টোকিও’র আকাসাকা রাস্তা । পাশ দিয়েই দূরে মিশে গেছে একটি ঢাল । নাম কিনোকুনিজাকা, যার মানে হল ‘কি প্রদেশের ঢাল’ । ঢাল দিয়ে নেমে একটু দূর গেলেই দেখা মিলবে বড় , গভীর খালটার । তখনো রাস্তায় বাতি আসেনি, রিক্সাও না । রাত নেমে গেলে খালপাড়ের রাস্তাটা হয়ে পড়ত অদ্ভুত নির্জন । ঘুটঘুটে আঁধার নাকি গ্রাস করে থাকতো জায়গাটাকে । আর যারা দেরি করে ফিরতো ওই পার ধরে, রাস্তা ভুলে অনেকেই চলে যেত মাইলের পর মাইল । কেউ রাস্তা ভুলে যেত, কেউ ভুলতে বাধ্য হত । ভয়ে .. মুজিনার ভয়ে ।
নারীকন্ঠের কান্না শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে লোকটা । আহারে .. কে কাঁদে এত রাতে, খালের দিক থেকে আসছিলো শব্দটা । এগিয়ে যায় সে । পারেই দেখা যায় মেয়েটাকে, কাঁদছিল মুখ ঘুরিয়ে । দেখতে তো সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয় । কিমোনোটা ময়লা হয়ে গেলেও দামী বলতে হবে । কাছে চলে আসে সে ..
‘এইযে মেয়ে .. কাঁদছো কেন মা ? কি হয়েছে ?’ কিছু বলে না মেয়েটা, কাঁদতেই থাকে .. ওর লম্বা ঝোলা হাতায় মুখ ঢেকে ।
‘আহা কেঁদোনা, আমাকে বল কি হয়েছে । দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা’ ফুঁপিয়েই যেতে থাকে মেয়েটা, ডুকরে ঘেষতে থাকে খালের ধারে ।
‘এতো রাতে কি করছো এই ভুতুড়ে জায়গায় ? আমাকে বল কি করতে পারি তোমার জন্য .. আহা কেঁদো না .. শুনবে তো একটু ..’
মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়, লোকটির দিকে পিছন ফিরে তখনো ..
‘ আহা .. শুনো, এই মেয়ে’ মেয়েটির পিঠে হাত রাখে লোকটা । আস্তে আস্তে মেয়েটি ঘুরে দাঁড়ায় .. হাতা গুটিয়ে আনে মুখ থেকে, আর তারপর .. হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করে নিজের মুখে ...
দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুঁটছিল লোকটা .. ! চিৎকার করতে পারছিল না ভয়ে .. । সামনে পিছে তার ধু ধু মাঠ । পিছে ফিরে তাকায় না সে একবারও, সাহস করে না । কিসে জানি হোঁচট খেয়ে পড়ে ও আর তখনি ফিরে পায় গলার স্বর । দৌড়াতে শুরু করে আবার, চিৎকার করতে করতে । হঠাৎ দূরে আলো দেখা যায় তখন, এক বিন্দু, জোনাকীর মত । মনে হচ্ছিল কোন লন্ঠন । কিছু আসে যায় না .. যেকোন আলো .. যাই হোক .. চোর বা ডাকাত .. চলবে ! .. ভাবতে থাকে ও, দৌড়াতে থাকে আরো জোরে ...
রাস্তার ধারে লন্ঠন জ্বালিয়ে বসেছিল সোবা-নুডুলস বিক্রেতা । অনেকক্ষন ধরেই দেখছিল মাঠে, কে জানি দৌড়ে আসছে চিৎকার করতে করতে ।
‘বলি হল কি .. ও মশাই !’ বড়বড় চোখে বলতে থাকে ও । লোকটা কাছে এসে বলতে গেলে ঝাপিয়ে পড়ল নুডুলসওয়ালার উপর, গড়াগড়ি খেয়ে হাঁপাতে লাগল মাটিতে পড়ে ।
‘আরে আরে ! করে কি .. করে কি ! হয়েছে কি ? এমন করছেন কেন ? কেউ তাড়া করেছে ? মেরেছে কেউ ? ...’
‘নারে ভাই .. কেউ মারেনি .. কেউ মারেনি আমাকে .. শুধু .. শুধু ওই মুখ .. উফ! কি ভয়ঙ্কর .. কি ভয়ঙ্কর !!’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে লোকটা ।
‘ও-ও বুঝেছি, ভয় পেয়েছেন .. ডাকাত ছিল বুঝি ?’
‘না .. ডাকাত নয় .. একটি মেয়ে ..খালের ধারে.. কি ভয়াবহ .. আমাকে ..আমাকে দেখালো মেয়েটা .. ওহ! আমি বলতে পারব না কি দেখিয়েছে ও !’
‘হেহ ! দেখুনতো .. এরকম কিছু দেখিয়েছে কি না ও ..’ বলে উঠে নুডুলস বিক্রেতা .. এবং আঘাত করে নিজের মুখে । .. যে মুখে তখন ছিল না কোন চোখ .. কোন নাক বা কোন ঠোঁট .. একদম মেয়েটির মত !
- Lafcadio Hearn এর Mujina কয়াইদান অবলম্বনে
মুজিনা বলতে এখানে লেখক মুখহীন ভুত বুঝাতে চেয়েছেন । মজার ব্যাপার হল জন্মসূত্রে গ্রীক হার্ন অনান্য বিদেশীদের মতই মুজিনা বলতে মুখহীন ভুত বুঝাতেন যেখানে জাপানীরা মুজিনা বলতো বহুরূপী ভুতদের । জাপানীরা মুখহীন ভুতকে বলতো নোপ্পের-বো ।
জাপানী নাগরিক লাফসাদিও হার্নের আরেক নাম কৈজুমি ইয়াকুমো ।
---------------------------------------------------
পূর্বকথা :
কয়াইদান কথা : ভূমিকা
মন্তব্য
অতি সুন্দর সুখ্পাঠ্য অনুবাদ। সচলায়তনের মুল্যবান লেখাগুলোর মাঝে অন্যতম। সাবাস!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অনেক ধন্যবাদ তীরুদা ! আপনার মন্তব্যে কি বলব বুঝছি না, আনন্দ হচ্ছে অনেক !
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
তীরন্দাজ বলেছেন :অতি সুন্দর সুখ্পাঠ্য অনুবাদ। সচলায়তনের মুল্যবান লেখাগুলোর মাঝে অন্যতম। সাবাস!
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ভাই অসাধারণ অনুবাদ!!
একবার একটা জুলভার্ন সমগ্র কিনেছিলাম. অনুবাদ! সব গল্প পঁচিয়ে ফেলেছিল সেই অনুবাদক!!
সচলায়তনে এসে অনেক ভাল ভাল অনুবাদক দেখলাম। আপনিও তাদের এক জন। এর পর থেকে কোন অনুবাদ কেনার আগে অনুবাদকের নামে যে কয়জনের নাম খুজবো তাদের এক জন আপনি।
-----------------------------
এখনো নজরবন্দী!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
হাহা এইবার লজ্জা পেলাম, আমি তেমন করে কিছু অনুবাদ করিনি এর আগে, সবই ভাব অবলম্বন করে লেখেছি । এই কয়াইদানে মনে হচ্ছে অনেক ফুটবল ক্রিকেট খেলতে হবে, খুঁজতে হচ্ছে অনেক গল্প । অনেক ধন্যবাদ স্পর্শ আবজাব ভাই !
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
দেখেছেন, ভাই শিয়াল সাহেব, আপনার অনুবাদিত বই কেনার জন্য লোক এসে গেছে! আরো বেশ কিছু ছাড়ুন তাড়াতাড়ি... কথা দিচ্ছি, বইমেলার সময় অন্তত দুশো কপি বিক্রি করিয়ে দেব!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
হাহাহা, ছাড়ছিতোরে ভাই, আরেকটা এসে যাবে শীঘ্রই ।
বইমেলা !! আপনার মুখে ফুলচন্দন !
অনেক ধন্যবাদ মৃদুলদা ।
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
বটে ! অনুবাদ তো দারুন হয়েছে !
আর এরই মধ্যে দেখি পাঠক শ্রেনীও তৈরি হয়ে গিয়েছে।
আপনার মধ্যে আমি জি এইচ হাবীব হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
গেলি !!
ধন্যবাদ কমরেড ।
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ঠিক জি এইচ হাবীব বস অনুবাদক!
কৌশিক দা এইবার একটা সিরিয়াস ট্রাই মারেন।
-----------------------------
এখনো নজরবন্দী!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
দারুণ অনুবাদ
ধন্যবাদ আপনাকে
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
প্রথম দান তো ভালোই উৎরোল একটা ব্যাপার খুব মজার লাগলো, মুজিনা না হলেও ঠিক এই ভাবধারার কাহিনী কিন্তু আমাদের দেশেও প্রচলিত আছে। হয়তো লম্বাআআআ একটা হাত কিংবা উলটো পা, বা এরকম কিছু দেখে কেউ ভয় পেয়ে পালাতে যেয়ে আবারও 'দেখ তো এরকম কিনা?' র সম্মুখীন হওয়া - বিভিন্ন দেশের লোককথায় মিল থাকার ব্যাপারটা আমার দারূণ লাগে !!
ঠিক বলেছেন, এরকম একটা গল্প আমিও শুনেছি বা পড়েছি কোথায় যেন । এইবার আরেকটা মজার কথা বলি, মুজিনার মত হুবহু একটা গল্প আমি শুনেছি, গল্পটা বাবা বলেছিল মজা করেই, বাবার এক কাকার গল্প । আমাদের গ্রামের এক বাগানে নাকি হারিয়ে যান ভদ্রলোক । তখন নাকি অনেক রাত । বাবার ওই কাকা দেখেন এক লোক বসে আছে মুখ ঘুরিয়ে । তিনি নাকি তখন জিজ্ঞাসা করেন, 'ভাই এখান থেকে বের হব কিভাবে বলতে পারেন? পথ হারিয়ে ফেলেছি' ওই লোক নাকি তখন কিছু না বলে খালি ফিরে তাকান, বাবার কাকা দেখেন ওই লোকের মুখে চোখ নাক মুখ কিছু নেই পুরোই নিট এন্ড ক্লীন ব্যাপার ! দেখে তো সে আ-আ-আ চিৎকার করে দে দৌড় ! পড়ে অনেক লক নাকি ছুটে আসে ওই চিৎকারে আর তাকে খুঁজে পায় ।
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
সুন্দর গল্প, অসাধারণ অনুবাদ...(বিপ্লব)
অফ দ্য টপিকঃ আপনি কোথা থেকে অনুবাদ করছেন তা কি জানতে পারি? মানে ইংলিশ থেকে না সরাসরি জাপানী ভাষা থেকে। মার্জনা ক্ষমা করবেন। ভূমিকা পোস্টটা পড়া হয় নাই।
---------------------------------
ধন্যবাদ রায়হান আবীর ।
এই গল্পগুলির বেশিরভাগই সংগৃহীত , এই গল্পটি হার্নের 'Kwaidan: Stories and Studies of Strange Things' বইটা থেকে নেয়া, ইংরেজীতেই লেখা । আর সামনে আরও গল্পও যদি পাই তা ইংরেজী থেকেই নিতে হবে, আমি ভাই জাপানী টুকিটাকি কিছু শব্দ জানি মাত্র, জাপানী পারি না
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
চমৎকার।
খেকশিয়াল ভাই, আরও কয়েকদান কয়াইদান হয়ে যাক।
কি মাঝি? ডরাইলা?
নতুন মন্তব্য করুন