শুক্লপক্ষ কৃষ্ণপক্ষ : শেষ

খেকশিয়াল এর ছবি
লিখেছেন খেকশিয়াল (তারিখ: মঙ্গল, ০৫/০৫/২০০৯ - ১০:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্ব

এইভাবে সেইদিনই ঘোড়া ছুটিয়ে তারা রাজ্যে এসে উপস্থিত হল। কৃষ্ণপক্ষ রাজার অবর্তমানে রাজ দরবারে পায়চারী করছিল, হঠাৎ দূত এসে বলল, “মন্ত্রীমশাই, দেহরক্ষীরা রাজার খবর নিয়ে এসেছে, তারা আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক।” মন্ত্রী দেখলো তার রাজাকে মারার দুষ্টবুদ্ধি ব্যর্থ হয়েছে। কিছু পরে দেহরক্ষীরা ফিরে আসলে তারা জানালো রাজা সুস্থ আর নিরাপদ আছেন, তিনি রানীসহ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করছেন, যেকোন মূহুর্তে এসে পড়বেন।”
- “রানী?” অস্ফুট স্বরে বলল কৃষ্ণপক্ষ।
- “হ্যাঁ মন্ত্রীমশাই, তিনি বিদ্যাধরদের রাজকন্যা। মহারাজ বনেই তার সন্ধান পান, সেখানেই বিয়ে করেন।” বলল দেহরক্ষী।
- “আমি ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, তারা নিশ্চয়ই এসে পড়েছেন।”
মুখে মহাখুশির এক ভাব নিয়ে মন্ত্রী এগিয়ে গেলেন রাজা আর রানীকে সম্বর্ধনা জানাতে।

রানী নিভৃতিকে দেখামাত্র কৃষ্ণপক্ষের চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিল, তিনি ভাবলেন, 'ইনি কে? এরকম সুন্দরী নারী আমি তো আর দেখিনি!' কৃষ্ণপক্ষকে এগিয়ে আসতে দেখে রাজা নিভৃতিকে বললেন, “ইনি হচ্ছেন কৃষ্ণপক্ষ, আমার মন্ত্রী।” আর নিভৃতি ভাবলেন, “ও! এই তাহলে সেই মন্ত্রী! এখন তাকে দেখে আসলেই আমার মনে হচ্ছে যে সে একজন দুষ্ট লোক। রাজাকে অতি শীঘ্রই তার সম্পর্কে সাবধান করে দিতে হবে।”
রাজা মন্ত্রীকে বললেন, “রানীর জন্য বাইরের প্রাসাদে থাকার ব্যবস্থা করুন, কদিন রানী ওখানেই থাকবেন।” মন্ত্রী প্রণাম করে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু ভাবলেন, ‘বাইরে কেন? হমম দেখতে হচ্ছে তো..’

এইভাবে দিন যায়। রাজা প্রতিদিন বাইরের প্রাসাদে গিয়ে রানীর সাথে থাকেন। চারদিকে ফিসফাস, উনারা প্রাসাদের বাইরে কেন, কি ব্যাপার.. নানাকিছু। রাজার কানেও খবর আসে। একদিন অন্তঃপুরে বসে তিনি ভাবছেন.. এভাবে তো আর চলে না, তাকে নিভৃতির যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। তাকে সেই মৃতদেহে প্রবেশের শক্তি লাভ করতে হবে। কৃষ্ণপক্ষকে ডাকলেন তিনি আর খুলে বললেন সবকিছু। কৃষ্ণপক্ষ ভাবল, ‘ও! তাহলে এই ব্যাপার! এর মানে এই যে নিভৃতি তারই হবে যার কিনা এই শক্তি থাকবে..’
রাজা বললেন, “কি করা যায় বলোতো কৃষ্ণপক্ষ?” কৃষ্ণপক্ষের বুদ্ধির অভাব ছিল না, সে কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর বলল, “একটা বুদ্ধি আছে মহারাজ, আসুন আমরা কেবলমাত্র সন্ন্যাসীদের জন্য উন্মুক্ত একখানা বিশ্রামালয় নির্মান করি। কে জানে, একদিন তাদের মধ্যে থেকেই হয়তো আমরা কাউকে খুঁজে পাবো যে আমাদের উপায় বলে দিবেন।” রাজা বললেন, “দারুণ বুদ্ধি! এখুনি ব্যবস্থা কর!”
মন্ত্রী ভাবলো, ‘.. যে করেই তুমি বুদ্ধি পাও না কেন রাজা.. ওটা আমারও চাই! তোমার আগেই নিভৃতিকে আমি আমার স্ত্রী করবো!’

শীঘ্রই বিশ্রামালয় তৈরী হয়ে গেলে নানা জায়গা থেকে নানান সাধু সন্ন্যাসীরা এসে সেখানে এসে সেখানে ভীড় জমালেন। তারা তাদের যাত্রাপথে দু-দন্ড সেখানে বসতেন, কেউ রাতে থাকতেন। কৃষ্ণপক্ষ প্রতিদিন এসে তাদের সাথে কথা বলতেন, উদ্দেশ্য সেই গুপ্তশক্তি লাভ। এইভাবে ছয় মাস অতিবাহিত হল কিন্তু কেউই সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারল না। রাজা এবং মন্ত্রী দুজনেরই মনে হল বিশ্রামালয় একটা ভুল বুদ্ধি ছিল।

একদিন বিশ্রামালয় যাবার পথে কৃষ্ণপক্ষের সাথে এক আগুন্তুকের দেখা হল। সে বলল, “ভদ্র, আপনাকে আগে কখনো এই রাজ্যে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না, আপনার পরিচয়?” আগুন্তুক বললেন, “মহাশয় আমি একজন গালিচার ব্যবসায়ী। আমি দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। এই জীবনে আমি অনেক আশ্চর্য জিনিস দেখেছি, অনেক অদ্ভুত লোকের সাথে পরিচয় হয়েছে আমার।” কৃষ্ণপক্ষের মাথায় ঘুরল কথাগুলো, ‘অনেক আশ্চর্য জিনিস.. অনেক অদ্ভুত লোক..’ সে হেসে বলল, “হতে পারে, তবে আমি নিশ্চিত আপনি নিশ্চয়ই এমন কাউকে দেখেননি যে কিনা মৃতদেহে প্রবেশ করতে পারে।” উত্তরে আগুন্তুক হাসলেন একটু, বললেন, “তাও দেখেছি!” কৃষ্ণপক্ষের চোখ জ্বলে উঠল ধক করে! আগুন্তুক বলে গেলেন, “তিনি একজন যোগী। কিন্তু তার কাছে পৌছানো বড়ই কষ্টসাধ্য ব্যাপার...”
- “সে যতই কষ্টকর হোক, আমাকে সেই জায়গায় যেতেই হবে, আপনি বলুন আমাকে কি করতে হবে” বলল কৃষ্ণপক্ষ। আগুন্তুক বললেন, “ ঠিক আছে, শুনুন তাহলে..
আমার নগরী থেকে প্রায় ছিয়ানব্বই ক্রোশ দূরে একটা পথ আছে যা কিনা ক্রমশঃ ঘন বনের ভিতর ঢুকে গেছে। সেই পথের দুই ধারে আছে দুটি তাল গাছ। তালগাছ দুটির একটিতে বসে একটি কাক, অন্যটিতে একটি হাঁস। আপনি যখন আস্তে আস্তে বনের গভীর থেকে গভীরে যাবেন অনেকক্ষণ পরে একখানা পর্বত দেখতে পাবেন। সেই পর্বত-শিখরেই বসে সাধনা করছেন যোগী সদানন্দ। তিনিই সেই শক্তির অধিকারী। বলা যায় না, আপনার উপর প্রসন্ন হলে সে গুপ্তবিদ্যা আপনাকে শেখাতেও পারেন তিনি।”

সেদিন কৃষ্ণপক্ষ চিন্তা করল অনেক, ভাবল, 'যোগীরা মানুষের মুখ দেখেই তার মন বুঝতে পারেন। সেখানে আমি একা গেলে তিনি আমার কথা বিশ্বাস নাও করতে পারেন। আমি রাজাকেই নিয়ে যাব আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকবো।' রাতে যখন সে রাজাকে সব খুলে বলল, রাজা তাকে শুধোলেন, “কিন্তু সেই বণিক থাকেন কোন নগরে, সে না জানলে তো আমরা বের হতে পারছি না।” কৃষ্ণপক্ষ দেখলো উত্তেজনায় তার বুদ্ধি নাশ হয়েছে, সে তখনি অতিথিশালা থেকে বণিককে সঙ্গে করে নিয়ে আসলো রাজার সামনে। রাজা বণিককে হেসে শুধোলেন, “ভদ্র, সবই তো শুনলাম কিন্তু আপনি আপনার নগরীর সম্পর্কে বলতে ভুলে গেছেন, আমরা সেখানে কিভাবে যাব?” বণিক বলল, “সে একদম সোজা মহারাজ! আপনার রাজ্য থেকে বের হয়ে বারোটি গ্রাম, নয়টি নগরী আর পাঁচটা শহর পেরুলেই গিয়ে পৌছবেন আমার নগরীতে।”

বণিক চলে গেলেই রাজা নিভৃতিকে এই খুশির সংবাদ দিতে ছুটে গেলেন। তিনি বললেন, “কালকেই আমি আর কৃষ্ণপক্ষ দুইজনে সেই জায়গার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করব।” নিভৃতি বলল, “খুবই ভাল সংবাদ রাজা, কিন্তু আমি আপনার মন্ত্রীকে একটুও বিশ্বাস করি না, তাকে দেখেই মনে হয় সে একজন শঠ, দুষ্ট এবং অকৃতজ্ঞ। দয়া করে আপনি তাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যাবেন না, সে আপনার প্রাণসংশয়ের কারন হতে পারে।” রাজা নিভৃতির কথা ঠিক মেনে নিতে পারলেন না.. তবু বললেন, “তুমি যদি তাই মনে কর, তবে তাই হবে।”
একটু পর মন্ত্রীকে ডেকে তিনি বললেন, “কৃষ্ণপক্ষ, আমি সে জায়গায় একলা যেতে চাই, আমি চাই আমার অবর্তমানে তুমি এই কদিন রাজ্যের রক্ষনাবেক্ষণ কর।”
কৃষ্ণপক্ষ হা হা করে উঠল, বলল, “সে কি কথা মহারাজ! আমি কিভাবে আপনাকে একলা ওই গহীন বনে যেতে দিতে পারি? আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমি সবাইকে বুঝিয়ে যাচ্ছি। অন্যান্য সবাই এই কদিন ঠিকই রাজ্য চালিয়ে নেবে।” রাজা ভাবলেন, “মন্ত্রী আমার জন্য কত চিন্তা করে, নাহ! ও নিভৃতির ভুল ধারনা!”

পরদিন সকালে রাজা মন্ত্রী দুজনে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হয়ে গেলেন সেই বণিকের নগরের দিকে। কিছুদিন পর, একদিন তারা বণিকের নগরী ছাড়িয়ে সেই বন খুঁজছিলেন। হঠাৎ কৃষ্ণপক্ষ বলে উঠল, “মহারাজ দেখুন, পথের দুইধারে দুটো তালগাছ! দেখুন একটার উপর হাঁস আছে ঠিকই, কিন্তু অন্যটায় কোন কাক নেই, যাই হোক.. আমার মনে হয় এই সেই বন।” বাস্তবিকই তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক প্রাচীন এক অরণ্য। তারা যতই গহীনে যেতে থাকলেন বিরাট বিরাট সব বৃক্ষ নিয়ে সে বন ততই তাদের ঘিরে ধরল। যেতে যেতে একসময় তারা বুঝলেন গাছপালা হালকা হয়ে আসছে। একসময় রাজা দূরে দেখতে পেলেন সেই পর্বত, বললেন, “কি আশ্চর্য! বাইরে থেকে বোঝার উপায়ই নেই যে এইখানে একটা পর্বত থাকতে পারে!”

চূড়ায় উঠে রাজাই প্রথম দেখলেন সেই যোগীকে। চূড়ার ঠিক মাঝখানে একটা বড় পাথরের উপর যোগাসনে বসে আছেন শান্ত সৌম্য কিন্তু তেজস্বী এক জটাধারী। কি সুন্দর দৈব এক আভা ঘিরে রেখেছে তাকে চারদিক থেকে! চোখ বুঁজে আছেন তিনি, ধ্যান করছেন। রাজা বললেন, “দেখেছ, ইনিই বোধহয় সেই যোগী। কিন্তু তিনিতো সাধনারত। আসো, তিনি চোখমেলা না পর্যন্ত, আমরা এখানেই বসে অপেক্ষা করি।” এইভাবে রাজা মন্ত্রী দুজনেই যোগীর পায়ের কাছে করজোড়ে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ পরে যোগী তাঁর চোখ খুললেন, কিন্তু যেন কিছুই দেখলেন না এরকম ভাব করে আবারও চোখ মুদলেন। এভাবে বেশ কদিন চলে গেল, যোগী তার সামনে উপবিষ্ট রাজা মন্ত্রী কাউকেই গ্রাহ্য করলেন না, কিন্তু তারাও বসে রইলেন ঠিক সেভাবেই, একটুও নড়লেন না।

অবশেষে একদিন যোগী চোখ খুললেন আর মন্ত্রীকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রাজাকে বললেন, “আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি, তুমি বর চাও।” উৎফুল্লচিত্তে রাজা বলল, “হে ঋষি, আমাকে বর দিন, আমি যেন মৃতের শরীরে প্রবেশ করার ক্ষমতা লাভ করি।” হঠাৎ মন্ত্রী কৃষ্ণপক্ষও বলে উঠল, “হে ঋষি, আমাকেও একই বর দিন, আমিও এই শক্তিলাভের প্রার্থনা করি।” কিন্তু যোগী কৃষ্ণপক্ষের দিকে ফিরেও তাকালেন না, তিনি রাজাকে সম্বোধন করে বললেন, “আমি এই শক্তি শুধুই তোমাকে দিতে চাই, কিন্তু তোমার সাথের এই লোকটিকে নয়, সে এই শক্তির যোগ্য নয়।” কৃষ্ণপক্ষের দুই চোখ থেকে জল বেয়ে পড়ল। রাজা ভাবলেন, ‘আমি নাহয় নিভৃতির জন্য এই শক্তি কামনা করছি, কৃষ্ণপক্ষের আবার কি হল? যাই হোক সে যখন এতই চাইছে আর কষ্ট করছে তারও এই শক্তি লাভ করা উচিত।’
রাজা বললেন, “হে যোগী, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার মন্ত্রীকেও আপনি সেই শক্তি দিন। তার দুঃখ আমি দেখতে পারছি না।”
যোগী বললেন, “রাজা, আমি যদি তাকে এই শক্তি দেই তবে সে তোমার প্রাণসংশয়ের কারন হয়ে দেখা দেবে। তাকে বিশ্বাস করা তোমার ভুল হচ্ছে।”
কিন্তু রাজা এতকিছুর পরও সেই কথা বিশ্বাস করতে পারলো না, সে বলল, “হে যোগী, আমি তাকে বিশ্বাস করি, আপনি আমাদের দুজনকেই সেই শক্তি দান করুন।”
যোগী বললেন, “তথাস্তু! কিন্তু রাজা.. এই লোক থেকে দূরে থাকলেই তোমার জন্য মঙ্গল হবে..” এই বলে তিনি তাঁর দুহাত তুলে তাদের দুজনকেই সেই শক্তি দান করলেন।

রাজ্যে ফেরার পথে একদিন রাজা আর মন্ত্রী এক হ্রদের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক করলেন কিছুক্ষণ এখানে বিশ্রাম নেবেন। কিছুক্ষন পর হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তারা দেখলেন ঝোপের পিছে কি যেন দেখা যায়। ঝোপ সরিয়ে এলে রাজা দেখলেন বিশাল এক হাতি মরে পড়ে আছে হ্রদের ধারে। রাজা ভাবলেন, ‘বেশ হল! দেখি হাতির শরীরে ঢুকতে পারি কিনা, আমার শক্তিরও পরীক্ষা হয়ে যাবে।’ এই ভেবে রাজা কৃষ্ণপক্ষকে বললেন, “কৃষ্ণপক্ষ, আমি ঐ মৃত হাতিটির শরীরে প্রবেশ করবো, দেখি কেমন শক্তি পেলাম। তুমি আমার শরীরটিকে দেখে রেখো।”
'বিশ্বাস করতে পারছি না, ব্যাপারটা এত সহজ হবে! এতো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!’ ভাবলো কৃষ্ণপক্ষ, পরমূহুর্তেই দেখতে পেল রাজা দাঁড়ানো অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে বসে পড়লেন, ওপাশে হাতিটাও যেন একটু নড়ে উঠল। বিস্ময় নিয়ে কৃষ্ণপক্ষ দেখলো রাজা নির্জীব হয়ে শুয়ে পড়া মাত্রই হাতিটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাতিরূপী রাজা তখন বেশ খুশি, তিনি ভাবলেন যাই জঙ্গলটা একটু ঘুরে আসি। যেই না রাজা চোখের আঁড়াল হলেন, দুষ্ট কৃষ্ণপক্ষ সাথে সাথে রাজার শরীরে প্রবেশ করল। তারপর নিজের দেহটাকে পুঁড়িয়ে ফেলে যাত্রা শুরু রাজ্য অভিমুখে।

রাজা শুক্লপক্ষ তখন ফিরে এসেছেন। এসেই দেখেন কৃষ্ণপক্ষ নেই, তার দেহটিও নেই! তিনি বুঝলেন কৃষ্ণপক্ষ তাকে ঠকিয়েছে। তাঁর মনে পড়ল নিভৃতির কথা, যোগীর সাবধান বানী, যা কিছুই তিনি শুনেন নি। ‘তারা ঠিকই বলেছিল’ ভাবলেন তিনি, ‘কৃষ্ণপক্ষ আমার দেহধারণ করে আমার রাজ্য আর রানী দুই ছিনিয়ে নিতে চায়! তার এই দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের আগেই আমাকে রাজ্যে ফিরতে হবে!’

এইদিকে রাজার দেহধারী কৃষ্ণপক্ষ রাজ্যে আসামাত্র সভাসদ সহ সেনাপতি সবাইকে ডেকে বললেন, “আমি আসার পথে এক হিংস্র হাতিকে দেখে এসেছি, সে এ পথেই আসছে, তাকে দেখামাত্রই হত্যা কর!” রাজার আদেশ নিয়ে সবাই ছুটে গেলে কৃষ্ণপক্ষ গেলেন রানী নিভৃতির কাছে, বললেন, “দেখ নিভৃতি! আমি ফিরে এসেছি! আমি সেই শক্তি লাভ করেছি!” কিন্তু বুদ্ধিমতী নিভৃতি কি যেন মেলাতে পারলেন না, মুখে বললেন, “আপনি ফিরে এসেছেন, শক্তি লাভ করেছেন, আমি অনেক খুশি হয়েছি! কিন্তু আপনার মন্ত্রী কৃষ্ণপক্ষ কোথায়?” রাজা বললেন, “হায়.. সে কথা আর বল না, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজের প্রাণ দিয়েছে। আসার পথে এক সিংহ আক্রমণ করে আমাদের। সেই সিংহের হাতেই প্রাণ দিয়েছে কৃষ্ণপক্ষ।” এইবার নিভৃতির বিশ্বাস দৃঢ় হল, সে ভাবলো, ‘.. সেই দুষ্ট কখনো এরকম মহান কাজ করতে পারে না। আমার সন্দেহ হয়, সেই দুষ্টই কোনভাবে রাজার দেহধারণ করে আছেন!’ কিন্তু তিনি তার মনের কথা বুঝতে দিলেন না, বললেন, “যদিও আপনার মন্ত্রীর জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে, তবু আপনি সুস্থ দেহে ফিরে এসেছেন, সেই গুপ্তশক্তি লাভ করেছেন এতেই আমি অনেক খুশি.. কিন্তু আপনি চলে যাবার পর আমি একটি ব্রত করেছিলাম। সেই ব্রত পূরণ হতে আমার আরো কয়দিন লাগবে, এরমধ্যে আপনি আমার সাথে দেখা করতে পারবেন না।” কৃষ্ণপক্ষ বলল, “অবশ্যই! তুমি তোমার ব্রত পালন কর, শেষ হলেই আমাদের আবার দেখা হবে।”

কিছুক্ষণ পর, কৃষ্ণপক্ষ যখন অন্তঃপুরে, হঠাৎ এক দূত এসে খবর দিল, “মহারাজ! সেই হাতি রাজ্যে ঢুকে পড়েছে!” গর্জন করে উঠল কৃষ্ণপক্ষ, বলল, “শীঘ্রই তাকে হত্যা কর! দাঁড়াও আমিও আসছি!” সবাই তখন নানা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো, দেহধারী কৃষ্ণপক্ষও হাতে তলোয়ার নিয়ে চললো তাদের সঙ্গে। কিছুদূর গিয়েই তারা দেখতে পেলো হাতিটাকে। হাতিরূপী রাজা শুক্লপক্ষও দেখলেন তাদের, ভাবলেন, ‘এইভাবে ওদের সাথে লড়তে যাওয়া বোকামী হবে, ওদের কাছে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, কিন্তু কি করি ?..’
পালাতে শুরু করলেন তিনি। হঠাৎ দেখলেন পথে একটা হরিণ মরে পড়ে আছে। ততক্ষণাৎ তিনি সেই হরিণের দেহে প্রবেশ করলেন, ভাবলেন তাড়াতাড়ি তো দৌড়ানো যাবে! সবাই এসে দেখলো হাতিটি মরে পরে আছে, তারপরও সবাই বর্শা তীর নিক্ষেপ করে হাতিটার মৃত্যু নিশ্চিত করলো। কিন্তু দুষ্ট কৃষ্ণপক্ষ দেখেছিল সবই, তাই তিনি আবারও আদেশ দিলেন, “ঐ যে একটা হরিণ! শীঘ্রই সবাই হরিণটিকে বধ কর!” নতুন আদেশে সবাই একটু থমকে গেলেও ছোটা শুরু করল আবার হরিণের পিছু। রাজার তীরন্দাজেরা অব্যর্থ নিশানায় ধরাশায়ী করল হরিণটাকে। খুশিতে লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে এলো কৃষ্ণপক্ষ, বলল, “দারুণ লক্ষ্যভেদ! এর জন্য তোমাদের পুরস্কৃত করা হবে!” কিন্ত সে দেখলো না তার পিছনেই ছিল একটা মৃত তোতা, যার শরীরে রাজা প্রবেশ করেছিলেন তার চোখের সামনেই। বন থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণপক্ষ আর শুক্লপক্ষ উভয়েই বলল, ‘বাঁচলাম!’

তোতারূপী রাজা তখন ভাবছিলেন নিভৃতির সাথে দেখা করতে হবে। তিনি উড়ে গেলেন নিভৃতির প্রাসাদের বারান্দার কাছে। সেখানে এক ডালে বসে আছেন, ভাবছেন নিভৃতি এলেই দেখা হবে। কিন্তু হায় যেখানে বসেছিলেন তিনি সেখানে ফাঁদ পেতে রেখেছিল এক পাখি শিকারী। ধরা পড়লেন রাজা। রাজাকে ধরে পাখি শিকারী যখন নিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ বুদ্ধি আসলো তাঁর মাথায়, তিনি বলে উঠলেন, “হে ব্যাধ, তুমি যদি আমার কথা মত কাজ কর, অনেক টাকা পাবে।” চমকে উঠল শিকারী, বলল, “ঈশ্বর এ পাখি দেখি কথা বলে! নিশ্চয়ই আমি স্বপ্ন দেখছি!” রাজা বললেন, “তুমি স্বপ্ন দেখছো না, উপযুক্ত লোকের কাছে আমাকে বিক্রী করলে তুমি অনেক টাকা পাবে।” ব্যাধ দেখলো, ঠিকই! যে ভাবা সেই কাজ, সেইদিনই সে বাজারে নিয়ে বসলো পাখিটাকে। অনেকেই কিনতে চাইলো কিন্তু ব্যাধ বলল, “না! এই তোতার দাম লাখ টাকা!” সেই বাজারে নিভৃতির এক পরিচারিকাও এসেছিল ঘরতে ঘুরতে। রাজা চিনতেন বৃদ্ধাকে, কাছে আসতেই বললেন, “তোমার রানী কেমন আছে? ভাল তো?” চমকে উঠল বৃদ্ধা, বলল, “ওমা এই তোতা দেখি আমার সাথে কথা বলছে!” ব্যাধ বলল, “হ্যাঁ এই তোতা নিজের থেকে কথা বলে, এর দাম এক লাখ টাকা!” বৃদ্ধা রানীর কাছে গিয়ে বলল সেই তোতার কথা। সব শুনে নিভৃতি বললেন, “এই তোতা পাখি আমার চাই! যাও রাজার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনে নিয়ে এসো পাখিটাকে।” কিন্তু রাজারূপী কৃষ্ণপক্ষ দাম শুনেই চোখ কপালে তুললেন, বললেন, “তোতার জন্য লাখ টাকা! টাকা কি গাছে ধরে নাকি।” বৃদ্ধা আবার ফিরে এলেন নিভৃতির কাছে, বললেন রাজার কথা। নিভৃতি শুনে ভাবলেন, “এ কখনোই আমার স্বামী হতে পারেন না, মহারাজ আমি কিছু চাইলে কখনো আপত্তি করতেন না।” তিনি তখন নিজের থেকেই এক লাখ টাকা নিয়ে বৃদ্ধাকে দিয়ে বললেন পাখিটা কিনে নিয়ে আসতে। কেন জানি তার মন বলছিল, এই পাখিই সব রহস্যের সমাধান করতে পারে।

এই সময় রাজার দেহধারী মন্ত্রী তখন ভাবছে, ‘রানী এক লাখ টাকা দিয়ে একটা তোতা কিনতে চান কেন? ব্যাপারটাতো সন্দেহজনক, একবার গিয়ে দেখতে হচ্ছে’। কৃষ্ণপক্ষ নিভৃতির প্রাসাদে গেল, গিয়েই দেখল পরিচারিকা মাত্র তোতাপাখিটা নিয়ে এসেছে। হঠাৎ করে কি জানি এক ভয়ে সে কেঁপে উঠল, আর কাউকে কিছু ভাবার সময়
না দিয়ে এক ছুটে গিয়ে তোতাটার মাথা ধরে মুচড়ে ভেঙ্গে ফেলল। হা হা করে উঠলেন রানী। এইদিকে কৃষ্ণপক্ষকে আসতে দেখেই রাজা শুক্লপক্ষ বুঝে ফেলেছিলেন কি করতে হবে, কাছেই ছিল একটা মরা মৌমাছি, রাজা গিয়ে ঢুকলেন মৌমাছির শরীরে।
রানী চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন, বললেন, “কোন অধিকারে তুমি আমার পাখি হত্যা করলে? এ পাখি আমি আমার নিজের টাকায় কিনেছি, এক্ষুনি এর মধ্যে প্রাণ সঞ্চারের ব্যবস্থা কর, নইলে আমি আত্মহত্যা করবো!” বলেই তিনি বিছানায় পড়ে কাঁদতে লাগলেন। রানীর কান্না দেখে কৃষ্ণপক্ষ কি করবে কিছুই বুঝতে পারল না, সে বলল, “আচ্ছা... আমাকে কিছুক্ষণ সময় দাও... আমি এখুনি আবার তোমার তোতাকে জীবিত করে তুলছি।” এই বলে সে তোতা পাখিটাকে নিয়ে পাশের ঘরে গেল আর রাজার দেহ ছেড়ে তোতার শরীরে প্রবেশ করে উড়ে এসে রানীর হাতে গিয়ে বসল। কিন্তু এইদিকে মৌমাছিরূপী শুক্লপক্ষ সবসময়ই তার কাছে কাছেই ছিলেন, যখনই সে রাজার দেহ ত্যাগ করল তার কিছুক্ষণ পরেই শুক্লপক্ষ নিজ দেহ ধারণ করলেন। নিজের শরীর ফিরে পেয়েই তিনি ছুটে গেলেন তার স্ত্রী নিভৃতির কাছে। রাজার স্বভাবসুলভ আচরণ দেখে নিভৃতিও বুঝতে পারলেন ইনিই আসল শুক্লপক্ষ। আর সবকিছু দেখে তোতারূপী কৃষ্ণপক্ষ ভয়ে কাঁপতে লাগলো।

রাজা সবিস্তারে রানীকে বললেন তাদের যাত্রার কথা, সেই শক্তি পাবার পর কি হয়েছিল সে কাহিনী। সব শুনে রানী নিভৃতি বলল, “এক্ষুনি আমি এই তোতার মাথা ছিঁড়ে এই দুষ্ট প্রাণ বিনাশ করবো!” রাজা বললেন, “কেন তুমি শুধু শুধু জীবহত্যার পাপ ঘাড়ে নেবে? কৃষ্ণপক্ষকে ওর ভাগ্যের উপরই ছেড়ে দাও। আমি ওকে একটা বড় লোহার খাঁচায় পুরে রাখবো যাতে আর কখনো তার এই শক্তি দিয়ে কারো কোন ক্ষতি করতে না পারে।”

আর তারপর রাজ্যে অনেক বড় করে উৎসব শুরু হল। রাজা রাজ্যের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন। আর অনেক ধুমধামের সঙ্গে রানী নিভৃতিকে সঙ্গে নিয়ে রাজপ্রাসাদে উঠলেন।

জৈন সাধু সন্তরা সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে পারে এরকম করে তাদের দর্শনগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেন। এজন্য তাদের মাধ্যম ছিল নানানরকম গল্প। জৈন দর্শনমতে মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য তৈরী করে। সে যেমন কাজ করবে তেমনই ফল পাবে। বাইরের কোনকিছুই তাকে সাহায্য করে বা ক্ষতি করে এর পরিবর্তন করতে পারবে না। উপরের জৈন গল্পটি আসলে এরকমই এক দর্শনেরই প্রচার। যেখানে চাঁদের শুক্লপক্ষ দিয়ে বোঝান হয়েছে মানুষের ভাল দিক আর কৃষ্ণপক্ষ দিয়ে খারাপ দিক। দেখানো হয়েছে এই যে, যত যাই হোক, সবশেষে মন্দের বিরুদ্ধে ভাল'র জয় হবেই।

(অমর চিত্র কথা'র The King in a Parrot's Body কমিকস্‌ অবলম্বনে)


মন্তব্য

অ এর ছবি

যত যাই হোক, সবশেষে মন্দের বিরুদ্ধে ভাল'র জয় হবেই।

রূপকথা এক ঘোর-লাগা জগৎ --- এই পৃথিবীর বাইরে --- ঐ নিয়ম এখানে খাটে না রে ভাই --- আফসোস এইখানেই!
অনেকদিন পর ঐ জগৎ ঘুরে আসলাম আপনার এই লেখা থেকে ---- ধন্যবাদ।

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

দুর্দান্ত হইছে! সাবাস! মুগ্ধ রে ভাই মুগ্ধ!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

রুপকথার সৌন্দর্য্যটাই আলাদা, ফাটাফাটি লেগেছে। আরো থাকলে নামিয়ে দিন।
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ

হিমু এর ছবি
আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আরে আমি তো ১ম পর্ব না পড়ে ২য় পর্ব পড়লাম। হা হা হা।
এইবার মিলায়ে নিই
চলুক

ভুতুম [অতিথি] এর ছবি

ভালো লাগলো। আরো লিখুন।

এনকিদু এর ছবি

দারুন । হুক্কা হুয়া ... দেঁতো হাসি


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সাধক শিয়ালের গল্পটা দারুণ লাগলো

খেকশিয়াল এর ছবি

কাজকাম নিয়া ব্যাপক ঝামেলায় আছি। এই গল্পতে অনেক রিটাচের দরকার আছে, ভুল ভ্রান্তি, কথা সাজানোর দরকার আছে। পরে করুম নে। অ, মৃদুলদা, লুৎফুল আরেফীন, হিমু ভাই, শিমুল ভাই, ভুতুম, এনকিদু, লীলেনদা .. আপ্নেগো সবাইরে ধন্যবাদ।

------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অবনীল এর ছবি

দারুন! দারুন হয়েছে। ভালো লাগলো বহুদিন পর এরকম মজার একটা রূপকথা পড়তে পেরে। আরো চাই।
___________________________________
স্বপ্ন নয়, - শান্তি নয়, - কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে!

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।