কোন এক গ্রামে এক বুড়ি আর তার মাইয়া থাকতো। বুড়ির চাল-চুলাই সম্বল। বুড়া মারা গেছিল সে অনেকদিন আগে। রাইখা গেছিল একটা ছাগল। গ্রামের এক কোনায় বুড়ির বাসা। বাসার থিকা একটু হাঁটলেই বন। বুড়ির মাইয়া ঐ বনে ছাগল চড়াইতো, পথের ধারের শাক-লতা-পাতা, গাছের ফল কুড়াইতো, লাকড়ি টুকাইতো। সেই শাক লতাপাতা খাইয়া আর বাড়ি বাড়ি লাকড়ির যোগান দিয়া কোনমতে তাগো দিন কাটতো। বুড়ির মাইয়ার নাম আছিলো দুলি।
একদিন বুড়ির মাইয়া ছাগল চড়াইতে গেল বনে। সারাদিন বনে টো টো কইরা ঘুরলো, শাকপাতা-ফলমূল কুড়াইলো, পূজার ফুল তুললো, গাছে উইঠা শালিকের বাসার থিকা বাচ্চা নিয়া খেইলাধুইলা আবার রাইখা দিলো। এমন করতে করতে যখন দিনের আলো ঢইলা পড়লো, তখন মাইয়া ছাগলের খুটা উঠাইয়া রওনা দিলো বাড়িতে। বুড়া বটগাছটার পাশ দিয়া যাইতাছে, আর তখনই, কে জানি হিসহিসাইয়া কইয়া উঠলো,
"কি রে ছাগল-রাখুনী বাইল্লাচুলী, আমার লগে বিয়া বইবি?"
শুইনাই মাইয়া বিষম ভয় পাইয়া পড়ি কি মড়ি দৌড় আর এক দৌড়ে বাড়ি! মাইয়ারে এমনে আইতে দেইখা বুড়িও ছুইটা আইলো,
"কিরে মা? কি হইসে? এমন করতাসস ক্যা? ভয় পাইসস?"
মাইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে কইলো ঘটনা। শুইনা তো বুড়ি হাসে, কয়,
"অঅ-মা! এই নি কান্ড! ধুরু, কেউ মজা করসে!"
কিন্তু মাইয়ার মন মানে না, ক্যান জানি ডর লাগে, কেমন জানি গলা ওই ব্যাটার!
পরের দিন দুলি আবারো বনে ছাগল চড়াইতে যায়। সারাদিন ঘুইরা যখন বাড়ি যাইবো, বটতলার নীচে দিয়া দুই কদম না যাইতেই আবারো সেই কথা,
"কি রে ছাগল-রাখুনী বাইল্লাচুলী, আমার লগে বিয়া বইবি?"
দৌড় দিয়া চইলা আসে মাইয়া। মারে আবারো কয়। বুড়ি শুইনা হাসে, কয় -
"কালকে গেলে একটা কাজ করবি। আবারো যদি জিগায় তাইলে কইবি ভাল বর পাইলে বিয়া করুম না ক্যান।"
"এহ আমি এইটা কমু ক্যান? আমারে বাইল্লাচুলী কয়!"
"হ কইবো না! চুলে ত্যাল পড়ে না, বাইল্লার বাসার মত চুল, বাইল্লাচুলী কইবো না তো কি কইবো? তোর মত আভাগীর বেটিরে যে বিয়া করতে চায় এইটাই তো বেশি!"
দুলি থম ধরে। মার দিকে রাগ কইরা তাকায়।
পরদিন আবারো বনে যায়। আজকে আর ফুল তুলে না, ফলমূল কুড়ায় না। খালি বটগাছের দিকে টানে মাইয়ারে। পা টিপ্পা টিপ্পা যায় দুলি। কত বড় বটগাছ! মাথা সমান উঁচুতে একটা বড় খোড়ল। কাছে আইতেই খোড়লটার থিকা হিসহিস কইরা কইয়া উঠে কে যেন,
"কি রে ছাগল-রাখুনী বাইল্লাচুলী, আমার লগে বিয়া বইবি?"
বুক ধড়ফড় করে মাইয়ার, ভয়ে ভয়ে কয়,
"ভাল বর পাইলে বিয়া বমু না ক্যান?"
কোন আওয়াজ আসে না। দুলি জিগায়, "আপনে আমারে বিয়া করতে চান ক্যান?"
"তোরে আমার ভাল লাগে, .. বিয়া বইবি তাইলে?" কথা কয় গাছের খোড়ল।
"কেমনে বমু? আমাগো চাল নাই চুলা নাই, বিয়ার আয়োজন কেমনে করুম?"
"ও এই কথা? শুন তাইলে.. এইখান থিকা একশো কদম উত্তরে হাইটা গেলে একটা বড় মান্দার গাছ পাবি। ঐটার নীচে তিন হাত খুড়বি। খুড়লেই দেখবি সোনার মোহর ভর্তি একটা কলস। ওই দিয়াই সবকিছু হইবো। কিন্তু খবরদার! .. বিয়া করতে চাইলেই শুধু কলস নিবি। যদি বুঝি ফাঁকি দিসস, তুইও শেষ, তোর মায়েও শেষ!"
হা কইরা শুনতাছিল সব দুলি, একটু পর তাব্ধা ভাইঙ্গা কয়, "আপনে কে? আপনে সামনে আসেন না ক্যান? .. আপনেরে না দেইখা বিয়া বমু ক্যান?"
"এহ! বাইল্লাচুলীর শখ কত! বিয়ার দিনই দেখতে পাবি আমারে, তার আগে না। রাজী থাকলে ক, তোর মায়রে জানা। "
বাড়িতে চইলা আসে বুড়ির মাইয়া। কইবো না কইবো না কইরা একসময় কয় মায়রে সবকিছু। মোহরের কথায় বুড়ির চোখ চকচক কইরা উঠে। বিশ্বাস করতে চায় না। তবুও পরদিন যখন মাইয়া বনের পথ ধরে, বুড়ি ছাগলের দড়ি থিকা খুটা ছুটাইতে ছুটাইতে কয়, "চল তোরে মা.. দেখি ব্যাপারটা।"
মা'য়ে ঝি'য়ে বনের পথ ধইরা ভিতরে ঢুকে। মাইয়া দূর থিকা দেখায় মা'রে বটগাছটা। কাছে আইতেই হিসহিস কইরা উঠে বটগাছের খোড়ল, কয়,
"বুড়ি আইছস? তোর মাইয়ার লগে আমারে দিয়া দিবি? অনেক সোনা পাইবি। দিবি?"
"বর না দেইখা মাইয়া দিমু ক্যান?"
"এহ! তোর মাইয়ারে বিয়া করতে তো রাজপুত্তুর আইবো পঙ্খীরাজে কইরা! বিয়া দিবি নাকি ক, দেখাদেখি সব পরে হইবো।"
বুড়ির কেমন ভয় লাগে, গলার স্বর শুইনা কেমন ঘোর ঘোর লাগে। কিন্তু লোভ ছাড়ে না বুড়িরে,
"কি করতে হইবো কও", আস্তে আস্তে কয় বুড়ি।
"সোনার কলস তুলবি যেমন কইসি ঐ মান্দার গাছের তল থিকা। তিন মাসের মধ্যে মধ্যে ওই সোনা দিয়া বাড়িঘর ঠিক করবি, আয়োজন করবি বিয়ার। বিয়ার পর কয়দিন আমি তোগো বাড়িতেই থাকুম। আর শুন, বিয়ার দিন কিন্তু আমি, তোর মাইয়া, তুই আর পুরুতঠাকুর ছাড়া কেউ থাকবো না। খবরদার, উল্টাপাল্টা যাতে না হয়। ..আর একটা কথা, উঠানের মাঝখানে একটা আইক্কাওয়ালা বাঁশ গাইড়া রাখিস। সন্ধ্যা হইলেই আমি আইসা পড়ুম।"
বুড়ি দুলির হাত ধইরা চইলা আসে। ঠান্ডা মুখে সোজা হাঁটতে থাকে উত্তরমুখী। মাইয়া খালি মার মুখের দিকে চায়। আর একশো কদম যাওয়ার পর ঠিক-ঠিকই দেখে একটা ইয়া মোটা কাঁটাওয়ালা মান্দার গাছ। গা ছমছম করে দুলির। বুড়ি কোন কথা না কইয়া মান্দার গাছের তলায় আসে আর বইসা ছাগলের খুটা দিয়া খুড়তে শুরু করে। খুড়তে খুড়তেই কইতে থাকে, "চিন্তা করিস না মা, সব ঠিক হইয়া যাইবো। এইটা ভগবানের আশীর্বাদ, নাইলে তোর বিয়া দিয়া যাইতে পারুম কোনদিন ভাবতে পারছি? ..চিন্তা করিস না।"
হঠাৎ কীসে জানি বাইঝা ঠং কইরা উঠে বুড়ির হাতের খুটায়। তড়িঘড়ি কইরা বুড়ি মাটি সরায় আর সত্য সত্যই একটা কলসের মত বাইরাইয়া আসে। কলসের ঢাকনা সড়ায় বুড়ি। চক্ষু ছানাবড়া হইয়া যায় তার। প্রথমে কিছুক্ষণ আক্কেল গুড়ুম হইয়া বইসা থাকে মায়ে ঝিয়ে, মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। এত সোনা জীবনেও দেখি নাই দুইজনের কেউ। আনন্দে চিল্লানি শুরু করে বুড়ি, দুলিরে ধইরা চুমা খায়, ভগবানরে ডাকে! কয়, "বড় ঘরে বিয়া হইতাসে রে তোর দুলি! কপাল খুইলা গেল রে তোর! নিশ্চয়ই এইটা কোন জমিদারের পোলা।" সোনার কলস ধরাধরি কইরা বাড়ি নিয়া আসে মায়ে ঝিয়ে।
পরদিন থিকা বুড়ির বাড়িতে হৈ হৈ কান্ড! কেউ ইট টানে, কেউ সুড়কি আনে, কেউ আনে বালি। নতুন বাড়ি বানানের কাজে লাইগা যায় কত লোক। সকাল সকাল গিয়া বুড়ি যোগাড় কইরা নিয়া আসে সবাইরে। বুড়ির পুরান ছনের ঘর ভাইঙ্গা চুইরা সেখানে নতুন বাড়ি উঠতে থাকে। পাড়া প্রতিবেশীরা চারদিক থিকা তামশা দেখার জন্য ছুইটা আসে আর হা কইরা দেখে। বুড়ির অবস্থা দেইখা সবার চক্ষু টাটায়। সুবল নামে বুড়ির জামাইয়ের এক দুঃসম্পর্কের ভাই থাকতো গ্রামের ভিতরে। কোনদিন বুড়ির খবরও নিয়া দেখে নাই, সে আইসা বুড়ির লগে খাতির জমানোর চেষ্টা করতে থাকে, জিগায় - 'কেম্নে কীরে বুড়ি!' বুড়ি একগাল হাইসা গল্প বানাইয়া খাওয়াইয়াও দেয় সুবলরে, কয় - বনের ধারে এক জমিদারের পোলা, সে দুলিরে দেইখা পছন্দ করছে, এক কলস সোনার মোহর দিয়া কইসে সব যোগাড়যন্ত করতে, এক সপ্তাহ পরেই বিয়া। বুড়ির কথার আগামাথা কিছুই বুঝে না সুবলে। শুধু বুড়ির বাড়ি বানানি দেইখা তার গা জ্বালাপোড়া করতে থাকে।
এমনে কইরা বুড়ি তিন মাসের মধ্যেই তার পুরান বাড়ি ভাইঙ্গা সেখানে সুন্দর একটা দালান-বাড়ি বানায়া ফেললো, চাইরদিকে সুন্দর পাঁচিল তুললো। বাড়ির পিছনে দুলি সুন্দর ফুলের বাগান বানাইলো। দুলির লেইগা দুজন দাসী-বান্দী রাখলো বুড়ি। তারা প্রতিদিন দুলিরে স্নান করাইয়া সুন্দর কইরা সাজাইয়া গুছায়া দেয়, ত্যাল দিয়া চুল বাইন্ধা দেয়। কে কইবো এই মাইয়াই আছিলো ছাগল-রাখুনী বাইল্লাচুলী? দুলিরে আর চিনাই যায় না, দেখতে একদম পরীগো মত লাগে। এতদিনের অভাবের পরে সবকিছু দুলির কাছে স্বপ্নের মত লাগে, তার মুখেও হাসি ফুটে। বুড়ি বিছানায় বইসা মাইয়ারে দেখে আর চক্ষু জুড়ায়। একসময় বুড়ির মনে পড়ে তার অনেক কাজ, কালকেই তিনমাস শেষ হইবো। পুরুত ঠাকুরের খোঁজে বাইর হয় বুড়ি ।
পরদিন সকাল থিকা বুড়ি আয়োজন করে, দূরের এক গ্রাম থিকা পুরুতরে নিয়া আসে বাড়িতে, কিন্তু কাউরে জানায় না, নিমন্তন্ন করে না। সকাল থিকা দাসী বান্দীগো খেদাইয়া দেয় বুড়ি। দুলিরে নিজে সাজাইয়া গুছাইয়া তৈরী করে, পুরুতঠাকুর উঠানে বিয়ার আয়োজন করে। বুড়ি উঠানে বাঁশ গাড়ার কথা ভুলে না। কিন্তু দুলির মন খারাপ। বুড়ি দুলিরে মানায়, ভুলাইয়া পিঁড়িতে নিয়া বসায়।
সন্ধ্যা হয় হয়, লগ্নের সময় যায়গা, পুরুতে তাড়া দেয়, কয় "কই গো, বর কই!" । বুড়ি উছপিছ করে। একটু পরেই, বাড়ির পিছে গাছ-লতা-পাতার মধ্যে কীসের যেন খুস-খাস শব্দ পাওয়া যায়। সর-সর শব্দে কি জানি এই মুখেই আইতে থাকে। ভয় পাইয়া আঁতকাইয়া উঠে দুলি। বুড়ি কি হইসে দেখার লেইগা পিদিম উঁচা করতেই হিসহিস কইরা খুব কাছ থিকা কেউ একটা ধমক দেয়,
"আলো সরা বুড়ি!"
- আর সাথেই সাথেই জিনিসটা কিলবিল কইরা আইসা বুড়ির হাতে ধাক্কা দেয়, পিদিম পইড়া নিভভা যায় বুড়ির হাত থিকা। সন্ধ্যা তখনো পুরাপুরি হয় নাই। সবাই দেখে তখন জামাই বাবাজিরে। বিরাট অজগর একটা! কিলবিল কইরা পাকাইতে পাকাইতে উঠতে থাকে উঠানে পোতা বাঁশটা বাইয়া। বুড়ি জামাই দেইখাই চোখ উল্টাইয়া ভিরমি খায়। দুলির চোখ ঠিকরাইয়া বাইরাইয়া আসতে চায়, তাব্ধা খাইয়া বইসা থাকে। পুরুতে আঁ আঁ করতাছিল, সাপে আবার দেয় ধমক,
"মন্ত্র পড় ঠাকুর, নাইলে তোরে খাইসি!"
ঠাকুরে মন্ত্র পড়ে তড়িঘড়ি কইরা। বর-বউয়ের মাথায় আশীর্বাদ কইরা নমঃ নমঃ কইরা কোনমতে বিয়া সাইড়া-ই উইঠা দেয় দৌড়! সাপে দুলিরে দেখে কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে ঘরের দিকে যায়। দুলি পিঁড়িতে বইসাই থাকে এক ঠায়। বুড়ি তখনো অজ্ঞান। অই রাতটা মায়ে ঝিয়ে বাইরেই কাটায়।
সকাল হইলে বুড়ির চেতনা হয়। দুলি ঘুমায় নাই সারা রাত। বুড়ি উইঠাই কয়,
"মা'রে, সাপটা কো! গেছে? গেছে? এইটা আমি কি করলাম! হায় হায় হায়! সোনার লোভে মাইয়ার এতো বড় সর্বনাশ করলাম! হায় হায় হায়! এইটা তো একটা কথাকওইন্না সাপ! নিশ্চয়ই কোন অপদেবতা! এইটা আমি কী করলাম!.."
ভয়ে ভয়ে মায়-ঝিয়ে ঘরের দিকে যায়। বুড়ি একটা লাঠি কুড়াইয়া হাত লয়, তখন ঘরের থিকা অজগরে কয়, "বুড়ি কালকে কিন্তু তোর মাইয়ার লগে আমার বিয়া হইছে, সাবধান কইয়া দিলাম! আমারে কথা দিসস, কথার বরখেলাপ করলে তোরেও খামু তোর মাইয়ারেও খামু।"
সাপের মুখে কথা শুইনা আবারো তাব্ধা খায় মায়ে-ঝিয়ে। এইটা তো যাদু! কিছুই বুঝতে পারে না কেউ। সাপে আবারো কয়, "ক্ষুধা লাগসে, আমি খাইতে গেলাম, রাত্রে আমু আবার" - কইয়া সরসর শব্দ কইরা বাইরাইয়া যায়গা।
এই কইরাই দিন যায়। বুড়ি সারাদিন হা-হুতাশ করে। দুলি চুপচাপ ঘরেই বইসা থাকে। বুড়ি কাইন্দা হাঁপাইয়া গেলে কিছু রান্ধে, নিজের আর মাইয়ার মুখে কিছু গোঁজার চেষ্টা করে। রাত্র হইলেই দুইজনের ভয় বাড়তে থাকে। দুলি বিছানায় পইড়া থাকে মরার মত, কিন্তু শব্দ পায়। সরসর শব্দ কইরা ঘরে ঢুকে অজগরে। দুলিরে ডাকে হিসহিস কইরা, 'বউ ঘুমাইলি, অ বউ, বউ!' দুলি সাড়া দেয় না। একসময় মাটিতেই শুইয়া থাকে সাপটা। দুলি একবার তাকাইয়াও দেখে না।
কিন্তু দুলির বিয়ার খবর চাপা থাকে না। কেমনে কেমনে জানি গ্রামের সবাই জাইনা যায়। বুড়ির বাড়ির আশে পাশে উঁকি ঝুঁকি মারে সবাই। বুড়ি সেইদিনের পর থিকা সবাইরে লুকাইয়া চলে। সবাই কয়, 'কী বুড়ি মাইয়া বিয়া দিসস বলে? কাউরে কইলিও না..' বুড়ি কয়, 'অমা, বিয়া দিমু আর তোরা জানবি না?' মাঝেমাঝে ভাবে সব কইয়া দেয়। তারপর লোকজন আইনা পিটায়া মারে সাপটারে। কিন্তু সাহসে কলায় না। যদি দেও হয়? দেওএর লগে মাইনষে পারে?
কিন্তু মানুষের সন্দেহ যায় না, বুড়ির বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে। বুড়ির বাড়িতে ঢুইকা দেখতে চায়। কিন্তু বুড়ি একবার ঘরে ঢুকলে আর সাড়া দেয় না। সদর দরজায় খিল দিয়া বইসা থাকে। পাঁচিল আরো উঁচা করে বুড়ি।
সেইদিনের পর থিকা তেমন কোন কথা কয় না দুলি। মায় খাওন দিলে খায়, না দিলে অমনেই থাকে। মাইয়ার অবস্থা চোখে দেখন যায় না। কিন্তু আস্তে আস্তে সবকিছু মাইনা নেয় দুলিও। সাপে সকালে বাইর হইয়া যায় ,আসে একদম রাত্রে। আগে সাপেরে পাশে নিয়া ঘুমাইতে পারতো না, এখন ইচ্ছা কইরাই আগে ঘুমাইয়া যায় দুলি। সাপেও ডাইকা ডুইকা নিজে ঘুম দেয় একসময়।
একদিন রাত্রে ব্যাপারটা ঘটে।
সেইরাত্রে সাপে আইসা প্রতিদিনকার মত দুলিরে ডাইকা ডুইকা ঘুম দিসে। দুলি ঘুমাইতাছিলো বেহুশ হইয়া। কোনদিন না, কিন্তু ওইদিনই ক্যান জানি ভোর হওনের আগে দিয়া দুলির ঘুম ভাইঙ্গা যায়। আর উইঠাই চোখ কপালে! দেখে মাটিতে এক দেবতার মত সুন্দর সুপুরুষ শুইয়া ঘুমাইতাসে। তার পায়ের কাছে সাপের খোলস পইড়া রইসে। দুলি অবাক হয়। কাথার ভিতর থিকা চুপচাপ দেখে, কিছু কয় না। তারপর কি জানি হইলো, হঠাৎ সেই খোলসটা নিজ থিকা মানুষটার গায়ে প্যাচাইতে শুরু করলো! দেখলে মনে হইবো যেন গিল্লা খাইতাসে মানুষটারে! এইভাবে প্যাচাইতে প্যাচাইতে একসময় সেই মানুষটা কিলবিল করা শুরু করলো আর একটা বিরাট অজগর হইয়া ঘর থিকা আস্তে আস্তে বাইর হইয়া গেল!
দুলি সকালে উইঠা কিছুই কইলো না মা'রে। সেইদিন সকালে উইঠা অনেকদিন পর আয়নার সামনে বইলো দুলি। সুন্দর কইরা সাজলো। অনেকদিন পর মাইয়ারে সাজতে দেইখা খুশি হইলো বুড়ি। দুলি মার লগে হাত লাগাইয়া কাম করলো, ঘর ঝাড়ু দিলো। অনেকদিন পর বাইর হইয়া বনে গেল। ফলমূল কুড়াইয়া নিয়া আসলো সন্ধ্যা কইরা। আর বাড়িতে আইসা রাত্রি হওনের অপেক্ষা করতে লাগলো।
সেইরাতে সাপে আইসা দুলিরে প্রতিদিনের মত ডাকলো, দুলি সাড়া দিলো না। একটু পর সাপে যখন ঘুমাইতে গেল দুলি কাথার তল থিকা সব দেখতে লাগলো। দেখে কি, যেমনে কইরা সাপের খোলস মানুষটারে প্যাচাইয়া ধরছিল ঠিক অমনেই আস্তে আস্তে খোলস খুইলা পড়তে লাগলো। আস্তে আস্তে মানুষটার সুন্দর মুখটা বাইর হইয়া আসলো, বাইর হইয়া আসলো হাত পা। খোলসটা পইড়া রইলো পায়ের ধারে।
দুলি হা কইরা দেখতাছিল সব। একসময় উইঠা নীচে নামে দুলি, মানুষটার পাশে শুইয়া অবাক হইয়া দেখতে থাকে তারে। এত সুন্দর মুখ আগে দেখে নাই দুলি। মানুষটা চোখ বন্ধ কইরা ঘুমায়। একটা হাত রাখে দুলি আস্তে আস্তে তার গায়ে, মানুষটা জড়াইয়া ধরে দুলিরে, কয় "আইলি বউ?"
দুলি কয়, "আপনে আমারে আগে কন নাই ক্যান?"
"অভিশাপরে বউ অভিশাপ! নিজের থিকা না দেখলে কইতে মানা আছিলো।"
"কেমনে হইসে এসব? সব খুইলা কন আমারে"
"শুন তাইলে..
আজ থিকা বারো বৎসর আগের ঘটনা। এই রাজ্যের রাজার পোলা আছিলাম আমি। একদিন শিকারে গেলাম বন্ধু বান্ধব নিয়া। শিকার টিকার কইরা ফিরা আসতেছি, হঠাৎ দেখি এক বিরাট এক অজগর এক গাছের ডালে কুন্ডলী পাকাইয়া রইসে। দেইখা আমার মনে কি হইলো, ভাবলাম সাপটারে মারুম। সবাই মানা করলো, বন্ধুরা কইলো সাপ মারবি ক্যান? সাপতো আমাগো কিছু করে নাই। কিন্তু আমি রাজার পোলা, যা ভাবি তাই করি, তলোয়ার বাইর কইরা দিলাম এক কোপ। আর সাথে সাথে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো! সাপটার খোলস খুইলা আমার গায়ে আইসা প্যাচাইতে লাগলো। সবাই উইঠা মুইঠা দিলো দৌড়। ওই অবস্থাতেই আমি দেখতে পাইলাম সাপের খোলস থিকা একটা মানুষ বাইর হইয়া আসতাছে। আমি যেখানে কোপ দিছিলাম সেখান থিকা রক্ত বাইরাইতাছিল, লোকটা মারা যাইতাছিল। কিন্তু মারা যাবার আগে লোকটা আমারে কিছু কথা কইয়া গেছিল, সে কথাও তোরে কইতে মানা। বুঝলাম, লোকটাও শাপ পাইছিলো কারো থিকা আর তার শাপই আমার গায়ে লাগছে। তারপর থিকা আমার অজগর জীবন শুরু। আমার এই অবস্থা দেইখা সবাই ভয়ে পালাইছিলো। আমিও আর ফিরা যাই কেমনে, সাপ হইয়া বনেই রইয়া গেলাম।"
দুলি সব শুনতাছিল তার অজগর বরের বুকে মুখ গুইজা। সেইরাতে দুইজনে অনেক গল্প করলো। আর গল্প করতে করতেই ঘুমায়া পড়লো। কিন্তু দুলি ঘুমাইলো না। ঠিক যখন সকাল হইবো তার আগ দিয়া সে সাপের খোলস নিয়া দিল এক দৌড়! এক দৌড়ে বাইরে আইসা আগুন জ্বালাইয়া দিলো সাপের খোলস তাতে ফালাইয়া! ভকভকাইয়া গন্ধ বাইর হইলো সেইখান থিকা।
হঠাৎ রাজপুত্রের ঘুম ছুইটা গেল, "করলি কি! করলি কি!" কইয়া দৌড়াইয়া বাইরে আসলো সে! কিন্তু ততক্ষণে খোলস পুইড়া ছাই।
"আপনেরে আর সাপ হইয়া থাকতে হইবো না। দিসি পুড়াইয়া আপনের খোলস!" দুলি কয়। রাজপুত্র তখনো তাকাইয়া আছে তার পোঁড়া খোলসের দিকে।
"এই কথাই কইছিল সেই লোকটা.. এই অভিশাপ কাটানের নাকি এই উপায়। অভিশপ্ত লোকের ঘুমের মধ্যে খোলস নিয়া পুড়ায়া ফালাইতে হয়। কিন্তু তা কইয়া দিলে কাজ করবো না। .. তুই আমারে বাঁচাইলিরে বউ।"
গন্ধ পাইয়া বুড়ি ছুইটা আসছিলো। আইসাই তো এরকম একটা আধানাঙ্গা মানুষরে দেইখা তার চক্ষু চড়কগাছ। দুলি হাইসা সব খুইলা কইলো মারে। সব শুইনা বুড়ির মুখে হাসি ফুটলো। আস্তে আস্তে গ্রামের সবাই জানতে পারলো এই অদ্ভুত কাহিনী। রাজপুত্র লোক দিয়া রাজধানীতে বার্তা পাঠাইলো।
কয়দিন পরেই রাজা হাজার হাজার লোক লস্কর সৈন্য সামন্ত নিয়া ছুইটা আসলো এই গ্রামে। পোলারে পাইয়া জড়ায়া ধইরা কানলো হাউ হাউ কইরা। তারপর সব শুইনা রাজা তার পোলা, পোলার বউ আর বেয়াইনরে নিয়া রাজধানীর দিকে রওনা দিল। যাওয়ার আগে গ্রামের সবাইরে নিমন্তন্ন করতে ভুললো না, রাজধানীতে গিয়া নাকি পোলার বিয়া আবারো ধুমধাম কইরা দিবো।
মন্তব্য
আজকে দেখি উপকথার বান ডাকছে। প্রথমে সত্যপীরের বাঘ আর ছাগলের গল্প পড়লাম তারপর আপনার এইটা। অনেকদিন পর লিখলেন। লাইনে আসুন, নিয়মিত হন।
অনলাইনে থাকুন, অনলাইনের পেম পোক্ত হয়
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
দারুণ
বাপরে
..................................................................
#Banshibir.
ধন্যবাদ ভাই
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
গল্পের যে প্রাচীন ভঙ্গি, একজন বলতো আর সবাই গোল হয়ে শুনতো। পড়তে পড়তে সেই প্রাচীন ভঙ্গির স্বাদটাই যেন পেলাম। যেন পড়ছি না, গোল হয়ে বসে থাকা দর্শকদের একজন হয়ে গল্প শুনছি!
ভালো!
ধন্যবাদ পান্থ
মা যেভাবে গল্প বলে সে আমেজটাই ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। ছোটবেলায় মা গল্প বলতো আর আমরা সব গোল হয়ে ঘিরে শুনতাম। মা অবশ্য এখনো বলে। এই গল্পটা অনেক আগের শোনা, কদিন আগে মাকে আবার জিজ্ঞেস করে ঝালিয়ে নিলাম
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
এমন মেঘ-মেদুর সকালে উপকথা পড়তে কী ভালই যে লাগল !
আচ্ছা, গ্রামের পাঁচিল দেয়া সুন্দর বাড়িটা কি সুবল পেল ?
সুবলে পাইলো নাকি জানি নাতো, মারে জিগামু নে
ধন্যবাদ পণ্ডিত মশাই
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ঠিক আছে আপনাকেও ধন্যবাদ সুন্দর গল্প বলার জন্য
হুট করে সচলে এসে ভালই হল, মজার একটা গল্প পড়া গেল! আহা এই পোড়ার দেশে কেন যে কোন বট গাছ নাই : গল্পটা খুব ভাল লেগেছে
অনেক ধন্যবাদ আয়নামতি, আপনার নিকটা দারুণ!
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
হ, ভালা লাগসে। আগেও হুনসি, তবে আফনের বলনের স্টাইল আসে।
কিন্তু বুকা মাইয়াডা - ছাল পুড়াইয়া বরেরে শাপমুক্ত কইরা ফালাইল!
পড়ত ত্যামন জম্পেশ কইন্ন্যার হাতে - আ:! অই ছাল-এ আংটা পড়াইয়া যখন যেমন দরকার, ছালে পুরত আবার ছাল থিক্যা বাইর কইরা আনত। দুনিয়া ভরা অজগর পুরুষগুলাইনরে এই যে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরায় সব হাঁটুর বইসী দিলের টুকরারা সে কি এমনি এমনি? হেঁ হেঁ বাবা, বডি তোমার, ছাল আমার!
পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম
- একলহমা
ধন্যবাদ
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
বাহ, গল্পটা জানা ছিল। কিন্তু এত সরস ছিল বলে মনে পড়ে না
হাহা আইক্কাওয়ালা বাঁশের কথায় দেখি গড়াগড়ি খাইতাছেন
ধন্যবাদ ভাই
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
খুব ভালোলাগলো! ছোটবেলায়, গ্রামে এ ধরনের অনেক গল্প শুনতাম। লিখে রাখলে ভালো হতো। আপনি সংগ্রহ চালিয়ে জান।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ধন্যবাদ স্পর্শ , আরেকটা গল্প আছে স্টকে, কদিন পরে ছাড়বো
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ছোটবেলার এক নানার কথা মনে করিয়ে দিলেন, ওহ! গল্পের বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন আর গল্প বলার ভঙ্গীটা আপনার মতই ছিল!
ধন্যবাদ স্যাম ভাই
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
আরো কটা উপকথা দেন - একটা দিয়েই আবর চুপ করে যেয়েন না। আপনার এই গল্পটা আজকে রাতে আমার ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর সময় বলবো বলে ভাবছি। ওর কোন কমেন্ট থাকলে জানিয়ে যাব। তবে গল্প বলার ভঙ্গি আপানার মত এত সুন্দর হবে না দ্যাটস ফর শিওর।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
চালাইতে থাক বন্ধু, ভালো লাগছে
facebook
ধন্যবাদ কাক্কু
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
গল্পটা রাইখা দিছিলাম।দুপুরে ভাত খায়া ধীরে সুস্থে পড়লাম। গল্প সিরাম লাগছে।
শাপ ট্রান্সফার হওয়ার আইডিয়াটা নতুন আমার কাছে,ভাল্লাগছে
অলমিতি বিস্তারেণ
হিহি অইটা মূল গল্পে ছিল না, আমার পাকনামি
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
উরি মারদাঙ্গা!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
আমার নানি চমৎকার সব গল্প বলতেন। ঝুড়ি ভরা গল্প ছিলো তার। মাথাটা যদি একটু ভালো থাকতো তাহলে সেগুলি আমিও লিখতে পারতাম।
ডরাইছি কিন্তু
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কয়টা লিখেন না
ধন্যবাদ অপু ভাই
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
বেশ একটা গপ্পো শুনলাম। না কি পড়লাম? দেখেন অবস্থা, মনে হচ্ছিল নানী-দাদীর কাছ থেকেই শুনছিলাম। সুন্দর হইছে॥
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
পুরাই উরাধুরা হইছে!!!
---------------
সুবোধ অবোধ
----------------
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কেন এত বোকা হয়?!!
দারুণ। চমৎকার।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
চমৎকার।
--------------------------------------------------------------------------------
দারুন । আমার মেয়ে গত কয়েকদিন থেকে নতুন গল্প শুনতে চাচ্ছে, এই গল্পটা শুনায় দেওয়া যাবে
গল্পটা আমিও শুনেছি। যদিও শেষটা অন্য রকম ছিল। এগুলোকে বলা হত হোককথা।
আমার গল্পে মেয়েটা কয়রাত সাপ থেকে মানুষে তারপর সকালে আবার সাপে রূপান্তর দেখে লুকিয়ে। কাউকে কিছু বলতে পারে না ভয়ে। শুধু চিন্তা করে কি করবে। শেষে একদিন অনেক চিন্তাভাবনা করে, সাহস করে খোলোসটা দেয় পুড়িয়ে। কিন্তু অভিশাপ কাটতে আরো ৭ দিন বাকি থাকায় স্বামী বেচারা পার্মানেন্টলি সাপ হয়ে জঙ্গলে চলে যায়।
সে এক বড়ই করুণ কাহিনী।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন