আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবস সামনে রেখে আমার মা’কে নিয়ে লিখতে বসেছিলাম। আমার মত সন্তান, যারা মা’দের জীবদ্দশায় তাঁদের মূল্যায়ন করতে শেখেনি, তাদের যা হয় আর কি! নাকের চোখের জল একাকার হয়ে যায়, লেখা আর এগোয় না।
মা’কে সারাজীবনে হয়তো হাজারবার, হয়তোবা লক্ষবার ডেকেছি। মা এই অংকটা পারছি না, মা পেট ব্যথা করছে, মা বাবাকে বলে দাওনা আমাকে একটা নীল শার্ট কিনে দিতে। পায়ে কাঁটা ফুটলে ‘মাগো’ বলে ডেকে উঠেছি, আর ভয়ের স্বপ্ন দেখেও ‘মা’ বলেই চিৎকার।
অর্থাৎ নিজের প্রয়োজনের বাইরে মা’কে একবারও ‘মা’ বলে ডাকিনি। একবারও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারিনি জীবনে যে ‘মা’ ‘মাগো’ বলে ডাকলাম, মা বললেন, কিরে খোকা কি চাস, আর আমি বললাম, মাগো তোমাকে শুধু ডাকার আনন্দ পাবার জন্য ডেকেছি। আজ শুধু মা ডেকে মনোতৃপ্তি লাভ করার জন্য বারবার ডাকতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তিনি যে শোনেন না, ছেলের সেই অকারণের ডাক শোনার জন্য অতদিন সময় দিতে পারেননি।
বাবার ষ্টীলের আলমারিটার একটা অংশে মা’র লেখালেখির অতীত। ঢাকা থাকতে মা অনেক লেখালেখি করতেন, সাময়িকী সম্পাদনার সাথেও অতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ডাক্তার স্বামী তাঁকে নিয়ে যান রংপুরের অজপাড়াগাঁয়ে, লেখা থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসনে। মাঝে মাঝে তাঁর সেই জীবনের কথা তাঁর ছেলেমেয়েদের সাথে গল্পচ্ছলে বলতেন। আর আমরা সন্তানেরা এক কান দিয়ে শুনতাম আর অন্য কান দিয়ে বের করে দিতাম। হয়তো নিজেদের খেলাধুলা আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে বড় বেশী ব্যস্ত ছিলাম! কিংবা মা’র কৃতিত্ব নিয়ে গর্বিত হবার উপলব্ধিই ছিল না আমাদের মনে।
১৯৫২ সাল। ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসন থেকে মুক্তি মিলেছে মাত্র পাঁচ বছর আগে। অর্থনৈতিকভাবে নড়বড়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের রাজধানী শহর ঢাকা। কয়টা দৈনিক পত্রিকা তখন প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে? আমার ধারণায় দশটির বেশী নয়। আর কয়টা সাময়িকী? এবং তার কয়টা মহিলাদের জন্যে? গুগল করে কোন পরিসংখান পাওয়া গেলো না। ‘বেগম’ নামে একটা মহিলা সাপ্তাহিক প্রকাশিত হতো কলিকাতা থেকে, পরে সেটা ঢাকা থেকে বেরুতে থাকে। ‘খাওয়াতীন’ নামে তখন একটা মহিলা মাসিক প্রকাশিত হতে শুরু করে ঢাকা থেকে। যার সম্পাদিকা প্রথম কয়েক মাস ছিলেন আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় এবং অতি পরিচিত এক মহিয়সী ব্যক্তিত্ব। পরবর্তীতে ‘খাওয়াতীন’ সম্পাদনা করতেন আরেক পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব বেগম সুফিয়া কামাল। আর একদম গোড়া থেকে ওই ‘খাওয়াতীন’এর সহ-সম্পাদিকা ছিলেন আমার মা হাবিবুন নাহার।
আমি ইচ্ছা করেই সেই প্রথোমোক্ত মহিয়সীর নাম উল্লেখ করলাম না। পরিবর্তে ওনার সাথে তোলা মা’র একটা ছবি নীচে সেটে দিলাম। যাতে তাঁহার গুণগ্রাহীরা এই দুষ্প্রাপ্য ছবিটাতে তাঁকে চিনতে পেরে গর্বিত এবং উচ্ছ্বসিত বোধ করতে পারেন।
১৯৫৬ সালে আমার মা লাইব্রেরীয়ানশীপে ডিপ্লোমা করতে স্কলারশীপ পেয়ে বিলেতে যাবার সুযোগ পান। ভাইয়ের অনুপ্রেরণায়, স্বামীর উৎসাহে তিনি যেতে সার্বিক প্রস্তুতি নেন। আমার বয়স তখন কয়েক মাস মাত্র। নানী বাধ সাধেন। আমিও হয়তো টের পেয়ে যাই এবং শক্ত একটা অসুখ বাঁধিয়ে বসি। একদম শেষ মুহূর্তে মা ওদেরকে নিষেধ করে দেন। আর সহস্র মা’দের মতো আমার মা’ও পুনরায় প্রমাণ করে দেন, মা’দের জন্ম যে শুধু ত্যাগ স্বীকার করার জনেই।
মন্তব্য
তেমন কিছু বলতে পারছি না। কি বলবো বুঝতেও পারছি না। মায়েরা এমন-ই হয়। মায়েরা বিধাতার এক স্বর্গীয় দান বলা যায়। যার তুলনা কোন কিছুতেই হয় না। মায়ের জন্য দোয়া রইলো। শুভেচ্ছা।
সম্পূর্ণ সহমত। অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
আপনাকে ধন্যবাদ জহির রায়হান।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
অসাধারন, আসলেই মায়ের কোন তুলনা হয় না , আপনার মায়ের জন্য শ্রদ্ধা।
ইসরাত
অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই আপনাকে ইসরাত লেখাটি পড়ার জন্য। ভাল থাকুন আপনার মা এবং আপনি।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
মাকে নিয়ে অবশ্যই আপনি একজন গর্বিত সন্তান। অফুরন্ত শুভেচ্ছা রইলো।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
বিনিময়ে আপনাকেও অফুরন্ত শুভকামনা রণদা।
অটঃ আপনার লেখাটি হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছি। তৃতীয় পর্বে এসে বুঝতে সহজ হচ্ছে। মন্তব্য করার যোগ্যতা নেই।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
আসলে আগেরগুলো মূলত জটিল তত্ত্ব, যা সহজ করতে গিয়েও আমারই সীমাবদ্ধতায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর তৃতীয় পর্বটা মূলত পরস্পর যুক্তিবিচার বলে বুঝতে সহজ হচ্ছে। তবে এখানকার জটিল যুক্তিতর্কগুলো আনার প্রয়োজন মনে হয়নি, দরকারও নেই। তবে সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে, ভারতীয় দর্শনের এ বিষয়গুলো আমারও এতো সহজে মাথায় ঢোকেনি ! কয়েক বছর ধরে বহুবার করে পড়ছি এগুলো নিজস্ব কৌতুহল থেকে।
যাক্, তবে মন্তব্যের যোগ্যতা কথাটাও কিন্তু একধরনের পরাবাস্তব উপলব্ধি, হা হা হা ! একজন পাঠক যেভাবে বুঝবেন সেভাবেই মন্তব্য করবেন। আর পাঠকের মন্তব্য থেকে একজন লেখক কিন্তু লেখাটার সমস্যাগুলো খুঁজে বের করতে চান। পাঠক বুঝতে না পারাটা কিন্তু লেখকের জন্যেও তার প্রচেষ্টার ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়। অন্তত আমি এভাবেই দেখি। তাই আমার কোন পোস্টে পাঠক হিসেবে নিশ্চিন্তে মন্তব্য করতে পারেন, কোনরূপ দ্বিধা না রেখেই। চূড়ান্ত বিচারে এতে আমারই উপকার হয়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
তাহলে তাই! আমি ভেবে বসেছিলাম কিছু কিছু উন্নতি হচ্ছে আমার!
আমার ছোট ছেলেটা ফিলোসফিতে গ্রাজুয়াশন করছে ওয়াটারলু থেকে। তার লেখা এসাইনমেন্টগুলোর বিষয়বস্তু দেখে/পড়ে ওর মা'র আর আমার চোখ কপালে! এত জটিল লেখালেখি এই বাচ্চা ছেলে করে কি করে! আমরা বিজ্ঞানের ছাত্র, সবসময় বড়াই করেছি। এখন উপলদ্ধি করি যুক্তিতত্ত্বের স্হান অনেক উপরে।
লিখতে থাকুন ভাই।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
বাবা-মা দু'জনকে নিয়েই আপনার লেখা পড়েছি। একদম মন থেকে লেখেন বলেই আপনার লেখা জল ভরায় চোখে।
রংপুর এর কোথায় আপনাদের বাড়ী? ছবির মহিয়সী নারী কি জ়াহানারা ইমাম?
হ্যাঁ জনাব, ছবির মহিয়সী নারী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ব্যতিত অন্য কেউ নন। মা'র কাছে শুনেছি ঘনিষ্ঠ মহলে ওনাকে এই বাংলার সূচিত্রা সেন বলা হতো।
আমার বাড়ী ঢাকায়। কিন্তু প্রথম জীবন কেটেছে রংপুরে। মহিমাগঞ্জ সুগার মিলে। ঘটনাক্রমে রংপুরে আমার শ্বশুরবাড়ি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
নতুন মন্তব্য করুন