম তাকে। ফিসফিসিয়ে নিজেকে বললাম, বাবা, তুমি আমার অনেক প্রিয় বাবা।
মন্তব্য
কি বলবো বুঝতে পারছি না। বাবারা মনে হয় এমনই হয়। আমাদের বাবাও কোন দিন তেমন কিছু বলত না কিন্তু আমরা তাকে খুব ভয় পেতাম। যদিও এখন আগের চেয়ে ভয় অনেক কমে গেছে
আপনার বাবার জন্য অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা রইলো।
সতত শুভ কামনা ও শুভেচ্ছা।
চমৎকার থাকবেন।
অজানা পথিককে অফুরন্ত ভালোবাসা।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
ভালো লেগেছে লেখা
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
শুভেচ্ছা।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
ধন্যবাদ।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
শুভেচ্ছা।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
খুব ভাল লাগলো। বাবার সাথে মনে হয় অনেকেরই এমন সম্পর্ক। আমারও তাই। বুক ফাঁটে তো মুখ ফুটে না।
ঠিক বলেছেন। বাবাদের আমরা অহরহ ভুল বুঝি।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
চোখ ভিজে উঠলো লেখাটা পড়ে!
আমার বাবা আর বেঁচে নেই। তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার অবস্হাও তাই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
কী বলবো... বলে অনেক কিছুই বোঝানো যায় না...
কড়িকাঠুরে
তবু তো কিছু বলেছেন। কৃতজ্ঞতা।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
আপনাকে ধন্যবাদ।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
ওই একই কাহিনী আমারও, অনেক ধন্যবাদ।
সব বাবারাই তাহলে এমন রহস্যময় আর আমরা বুঝি ভুল। আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
কি অদ্ভূত মিল। সব বাবারাই এমন হয়। লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।
সব বাবারাই এমন। গাম্ভীর্যের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখে। আর সন্তানরা ভুল বুঝতেই থাকে। আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
চোখে জল এনে দিল আপনার লিখা সামান্য কটি লাইন।
ভীষণ স্পর্শী।
লেখাটা আপনার হৃদয় স্পর্শ করেছে জেনে অভিভূত হলাম। লেখাটা লিখতে বসে অনেকবার অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
দেশে যখন ছিলাম ভাবতাম দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন মানুষটিই যেন আমার বাবা, বিদেশে আসার পর থেকে ধারনাটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। এখন একটানা দু-দিন বাড়িতে ফোন না দিলে মা কি ভাবেন জানি না, কিন্তু বাবা কঠিন সুরে হলেও বলেন, কাল কেন ফোন করলি না। তখন ভাবতে থাকি এ কি সেই বাবা, যার ছায়া দেখলে কাদা মাখা শরীর হলেও টেবিলের আড়ালে শরীর লুকিয়ে নিজেকে পড়ালেখায় ব্যস্ত দেখাতাম নিজেকে।
একদম ঠিক বলেছেন। বিদেশে এলে বাবাদের নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ হয়।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে স্নেহের ফল্গুস্রোত। পৃথিবীর সব বাবারাই বোধহয় এরকমি হয়।
অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল।
এই স্নেহটা ওইবয়সে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। আর ভুল ধারণার পাহাড় গড়তে থাকে।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
প্রথম গম্ভীর কণ্ঠে জানাই... দারুণ লিখেছেন... আপনার লেখার নিয়মিত পাঠক হয়ে গেলাম
তারপর কান্না... চোখটা খুব ভিজে উঠলো... বাবাকে খুব মনে পড়লো... একটা লিখেছিলাম অনেক আগে...
http://www.sachalayatan.com/nazrul_islam/9063
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সবার আগে আপনার লেখাটা পড়ে এলাম। হাসতে হাসতে কথা বলে সবাইকে কাঁদিয়েছেন। বিশেষত আমার মত সন্তানদের, যারা নিজেদেরকে শোধরাতে অনেক দেরী করে ফেলেছি।
অনেক ভাল থাকুন ভাই। পিতার মুখোজ্জ্বল করতে থাকুন।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
ভিতরটা খুব করে নাড়া দিয়ে গেল আপনার লিখা।
আশ্বস্ত্ করলেন। পড়েছেন বলে ধন্যবাদ জানাই।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
নতুন মন্তব্য করুন