১
মুনীর হক ভয় টয় একটু কমই পান। রাত বিরেতে একলা চলাফেরার অভ্যাস তাঁর আজকের নয়। ভয় থাকে শুধু ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়ার। ভূত প্রেত কথাগুলো তাঁর কাছে আজগুবি লাগে, হাসিও পায় বেশ। বয়সটা মনে হয় তিনি পেরিয়ে গেছেন অনেক আগেই। এইতো এই বছর পঞ্চান্ন পেরুলেন। তবে ভয় পেতেন একসময়, সেই ছোটবেলায়। শীতকালে গ্রামের বাড়িতে গেলে সব পিচ্চিকাচ্চি তাঁর মা'র কাছে এসে গল্প শুনতে চাইতো। যখন সবাই উঠানে গোল হয়ে খেজুরের রস জ্বাল দিতো, তখন তাঁর মাকে ঘিরে গল্পের বায়না আসতো। মা যখন ভূতের গল্প বলতেন তখন তিনি মায়ের কোলে একদম সেঁটে বসে শুনতেন সব গল্প। মা খুব সুন্দর গল্প বলতে পারতেন।
কিন্তু তাঁর এখন এইসব কথা মনে হচ্ছে কেন? জায়গাটা অপরিচিত আর নির্জন বলে? বেশি রাত হয়ে গেছে বলে? মনে মনে সব উড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসেন তিনি।
যাত্রীদের বসার জন্য ঘরটা বেশ ছোট। দেয়ালের সাথে লাগানো তিন পাশে তিনটা বেঞ্চ। আর এমনিতে কয়েকটা চেয়ারও আছে। তাঁর পাশের বেঞ্চিতে কে যেন আপাদমস্তক চাদরে মুড়ে ঘুমিয়ে আছে। বাইরে মাঝেমাঝে দুই একটা লোক দেখা যাচ্ছে। মুনীর সাহেব একেবারে একা নন।
প্রায় দশ বছর পরে এলেন তিনি গ্রামে। এসেছেন বাসে করে। আসবার পথে স্টেশন আর রেললাইন দেখে তাঁর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। কত খেলেছেন এই লাইন ধরে। তাঁর মনে পড়ে লাইন ধরে সব ভাইবোন মিলে চলে যেতেন পাশের গ্রামের খলিল চাচার বাড়িতে। গ্রামটা একটু দূরে। যাওয়ার সময় বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ভাব হত! না জানিয়ে যাওয়ায়, পরে বাসায় ফিরলে অবশ্য বেশ বকুনি খেতে হত। অনেক মজার ছিল দিনগুলি।
এসেছিলেন তাদের গ্রামের জায়গাটা বিক্রী করতে। সোজা কথায় গ্রামের সাথে শেষ সম্পর্কটা ছিন্ন করতে। গ্রামে আপন বলতে আর কেউ থাকে না। চাচাতো ভাই বোন যারা থাকতো, ছোট চাচা মারা যাবার পর তারাও সব ঢাকায় চলে আসে। সেও বেশ আগের কথা। পড়ে ছিলো শুধু তাঁদের জায়গাটা, বাবার ভিটা। আজই বিক্রী করে দিলেন দূর সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের কাছে।
বাসে করে আসার পথে স্টেশনটা দেখেই নস্টালজিক হয়ে পড়েন তিনি। ছোটবেলায় ট্রেনেই যাতায়াত করতেন। বাবার কাজ ছিলো ঢাকায়। গ্রামে ঘোরা শেষ হলে সবাই মিলে ফিরতেন রাতের ট্রেনে। এখন মনে হচ্ছে এতো রাতে না বের হলেই পারতেন। ভোরে বাসে করেই চলে গেলেই হতো। কিন্তু তাতে আবার দেরী হয়ে যাবে। সকালের মিটিংটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেরী করলে চলবে না।
বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। গল্পটা তাঁর এক আধপাগলা চাচা তাকে বলেছিল মনে হয়। ঠিক ভৌতিক না, অদ্ভুত। আধিভৌতিক বলা যায় কি? গল্পটা আবছা আবছা মনে পড়ে। সেই চাচা বলেছিল ,এটা গল্প না, এটা সত্যি কাহিনী। যদ্দুর মনে পড়ে ব্যাপারটা ঘটেছিলো সেই চাচার'ই সাথে।
ট্রেন আসতে আরো দুই ঘণ্টা বাকি। পাশের বেঞ্চির লোকটা পাশ ফিরে শোয়।
এটা মনে আছে যে গল্পটা একটা স্টেশন নিয়েই। স্টেশন বলেই তাঁর মনে পড়েছে। তাদের গ্রামেরই স্টেশনই কি? মুনীর সাহেব কি এখন সেখানেই বসে আছেন? ভেবে একটু রোমাঞ্চিত হন তিনি, মনে করার চেষ্টাকরেন গল্পটা। বয়স হয়ে গেছে, কিচ্ছু মনে পড়ে না আগের মতন।
"ধ্যাত!" একটু জোরেই বিরক্ত হয়ে উঠেন তিনি। বলেই সামলে নেন। পাশের লোকটা জেগে গেছে। ঘুমভাঙ্গা ফোলা ফোলা চোখে তাকে দেখছে। মুনীর সাহেব মাটিতে তাকিয়ে থাকেন। মজা লাগে তার, অনেকটা স্কুলে পড়ার সময় দুষ্টুমির মত মজা।
"কি হইছে ভাই?" লোকটা ছাড়ে না, প্রশ্ন করে।
"এইতো.. কিছু না, অনেক তেলাপোকা, জ্বালাচ্ছে বেশ!" মাটিতে কাল্পনিক তেলাপোকাদের তাকিয়েই বলেন তিনি।
"অ.." বলে লোকটা। আবার শুয়ে পড়ে পাশ ফিরে। কিন্তু ঘুমায় না, কথা শুরু করে আবার,
"এই শীতের রাইতে এহানে কি করেন ? বাড়িঘর নাই?" ঘুমজড়িত কণ্ঠে শুয়ে শুয়েই বলে লোকটা।
ভ্রু কুঁচকে উঠে মুনীর সাহেবের। ঘরের টিমটিমে আলোয় দেখেন লোকটাকে ভাল করে। লোকটার সাথে কোন ব্যাগ কিংবা মালপত্র কিছু নেই। লোকটা হয়তো কোথাও যাবে না। লোকটা মনে হয় এখানে ঘুমাতেই এসেছে। হয়তো এখানেই প্রতিরাতে ঘুমায়। তাঁর মনে একটা অস্বস্তি উশখুশ করতে থাকে।
"আচ্ছা দুই ঘন্টা পরে না একটা ট্রেন আসার কথা?" লোকটাকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি। নাকডাকার শব্দ আসে উত্তরে। আবার ঘুম দিয়েছে ব্যাটা।
২
মুনীর সাহেব উঠে পড়েন। হঠাৎ করেই যেন চারপাশটা বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে ব্যাটার ঘরঘর করে নাক ডাকার শব্দ। মনে হচ্ছে ছোটবেলার কথা। গভীর রাতে যখন মাঝে মাঝে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যেত, বিছানায় শুয়ে শুয়েই পাশের ঘরের বাবার নাক ডাকার শব্দ শুনতেন তিনি। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল তাঁর। একদিন থেকে গেলেই পারতেন। বাবা মা'র কবরটা দেখে আসতে পারতেন তিনি।
দরজার কাছে আসতেই শুনলেন পিছনে একটা অস্ফুট শব্দ। ব্যাটা আবার জেগে গেছে। ঘুম ভেঙ্গে হাই তুলে উঠে বসেছে।
"মুরুব্বী, খুব খিদা লাগসে, খাওনের কিছু আছে আপনের লগে? বিস্কুট টিস্কুট?" ঘুমজড়িত কন্ঠে বলে লোকটা।
এহ! কী আবদার! খানিক বিরক্তি নিয়ে তাকান মুনীর সাহেব। কিন্তু তিনি ভদ্রলোক, বিরক্ত হলেও ব্যাগ খুলে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বাড়িয়ে দেন লোকটার দিকে।
"আপনি কি এখানেই ঘুমান?" প্রশ্ন করেন মুনীর সাহেব।
"উহু!" বিস্কুট চিবুতে চিবুতে বলে লোকটা, "একটা কাম আছিলো, একজনের লেইগা বইসা আছি" বিস্কুট চিবুতে চিবুতে বলে লোকটা।
"নাম কি আপনার? আমি মুনীর হক।"
"জ্বে, আমার নাম লোকমান হাসান !" দাঁত বের করে দেয় লোকটা।
"আচ্ছা.. আর কোন মানুষ দেখছি না যে? এই স্টেশনে লোকজন যাতায়াত করে না?"
"করবো না ক্যান..করে, সকালে করে। আপনে আইছেনই আখাইড়া টাইমে.. মানুষ দেখবেন কইত্থে? এতো রাইতে মানুষ ট্রেনে উঠে? এই এলাকায় মানুষই আর কয়টা.. ট্রেন যে থামে এই না কত!"
"না ভাবলাম অনেকদিন ট্রেনে যাই না.. " একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করেন মুনীর সাহেব, "আচ্ছা স্টেশন মাস্টারকে দেখলাম না, লোকজনও নেই.."
একটু হাসার ভঙ্গি করে লোকমান, মুখ ভর্তি বিস্কুট নিয়ে বলে,
"বুইড়া কি স্টেশনে থাকে? অরে তো আমরাই খুঁইজা পাই না, আপনে পাইবেন কেমনে? দেখেন বাড়িত গিয়া ঘুমাইতাছে। আর কাশেইম্মা আছে, সিগন্যাল দেয়। বাড়িত গেছে মনে হয়। আইবো একটু পরে.. দেখতে পাইবেন।"
"আচ্ছা এই স্টেশন নিয়ে কি কোন ভূতের গল্প আছে?" মুখে কৌতুকমিশ্রিত একটা হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেন মুনীর সাহেব, "আমার চাচা বলেছিল অনেকদিন আগে। ঠিক মনে করতে পারছি না। আপনি জানেন কিছু?"
তাঁর হাসি লোকটার মুখেও সংক্রামিত হয়। খালি বিস্কুটের প্যাকেটটা একপাশে ছুঁড়ে পানি চায় এবার। মুনীর সাহেব পানির বোতলটা এগিয়ে দেন।
"তা চাচামিয়া, এরম একটা গল্প আমিও শুনছিলাম। একটা ট্রেন নাকি আসে মাইঝরাতে.. ট্রেনভর্তি নাকি ভূত পেত্নী থাহে। হে হে ..আজাইরা গল্প!"
মুনীর সাহেবের মনে পড়ে এবার। হ্যাঁ তাঁর চাচা বলেছিল এরকম। ট্রেনভর্তি নাকি ছিল সব মৃতমানুষ। তাঁর চাচার দাদা, দাদী, মা বাবা, আর সব মৃত আত্মীয়রা। ছোটবেলায় গল্পটা শোনার পরে একলা স্টেশনে আসতে ভয় পেতেন, মনে পড়ে তাঁর। হাসি আসে মুনীর সাহেবের। আসলেই আজাইরা গল্প।
"চাচামিয়া কি করেন? ব্যবসা বাণিজ্য?" একটা বিশ্রী শব্দে ঢেঁকুর তুলে জিজ্ঞাসা করে লোকমান।
"অনেকটা সেরকমই।" অস্ফুট স্বরে বলেন মুনীর সাহেব। তাঁর আর অপেক্ষা করতে ভাল লাগছে না। এখন ট্রেন আসলেই বাঁচেন তিনি। ঘড়ি বলে আরো এক ঘন্টা। লোকটাকেও এখন অসহ্য লাগছে।
একটা লম্বা হাই তোলে লোকমান। হাতের আঙ্গুল মটকাতে মটকাতে বলে,
"চাচামিয়া.. আপনেরা এতো ভুদাই ক্যান?"
লোকটার মুখে কৌতুকের হাসি। মুনীর সাহেব চমকে ওঠেন।
"অবশ্য বয়স হইলে নাকি মাইনষের বুদ্ধিশুদ্ধি পোলাপাইনের মত হইয়া যায়.." লোকটা বলতে থাকে, "কিন্তু আপনের তো এহনো অত বয়স হয় নাই.. দিনকাল যে ভাল না, বুঝেন না? ব্যাগভর্তি কইরা এতো টাকা নিয়া কেউ চলাফেরা করে?"
মুনীর সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। লো প্রেশারের রোগী তিনি। ঝড়ের বেগে অনেকগুলো চিন্তা পরপর মাথায় ঘুরতে থাকে তাঁর। লোকটা জানলো কিভাবে টাকার কথা? ব্যাগ খোলার সময় দেখেছে? কিন্তু তিনি তো বেশ সাবধানে লুকিয়েই খুলেছেন। লোকটা কি বিপদজনক? টাকার জন্য এসেছে? ছিনতাই করবে? নিজের উপর বেশ মেজাজ খারাপ হয় তাঁর। কেন টাকাগুলো সাথে নিয়ে আসতে গেলেন। মানিক কেও বলেছিলেন তাঁর একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু ও কী সব ঝামেলার কথা বললো, বললো অনেক দেরী হয়ে যাবে। আর কয়টা টাকারই তো ব্যাপার। তাই ক্যাশ নিতে তিনি আর আপত্তি করেননি। কিন্তু এইসব লোকের কাছে এই টাকাই তো অনেক। বড় ভুল হয়ে গেছে। আসলেই বুড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। ঘরের দরজাটা ভেড়ানো। শ্বাসকষ্ট হতে থাকে মুনীর সাহেবের।
"কি ভাবেন চাচামিয়া? ভাবেন কেমনে জানলাম? হে হে.. আপনেরে তো সেই মানিক ব্যাপারীর অফিস থিকা ফলো করতাসি। মানিক ব্যাপারী আপনের চাচতো ভাই না? হে হে.. জানি সবই। আপনের লগে লগে আজমীর হোটেল গেলাম। আপনে গরুর গোস্ত দিয়া ভাত খাইলেন। খাইলেন কম, ফালাইলেনই বেশি। আপনেরা শহরের মানু্ষ, আপনেগো এডি হজম হইবো ক্যান.. তারপর একটা রিশকা ধইরা আইলেন এই স্টেশনে।"
মুনীর সাহেবের কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। লোকটার কথা মনে হয় বহু দূর থেকে ভেসে আসছে। দমবন্ধ হয়ে আসতে থাকে তাঁর। জামার বোতাম খুলতে খুলতে হাঁটতে থাকেন দরজার দিকে। চিলের মত ছোঁ দিয়ে তাকে পিছন থেকে ধরে লোকমান।
"উ হু! কই যান চাচামিয়া? এই ঘর থিকা আপ্নের বাইরন নিষেধ আছে.. হে হে। চিক্কুর পাইরা লাভ নাই। মহল্লায় এহন কেউ নাই। অবশ্য আপনে এহন চিক্কুরও পারবার পারবেন না.."
তারপর কয়েক মিনিট আর কোন কথা হয় না। লোকমানের গায়ে অসুরের মত শক্তি। পিছন থেকে গামছা দিয়া তাঁর গলায় চেপে ধরে লোকমান। মুনীর সাহেব হাতড়ে ফেরেন, চেষ্টা করেন গামছা সড়াতে। পারেন না, পারবার কথা নয়। হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন তিনি। নড়তে পারেন না একচুল। চারদিক আবছা হয়ে যাবার আগে ভেড়ানো দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেন তিনি। একটা ট্রেন। প্লাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ট্রেনে তাঁর যাবার কথা ছিল।
৩
আরো কিছুক্ষণ ওভাবেই গামছা ধরে বসে থাকে লোকমান। খুন জীবনে কম করেনি সে। এই কাজে সে সিদ্ধহস্ত। ছিনতাই, ডাকাতির পাশাপাশি ভাড়াতেও খাটে ও। অনেক আগে একবার সমস্যায় পড়েছিল এরকম এক কেসে। ব্যাটা দম আঁটকে ভান করে পড়েছিল। সেবার বেশ ঝামেলা হয়েছিল। রক্তারক্তি হয়েছিল, দুইপক্ষেই। রক্তারক্তি তার ভাল লাগে না। তাঁর একটা আঙ্গুল কামড়ে নিয়েছিলো ব্যাটা। অন্যহাতে ক্ষুর বের করে গলায় পোঁচ মেরেছিল লোকমান, তাঁর মনে পড়ে। তারপর থেকে সে খুব সাবধানে কাজ করে, একটু বয়স্কদেরই বেছে নেয় ছিনতাই করলে। সবই অভিজ্ঞতা।
মুনীর সাহেবের নাড়ী দেখে লোকমান। নাকের সামনে ছোট আয়নাটা ধরে একবার। না শ্বাস ফেলছে না আর, মরে গেছে। এসব সে শিখেছে তাঁর ওস্তাদ কায়েস আলির কাছে। কায়েস আলি পড়াশুনা করেছিল। কিন্তু করলে কী হবে? শেষমেশ মরতে হলো কিনা তার মত আকাট মূর্খের হাতেই। সাধে কি বলে গুরুমারা বিদ্যা? পুরান কথা ভেবে হাসি আসে লোকমানের।
গামছা সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় লোকমান। আর দরজায় চোখ পড়তেই থমকে যায় একদম। ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে যায় পিঠ দিয়ে। ট্রেন? কখন আসলো? এখনো তো এক ঘন্টা বাকী!
মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করতে হবে। আগেই তাড়াতাড়ি করে দরজায় ছিটকানি তুলে দেয় ও। লাশটা টেনে নিয়ে যায় ঘরের কোনে। একটা বেঞ্চে তুলে শুইয়ে দেয় পাশ ফিরিয়ে। পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে মুনীর সাহেবের মৃত চোখদুটি। চোখদুটো বন্ধ করে, নিজের চাদর দিয়ে ঢেকে দেয় লাশটা। দূরে এসে তাকিয়ে দেখে একবার। মুখে হাসি ফুটে ওঠে ওর। দেখলে মনে হবে কেউ চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। নাহ, বেরিয়ে যেতে হবে। যাত্রীরা এসে পড়বে এখুনি। তাড়াতাড়ি ব্যাগটা তুলে নিয়ে, ছিটকানি খুলে বেরিয়ে আসে সে বাইরে।
৪
ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। লোকমান দ্রুত পা চালায়। হাঁটতে হাঁটতেই দেখতে থাকে ট্রেনটাকে।
আচ্ছা ট্রেনটা কখন আসলো? এত তাড়াতাড়ি? কিন্তু কোন শব্দ পেলো না কেন? লোকমান ভাবতে থাকে। তাহলে কি উত্তেজনায় শব্দ শুনে নি সে? কিন্তু একটা ট্রেন আসবে একটুও শব্দ কি শুনবে না সে? লোকমানের কপালে ঘাম জমে।
ট্রেনটা কেমন অদ্ভুত। জানালাগুলো সব বন্ধ। এখন পর্যন্ত কাউকে নামতে উঠতে দেখেনি সে ট্রেন থেকে। একটু থেমে যায় লোকমান। ট্রেনটার মাথা প্লাটফর্ম ছাঁড়িয়ে কুয়াশায় ঢুকে গেছে। এমনটা হবার কথা নয়। পিছনের দিকে তাকায় ও। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। কী সেটা? লোকমান দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা টু শব্দ নেই। মুনীর সাহেবের লাশ নিয়ে এখন আর চিন্তা করছে না সে। রেস্টরুমটা ফেলে চলে এসেছে অনেকদূর। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে দেয় সে। পকেটে হাত দেয় ম্যাচের জন্য। কিন্তু বের করতে পারে না আর, ওভাবেই থাকে। পেছনের বগির একটা জানালাটা খুলে যায় সশব্দে। একটা মাথা বেরিয়ে আসে, কলের পুতুলের মত। মাথায় বাবরি চুল। এই দূর থেকেও কেমন যেন পরিচিত ঠেকে লোকমানের। সাথে সাথে পাশের জানালাটা খুলে যায়, আবার বেরিয়ে আসে একটা মুখ। সাথেসাথে আরেকটা জানালা, আরেকটা মুখ! সবার মুখে হাসি, সবাই দেখছে তাকে। লোকমানের মুখ থেকে সিগারেট পড়ে যায়। দ্রুত হাঁটতে থাকে ও। জানালা খুলতেই থাকে। একটার পর একটা। এবার খুব কাছে জানালা খোলার শব্দ হয়। লোকমান ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, কেমন যেন চেনা চেনা সব মুখ। এবার একদম সামনে খোলে একটা জানালা। একটু দেখেই মুখটা চিনতে পারে এবার। প্রচণ্ড ভয়ে মুখের রক্ত সরে যায় ওর। চিৎকার করতে গিয়ে আঁ আঁ শব্দ হয় কেবল। একটু আগেই এর কথাই ভাবছিলো ও। তার বাম হাতের কেনো আঙ্গুলটা কামড়ে নিয়েছিল ব্যাটা। পোঁচ দেয়া গলাটা এখনো ওভাবেই ফাঁক করা, শেষ যেরকম দেখেছিলো ও। শান্ত মুখখানিতে কোমল একটা হাসি ছড়িয়ে আছে।
দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে থাকে লোকমান। তার পাশে খুলতে থাকে একটার পর একটা জানালা, সাথে বের হতে থাকে মুখ। লোকমান চেনে এরা কারা। সবাইকে খুন করেছে সে। সবাইকে! মুনীর সাহেবের ব্যাগটা কখন হাত থেকে পড়ে গেছে জানে না। ট্রেনটার একদম মাথায় চলে আসে ও। আর তখনই দেখতে পায় সে শেষ মুখটাকে। মুখটা মুনীর সাহেবের। মুখে শান্ত কোমল হাসি।
পাগলের মত ছুটে লোকমান। লাইন পেরিয়ে ক্ষেতের উপর দিয়ে দৌড়াতে থাকে ও। মাথা কাজ করছে না ওর একটুও। ট্রেনটাকে রেখে পেরিয়ে আসে ও অনেকখানি পথ।
হঠাৎ ট্রেনটা নড়তে শুরু করে। লাইন ছেড়ে নেমে আসে ক্ষেতের উপর, ধীরে ধীরে। চলতে শুরু করে আবার, একটুও শব্দ না করে । ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে লোকমান আর সাথে সাথেই পড়ে যায় হোঁচট খেয়ে। চলতে পারে না আর, হাঁপাতে হাঁপাতে দেখতে থাকে ধেয়ে আসা ট্রেনটাকে।
প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসতে থাকে ওটা। জানালার মুখগুলো বের হয়ে আছে সেভাবেই, মাথা বের করে সবাই দেখছে তাকে। আধখানা চাঁদের আলোয় মাঝেমাঝে ঝলকে উঠে তাদের সারিসারি হাসিমুখ। বোবাচোখে লোকমান বসে দেখে শুধু , আর অসহায়ের মত অপেক্ষা করে।
মন্তব্য
ডায়ালগগুলো চমৎকার ও একদম বাস্তব। কিন্তু গল্পে ভৌতিক আবহ তৈরিতে আরেকটু লিখলে ভাল হত।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ধন্যবাদ আপনাকে। অনেকদিন পর লিখলাম ভাই, আরো ঘষামাজা করা দরকার আসলে।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ঠান্ডা মাথার খুনীর মাথা গরম কাহিনী।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
খুন করার সাথে সাথে লাশ শক্ত হয় নাকি?
হাহা এই ব্যাপারে ভুদাই ছিলাম। ঘ্যাচাং করতাসি!
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ভূতায়ন ভাল্লাগসে।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
ধন্যবাদ
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
গল্প খুবই ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ভাল লাগল দোস্ত, চালায়ে যা। নাহলে লোকে কদিন পর তোকে সচল ভূত বলবে!
এই গল্প আগে বলছিলি নাকি, মাঝে মাঝে একটা পরিচিত গন্ধ পেলাম।
facebook
হাহা বলছিলাম নাকি? পরশু রাতে বানাইলাম গল্পটা। তুই এখন কই আছিস বাঁদর?
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
গল্পটি ভাল লাগল । তবে আমারও মনে হয় লাশ শক্ত হয়ে যাবার ব্যাপারটা না থাকলেই ভাল হত ।
আর শেষ লাইনটা চমৎকার । চালিয়ে যান ।
হ্যাঁ, বাদ দিয়ে দিছি লাইনটা। ধন্যবাদ আপনাকে
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ইয়ে, চারটে চন্দ্রবিন্দুজনিত টাইপো আছে। [ভূতের গল্প বলে কথা ]
ছুড়ে > ছুঁড়ে।
ফুঁটে > ফুটে।
ধেঁয়ে > ধেয়ে।
বেঁছে > বেছে।
আর মৃত্যুর পর রিগোরাস মর্টিস বলে যে ব্যাপারটা হয় মানে শরীরের মাংসপেশী শক্ত হতে শুরু করে, সেটা যতদূর জানি পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা সময় নেয়।
গল্পে ।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
রিগোরাস মর্টিস এর ব্যাপারটা ভাল করে জানতাম না আগে। বাদ দিলাম
বানানগুলোও ঠিক করে দিলাম। অনেক ধন্যবাদ!
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
শব্দটা রিগর মর্টিস
হ দেখলাম, তিন চার ঘণ্টা লাগে শক্ত হইতে, বারো ঘন্টায় একদম শক্ত
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
চমৎকার। যদিও শেষটা বেশ আগেই আন্দাজ করা গেছিল।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
এই ভুত কোত্থেকে ফিরে আসলো! যাকগে, একদিনে সচলের পাতায় দুই দুইটা ভৌতিক গল্প!!
গল্পটা মাঝপথ থেকে কিছুটা অনুমান করা যাচ্ছিলো। ভৌতিক গল্পে এমনটা হলে মজা নষ্ট হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অনেকদিন পর লেখলাম তো। একটু ক্ষমা সুন্দর মুন্দর.. দৃষ্টি মিষ্টি ..
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
কতদিন পর লিখলেন । খুব ভালো লেগেছে গল্পটা... প্লট এবং সংযোগ সব মিলিয়ে চমৎকার...
ডাকঘর | ছবিঘর
হ্যাঁ অনেকদিন পর লিখলাম, ধন্যবাদ আপনাকে
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
আহা আহা! সুরঞ্জনা কালকে সকালে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলো, যে সচলায়তনের পাতায় এত ভালো ভালো লেখা চা নিয়ে বসা দরকার, তা আমি গত দুইদিন ধরে চা নিয়েই বসে আছি, সেটা শুধু গলাব্যথার জন্যেই না! যাক! কাইদান লেখক ব্যাক করেছে দেখেও শান্তি! যদিও এ গল্পটা আমাকে বদরুলের গল্পের মত চমকে দেয়নি! শেষটা আন্দাজ করাই যাচ্ছিলো, কিন্তু তাতে কিই বা এমন, শীতের সন্ধ্যায় ছুটির আমেজটা থাকলেই হলো!
কিন্তু ট্যাগিং ঠিক্করে কর খেকুদা! এমন হালকা ট্যাগিং-এ ছৈলত ন! জানো তো এখন আবার 'মাঝি' সব পুরাতন হিসেব আনা-নেয়া করে! আরও কিছু ভৌতিক-আধাভৌতিক-অলৌকিক লেখা এই হাতে পাতে পড়বে সেই আশায় আরেক কাপ চা আনতে গ্লাম!
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ট্যাগিং কিন্তু মাঝেমাঝে কাহিনী স্পয়েল করে। আমি চাইছি সবাই সাদামাটাভাবে একটা গল্প পইড়া যাক।
হ, অনেকদিন পর লিখতে পাইরা বেশ ফুরফুরা লাগতাসে। আর যাই হোক কুফা তো কাটছে? আমি তাতেই খুশি
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
অনেক দিন পর ভূতের গল্প পড়লাম!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ভুতোদা, গল্পটা দারুণ হয়েছে। একটা বিদেশি গপ্পের আমেজ আছে গল্পটায়।...
আপনি কিন্তু অনেকদিন লেখেন না। নতুন ভূতের গল্প কই কই কই ??
ধন্যবাদ হে!
ক্যান এই ভূতের গল্পটা দোষ করলো কী?
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ভাল লেগেছ।
নিয়মিত লিখুন না!
ধন্যবাদ, লিখবো
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ভালো লাগলো হে কমরেড! ভালো লাগলো!
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
ধন্যবাদ ধন্যবাদ
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
খেকুদা, আরেট্টা বলো!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
খ্রাউ,আরেট্টা চিন্তা করতাসি
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
এই লেখায় পাঁচ তারা না দাগিয়ে উপায় আছে?!
অসাধারণ সুন্দর গল্প।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
অনেক ধন্যবাদ
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
আরে! হেভি গল্প তো। আমি তো এই রাতের বেলা পড়ে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
জটিল লাগলো ভূতের গপ্প । আপনার বর্ণনার স্টাইল চমতকার।
রাতের বেলা পড়ে আমিও ভয় পেয়েছি। দারুন।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
নতুন মন্তব্য করুন