ঝড় থেমে গিয়েছিল পরদিন সকালেই। সূর্য ওঠার কিছুক্ষন পরেই ফেরীর মাঝি যখন ঘাটে আসলো, দেখল জ্ঞানহীন মিনোকিচিকে.. পড়ে আছে মৃত মোসাকুর পাশে। তাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল আরো অনেকদিন। সে রাতের ঠান্ডায় বেশ কাবু হয়ে গিয়েছিল সে। মোসাকুর মৃত্যুতে অনেক ভয় পেয়েছিল। কিন্তু সে কাউকেই বলল না সে রাতের কথা, সেই তুষার সাদা মেয়েটির কথা। আস্তে আস্তে যখন সে আবার সুস্থ হয়ে উঠল, ফিরে গেল তার দৈনন্দিন কাজে। প্রতিদিন একাই বেরিয়ে যেত বনের পথে। রাত নামলেই ফিরত কাঠ কেটে, যা বিক্রী করতে তার মাও সাহায্য করত।
তার ঠিক এক বছর পরেই বিয়ে করল সে।
ও-ইউকি’র সাথে মিনোকিচির দেখা হয়েছিল পরের শীতের এক সন্ধ্যাবেলায়। কাঠ কেটে বাড়ী ফিরছিলো মিনোকিচি। দেখল একটা মেয়ে একই পথে যাচ্ছে। মেয়েটা দেখতে লম্বা-পাতলা, খুবই সুন্দরী। তার অভিবাদনের উত্তরে মেয়েটা যখন মুখ খুলল, মনে হচ্ছিল যেন গান গাইছে। যেতে যেতে কথা বলছিল তারা। মেয়েটির নাম ও-ইউকি, কবছর আগেই বাবা মাকে হারিয়েছে মেয়েটা। যাচ্ছিল ইয়েদো নামে এক জায়গায়, যেখানে তার জন্য গৃহপরিচারিকার চাকরী ঠিক করে দিয়েছিল তারই কোন আত্মীয়। ও-ইউকিকে মিনোকিচি যতই দেখছিল ততই মুগ্ধ হচ্ছিল। তার কথায়, তার ব্যবহারে। একসময় মিনোকিচি তাকে জিজ্ঞেস করে বসে সে বিবাহিতা বা কারো বাগদত্তা কিনা। উত্তরে লজ্জ্বায় হেসেছিল ও-ইউকি, মাথা নেড়েছিল ডানেবামে। সেও মিনোকিচিকে জিজ্ঞেস করেছিল একই প্রশ্ন। মিনোকিচি বলেছিল তার বিধবা মার কথা, তার মায়ের মনের মত পুত্রবধুর কথা, যাকে সে খুঁজে পায়নি এখনো। এরপরে অনেকক্ষন চুপ করে হাঁটে তারা, কোন কথা না বলে। কিন্তু কথায় বলে, ‘যখন ইচ্ছা থাকে, তখন নাকি চোখ, মুখের থেকেও বেশী কথা বলে’। হাঁটতে হাঁটতে তারা যখন গ্রামে ঢুকে মিনোকিচি তাকে তার বাড়িতে যেতে অনুরোধ করে। ও-ইউকি অধঃমুখে না বলেও তার কথা ফেলতে পারে না। ও-ইউকির কথায় ব্যবহারে মিনোকিচির মাও অনেক খুশি হয়, তাকে কিছুদিনের জন্য থেকে যেতে বলে। কিছুদিন পরে ও-ইউকির ইয়েদোতে আর যাওয়াই হয় না, সে ও বাড়ীতেই থাকতে শুরু করে, মিনোকিচির বউ হয়ে।
ও-ইউকি ছিল খুবই ভাল পুত্রবধু। তার বউ হয়ে আসার পাঁচ বছর পরে যেদিন মিনোকিচির মা মারা যান, তাঁর শেষ কথা ছিল শুধুই তার বউয়ের প্রশংসার কথা, তার ছেলের বউকে আশীর্বাদের কথা। এরপরে ও-ইউকি আর মিনোকিচি দশ ছেলে মেয়ের জন্ম দেয়, যারা ছিল যেমনি সুন্দর, ফর্সা তেমনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
গ্রামের অন্যান্যরাও ও-ইউকিকে খুবই ভাল জানত। তারা বুঝত সে তাদের থেকে আলাদা। বেশীরভাগ গ্রামের মহিলাই বিয়ের পরে বেশ তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যায়। কিন্তু ও-ইউকি, যে কিনা ছিল দশ সন্তানের জননী, সে দেখতে এখনো সেদিনের মতই সুন্দর, যেদিন সে প্রথম এসেছিল এই গ্রামে।
এক রাতে, বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে গেলে, কাগুজে লন্ঠনের আলোয় সেলাই করতে বসেছিল ও-ইউকি। মিনোকিচি দেখছিল তাকে, সে বলল:
“তোমাকে ওভাবে সেলাই করতে দেখে, তোমার মুখে লন্ঠনের আলো পড়তে দেখে আমার এক অদ্ভুত ঘটনার কথা মনে পড়ল, যখন আমি আঠারো বছরের ছিলাম। সেদিন আমি তোমার মতই সুন্দরী, তোমার মতনই ফর্সা একজনকে দেখেছিলাম.. সত্যিই, সে দেখতে অনেকটা তোমার মতই..”
সেলাই থেকে চোখ না সরিয়েই ও-ইউকি বলল:
“তাই নাকি? কোথায় দেখেছিলে তাকে? আমাকে বল তার কথা..”
তারপর মিনোকিচি তাকে বলল সেই ভয়াবহ রাতের কথা, সেই মাঝির কুড়েঘরের কথা, যেখানে সেই তুষার মানবী হেসেছিল তার দিকে চেয়ে, ফিসফিসিয়ে বলেছিল কথা আর মেরে ফেলেছিল বুড়ো মোসাকুকে, ধীরে ধীরে। সে বলল:
“ জেগে বা ঘুমিয়ে যাই হোক, সেই সুন্দরের মত এমন সুন্দর আমি তোমাকে ছাড়া আর কোথাও কোন মেয়েতে দেখিনি। অবশ্যই সে কোন রক্ত মাংসের মানুষ ছিল না; আর আমি তাকে অনেক ভয়ও পেয়েছিলাম .. অনেক ভয়, ...সে ছিল অনেক সাদা! আজো আমি ভাবি, সে কি শুধু স্বপ্নই ছিল নাকি সত্যিই ছিল কোন তুষারকন্যা..”
ও-ইউকি তার হাত থেকে সুই-সুতো ছুড়ে ফেলে দিল.. হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সে আর ঝুঁকে এগিয়ে গেল মিনোকিচির দিকে! তীক্ষ্ণ স্বরে বলল:
“সে আমিই ছিলাম! হ্যাঁ! আমিইই! আর আমি তোমাকে বলেছিলাম যদি এই ব্যাপারে কারো কাছে টু শব্দটাও কর আমি তোমাকে খুন করে ফেলব!" মিনোকিচি কিছুই বলতে পারছিল না। হঠাৎ ঠান্ডা যেন গ্রাস করেছিল তাকে চারদিক থেকে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে শুধু ও-ইউকিকে দেখছিল, যে ধীরে ধীরে আরো সাদা হচ্ছিল, সেই তুষার মানবীর মত ..
"আমি এই মূহুর্তেই তোমাকে শেষ করে দিতাম! .. কিন্তু বাচ্চারা ঘুমুচ্ছে। তাই তোমাকে বলে যাচ্ছি .. যদি তুমি বাচ্চাদের ভালমত দেখাশোনা না কর, যদি তাদের কখনো তোমার বিরুদ্ধে কোন নালিশের কথা মনেও আসে, আমি ফিরে আসব! আর তোমার পরিণতি হবে ভয়াবহ!”
ও-ইউকি যতই চিৎকার করছিল, তার কন্ঠস্বর আরো মিহি হয়ে আসছিল, অনেকটা ফিসফিসে বাতাসের কান্নার মত। তার শরীর আস্তে আস্তে উজ্জ্বল সাদা কুয়াশার মত ছড়িয়ে গেল, এঁকেবেঁকে উঠে গেলো সে থামগুলো বেয়ে। চিমনী গলে বাইরে মিলিয়ে গেল একসময়। তাকে দেখা গেল না আর, কোনদিনই।
লাফসাদিও হার্ণের 'ইউকি-ওন্না' কাইদান অবলম্বনে
ইউকি-ওন্না মানে তুষারকন্যা
মন্তব্য
সেরম হইছে। পাঁচতারা...
ধইনাপাতা শিমুল ভাই
------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
যাক, একদানেই দুই পর্বের কাইদান পড়ে ফেলতে পারলাম। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় পড়া রদুগা প্রকাশন থেকে বের হওয়া 'রূশ দেশের উপকথা' নামের বইটার কথা। কত অসংখ্যবার যে গল্পগুলো পড়েছিলাম তা বলে শেষ করতে পারব না। এখনও আবছা আবছা মনে পড়ে দূসাহসী ইভানের অভিযানের কথা গুলো। তোর এইগল্পেও সেই উপকথার অনন্য স্বাদটা পেলাম। এজন্য তোকে ধন্যবাদ। বলা বাহুল্য খুবই সুন্দর উপস্থাপন। আরো পড়ার আশায় থাকলাম।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
থেঙ্কু দোস্ত, হ আরো লিহুম!
------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ফাটাফাটি কমরেড।
একটা ব্যক্তিগত মতঃ গল্পের একদম শেষ প্যারাটুকু কি আরো একটু অন্যভাবে লেখা যায়, চমৎকার একটা গল্পের শেষটা যেন একটু তাড়াহুড়োয়... তবে গল্পটা চমৎকার আর অনুবাদ তার থেকেও চমৎকার...
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
হাহা তোর ব্যাপারটা আমি বুঝসি, মূল গল্পটাও আসলে এম্নেই শেষ হয়, ব্যাপারটা শকিং করার জন্য। আমি ভাবছিলাম একবার সে আরো একটু বর্ণনায় যামু নাকি, পরে ভাবলাম এইটাই ভাল।
থেঙ্কু কমরেড
------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
খুব ভাল । থামিসনে পাগল চালিয়ে যা ।
- হুমম
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
কাইল তো চা খাইতে গেলেন দেইখা চিন্তায় পড়ছিলাম যাউকগা সব মিলাইয়া দারুণ একখান গল্প পড়লাম খেকশিয়াল ভাই।
মেঘ
ভাল গল্প
তাড়াতাড়ি চা খাওয়ার জন্য শখানেক ধন্যবাদ।
আর এত চমতকার অনুবাদের জন্য হাজারখানেক ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------------------------------
If your father is a poor man, it's not your fault ; but If your father-in-Law is a poor man, it's definitely your fault.
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
তাড়াতাড়ি চা খাওয়া/দম লওয়া শেষ করার জন্য ধন্যবাদ। আগামী এগারো মাসে এত পরিমান কাইদান অনুবাদ করা কি সম্ভব যাতে ফেব্রুয়ারী ২০১০-তে বই হিসেবে "কাইদান"কে দেখা যেতে পারে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হুমম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
যাক !
দমশেষে তাড়াতাড়িই ফিরলেন।
শেষটা হুট করেই শেষ হলো যে...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ভাল লাগল, কিন্তু ভয়তো পাইলাম না দাদা!
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
আগের গল্পগুলাও পড়তে হবে দেখছি। পাঁচ তারা আমার থিকাও।
নিজের ফুলদানীতে যারা পৃথিবীর সব ফুলকে আঁটাতে চায় তারা মুদি; কবি নয়। কবির কাজ ফুল ফুটিয়ে যাওয়া তার চলার পথে পথে। সে ফুল কাকে গন্ধ দিলো, কার খোঁপায় বা ফুলদানীতে উঠলো তা দেখা তার কাজ নয়।
___________________________ [বুদ্ধদেব গুহ]
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
সবার কথায় একটু নিজে পাকনামি কইরা কিছু লাইন যোগ করলাম। আসলে গল্পটা যত না ভয়ের তার থেকে বেশি শকিং লাগছিল আমার কাছে। মুভিতেই প্রথমে দেখি। সবাইকে আবারো ধইনাপাতা।
------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
কাল্কে অর্ধেক পড়লাম না লগাইয়া
আজ লগাইয়া বাকি অর্ধেক পড়লাম একই কথা কওনের লাইগা যে
পরের কাইদানের লাইগা কৈদিন অপেক্ষা কর্তইব আর?
এট্টু দেরী কইরা পড়ছি, এই জন্য এক লগে দুইটাই পড়তে পারলাম।
দারুন, চমৎকার, অসাধারণ
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
নতুন মন্তব্য করুন