'আহারে! কি লক্ষ্মী আছিলো মাইয়াটা..'
আক্ষেপ করে উঠলেন বুড়ো হরিপদ। তার বয়সের কোন গাছ পাথর নেই। তার সমবয়সীও কেউ নেই। শেষ ছিলেন একমাত্র রফিক সাহেব, তবে তার বয়স 'কাছাকাছি' বললেও অনেক ভুল হবে। তাকে ছেলের মতই জানতেন হরিপদ। তাই রফিক সাহেবের ষাটোর্ধ স্ত্রী, আকলিমা বেগমের মৃত্যুতে তাঁর এই আক্ষেপে বাইরের সবাই চমকে উঠলেও গ্রামের সব স্বাভাবিকই ছিল।
'কালকেও তো দেখলাম.. এক গাদা আন্ডাবাচ্চা নিয়া পড়াইতে বসছে.. আমি যাইতাছি.. কয় হরিকাকা কই যান..
চুলতো একটাও পাকে নাইরে.. আহা! .. কেমনে গেলিগারে মা..'
তাকিয়ে রইলো বুড়া উদাস চোখে।
'কথা কই, শুনলে তো! আছিলো বুকের ব্যারাম, কিন্ত সব কাজ তার করা লাগবো.. কাল রাতের ব্যাদনাতেই তো..' নিচু স্বরে বলছিলেন শফিক সাহেব।
খেঁকিয়ে উঠলেন বুড়ো, 'আমারে মুখ খুলাইয়াও না শফিক! এমন ভাবে ..কইতাছো যেন কত খেয়াল রাখছ মায়ের! মার লগে একদিনও ভাল কইরা কথা কইছো তুমি? বুকে হাত দিয়া কও তো? কি কষ্টটাই না পাইয়া গেল সে কে জানে..
যাউকগা.. সে আর নাই, এখন সারা জীবন মাতম কইরা বেড়াইলেও তারে পাইবা না। এখন বুঝবা.. কি জিনিস হারাইছো।'
কিন্তু শফিক মেম্বারের চেহারায় হারানোর তেমন কোন অভিব্যক্তি দেখা গেল না। তার বদলে সেখানে ফুঁটে উঠলো একরাশ বিরক্তি।
'ঐ হাসু হারামীটা কই গেল! হুজুররে নিয় আইতে কি এতক্ষণ লাগে? গোর দিতে হইবো না?' চেঁচিয়ে উঠলো সেও। তার কথায় দৌড়ে গেল কেউ একজন, খবর নিতে। শফিক মেম্বাররে সবাই ডরায়। সবাই জানে এই লোক কি করতে পারে।
মাটি কাটতে কাটতেই হেসে উঠে হাসান। বাইরে থেকে সবই শুনছিল তারা। তার হাসি সংক্রামিত হত আলীর মুখেও। সবাই জানে, শফিক মেম্বার শুধু একজনকেই সমঝে চলে, সে হল এই হরিপদ কাকা।
'শুওরের বাচ্চা..' বিড়বিড় করে বলে উঠে হাসান। গোর কাটা তখন প্রায় শেষ। মাটি সরাচ্ছিলো আলী, বলল, 'আস্তে কও হাসান ভাই, এই সীমারের কান অনেক বড়, হাতটাও বেশ লম্বা.. নিজের ভাইরেই যে.. হেহ্, তুমি তো কোন ছার..'
'কি করবো? মাইরা ফালাইবো?.. আর রাখছে কি? আরকি কিছু বাকি আছে? যেট্টুক জমি আছিলো তাও তো নিছে। খালাম্মা আছিলো দেইখা এদ্দিন কিছু কই নাই, এহন হেও চইলা গেল.. আল্লা তার বেহেস্ত নসিব করুন। আমি আর কাউরে ডরাই না..'
'কিরে তোরা মাটি কাটস না খোশগল্প করস? এত কথা কিসের, ঐ!' ভিতর থেকে খেঁকিয়ে উঠে আবার শফিক।
'হারামজাদা.. !' একগাদা থুথু ফেলল হাসান।
২
হাসু যখন হুজুর নিয়ে আসছে তখন বেলা পড়ে গেছে। আগরবাতি আর আতরের গন্ধে শেখবাড়ী ভরে গেছে। হাসান মাঝি ধরে রেখেছিল তার বউকে। লাশ নামানোর সময় কাঁদছিল সব বউ ঝিরা, সবাই ভালবাসত তাদের আকলি খালাকে। মাটি দেয়া হয়ে গেলে মা মা বলে কেঁদে উঠলেন শফিক সাহেব। কেউ ফিরেও তাকালো না তার দিকে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, দাফন কাজ শেষ। সবাই চলে গেছেন একে একে। হুজুরের সাথে কথা বলে ঘরে উঠল শফিক।
'বউ ও বউ, একটু এদিকে আসো, বাতাস কর।' ডাক দিলো ভিতরের দিকে.. শব্দ এলো না কোন।
'কি হইলো, সব কই গেল? আম্মা তো গেছে আমার, তোমাগো কি হইছে?..' পিছনে চাবির গোছার শব্দ শোনা গেল তখন। হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগলেন শফিকের দ্বিতীয় স্ত্রী।
'বড়জন কই? এহনো কান্দে?'
'বুবুর শরীলডা ভাল না..'
'আমারে খাইতে দাও, অনেক ক্ষুধা লাগসে।'
'এহনি খাইবেন? কয়টা বাজে?'
'আরে ক্ষুদা লাগসে তার আবার এহন তহন কি..' বলে কব্জির দিকে তাকালো শফিক মেম্বার। চোখ কপালে উঠল তার, ঘড়ি নেই!
'হায় হায় আমার ঘড়ি কই গেল?'
'খুইলা কোথাও রাখছেন নি দেখেন'
'আরে কই রাখুম? আমারে ঘড়ি খুলতে দেখছো আজকে?'
'গোসলের সময় কই রাখছেন?'
'আরে গোসলের পরেও তো পড়ছি, কই গেল ঘড়িটা!' চেয়ার থেকে উঠে পড়ে শফিক, হাঁতড়াতে থাকে সবকিছু..
'আরে এত উতলা হইয়েন না, ঠান্ডা মাথায় দেখেন, আছে কোথাও..'
কিন্তু শফিক সব জায়গায়ই দেখলো। বিছানার পাশে, নীচে, বাড়ির দাওয়ায়, উঠানে, সবগুলা ঘরে এমনকি গোয়াল ঘরও বাদ গেলো না।
তার চেঁচামেচিতে বড় বউ উঠে এলো বিছানা থেকে। সেও খুঁজলো, কিন্তু তার বিশ হাজারী ঘড়ির হদিশ নাই।
রাত তখন একটা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, শফিক মেম্বার জেগেছিল তখনো। না, মায়ের দুঃখে নয়। ঘড়ির চিন্তায়। দূরের ছাতিম গাছটার নিচে তার সদ্য গোর দেয়া মা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ চোখ বড় বড় হয়ে উঠল তার। সাথে সাথে কিছু জিনিস মনে পড়ল তার, মাটি দিচ্ছিল সে তখন মার কবরে.. ঘড়িটা তখন পড়ল নাকি? চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো শফিক, হাঁটতে লাগল দাওয়ায়, এদিক ওদিক।
'কি করা যায়? গোর আজাব হইয়া যাইবো না? না না.. কি ভাবি আমি?..
কিন্তু এতো সাধের ঘড়িটা.. এতো দামী' ঘেমে নেয়ে উঠে সে। তার মনে পড়ে যায় তার মায়ের বলা কথাগুলো। বড়ভাইয়ের লাশ পাবার দিন কেঁদে কেঁদে বলছিলেন তাকে, 'মনে রাখিস শফিক.. মনে রাখিস আল্লাহ সব দেখে.. সব দেখে'। শফিক আর ভাবতে পারলো না। চুপিচুপি হেঁটে গেল রান্নাঘরের দিকে, ওইদিকের একটা ঘরেই আলী ঘুমায়।
আলী তখন বিশ্বাস করতে পারছিল না সে কি করছে। সে শুধুই খুঁড়ছিল আর আল্লা আল্লা করছিল। আর এক সময় উঠে এলো সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শফিক, 'কিরে! উইঠা আইলি কেন?'
'আমি আর কাটতে পারুম না' শান্ত গলায় বলে উঠে আলী, 'এই পাপ আমি করতে পারুম না!'
'ওই হারামী পাপ হইলে আমার হইবো, তোর কিরে?' নীচু গলায় বকে উঠে শফিক। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে আলীর, 'লোভ একটু কম করেন মেম্বার সাব, আল্লা ত আপনেরে কম দেয় নাই..'
'ওই শুওরের বাচ্চা ভাগ এইখান থিকা, আমার লগে তুই এমনে কথা কস? তোর সাহস তো কম না, এখনই এই বাড়ী থিকা দূর হ। খাড়া, কালকে আমি তোর ব্যবস্থা করতাছি!'
আলী চলে যেতে যেতে শুনে মাটিতে কোপের শব্দ, মেম্বার শফিক নিজেই খুঁড়ছে এবার।
'আর একটু.. এইতো শেষ.. হ!' চাটাইয়ে বাড়ি লাগে তার কোদালের। মাটি সরাতে থাকে সে দুহাতে। কিন্তু ঘড়ি কই? খুঁজতে থাকে সে এদিক ওদিক.. হাত দেয় একবার চাটাইয়ের নীচে, অনেক ঠান্ডা জায়গাটা। হাতড়িয়ে দেখে সে নীচের প্রতিটা জায়গায়, প্রতিটা কোনায়, ঘড়ি নেই। হাঁপিয়ে যায়, শফিক মেম্বার, বসে পড়ে। উপরে তখন গাঢ় অন্ধকার, গর্তের মুখ বোঝা যায় না। টর্চের মিটমিটে আলোতে যেন শুধু অন্ধকারই বাড়ে।
শফিক চাটাই সরায়, কিন্তু অন্ধকারে দেখতে পায় না কিছুই। যেন সে বসে আছে আরেকটা গর্তের মুখে, একবুক নিঃশ্বাস নেয় আর টর্চ মারে সে মায়ের মৃতদেহে..
..শফিক পড়ে যাচ্ছিল.. সেই গর্তে.. নীচে অনেক নীচে। দেখছিল সে সবকিছু, আর চিৎকার করছিল সে.. প্রচন্ড চিৎকার। সে পড়ছিল আদিগন্তব্যাপী বিরাট বিশাল এক রক্তাক্ত চোখে, চারদিকের সাদা থিকথিকে অংশে বীভৎস কিসের যেন নড়াচড়া সবখানে.. আর চোখের মণিটা শুধু নড়ছিল এপাশ ওপাশ, দেখছিলো তাকে প্রতিটি মূহুর্তে..
তার মায়ের চোখ কি?
মন্তব্য
বাহ্, সুন্দর লিখেছেন !
ধন্যবাদ
------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
- বাহ্ পণ্ডিত!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
বেড়ে লিখেছেন।
-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি
ধন্যবাদ
------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
স্তম্ভিত হলাম পড়ে।
------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
হ গল্প ভাল হইছে। পুরা চ্রম।
তয় একটা কথা হইলো - আমগো দেশে মুসলমানদের কবরে কফিন ব্যবহার হয় না। গর্তে শুধু লাশ নামিয়ে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে তার ওপর মাটি দেয়া হয়।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
হ, এইটা আমিও দেখছি, কফিন বহনে ব্যবহৃত হয়, আমি মনে করছিলাম কফিনসহ দাফনও হয় বুঝি, এখন শিওর হইলাম।
------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
শেষের দিকে এসে একটু ভয় ভয় লাগলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ঘাবড়াইয়া গেলাম পুরা!!!!!!!!!!!!!! দারুন!!!!!!!!!!
------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ভয়ানক, ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
গল্পটা অতি সুন্দর
তবে শফিক হাসান নাম দুটো গল্পের তুলনায়
একটু বেশী শহুরে মনে হলো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
মামা জ়টিল হইসে !!! সাবাশ বন্ধু!!
দারুন লাগ্লো! আরো চাই!
___________________________________
স্বপ্ন নয়, - শান্তি নয়, - কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে!
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
এইডা কি অফিসিয়ালি শেষ? নাকি চলপো? মামা? কেমুন জানি মনে হইল আরো কিসু কইপার চাইলা???
নতুন মন্তব্য করুন