অনেক অনেক দিন আগের কথা। ভারতবর্ষে পৃথিবীভূষণ নামক এক রাজ্য শাসন করতেন রাজা শুক্লপক্ষ। তিনি ছিলেন অতি সৎ এবং সাদাসিধা একজন মানুষ। কেউ কখনো কারো খারাপ করতে পারে এই চিন্তা তিনি করতে পারতেন না। রাজার এক মন্ত্রী ছিল, নাম কৃষ্ণপক্ষ। এই কৃষ্ণপক্ষ ছিল খুবই ধূর্ত এবং দুষ্ট একজন লোক। একদিন সকালে শুক্লপক্ষ যখন সভাসদদের সাথে রাজদরবারে বসে রাজকার্য পরিচালনা করছিলেন দূত এসে বলল, “মহারাজ, বহু দূর হতে এক বণিক এসেছে, সে বলছে সে নাকি আপনার জন্য এক উপহার নিয়ে এসেছে।”
রাজা বললেন, “তাই নাকি, কই তাকে এখানে নিয়ে এসো।” কিছুক্ষণ পরে শ্বেত-শুভ্র এক অশ্ব সহ সেই আগুন্তুক প্রবেশ করল রাজদরবারে, সবাই বুঝতে পারল ইনি একজন অশ্ব ব্যবসায়ী। ঘোড়াখানা দেখে মহারাজ বেশ চমৎকৃত হলেন, বলে উঠলেন, “বাহ! কি সুন্দর ঘোড়া!”
বণিক বলল, “মহারাজ আমার উপহার আপনার পছন্দ হয়েছে দেখে আমি খুবই আনন্দবোধ করছি। এই ঘোড়া অতীব দ্রুতগতিতে ছুটতে পারে। আমি এরকম তেজী ঘোড়া আর দেখি নাই।”
রাজা যখন সিংহাসন থেকে নেমে ঘোড়া পর্যবেক্ষণ করছিলেন, দুষ্ট কৃষ্ণপক্ষের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো! সে ভাবলো, “এই ঘোড়া দ্রুতগতি সম্পন্ন হতে পারে কিন্তু সে এখনো বন্য। দারুণ! আমি এখনি রাজাকে বলবো একে বাজিয়ে দেখতে!..” সে বলল, “মহারাজ, অশ্বখানা কেমন একটু চড়েই দেখুন না তাহলে..”
মহারাজ বললেন, “ঠিক বলেছ!”
তারপর বণিককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চেপে বসলেন তিনি ঘোড়ায় আর দ্রুত বেড়িয়ে গেলেন রাজপ্রাসাদ থেকে। বণিক তখন পিছনে চিৎকার করছিল, “ওহ ঈশ্বর! এতো বন্য ঘোড়া, একে বশ না মানিয়ে নিলে তো চড়া যায় না! মহারাজ তো মারা পড়বেন!” কৃষ্ণপক্ষ মনে মনে হাসল, “তবেই তো আমি রাজা হতে পারব..”
এর মধ্যে রাজার দেহরক্ষীরা রাজার পিছু পিছু ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে রাজা রাজ্য থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন। ঘোড়ায় চেপে রাজা ছুটতে ছুটতে যখন এক গভীর বনে প্রবেশ করলেন ততক্ষণে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে, সন্ধ্যা হয় হয়। সেই তেজী ঘোড়াও হাঁপিয়ে তখন আস্তে আস্তে হাঁটছে, রাজা ভাবলেন এ যাত্রা বেঁচে গেলেন। কিন্তু যখন ঘোড়া একদম দাঁড়িয়ে গেল, রাজা চিন্তিত হয়ে পড়লেন, ঘোড়ার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “কি হয়েছে তোমার বাছা? আমরা এমনিতেই পথ হারিয়েছি, এখন আর থেমো না..”। কিন্তু ততক্ষণে ঘোড়া রাজাকে নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে। রাজা নেমে আসতেই সে একপাশে পড়ে গেল। রাজা দেখলেন ঘোড়াখানা মৃত।
মৃত ঘোড়া পিছনে ফেলে জনমানবহীন জঙ্গলে ঘুরতে লাগলেন রাজা। শীঘ্রই তিনি তৃষ্ণার্ত আর ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লেন। এইভাবে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় রাজা দেখলেন দূরে একটা পুকুর দেখা যায়, কাছেই কিছু ফলের গাছ। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলেন রাজা। পুকুর থেকে বুকভরে জলপান করে যেই তিনি গাছের ফল ছিড়তে যাবেন, কে যেন পিছনে থেকে ডেকে উঠল,
- কে তুমি যুবক? কি কারনে একা একা এই বনে ঘুরছ?
রাজা দেখলেন তার পিছনে ধবধবে সাদা জটাধারী এক সন্ন্যাসী। তিনি বললেন,
- হে সাধু, আপনাকে দেখে বড়ই আশ্বস্তবোধ করছি।
তিনি সেই সন্ন্যাসীকে বললেন তিনি কে এবং কেন এখানে এসেছেন। সবকিছু শুনে সন্ন্যাসী তাকে রাতখানা তাঁর কুটিরে থেকে যেতে অনুরোধ করলো। রাজাও খুশিমনে চললেন তার পিছু।
সন্ন্যাসীর সাথে তাঁর কুটিরে এসে যখন রাজা যখন পৌছালেন তখন প্রায় রাত। কুটিরের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল এক যুবতী। তাকে দেখে রাজার চোখ কপালে উঠল, তিনি ভাবলেন, “এতো দেবী লক্ষ্মী! তিনি এইখানে সাধারণ মানুষের ন্যায় জীবনযাপন করছেন কেন?” যুবতীও ভাবল, “এই বনে এইরকম তেজ দীপ্তিময় যুবক কে? তার গায়ে যে অলঙ্কার তিনি নিশ্চয়ই কোন রাজা হবেন।” যাই হোক সেই সুলক্ষণা সুন্দরীকে দেখে রাজা ততক্ষণাৎ তার প্রেমে পড়লেন। তিনি ভাবলেন, “যদি কেউ আমার রানী হয়, তবে ইনি সেই” আর রাজার এই ভাব সন্ন্যাসীরও চোখ এড়িয়ে গেলো না।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে একসময় রাজা সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে সাধু, কে এই কুমারীরত্ন?” সন্ন্যাসী বললেন, “ও নিভৃতি, বিদ্যাধরদের রাজার কন্যা।” সেইসময় দেবতাদের কাছাকাছি কিছু জাতি ছিল, তাদের দেবতাদের মত অত শক্তি না থাকলেও কোন অংশে তারা কম যেত না, নানাবিধ শিল্পকলায় এরা ছিল পারদর্শী। এদেরকে সবাই বিদ্যাধর বলেই চিনতো। রাজা শুধোলেন, “তবে সে এখানে কেন?”
সন্ন্যাসী বললেন, “মহারাজ সে এক বিরাট কাহিনী, তবু আমি যত সংক্ষেপে পারি তা বলার চেষ্টা করছি..
- একদিন নিভৃতি যখন তার পিতার প্রাসাদে, এক বিদ্যাধর আকাশপথে উড়ে আসে আর তাকে নিয়ে পালাতে থাকে। মেয়ের চিৎকার শুনে তার বাবা যখন দেখেন এই অবস্থা, তিনিও ঘোড়ায় চেপে পিছু নেয় সেই দুষ্টের। সেই বিদ্যাধর যখন দেখে তার পিছে রাজা স্বয়ং ধাবমান ভয় পেয়ে যায় সে। সে তখন আমার আশ্রমের উপর দিয়েই যাচ্ছিল। নিজের প্রাণ বাঁচাতে সে তখন নিভৃতিকে এখানেই নামিয়ে রেখে পলায়ন করে। তার কিছুক্ষণ পরেই রাজা এসে পড়েন। তিনি আমাকে বলেন, “হে ঋষি, আমি সেই দুষ্টকে ধরতে তার পিছু যাচ্ছি। তাকে ধরে শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত আমি ফিরবোনা। এই কটা দিন দয়া করে আমার কন্যার দেখাশোনা করুন। যদি আমার ফিরে আসতে তেমনই দেরী হয় তবে উপযুক্ত পাত্রে আমার কন্যাকে দান করুন, তবে মনে রাখবেন যে সেই পাত্রকে অবশ্যই মৃতদেহে প্রবেশ করার করার ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে।”
এই ঘটনা আজ থেকে বেশ কবছর আগের। কেন জানি মনে হয় তিনি হয়তো আর ফিরবেন না। এই কন্যা এখনো অবিবাহিতা।
সব শুনে রাজা বলে উঠলেন, “হে সাধু, আপনার যদি অমত না হয় আমি এই কুমারীকে বিয়ে করতে চাই।”
সন্ন্যাসী স্মিত হেসে বললেন, “আপনি অবশ্যই যোগ্য পাত্র মহারাজ। কিন্তু একটাই কমতি, আপনি যে মৃতের দেহে প্রবেশবিদ্যা জানেন না।”
করুণ মুখে রাজা বললেন, “এর কি কোন উপায় নেই? আমি যে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি একেই আমার সহধর্মিনী করবার।”
সাধু কিছুক্ষণ ভাবলেন, অবশেষে বললেন, “ঠিক আছে। আপনি নিভৃতিকে বিয়ে করুন। কিন্তু একটা ব্যাপার, যতদিন না আপনি সেই গুপ্তবিদ্যা লাভ করছেন নিভৃতিকে রাজ অন্তঃপুরে নিয়ে যাবেন না।”
রাজা তখন তাতেই খুশি, বললেন, “আপনি যা বলবেন তাই হবে, শুধু তাকে আমার সাথে আসতে দিন।”
সন্ন্যাসীর তত্ত্বাবধানে সেইরাতেই রাজা শুক্লপক্ষ আর নিভৃতির বিয়ে হয়ে গেল। মালাবদল শেষ করা মাত্রই রাজা দেখলেন তাকে খুঁজতে খুঁজতে দেহরক্ষীরা এসে গেছে আশ্রমে। রাজা উৎফুল্লচিত্তে বললেন, “বাহ! তোমরা দারুণ সময়ে এসেছ! শীঘ্রই রাজ্যে খবর দাও! বল আমি আসছি!” দেহরক্ষীরা সেই দেবী লক্ষ্মীর মত নারীর গলায় মালা আর উঠোনে যজ্ঞ দেখেই বুঝে নিয়েছিল সবকিছু। আহলাদিত হয়ে তারা যখন ছুটে গেল রাজার আগে, রাজাও তখন সব গুছিয়ে নিভৃতিকে নিয়ে চড়ে বসলেন তাদেরই আনা একটা ঘোড়ায়। যাবার আগে সন্ন্যাসী আবার তাকে শর্তের কথা মনে করিয়ে দিলেন। রাজাও তা পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নিজ নগরীর পথে। পথে যেতে যেতে নিভৃতি রাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মহারাজ, একটা বিষয়ে আমি বেশ কৌতুহল বোধ করছি। আপনি আমাদের এই আশ্রম খুঁজে পেলেন কিভাবে?” যখন রাজা সবকিছু তাকে খুলে বললেন, নিভৃতি বুঝলেন সবকিছুই। তিনি ভাবলেন, “এই মন্ত্রী নিশ্চয়ই দুষ্ট প্রকৃতির লোক। সে যদি সত্যই রাজার খেয়াল করতো তবে কখনোই তাকে বন্য ঘোড়ায় চড়ার বুদ্ধি দিত না।” কিন্তু নিভৃতি মুখে কিছুই বললেন না।
(চলবে)
মন্তব্য
ভাল্লাগলো।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
চলুক।
চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ছোটবেলার রুপকথার গল্পের মত, আহ!
তবে এসব রাজা আর তাদের মন্ত্রীগুলি একটু অতিরিক্ত গাব আর কি, সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফের প্রশ্নই আসে না, এজন্যই মজা পাই হয়তো!
সুন্দর গল্প!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
পরেরটা তাড়াতাড়ি।
ভাই খেকশিয়াল। পুরেটা শেষ না করে দিস না ভাই। ধাক্কা লাগে। দরকার হলে দুদিন পরে দে। এভাবে মাথায় বাড়ি দেয়ার মানে কী?
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
পুরাটা নামুক আগে তারপর পড়ুম। তা নইলে মৃদুল ভাই'র মত আহাজারি করতে হবে
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
আহ্ বড়ই আরামের লেখা পড়লাম! অ-নে-ক-দি-ন এতো মজা করে রুপকথা পড়ি না। প্লিজ পরেরটা তারাতারি ছাড়েন।
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
কুইক!!!
---------------------------------------------------------------------------
No one can save me
The damage is done
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
আহা কত দিন পর রূপকথার গল্প পড়লাম।
পরের পর্ব তাড়াতাড়ি আসুক।
- "চলুক", ব্র্যাকেট উইদিন এবং ব্র্যাকেট ছাড়া।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
১০ | অনিন্দিতা (যাচাই করা হয়নি) | মঙ্গল, ২০০৯-০৫-০৫ ০৪:৪২
আহা কত দিন পর রূপকথার গল্প পড়লাম।
পরের পর্ব তাড়াতাড়ি আসুক।
রিপিট করলাম।
নতুন মন্তব্য করুন