শেয়ার ব্যবসায় আমার হাতেখড়ি হয়েছিলো জাপানি স্টক এক্সচেঞ্জে, ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে। সেখানকার সূচককে এক ডাকে সারা পৃথিবীর বিনিয়োগকারীরা চেনেন Nikkei Index নামে। জেদ্দাতে ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করছিলাম মাথা গুঁজে, নির্ঝন্ঝাটে। একদিন সৌদি শেখের খাস কামরায় ডাক এলো। ভণিতা না করে বললেন, তোমার ইংরাজিটা ভালো, আজ থেকে আমার জাপানের শেয়ার কেনা বেচার ফাইলটা তুমি দেখবে। কাঁচুমাচু হয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম। পকেটে দুটো পাঁচশো রিয়ালের নোট গুঁজে দিয়ে পিঠ থাবড়ে ভরসা দিলেন। আর এক গাদা ফাইল তুলে দিলেন আমার হাতে।
সেদিন শুধু ফাইল নয়, পৃথিবীর অন্যতম গরিব রাষ্ট্রের অতি নিরীহ পঁচিশ বছরের যুবকের মাথার কোষে উপকোষে তিনি পুঁজি বিনিয়োগের উচ্চাভিলাষ সেঁধিয়ে দিলেন। যা থেকে আজো মুক্ত হতে পারিনি।
যা বলছিলাম। জাপানি স্টক এক্সচেঞ্জের তখন জমজমাট অবস্থা। Nikkei Index ৩০০০০ এর উপর। রোজই এই উছিলায় ওই উছিলায় শুধু বাড়ছেই। টেলেক্সে খটখট করে রিপোর্টের পর রিপোর্ট আসছে। সূচক ৪০০০০ এইতো এলো বলে ধারণা সবার। বলাবাহুল্য, তখনো ফ্যাক্সের প্রচলন হয়নি। আর ইমেইল ছিলো কল্পনাতীত ব্যাপার।
সৌদি শেখের এক মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এক মিলিয়ন একশ হাজার ডলারে পরিণত হলো তিন মাসের মধ্যে। আমার ফার্মাসিস্টগিরি শিকাতে উঠলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটতে লাগলো তাঁর কামরায় শেয়ার নিয়ে আলোচনায়। টেলেক্সে আসা রিপোর্টগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে। অফিসের সংখাগরিষ্ঠ মিশরীয়দের ঈর্ষান্বিত করে রোজ দুপুরে তাঁর ক্র্রাইজলারে চেপে একসাথে লাঞ্চ করতে যেতে লাগলাম।
একটা কথা তিনি সবসময় বলতেন। রিপোর্ট পড়বা ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস করবা না। সিদ্ধান্ত নিবা নিজের ‘এহসাস’ দিয়ে। ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা নিজের বুকে ঠেকিয়ে ধরতেন। বুঝতাম, ‘এহসাস’ নামক উপলব্ধিটার অবস্থান বুকের ভেতর।
তখন ইয়েনের মূল্যমান ছিলো খুব সস্তা। ১৩০ ইয়েন দিয়ে পাওয়া যেতো এক আমেরিকান ডলার। আর জাপানের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ছিলো আকাশচুম্বী। প্রেসিডেন্ট রিগান কারণে অকারণে জাপানকে চাপ দিতে লাগলেন ইয়েনকে শক্তিশালী করে এই ঘাটতি কমিয়ে আনতে। পৃথিবীর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সমানে খোলা বাজারে হস্তক্ষেপ করতে লাগলো আমেরিকান ডলার বিক্রি করে। ইতোমধ্যে জাপানের প্রোপার্টি ব্যবসায় নেমে এলো মহা ধস। বুদবুদের মতো ফেটে গেলো মাল্টিট্রিলিয়ন ডলারের প্রোপার্টি বাণিজ্য। তারই ধারাবাহিকতায় মহাপ্রলয় নেমে এলো জাপানি স্টক এক্সচেঞ্জে। সর্বোচ্চ ৩৮৯৫৭ থেকে সূচক শুধু নামতেই থাকলো। ৮০% পতন হয়ে পৌঁছে গেলো ৮০০০ এর ঘরে তিনমাসের মধ্যে।
এই ভয়ংকর পতন থেকে জাপানি স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক ত্রিশ বছর পরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। Nikkei Index এর চলাচল ৮০০০ থেকে ১০০০০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।। আর এতো বছর পড়েও জাপানে কার্যত মন্দা চলছে। ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখলে কোন সুদ দেয়া হয় না।
সৌদি শেখের এক মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের কি দশা হলো সবাই নিশ্চয় জানতে উৎসুক! অবাক হলেও সত্যি, সে প্রায় বিনা আঁচড়ে বেরিয়ে গেছেন। কিভাবে? আমি বলবো তাঁর ‘এহসাস’ এর করিশমায়। বাংলায় যেটাকে বলা যায় ‘উপলব্ধি’।
মন্তব্য
পড়ছি।
আরেকটু বড় পর্ব হলে ভালো। এত ছোট পর্ব শুরু না হতেই শেষ হয়ে যায়।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আপনার পরামর্শ মনে থাকবে পরবর্তী পর্বগুলো লেখার সময়। পড়েছেন বলে ।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
জানলাম, ভালো লাগলো পড়ে।
আমার মূল লক্ষ্য দেশের বাজার নিয়ে লিখতে। আগে আমার বিনিয়োগ অভিজ্ঞতার তেতো এবং সুখকর দিনগুলোর সাথে আপনাদেরকে পরিচয় করাতে চাই শুধু বক্তৃতা নির্ভর না হয়ে।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
আমাদেরকে এত ছোট পর্ব দিয়ে শেয়ার ব্যবসা শিখাতে পারবেন না!
শেয়ার ব্যবসাকে পার্ট টাইম হিসাবে নিন। দেখবেন, কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
পার্ট টাইম হিসাবে নিলেও যারা এনালাইসিস করে ব্যবসা করে তাদের এইটার পিছনে ফুলটাইমের চেয়েও বেশী মেধা ও সময় ব্যয় হয়। এইজন্য অনেকেই এনালাইসিস বাদ দিয়ে গুজব-নিউজের পিছনে ছোটা শুরু করেন।
'এহসাস' টা বিশাল জিনিস, যাকে বলে সিক্সথ সেন্স। আমাদের বাজারে প্রচলিত ধারনা হল এই 'এহসাস' বাড়ানোর/তৈরির জন্য শেয়ার বাজারে ভালোমত লস খাওয়া ১টা পূর্বশর্ত। যে যত বেশি লস করে তার এহসাস তত বেশী কার্যকর!!!
১৯৯৬ এর কথা শুনেছি, ২০১০ বাইরে থেকে দেখেছি আর ২০১১ তে এন্ট্রি দিয়ে ফলিং নাইফ ক্যাচ করে হাত কেটেছি!! আপনি অনেক অভিজ্ঞ ও পুরাতন বিনিয়োগকারী (প্রায় আমাদের জন্মের সময় থেকে ব্যবসা করছেন!!)। আপনার কাছ থেকে আরও লেখা আশা করছি।
একদম সত্য কথা।
একমত হতে পারছি না। ভালোমত লস খেলে আমরা সতর্ক হতে শিখি। সেটা হেল্পফুল। কিন্ত 'এহসাস' সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
আমার বিনিয়োগ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে থাকার ইচ্ছে রইল। সংগে থাকলে ভাল লাগবে।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
অনেক আগ্রহ নিয়ে শুরু করলাম ফট করে শেষ হয়ে গেল!
---------------------
আমার ফ্লিকার
দুঃখিত ভাই। পরের পর্বগুলো একটু বড় করার চেষ্টা করব।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
শেয়ার ব্যবসায় টিকে থাকার প্রথম শর্ত হল নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। যদি ২০ ভাগ লাভ হওয়ার পরে বিক্রি না করে ৪০ ভাগ লাভের জন্য কেউ অপেক্ষা করে তাহলে তার লস হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
যেখানে বাংলাদেশে ব্যাংকে টাকা রাখলে ৬ বছরে দ্বিগুণ হয় সেখানে কেউ যদি সেকেন্ডারি শেয়ারে বিনিয়োগ করে এক বা দুই বছরে টাকা দ্বিগুণ করার চিন্তা করে তবে তার লস করাই উচিত। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীর লক্ষ্য হল এক বা দুই বছরে টাকা দ্বিগুণ করা। আর তাদের এই লোভ কাজে লাগিয়ে বড় বড় খেলোয়াড়রা বাজার থেকে টাকা বের করে নিয়ে যায়।
-সুমন
নতুন মন্তব্য করুন