"ভাই পানি আছে?"
"আছে, মিনারেল না জগের পানি?"
"জগের পানিই দ্যান।"
লোকটা ঘাড় থিকা বড় একটা ছালার বস্তা ধপ্পড় কইরা নামায়া এক পাশে রাখলো। বস্তাওয়ালা গায়ে গতরে তাগড়া, বেশ গাইট্টা গুইট্টা। এই শীতের রাইতেও ঘাইমা পুরা গোছল কইরা ফালাইছে। মনে হয় অনেকক্ষণ ধইরাই সে এই বোঝা নিয়া বইয়া বেড়াইতাছে। কইত্থিকা আইতাছে, বুঝা গেল না। ওইপার যাইবো মনয়।
রাত্র বাজে বারোটা। এইসময় গঞ্জ ঘুমায়া গেলেও ফেরিঘাটে মানুষজন কিছু থাকে। যদিও এই জায়গাটা ফেরি থিকা বেশ খানিকটা দূরেই পড়ছে। জায়গাটায় ফেরিঘাটের কোন হাউ কাউ নাই। বেশ শুনশান। একটু যেন বেশিই চুপচাপ। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়া উপরে তাকাই। সেলিমরে মেসেজ দিলাম, কইলো আইতাছে। আজকে আকাশ ভরা জোছনা। চান্দের গায়ের দাগগুলানও সুন্দর বুঝা যাইতাছে।
দোকানদার লোকটারে কী জানি জিগাইলো, বুঝতে পারলাম না। দোকানদারের কথার টানে মনে হইলে চিন পরিচয় আছে। লোকটা প্রথম এক গ্লাস পানি খাইছিল। পরে দেখলাম জগ ধইরাই সে ঢকঢক কইরা গিলতাছে। অনেক তেষ্টা পাইছে মনয়।
দোকানটা একটা চা সিগারেটের দোকান, পিছে একটা ছোট ঘরের মতন। চা সিগারেট ছাড়াও সামনের বয়মে বিস্কুট, লজেন্স রাখা। নীচে একপাশে গামলায় লাল কাপড়ে পান আর সাথে জর্দা সুপারির নানান কৌটা। জায়গাটা ফেরিঘাট থিকা একটু দূরে একটা ভাঙ্গা সিঁড়িওয়ালা ঘাটলার কাছে। সিঁড়ি গুলা পুরাই ভাঙ্গা, নামনের আর উপায় নাই। কেউ আর আসে না এইদিকে। দোকানটায় আসার আগে দেখতাছিলাম ঘাটপাড়ে একটা ছোট্ট নাও বান্ধা। চা খাইতে খাইতে জিগাইলাম,
"মুরুব্বী, এইটা কি আপনার দোকান?"
"হ বাবা।"
"এতদিন গঞ্জে ঘুরি, কই আপনের দোকান তো আগে দেখি নাই।"
"সারাদিন তো নাও চালাই বাজান, দোকানদারি করি সন্ধ্যাকালে।"
"রাইতে কি দোকানেই ঘুমান?" চায়ের কাপটা নামায়া রাখি আমি বেঞ্চে।
"হে হে না বাবা। রাইতে যাই গা ওই পার।"
ওই পার মানে বন্দর শহর। আমি আর জিগাইলাম না হে ফেরির ধারে না গিয়া এইখানে নাও চালায়া ক্যা। হ আগে একসময় এই ঘাটের থিকাও মানুষ যাইতো, কে জানে এখনো যায় মনয়। যাউকগা।
আমি চা শেষ কইরা একটা বিড়ি ধরাইলাম। যদ্দুর মনে পড়ে মাইয়াটারে এইদিকেই তো আইতে দেখছিলাম। ঘরের ভিতরে নাকি? হইতে পারে। মাইয়াটারে বিকাল থিকাই খেয়াল করতাছিলাম। লগে কেউ নাই, মনে হয় পলায়া আইছে, লগে একটা ব্যাগ। ফেরীঘাটে ওয়েট করতাছিল কারো লেইগা, খালি ইতিউতি চাইতাছিল। কিন্তু কেউ আসে নাই। একটু পরপর ফোনে কার লগে জানি কথা কইতাছিল। একসময় ফোন রাইখা কানতাছিল ছেমড়ি। ফোনডা তো দামীই মনে হইলো। স্যামসান ট্যামসান হইবো।
"মুরুব্বী, কিছুক্ষণ আগে একটা ষোল সতেরো বছরের মাইয়া কি আইছে আপনের এইখানে? অনেক কান্নাকাটি করতাছিল।"
"হ বাবা। তোমার চেনা কেউ? মাইয়াডা খালি কান্দে। কয় জামাইয়ের মোবাইল বন্ধ, খবর নাই। কয় বন্দরে যাওনের কথা। কইলাম আমিই নিয়া যামু।"
জামাই না ঘোড়ার ডিম! এই ছেমরি পলাইছে, ছেমরির লাভার হেরে ফালায়া ভাগছে। মনে মনে কইলাম আমি। এইসব সিন দেখা আছে আমার! কইলাম,
"না চাচা৷ চেনা কেউ না। বিকাল থিকাই দেখতাছিলাম মাইয়াটা ঘুরতাছে। মনে হইলো বিপদে পড়ছে। এইদিকেই আইতে দেখছিলাম তো তাই জিগাইলাম।"
"মাইয়াডা এতক্ষণ তো এইখানেই আছিলো। মনে হয় ঘরে গিয়া জিরাইতাছে।"
বিড়িটায় একটা সুখটান দিয়া ফালায়া দেখি বস্তাওয়ালা লোকটা এখনো হাঁপাইতাছে। আমার একটু তাজ্জব লাগলো, হালার অসুখ আছে নাকি।
বস্তাওয়ালা কইলো, "কাকা আর পানি নাই?"
হালায় দেখি এক জগ পানি শেষ কইরা আরো পানি চায়। আজব তো!
"পানি তো রে ভাই চারিদিকে, নদী ভরা পানি হে হে - নদী ভরা ঢেউ, বোঝ না তো কেউ.. " দোকানদার চাচা গান গাইয়া উঠে, একটু থাইমা কয়, "মিনারেল বোতল আছিল কয়টা, দেখি কই গেল, বেশি রাখি না রে বাবা, বেচা বিক্রি কম।" বস্তাওয়ালা হাত বাড়ায়া চাচার হাত থিকা মিনারেল বোতল নিয়া খুইলা খাওয়া শুরু করলো। হালার সমস্যা আছে, বড় সমস্যা। জিগাইলাম,
"ভাইয়ের কি কোন সমস্যা? আইছেন কইত্থিকা?"
লোকটা আমার দিকে তাকাইল। এক বোতল শেষ কইরা আরেকটা খুলছে, কইলো,
"ম্যালা দূর থিকা আইতাছিরে ভাই, শান্তি পাই না। অবসর পাই না।" কইতে কইতে ডুকরাইয়া কাইন্দা দেয়! কয়,
"বুইড়ায় শান্তি দেয় না। দুই দন্ড বইতে দেয় না। পত্তেকদিন এই মোট টানায়। আমি আর পারি না।"
মাথায় ছিট নি। কোন বুইড়ার কথা কয়? আমি দোকানদাররে জিগাই, "চাচা কেইস কী? ছিট নি?"
"ছিট না রে বাজান, চাকরি করে। এই চাকরির ম্যালা ঝামেলা। চাকরির খাটনিতে এমন পাগল পাগল করে, ওই যে আইয়া পড়ছে হের মালিক।"
হঠাৎ দূরে দেখি একটা বুড়ালোক, লাঠিতে ভর দিয়া আসতাছে এইদিকেই। শীতে কাবু হইয়া গেছে মনে হইল। চাদর দিয়া মাথামুথা বডি সব প্যাচায়া রাখছে।
কার চাকরি করে এই পালোয়ানে? এই বুইড়ার? বুইড়া আইসাই এক কাপ চায়ের অর্ডার করলো। দোকানদার বুইড়ারে কী জানি জিগাইলো, বুইড়া উত্তর দিল না। কিন্তু এই এরা এইখানে থাকলে তো ঝামেলা। একটু আগেই মদ খাইয়া লোড হইয়া আইছি ক্লাবের থিকা। নেশা মেশা ছুইটা যাইতাছে ঘোড়ার ডিম! মাইয়াডা চোখে লাইগা গেছে। মাইয়াডারে লাগবই আমার! সেলিমরে অনেক আগেই মেসেজ দিছি। হালার দোকান তো বগলেই, আহে না ক্যা বালটা?
এই জায়গাটায় আগে আইছি আমি। আমি একলা না, সেলিমও আইছে। কিন্তু দোকানডা যে কবে গজাইলো বুঝলাম না। লিটনরে সপ্তা দুই আগে আমি আর সেলিম মিল্লা বস্তায় ভইরা যে জায়গায় গাইড়া থুইছিলাম, সেই জায়গাটা মনে হয় এই ভাঙ্গা ঘাটলা সিঁড়িটার ধারেকাছেই কোথাও হইবো। হে হে লিটন নাটকির পুতে ব্যাংকে টাকা থুইতে যাইতাছিল। সেলিম কেমনে জানি খবর পাইয়া গেছিল। হারামীটার কামই মনয় মাইনষের ঘরে মাথা হান্দায়া রাখা, হে হে। তয় মারনের প্ল্যান আছিলো না। কিন্তু হালায় যে পার্ট টা নিলো, হেহ চাক্কু বাইর করে। দিছি না ভইরা ওর চাক্কু ওর গুয়াতে হে হে! যা মাঙ্গের পো, গুয়ায় চাক্কু নিয়া এখন মাটি কামড়াইয়া পইড়া থাক। বুদ্ধিটা সেলিমই দিছিল, কইলো আরে গাঙ্গে ভাসাইছ না, ভাইসা উঠবো। হালারে পুইতা রাখ। এই জংলায় কেউই খোঁজ লইব না। ঠিকই, দুই সপ্তা হইছে। দুই তিনজন লিটনের বাড়ির খোঁজ নিছিল। পুলিশও আইছিল। কিন্তু বেশি ঘাটায় নাই এইদিক। সেলিম আরেকটা কাম করছিল বুদ্ধি কইরা, লিটনের টাকার খালি ব্যাগটা বন্দরে এক জায়গায় গিয়া রাইখা আইছিল লুকায়া। কইত্থে যে এডি শিখে! অনেক সিনেমা দেখে হালায়। সেলিমের বুদ্ধিতে কাম দিছে। আমরা ওই কয়দিন কোথাও যাই নাই। সেলিমই কইছে, আরে পলাবি ক্যান গাবর। পলাইলে সন্দেহ করবো। পত্তেকদিন গঞ্জে আইবি, কেউ বুঝতেই পারবো না কী হইছে।
শুনলাম, দোকানদার চাচা বুইড়ারে জিগাইতাছে, "আজকের মত কালেকশন শেষ না বাকি আছে?" আমার বুকটা ক্যান জানি ধক কইরা উঠলো কথাটা শুইনা।
"চাচা দোকানে কি এনার্জি বিস্কুট আছে?"
সেলিমের গলা। আইয়া পড়ছে মাঙ্গের পো, হে হে, পিছনে দেখি জুম্মন ক্যালাইতাছে। সেলিমে আজকে একটা হুডি পিনছিল। হাতে একটা চাবির গোছা লইয়া খেলতাছে। জুম্মনের হাতে একটা লাঠি।
"জ্বে এনার্জি বিস্কুট আছে। বয়ম খুইলা নিয়া নাও বাবা।", দোকানদার চাচা কইলো।
"বিস্কুট তো চাচা আমার লেইগা চাই নাই, হে হে। বিস্কুট তো আমি আপনারে খাওয়ামু। আপনার তো এখন অনেক এনার্জি লাগবো।" সেলিম হালার পোলার রসের শেষ নাই।
"বিস্কুট আমি খামু মানে?" দোকানদার চাচার চোখেমুখে প্রশ্ন।
"হ আপনারই তো খাওয়ামু বিস্কুট। একটু পরে আপনারে আমি একটু মাইরধইর করুম, একটু এনার্জির ব্যাপার আছে না হে হে। আচ্ছা চাচা লাস্ট মাইর খাইছিলেন কবে কইতে পারেন? বুঝতেছিনা আপনারে মারলে নিতে পারবেন তো নাকি আবার মইরা টইরা যাইবেন।"
সেলিম কথা কইতে কইতেই জুম্মন হাতের কাম শুরু কইরা দিলো, লাঠিটা দিয়া ঝনঝন কইরা দোকানের সামনে রাখা বয়ম গুলো ভাঙ্গতে লাগলো। আর তখনই দেখি দরজার ফাঁক দিয়া মাইয়াডা আইসা দাড়াইছে। আমি উইঠা খাড়াইলাম।
সেলিম কইতে লাগলো, "বুইড়া, কচি মাইয়া নিয়া ফুর্তি করস? কোনোদিন দেখলাম না আর একদিনেই এই জায়গায় দোকান সাজায়া বইসস? ধান্দা কী? মাইয়া পাচার করছ? তোর লগে এডি কে? বন্দরের দালাল? মাগির ব্যবসা করছ তোরা? দাড়া করাইতাছি ব্যবসা, ওই জুম্মন ধর তো খানকির পোলারে.. "
মাইয়াটা আবার ঘরের ভিতরে গিয়া ঢুকছে মনে হয় ডরায়া। পিছনে শুনি জুম্মন বস্তাওয়ালারে ধরছে, "এই মাঙ্গের পো, কী পাচার করস বস্তায়, বস্তা খোল। আজকে তোগো সবডিরে খাইছি। বাজার থিকা আরো পোলাপান আইতাছে।" জুম্মনরে বুদ্ধি কইরা নিয়া আইছে সেলিম। গাবরটারে দরকার আছিল না। কিন্তু বস্তাওয়ালার মইষের মত বডি দেইখা মনে হইলো রিস্ক নেয়াটা ঠিক হইবো না৷ সেলিম আমারে ইশারা দিল। এখন মাইয়াটারে বুঝায়া ক্লাবঘরে লইয়া যাইতে পারলেই ফুর্তি। ঘরের দিকে গেলাম আমি।
ঘরের দরজা খুইলা দেখি একটা কোনায় মাইয়াডা একটা খুঁটি ধইরা পিছমুখী হইয়া আছে। টিমটিমা একটা আলো ঘরে। আমি কাছে আগায়া গেলাম, কইলাম, "আপা ডরায়েন না। আমরা গঞ্জের ইয়ুথ ক্লাবের পোলাপান। এই বুড়া চাচা ভাল লোক না, আমরা এর আগে তারে কখনো দেখি নাই গঞ্জে। আমরা খবর পাইছি সে একটা ধান্ধা নিয়া এইখানে দোকান বানাইছে। আপনারে এইদিকে আসতে দেইখা আমার সন্দেহ হইতাছিল। আমিই সবাইরে খবর দিছি। তার মতলব ভাল ছিল না। সে আপনারে পাচার কইরা দিত বন্দর শহরে। আমাদের সাথে চলেন। আপনি কোথায় থাকেন বলেন আপা, আপনারে আমরা পৌছায়া দিব।"
আমি যত কথা কই, মাইয়াডা আরো সিটায়া যাইতে থাকে।
আমি কইতে থাকি, "ডরায়েন না আপা, আমি আপনার ভাইয়ের মতন।" এইবার ছেমরি কান্তে শুরু করল। ধুর জ্বালা, কান্দে ক্যা।
কইলাম, "আরে ভইন, কাইন্দেন না, আমার সাথে চলেন।" কইয়া যেই হাত ধরতে যামু, আমার হাতটা মনে হইলো যেন বাতাসের মধ্য দিয়া গেল। আমি হঠাৎ টালমাটাল হইয়া গেলাম। মাইয়াডা এতক্ষণে ফিরা তাকাইছে আমার দিকে। ভাল কইরা দেখলাম মাইয়ার গলায় একটা বিশ্রী দাগ। এই দাগ দেখছিলাম লিটনের গলায়। লিটনরে যখন সেলিম ফাঁস দিয়া মারছিলো তখন ওর গলাতেও এমন দাগ পড়ছিল। তব্ধা খাইয়া যখন দেখতাছি, সেই সময় কে জানি আমার চুল ধইরা হ্যাঁচকা টানে হিড়হিড় কইরা আমারে বাইরে নিয়া যাইতে লাগলো। বুঝলাম আমারে পুতুলের মত অনায়াসে টাইনা নিয়া যাইতাছে বস্তাওয়ালা। একটানে আমারে আইনা যখন বেঞ্চের উপর আছাড় মাইরা ফালাইলো, ব্যাথার চোটে আমি ভড়ভড় কইরা বমি কইরা দিলাম। আমার মুখে টর্চ মারলো দোকানদার চাচা। আর সামনে আইসা দাড়াইলো সেই চাদর প্যাচাইন্না বুইড়া। বুইড়া ঠাণ্ডা চোখে আমারে দেখতাছে। আমার চোখ কপালে উইঠা গেল। মরণচান! এই তো সেই মরণচান! সেই দশ বছর আগের ট্রেন ডাকাতি। ডাকাতি শেষে ওস্তাদের মাথা খুইলা পড়ছিল বুইড়ার বস্তায়! এই চোখ আমি এই জনমে ভুলতে পারুম না। আমার সব মনে পইড়া গেল। আমি উইঠা দৌড় দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়া কিসে জানি পিছলা খাইয়া আবার পড়লাম মাটিতে। মাটি ভিইজ্জা রইসে কীসে জানি। কী এগুলা? রক্ত? দোকানডার চারপাশের মাটি রক্ত দিয়া ভাইসা গেছে। দেখি জুম্মন আর সেলিমের মাথাছাড়া বডিও মাটিতে পইড়া আছে, সেলিমের হুডিখোলা, ওর কল্লাকাঁটা ধড়টা এখনো মুরগীর মত ধরফর করতাছে, গলার জায়গাটা দিয়া চিরিক চিরিক কইরা রক্ত বাইর হইতাছে। প্যান্টে পেশাব হইয়া গেল আমার। হঠাৎ হ্যাচকা টান দিয়া বস্তাওয়ালা অসুরটা আমারে তুইলা খাড়া করাইলো, মরণচান আইসা বস্তাটা মেইলা ধরলো আমার সামনে। ঠোটের কোনায় একটা হাসি ঝুলায়া বুইড়া কইলো, "জিগাইবি না বস্তায় কী আছে?" কিন্তু আমি জানি বস্তায় কী আছে। আমি কিছু কইতে পারি না। বস্তার মুখটা হঠাৎ চারদিক থিকা আমার দিকে ঘিরা আসে। আমি তাকায়া দেখি ভিতরে খালি অন্ধকার। তারপর কোথায় যেন আমি খালি পইড়া যাইতে থাকি, তলায়া যাইতে থাকি। আমার চোখটা ভারী হইয়া আসে, আমি আর চক্ষু খুইলা রাখতে পারি না। পড়তে পড়তে শুনি দূর থিকা আসা মরণচানের গলা, "হরিদা, আজকের লেইগা কালেকশন শেষ। নাও ছাইড়া দেন।"
----
আমি মইরা আছি নাকি বাইচা আছি বুঝি না। চাইয়া দেখি আমি একটা বস্তার ভিতর আছি। আমার আশেপাশে কারা জানি ফোঁপাইতাছে, মাতম করতাছে। একদম ঠাসাঠাসি কইরা আছি আমরা সবাই। বাইরে মনয় অনেক চান্দের আলো, চাইরদিক ভাইসা যাইতাছে। আস্তে আস্তে আমার সব মনে পড়ে। কিন্তু কই আছি কিছু ঠাহর করতে পারি না। বস্তার ফাঁক দিয়া যট্টুক দেখা যায় দেখি দোকানদার চাচা নৌকাডা বাইয়া নিয়া যাইতাছে। আমার চারপাশে সব মানুষেরা ফোঁপায়া কানতাছে, আমার মুখে আইসা কার মুখ জানি লাইগা রইছে। আমি হাত দিয়া সড়ানোর চেষ্টা করি, হাত পা শরীর কিছুরই বোধ পাই না। মনে হইতাছে গলা মুখ বাইয়া কীসব জানি পড়তাছে। বুঝতাছি না কী হইতাছে। চিক্কুর পাইরা কানতে মন চাইতাছে। বস্তার ফাঁক দিয়া দেখি কাছেই বইসা আছে মাইয়াটা। আমি মাইয়াডার লগে কথা কওনের চেষ্টা করি, "এই যে আপা শুনছেন। আমি কিছু বুঝতাছি না। আপনি বলবেন কী হইতাছে? আমি কই, আমরা কই আছি, কই যাই?"
মাইয়াডা কইলো, "হরি কাকার নাও'য়ে আছি আমরা, কাকায় আমাগো নদী পার কইরা দিবো। আমিও জানেন, কিছুই বুঝতে পারতাছিলাম না। প্রতিদিনই আমি নদীর পার আসি, মনে করি আমি বুঝি নদী পার হব। কিন্তু আমার আর পার হওন হয় না। আমি আমার ভালবাসার মানুষটারে ফোন দেই, উনি ধরেন না। উনি বলছিলেন আমারে বন্দরে নিয়া যাবেন বিয়া কইরা। কিন্তু উনি আর আসেন না। আমার পেটে দুইমাসের বাচ্চা, লুকায়া ছুপায়া চলি, কাউরে বুঝতে দেই না। আমি কই যাই কি করি কিছুই বুঝি না। একদিন ভাবলাম নিজেই চইলা যাব ওইপার। ফেরিঘাটে আইসা ফোন দেই। অনেক পরে উনি ফোন ধরেন, বলেন বন্দরে উনার বিয়া করা বউ আছে, আমারে উনি নিতে পারবেন না। আমার মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পড়ে। বাড়ির থিকা পলায়া বাইর হইছিলাম। সারাদিন ফেরিঘাটে ঘুইরা রাইত হইলে আমি এক গাছি দড়ি কিন্না চইলা আসি গেরামের রাস্তায়। বাজার থিকা গেরামের রাস্তায় ঢোকার মুখে একটা কাঁঠাল গাছ আছে। আমি সেই কাঁঠাল গাছটায় গিয়া গলায় ফাঁস দেই। কিন্তু ক্যান জানি আমার মরণ হয় না, নাকি হয়, আমি বুঝি না। খালি বুঝি যে আমি আবার ফিরা আসছি নদীর পাড়ে। আমি আবার উনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। উনি বলেন উনি আমাকে নিবেন না। আমি আবার গেরামে আসি। ফাঁস দেই, আবার ফিরা আসি নদীর পারে। ফাঁসেও আমার মরণ হয় না। কিন্তু আজকে মনে হয় পার হইতে পারব, হরি কাকা আমারে পার করাবে। কী কাকা, পার করাবা না?"
আমি দেখি দোকানদার মাইয়াডার কথায় কিছু কয় না, খালি হাসে। আমি কিছুই বুঝি না। আমি শুধু বুঝি আমার কাটা মাথা একটা বস্তায় আরো একশোটা মাথার লগে দলাদলি কইরা পইড়া আছে। এইটা কিভাবে সম্ভব আমার বুঝে আসে না। চিক্কুর দিয়া কানতে মন চায় আমার। আমার কানে ভাইসা আসে হরি মাঝির গান। হরি মাঝি গান গায়,
নদী ভরা ঢেউ, বুঝো না তো কেউ
কেনে মায়ার তরী বাও বাও বাও রে
নদী ভরা ঢেউ..
(সমাপ্ত)
নদী ভরা ঢেউ গানটা আমার সুকুমার বাউলের গলাতেই ভাল লাগে। মনে হইলো গানটা এইখানে সংযুক্ত করা যায়।
সহপাঠ : কালেকশন
মন্তব্য
বছর চারেক আগে 'লঞ্চ' তার পরে 'মায়াতরী'। আরও বছর চারেক পরে হয়তো ভেলা বা ডোঙা বা জালিবোট আসবে। আসুক তা যখন আসার।
মায়াতরী একটু বেশি predictable লেগেছে। এটা হয়তো লেখকের স্টাইলের সাথে পূর্ব পরিচয় থাকার দরুন অথবা লেখক এমনটাই চেয়েছেন বলে।
বাংলা ভাষায় হরর গল্প একটু কম মনে হয়। একসময় ভালো বাংলা হরর গল্প লেখা হয়েছে। ইদানীং কালেরগুলো পড়ে মজা পাওয়া যায় না। সেসব বিবেচনায় এই লেখকের হরর গল্প উপভোগ্য।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপনার কথা শুইনা একটু চেষ্টা করলাম সংশোধনের। আশা করি খানিকটা predictability কমছে। ধন্যবাদ পাণ্ডবদা, আপনের মন্তব্য একদম টু দি পয়েন্ট হয়, আমারে সবসময় হেল্প করে।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
পরিবেশ আর চরিত্রগুলো এত জীবন্ত মনে হলো আমি চোখের সামনে পুরো সিকোয়েন্সগুলো দেখে যাচ্ছি। একটাই অনুযোগ- শেষটা একটু দ্রুত হয়ে গেলো। এই গল্পটা আরেকটু বড় হওয়ার দাবী রাখে।
আর পড়তে পড়তেই ভাবছিলাম তোমার লেখা কালেকশনের কথা। পরে দেখি লিখে দিয়েছো। একই ইউনিভার্সের বুঝি? কেএইচইউ- খেকশিয়াল হড়ড় ইউনিভার্স?
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
ধন্যবাদ ভাই। আমারো আসলে প্ল্যান ছিল গল্পটা একটু বড় করার। আচ্ছা দেখুমনে, দাঁড়াও।
হেহে আমার আবার ইউনিভার্স, তবে হ এইটা মরণচানের দ্বিতীয় আবির্ভাব, গল্পে আরো দুইটা মিথিক্যাল চরিত্রের হিন্টস আছে কিন্তু হেহে।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
আগেরগুলার মতো এই গল্পটাও আগাগোড়া টেনে রেখেছে। আরেকটু ঘন ঘন লিখতে পারেন। বছরে অন্তত একটা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
চেষ্টা করবো, আসলে মহা অলস আমি। ধন্যবাদ আপনাকে।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ভাল লাগছে অনেকদিন পর আপনার গল্প পড়ে।
হরর গল্প লেখার ব্যাপারে ইন্সপায়ার্ড হলাম।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ধন্যবাদ ভাই!
দারুণ কথা! লিখে ফেলো শিজ্ঞির!
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
নতুন মন্তব্য করুন