উপসহকারি করণিক-সংকীর্ণতার আরেক রূপ

খন্দকার আলমগীর হোসেন এর ছবি
লিখেছেন খন্দকার আলমগীর হোসেন [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২৮/০৭/২০১৩ - ৬:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গালভরা পদবির দিকে সবার ঝোঁক থাকে কিনা জানি না, কিন্তু আমার একটু যেনো বেশীই ছিলো । ফার্মেসীতে মাস্টার্স পাশ করে শখ হোল সেলসে কাজ করবো। একটা মোটর সাইকেল পাওয়া যাবে এবং সেটা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর প্রচণ্ড আকর্ষণে। বেশির ভাগ কোম্পানিতে দেখলাম পোস্টটার নাম মেডিকেল রিপ্রেজেন্ন্টেটিভ। পছন্দ হোল না। আই-সি-আই এ একই চাকুরীতে পজিশনটার নাম ছিল সেলস প্রোমোশন অফিসার। দারুণ মনপুত হোল এবং বিনা পরিশ্রমে চাকুরীটাও হয়ে গেলো। আহা কি আনন্দ! নিজেকে বিরাট কিছু ভাবতে শুরু করলাম।

তারপর চল্লিশটা বছর পার করে দিলাম। বিশ বছর মধ্যপ্রাচ্যে আর বাকিটা কানাডায়। এসব দেশে ভারী ভারী পদবি কর্মচারীদের বিলানো হয় তাদের কর্ম সন্তুষ্টি (job satisfaction) এবং আত্মমর্যাদা (self esteem) বাড়ানোর জন্য। এতে চাকুরিদাতারই ফায়দা। কর্মচারীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ আনুগত্য এবং মনোযোগ পাবার এটা একটা অতি সহজ উপায়।

আমার কোনকালে জব-না-করা সহধর্মিণীর কানাডা এসে শখ হোল একটা কিছু করার। এতে ইংরেজিতে কথোপকথনের অভ্যাসটা একটু রপ্ত করার আগ্রহও। কাজ শুরু করার তিনদিনের মাথায় ওয়াল-মার্ট থেকে একটা এমপ্লয়িজ ব্যাজ পেলো। আমার কাছ থেকে লুকাচ্ছিলো দেখে জোর করে নিয়ে পড়লাম, আরেফা খন্দকার, সেলস স্পেশালিষ্ট। বাপরে!

আমার এক ফার্মাসিস্ট বন্ধু এক আমেরিকান ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিতে চীফ সাইন্টিস্ট। এটা জানার আগে পর্যন্ত সাইন্টিস্ট শব্দটা দেখলে কিংবা শুনলে আমার কেবল ডক্টর জগদীশ চন্দ্র বসুর কথাই মনে পড়তো ।

দেশ থেকে সদ্য কানাডা আগত আমার এক ভাতিজা 'ফিউচার শপ' নামের এক প্রসিদ্ধ ইলেক্ট্রনিক্স চেইন শপের দোকানে চাকুরী পেয়ে সাত দিনের ট্রেনিং শেষ করেই পদবি পেলো 'সেলস কনসালটেন্ট'। সমগ্র কানাডাতে দু'শয়ের বেশী যাদের আউটলেট। কর্মচারীদের কর্মে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি ক্রেতার আস্থা বাড়াতেই সম্ভবত এই রকমের কর্পোরেট পলিসি।

দেশে কিন্তু এর অনেকটা ব্যতিক্রম। বিশেষত নিম্নপদস্থ চাকুরীগুলোর ক্ষেত্রে। যেন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেই বস শ্রেণীর মহা ফায়দা আর কি! আমাদের গ্রাম থেকে একটি ছেলে এলো ঢাকায় ইন্টারভিউ দিতে। চাকুরীটা হয়েও গেলো আমার বাবার অল্প একটু তদবিরে। মা'টার সে কি খুশী, ছেলে অফিসে চাকুরী করে, পারলে কালই তাকে বিয়ে করায়। ছেলেটার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পড়তে গিয়ে মনটা একদম তেতো হয়ে গেল। 'করণিক' শব্দটা নিজেই একটা কর্ণ পীড়াদায়ক পদবি , সাধারণ বাংলায় যাকে বলা হয় কেরানী। তাতেও যদি ক্ষান্ত দিতো চাকুরিদাতা। লিখেছে 'উপসহকারি করণিক'। অর্থাৎ কেরানীর সহকারী করেও পূর্ণতৃপ্তি আসেনি, 'উপ' তে নামিয়ে পরম শান্তি লাভ!

আরবরা কিন্তু পশ্চিমের মতো কর্মচারীদের 'হৃদয় জুড়ানো' পদবি দিতে অকৃপণ। সৌদিতে ভিসায় আমার পেশা ছিলো 'মুদির মুস্তাওদা আদাওই' অর্থাৎ মেডিকেল ষ্টোর ম্যানেজার। কোম্পানির মালিক বললেন, তুমিতো সেলস দেখছো, বিজনেস কার্ডে লিখো, সেলস ম্যানেজার। তথাস্তু মেনে দেশের সাদাসিধা 'সেলস প্রোমোশন অফিসার'কে ট্রিপল প্রোমোশনের সিঁড়ি বাইতে হোল। কয়েকমাস পর দেখা গেলো আন্তর্জাতিক কেনাকাটাও আমাকেই দেখতে হচ্ছে, ইজিপশিয়ান কর্মচারীর চেয়ে আমার ইংরেজিতে যোগাযোগ দক্ষতা একটু বেশী নির্ভুল বলে। ব্যস হয়ে গেলাম পারচেজিং ও সেলস ম্যানেজার। একই ব্রিফকেসে দুই ধরণের বিজনেস কার্ড নিয়ে চলতে হোল। একই অঙ্গে দুই রূপ ধারণ আর কি! কথায় বলে না, ধারে না কাটলে, ভারে কাটে। এই পদবির ভার ব্যবহার করে আর একচিমটি দেশি কূট কৌশল খাটিয়ে এক অখ্যাত বাঙালি ছেলে হয়ে কত পশ্চিমা কোম্পানির লোকজনকে যে নাস্তানাবুদ করেছি আর সৌদি কোম্পানির মুনাফা বাড়িয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।

আরবদের মধ্যে ইজিপশিয়ানরা সবচেয়ে বাচাল। কিন্তু ওদেরও প্রশংসা করতে হয়। ঘরে প্লাম্বার এলো। ছেলে বাবাকে বলবে, বাবা বাবা, 'মোহান্দেছ' এসেছে, অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ার এসেছে। ইলেক্ট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, মেকানিক্স, সবার আলাদা আলাদা আরবি রয়েছে। কিন্তু এদের সবাইকে ইজিপশিয়ানরা সম্বোধন করবে 'ইঞ্জিনিয়ার' বলে। আর আমরা! সেদিন এক পার্টিতে নতুন এক দম্পতির সাথে পরিচয় হোল। অমায়িক স্বামী জানালেন, তিনি কোথাও একজন ইঞ্জিনিয়ার। বিদায় নিয়ে পাশ ফিরতেই আরেক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুর সাথে দেখা। বন্ধু-পত্নী সম্ভবত পরিচিতি পর্বটা দেখছিলেন। কাল বিলম্ব না করে বললেন, উনি কিন্তু একজন ডিপো! আমিতো থ! আরব বিশ্বের সাধারণ জনগণ তো আর কর্পোরেট জগত নয়। ওরা কি করে মানুষের কাজকে বড় করে দেখতে শিখলো? যুগপৎভাবে অবাক হই আর নিজেদের সংকীর্ণতা দেখে মরমে মরে যাই।


মন্তব্য

ক্যাপ্টেন নিমো এর ছবি

আসলেই আমরা মানসিক সংকীর্ণ

খন্দকার আলমগীর হোসেন এর ছবি

হ্যাঁ, আসলেই আমরা তাই। লেখাটা পড়েছেন বলে ধন্যবাদ নিন ক্যাপ্টেন নিমো।

____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।

অতিথি লেখক এর ছবি

শব্দ ধরে ধরে প্রতিটি কথার সাথে একমত। যন্ত্রণা হ‌য়, বড় যন্ত্রণা হয়।
- একলহমা

খন্দকার আলমগীর হোসেন এর ছবি

বলতে পারেন এই অবস্হান থেকে উত্তরণের কি উপায়? আমার জীবনে তো কোন উন্নতি দেখছি না। আপনাকে শুভেচ্ছা একলহমা।

____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।

অতিথি লেখক এর ছবি

লইজ্জা লাগে

খন্দকার আলমগীর হোসেন এর ছবি

লইজ্জা লাগে প্রকৃত অর্থেই।

____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।

নজমুল আলবাব এর ছবি

আমরা মানুষকে অপমান করে কত আনন্দ পাই। অপমানেই সব সুখ

খন্দকার আলমগীর হোসেন এর ছবি

আমরা বড় ঈর্ষাকাতর জনগোষ্ঠি বলেই একে অপরকে অপমান করে পুলকিত বোধ করি।

একসময় মনে করতাম আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ বলেই আপনি, তুমি, তুই ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, যা অনেক ভাষায় অনুপস্হিত। এখন কেন যেন মনে হয় যুগ যুগ ধরে শ্রেণী বিভেদ টিকিয়ে রাখতেই এই বিভাজন।

আপনাকে ধন্যবাদ ভাই।

____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

খন্দকার আলমগীর হোসেন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো-
দেশের নামকরা একটি বহুজাতিক কোম্পানী তাদের পদগুলিকে আন্তর্জাতিক আদলে পূনর্বিন্যাস করে। ফলে তাদের বেশ কিছু ডিজিএম পরিণত হয় ম্যানেজারে। ক্ষোভে অনেকে চাকরী ত্যাগও করে।

তাদেরই প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটি কোম্পানী নিজেদের পদ পূনর্বিন্যাস করে ম্যানেজারদের অনেককে এক্কেবারে জিএম করে দেয়!! ফলে বেশ কিছু মজার ঘটনা তৈরী হয়ে যায় কর্পোরেট জগতে। যেমন দ্বিতীয় কোম্পানীর একজন ভাইভা দিতে গেছিল আরেকটি প্রতিষ্ঠানে। তার সিভিতে জিএম দেখে ভাইভায় প্রশ্ন করা হয় কর্মী জিএম নাকি টিম-লীডার জিএম!

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

হো হো হো

খন্দকার আলমগীর হোসেন এর ছবি

পদ পূনর্বিন্যাস যেহেতু 'বস'রাই করেন, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বস শ্রেণীরই স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।

তবে গালভরা পদবি (যেমন পদটা স্টোর কীপার না হয়ে স্টোর ম্যানেজার হোলে) কর্মে উদ্দীপনা আনতে সাহায্য করে সন্দেহ নেই।

____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

চলুক
হক কথা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।