ঠিক সূর্যাস্তের সময়ে তারা পৌঁছায় পাহাড়ের পাদদেশে। কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই সেখানে। একফোঁটা পানি কিংবা কোন বৃক্ষ.. কোন পাখির ছায়া, কিচ্ছু না। শুধু শূন্যতার উপর ভর করে ওঠা শূন্যতা আর সেই প্রকাণ্ড পাহাড়, যার চূড়া হারিয়ে গিয়েছিলো ওই স্বর্গে।
বোধিসত্ত্ব তাকান তার সহযাত্রী যুবকটির দিকে, বলেন, -
“তুমি যা দেখতে চাও, তাই তোমাকে দেখানো হবে। কিন্তু তা এখনো অনেক দূর, আর যাত্রাপথ বড়োই দুর্গম। আমাকে অনুসরণ করো, ভয় পেয়ো না। শক্তিই তোমাকে আশ্রয় করবে।”
গোধূলির বিষন্নতা বুকে নিয়ে তারা ওঠে পাহাড় বেয়ে। সেখানে পায়ে হাঁটা কোন রাস্তা নেই, নেই কোন মানুষের চিহ্ন । পুরো পথটাই যেন খণ্ড-বিখণ্ড কিছুর স্তুপাকারে সাজানো। প্যাঁচানো সিড়ির মত পিছু সরে সেই রাস্তা, ধীরে ধীরে, তাদের পায়ের নীচে। মাঝে মাঝে পায়ের নীচ থেকে ক্ষুদ্র খন্ডাকারে খসে পড়ে পথ, হারিয়ে যায় প্রতিধ্বনি তুলে; আর মাঝে মাঝে ফেঁটে পড়ে ফাঁপা শব্দে।
নিকষ আকাশে তারারা ফুঁটে, কেঁপে ওঠে মাঝে মাঝে; সন্ত্রস্ত যেন খুব। আর আঁধার ঘনায়, আরো গাঢ় হয়ে।
“ভয় পেয়ো না বাছা,” বলেন বোধিসত্ত্ব, হাত তুলে দেখান উপরে,-
“বিপদ নেই ওখানে, কিন্তু পথ.. সে বড়ই ভয়াল।”
তারার আলোয় উঠছিলো দুইজন। এবার দ্রুত, বেশ দ্রুত। যেন এক অতিমানবীয় শক্তি ভর করে তাদের দেহে.. ঘোরগ্রস্তের মত এগিয়ে চলে পা। কুয়াশা ঢাকা জায়গা পেরিয়ে দু’জোড়া চোখ ফিরে তাকায় নীচে। সেখানে চুপিচুপি বয়ে যায় এক নীরব নিঃস্তব্ধ মেঘ, অদ্ভুত সাদা দুধ-সাগর যেন এক। অনেক উঁচুতে এখন তারা।
ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে উঠে চলে তারা। মৃদু ভোঁতা শব্দেরা হারিয়ে যাচ্ছিলো পায়ের নীচে নীচে; অদ্ভুত এক আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠে সেখানে আর মরেও যায় দ্রুত, পথ ভাঙ্গার সাথে সাথে। আর একসময়, যুবকটির হাতে ঠেকে মসৃণ মতন এক বস্তু, পাথর নয়। তুলে ধরে সে ওটা, আর দেখে অস্পষ্টভাবে.. গালবিহীন মুখের মত কী যেন এক.. সাক্ষাত মৃত্যু যেন, ভেঙ্গাচ্ছে তার দিকে চেয়ে।
“ফেলে চলে এসো ওটা!” বলে ওঠেন বোধিসত্ত্ব।
“চূড়া এখনো বহু দূর..”
আঁধার ভেদ করে ফের শুরু হয় তাদের যাত্রা। পায়ের নীচে চলতে থাকে সেই মৃদু ভঙ্গুরতা, আর অদ্ভুত যত আগুনে ফুলকি, যতক্ষণ না কালো থেকে ধূসর হয় রাত। আর একসময় তারারা ম্লান হয়ে আসতে থাকে.. পূব-আকাশের লালচে আভায়।
তবু উঠে চলে তারা। দ্রুত, আরো দ্রুত। মৃত্যু শীতল নীরবতা জড়িয়ে এগিয়ে যায় তারা এক অতিমানবিক গতিতে।
... সোনালী এক আগুনে জ্বলে ওঠে পূবের আকাশ। হঠাৎ যুবকের চোখে চারপাশ নগ্ন হয়ে ওঠে। শিউড়ে উঠে সে আতংকে। কারণ সেখানে কোন মাটি নেই, নেই কোন পাথর। তার পায়ের নীচে, আশেপাশে, এমনকি উপরেও না। তার চারদিকে পড়েছিলো অগুণিতক দানবাকৃতির যত খুলি আর কংকালের স্তুপ। হাড়েগোড়ের গুড়ো ধূলো হয়ে উড়ছিলো তার পায়ের সাথে সাথে। জ্বলজ্বল করছিলো চোয়ালবিহীন দাঁতেরা তাদের মাঝে।
“ভয় পেয়ো না বাছা!” দূর থেকে চিৎকার করে বলেন বোধিসত্ত্ব,
“ভয় পেয়ো না, সাহস সঞ্চয় করো। শুধুমাত্র দৃঢ়চেতারাই উঠতে পারে এই পর্বতশিখরে।”
পিছনের জগত লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো তাদের। নীচে মেঘ আর উপরে আকাশ কিছুই নেই, আর আছে শুধু সেই খুলির স্তুপ। পা টেনে চলে তারা, উঠতে থাকে.. আরো উপরে।
তখন তাদের সাথে সূর্যও উঠতে শুরু করে পাহাড় বেয়ে। নিরুত্তাপ এক সূর্য। কিন্তু সেই ভয়ানক উচ্চতা, গভীর গিরিখাত আর সন্ত্রস্ত নীরবতা বাড়তে বাড়তে ভারী হয়ে ওঠে যুবকের কাছে। পা আর চলতে চায় না তার। হঠাৎ করে কে যেন শুষে নেয় তার সমস্ত প্রাণশক্তি। দুঃস্বপ্ন দেখা ঘুমন্ত ব্যক্তির মত গুঙ্গিয়ে ওঠে সে।
“দ্রুত বাছা, আরো দ্রুত!” চিৎকার করে বলেন বোধিসত্ত্ব : “দিন খুবই ছোট আর চূড়া এখনো অনেক দূর।”
কিন্তু যুবক ভেঙ্গে পড়ে, মাথা নাড়তে থাকে সে, “আমি আর পারছি না! আমি ভয় পাচ্ছি! প্রচণ্ড ভয়! আমার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে..”
“শক্তি ফিরে আসবে বাছা, শক্তিই তোমাকে আশ্রয় করবে” বোধিসত্ত্ব বলে ওঠেন ... “আচ্ছা শোনো.. নীচে তাকাও, উপরে .. আর তোমার চারদিকে, দেখো.. বলো, কী দেখতে পাচ্ছো?”
“আমি বলতে পারবো না!” চেঁচিয়ে ওঠে যুবক, ভয়ে কেঁপে ওঠে সে, বলে, “আমি আর কোথাও তাকাতে সাহস পাচ্ছি না! .. আমার নীচে উপরে আর চারদিকে শুধুই নরকঙ্কাল, শুধুই মাথার খুলি! ”
“আর এখনো বাছা..আর এখনো তুমি বুঝতে পারছো না এই পাহাড় কিসের তৈরী?” ” স্মীত হেসে বলেন তিনি।
“আমি ভয় পাচ্ছি! ওহ ঈশ্বর! এতো খুলি! এখানে মানুষের খুলি ছাড়া আর কিছুই নেই!” পুনরাবৃত্তি করে ওঠে যুবক।
“হ্যাঁ, মানুষের খুলি আর কংকাল দ্বারাই তৈরী এই পাহাড়” বলেন বোধিসত্ত্ব, “কিন্তু বাছা, এইসব খুলি আর কংকাল এ-সবই তোমার নিজের! এখানের প্রতিটি খুলি একসময় তোমার কোন না কোন সময়ের স্বপ্নকে ধারণ করেছিলো, আকাঙ্ক্ষাকে আশ্রয় দিয়েছিলো। এখানে একটি খুলিও অন্য কারোর নয়, সবই তোমার। প্রতিটি খুলিই তোমার কোটি কোটি প্রাক্তন জীবনের অসফলতার স্বাক্ষর।”
লাফকাদিও হার্ণের Fragment গল্প অবলম্বনে
মন্তব্য
ইন্টারেস্টিং একটা মোরালকে জানান দিতে এতো পেঁচিয়ে গল্প লেখা হয়েছে কেনো বুঝলাম না। আমি হলে সোজা দুই লাইনে কথা শেষ করে দিতাম। একারনেই বোধহয় গল্প লিখতে পারি না।
গল্প কিন্তু আসলে দুই লাইনেরই হাহা, তবে বর্ণনাটা জোস লাগসিলো যখন পড়সিলাম। আমারটা জমলো না মনে হয়
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
সুন্দর!!!
-অতীত
ধন্যবাদ
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
হুমম! Failure is the mountain of success.
লেখা ভাল লাগল। -রু
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
গল্প ভালো লেগেছে। তবে কে ফক্সের কাছ থেকে মৌলিক গল্প চাই, অনুবাদ না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এইটার অনুবাদ করার লোভ সামলাইতে পারলাম না দাদা, পইড়া বেশ মজা পাইছিলাম।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
বেশ। পেছন ফিরে তাকাতে হয় তাহলে..
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ভুলের পাহাড় না সাগর? ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক, আমার কিন্তু পাহাড়ই পছন্দ...
কুটুমবাড়ি
হ, পাহাড় আমারও বেশ পছন্দ!
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
বাহ, আজকে সচলে সব মোরালের গল্প, ভাল লাগল, ধন্যবাদ অনুবাদের জন্য
আপনাকেও ধন্যবাদ
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
শেষটা আসলেই সুন্দর। আরো অনুবাদ করেন না। ...
ধন্যবাদ , লিখুম।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
সবই মায়া!
ভালো লাগলো!
কৌস্তুভঃ হ!
পান্থঃ ধন্যবাদ
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
চ্রম!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
হ, মূল গল্পটা চ্রম!
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
গল্প আর অনুবাদ দুইটাই দারুণ
কিন্তু বিষয়বস্তুর সাথে একমত না
পরজন্ম থাকলে আমি এই জীবনের রঙিন ভুলগুলো করার জন্যই আবার জন্মাতে চাই
ঠিক আপনের কথাও ঠিক
"ভুল" "ঠিক" কথাগুলা আসলে আপেক্ষিক আর "সফল" "অসফল" ও
সবই মায়া
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
হুম, খুলির স্তুপ বেয়েই কিন্তু উপরে উঠে যেতে হয়।
ভালো লাগলো। আরো কিছু করলে হয় অনুবাদ। যেমন ধর কাইদান?
কিছু বানান ভুল ধরে দেই যদি আপত্তি না করো, একটু বেশিই চোখে লাগছে তাই
নীচে > নিচে (নীচ - হীন; নিচ - below, down)
ফেঁটে > ফেটে
তারারা ফুঁটে > ফুটে, ফোটে
শিউড়ে > শিউরে
সোনালী, তৈরী > এগুলো এখন সোনালি, তৈরি লেখে
স্মীত > স্মিত
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন