১৭৮০ সালের নভেম্বরের শেষদিকে লেফট্যানেন্ট জেনারেল আইরে বাংলা হতে মাদ্রাজ এসে পৌঁছান; উদ্দেশ্য হায়দারের হাত থেকে মাদ্রাজ কুঠি বাঁচানো। আইরে মাদ্রাজে এসেই প্রথমে মুনরো হতে মাদ্রাজের দায়িত্ব বুঝে নেন।
এদিকে ঘটে আরেক ঘটনা। ১৭৮০ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশরা ডাচদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে১। এর ফলে, ডাচরা মহীশুর-ব্রিটিশ যুদ্ধে মহীশুরের পক্ষ অবলম্বন করে।
১৭৮১ সালে লে. জেনারেল আইরে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কর্নাটকে মহীশুরের লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমন করেন; ব্রিটিশ বাহিনী দখল করে নেয় কোড্ডালোর আর অবরোধ করে চিদাম্বরাম দূর্গ। সেসময় হায়দার ব্রিটিশদের অধীন দেশীয় রাজ্য তান্জোর অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। বিষয়টি জানার পর খুব ক্ষুব্ধ হন হায়দার, ব্রিটিশ অনুগত তান্জোরে চালান ধ্বংসযজ্ঞ২।
তান্জোর অভিযান শেষ করে হায়দার-টিপু সৈন্য নিয়ে কর্নাটকের দিকে এগুতে থাকেন, তখন লে. জেনারেল আইরে ব্যস্ত কর্নাটকের মহীশুর অধীন চিদাম্বরাম দূর্গ অবরোধে। হায়দারের কাছে খবর এলো, চিদাম্বরাম দূর্গ অবরোধে লে. জেনারেল আইরের রসদ আসছে ব্রিটিশদের সদ্য দখলকৃত কোড্ডালোর হতে। হায়দার তাই পুত্র করিম খানকে সাথে নিয়ে কোড্ডালোর আর চিদাম্বারামের মাঝামাঝি জায়গা পোর্টো নভোতে বিশ হাজার সৈন্য সমাবেশ করেন, যাতে ব্রিটিশরা রসদ চিদাম্বরায় পাঠাতে না পারে। ব্রিটিশ লে. জেনারেল আইরে হায়দারের সৈন্য সমাবেশের খবর শোনার পর দশ হাজার সৈন্য নিয়ে পোর্টো নভোতে মহীশুর বাহিনীর অবস্থানে আক্রমন করে।
সেদিনটি ছিল পহেলা জুলাই, ১৭৮১; মহীশুরের জন্য এক রক্তাক্ত দিন। পোর্টো নভোতে প্রচন্ড যুদ্ধ হলো। মহীশুর বাহিনীর রসদ-গোলাবারুদের ঘাটতি ছিল। টিপু পেরামবাক্কামের প্রথম যুদ্ধে যে পদ্ধতিতে ব্রিটিশদের নাস্তানাবুদ করে, সেই একই পদ্ধতিতে ব্রিটিশ জেনারেল আইরেও অবলম্বন করেন। চিদাম্বরাম, কোড্ডালোর আর নৌপথে তিন দিক হতে ব্রিটিশ গোলন্দাজদের গোলার আঘাতে অসহায় হয়ে পড়লো মহীশুর বাহিনী। মহীশুরের সৈন্যরা বীরের মত যুদ্ধ করার পরও পরাজিত হলো। এ যুদ্ধে পরাজয়ের বেদনা কখনো ভুলতে পারেননি হায়দার। কারন, এ যুদ্ধে পুত্র করিম খানসহ প্রায় দশ হাজার সৈন্য প্রাণ হারায়।
পুত্রশোকে কাতর হলেও হায়দারের উপস্থিত বুদ্ধি লোপ পায়নি, তিনি পোর্টো নভো হতে বাকি সৈন্যদের সরিয়ে পুত্র টিপুকে পাঠালেন আইরের বিরুদ্ধে। কিন্তু ভূপ্রকৃতিগতভাবে ভাল অবস্থানে সৈন্য সমাবেশ করেছিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ গোলন্দাজদের প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে টিপু এগুতে পারলেন না। শত্রুর কামানের সামনে সৈন্য সমাবেশ করে যুদ্ধ করাটা এক ধরনের বোকামী। তাই, টিপু সৈন্য নিয়ে পিতা হায়দারের বাহিনীর সাথে একত্রিত হন।
হায়দার-টিপু পেরামবাক্কামে৩ তাঁদের সৈন্য সমাবেশ করেন। পেরামবাক্কামের একদিকে ব্রিটিশদের মাদ্রাজ কুঠি, অন্যদিকে পোর্টো নভো, কোড্ডালোর, চিদাম্বরামে ব্রিটিশ সৈন্য সমাবেশ। হায়দার-টিপু ভেবে দেখলেন, দুদিকে শত্রু রেখে মাদ্রাজ আক্রমন করা বোকামী, তাঁরা অপেক্ষা করতে লাগলেন সুযোগের। এসময় মহীশুরের মিত্র ডাচরা হায়দার-টিপুর বাহিনীকে কিছু রসদ-অস্ত্র-গোলাবারুদ-সৈন্য সরবরাহ করে। আগস্টের দিকে লে. জেনারেল আইরের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা পেরামবাক্কামে মহীশুরের সৈন্য সমাবেশে আক্রমন করে৪। ব্রিটিশদের গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনীর একের পর এক আক্রমনে প্রথমদিকে সুবিধে করতে পারছিল না হায়দার বাহিনী। ২৭ আগস্ট, ১৭৮১, কোনঠাসা হয়ে পড়ে মহীশুর বাহিনী কিন্তু ব্রিটিশদের রসদ ফুরিয়ে যাওয়ায় লে. জেনারেল আইরে বাধ্য হয়ে ত্রিপাশুরের দিকে চলে যান। যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত রয়ে যায়৫।
এরপর, সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে হায়দার ভেল্লোরে থাকা ব্রিটিশ কুঠিগুলো আক্রমন করেন। মহীশুর ভেল্লোরের ব্রিটিশ কুঠিগুলো দখল করে নিচ্ছে, এ খবর পাবার পর লে. জেনারেল আইরে সৈন্য নিয়ে ভেল্লোরের দিকে এগুনো শুরু করে। ব্রিটিশ বাহিনী ভেল্লোরের দিকে আসছে; বিষয়টি জানার পর হায়দার আলী সৈন্য বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হন। অবশেষে, ২৭ সেপ্টেম্বর, ভেল্লোরের শৈলিঙ্গুরে ব্রিটিশ ও মহীশুর বাহিনী মুখোমুখি হয়। এবারো ব্রিটিশদের গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমনে দিশেহারা হয়ে যায় মহীশুর বাহিনী। কোন উপায় না দেখে হায়দার আলী সৈন্য নিয়ে ভেল্লোর হতে পিছু হটে যান।
আগেই বলেছি, ডাচরা মহীশুরের মিত্র। অক্টোবর, ১৭৮১, ভূমিপথে ব্রিটিশ কর্নেল একক্লিস নিক্সন ও নৌপথে এ্যাডমিরাল এডওয়ার্ড হিউ ও হেক্টর মুনরো দক্ষিণ ভারতের ডাচ-কুঠিগুলো আক্রমন করে।
২০ অক্টোবর, ব্রিটিশরা কারাইকালের ডাচ কুঠি আক্রমন করে। ২১ অক্টোবর, ব্রিটিশরা ডাচদের নাগোরের কুঠি দখল করে নেয়। এরপর, ব্রিটিশরা নাগাপত্তমে অবস্থিত ডাচদের বড়-কুঠি আক্রমন করে। হায়দার আলী ডাচদের সাহাযার্থে সৈন্য পাঠান। কিন্তু কোন ফল হলো না। ১২ নভেম্বর, ১৭৮১, ব্রিটিশরা নাগাপত্তম দখল করে নেয়।
মহীশুরের জন্য আরো দু:সংবাদ ছিল। ১৭৮১ সালের শেষদিকে ব্রিটিশদের হাতে নাগাপত্তমের পতনের পর মহীশুর বাহিনী তান্জোর হতে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
পরপর কয়েকটি যুদ্ধে সুবিধে করতে না পারার কারনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন হায়দার। কিন্তু তিনি আশাহত হননি। তিনি বুঝতে পারেন, নৌ শক্তিতে সমৃদ্ধ ব্রিটিশ বাহিনীকে হারাতে হলে মহীশুরের নৌবাহিনীকে আরো পোক্ত হতে হবে। নতুন করে মহীশুর বাহিনী সংগঠিত করার কাজে মন দেন হায়দার-টিপু।
মন্তব্য
আর আমি বলি আমার পর্যাপ্ত টাকা থাকলে আমি তারেকাণুর মত টইটই ঘুরতাম। আর পর্যাপ্ত শিক্ষা থাকলে বিরাট আপিসার হইতাম। আর পর্যাপ্ত প্রতিভা থাকলে সাকিব আল হাসান হইতাম।
আমিও কিছু হই নাই তুইও শালার ভাই যুদ্ধ জিতসনাই।
..................................................................
#Banshibir.
বিচার মানি তয় তালগাছটা আমার।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
শালারা বিচারও মানেনা তালগাছ লয়া হাঁটা দিসে। বদমাইস। তালগাছ চুর।
..................................................................
#Banshibir.
হা হা হা
ব্রিটিশরা আসলেই বিটিশ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
পড়ছি।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ভালো লিখছিস।
চলতে থাকুক।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
আমি মনে করতাম হায়দার আলী কখনো ব্রিটিশদের কাছে হারেননি। আসল ঘটনা দেখি অন্যরকম। হায়দার আলী একজন ভালো যোদ্ধা ছিলেন কিন্তু তিনি ব্রিটিশদের কাছে অপরাজেয় ছিলেন না।
লেখা চলুক।
সুমন ভাই, শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
রক্তাক্ত প্রান্তর ভাই ও সুমন আহমেদ ভাই,
আপনাদের দুজনকে অসংখ্য ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য।
অফলাইন জীবনে এই সিরিজটি লিখতে উৎসাহ দেবার জন্য আপনাদের দুজনকে ১০০ কেজি ধইন্যা পাতা।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
এই পর্বের ঘটনাপ্রবাহ যে সময়ের, সেই সময়টাই মনে হয় হায়দার-টিপু আমলের মহীশূরের সবচেয়ে দুঃসময়। পরের বছরই তো হায়দার মারা যায়।
হুমম। ১৭৮১ আর ১৭৯৯ এ দুই বছর মহীশুরের চরম দু:সময়। পরের বছর, ১৭৮২ সালের শেষ দিকে হায়দার মারা যান।
মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারি না। সেই সুদূর থেকে ইউরোপিইয়ানরা এসে ভারতীয়দের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাচ্ছে, অথচ এখানকার ছোট ছোট রাজ্যগুলো তখন ব্যাস্ত ছিল পরস্পরের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে! কে শত্রু, কে মিত্র; এই সামান্য বিবেচনাবোধ কি তাদের মধ্যে ছিল না?
যদি রাজ্যগুলোর মধ্যে সদ্ভাব থাকত, তাহলে মনেহয় কোনওদিনও ইস্টইন্ডিয়া কম্পানির মুরোদ হতনা ভারত শাসন করার। টিপু-হায়দার যখন লড়ছে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে, মারাঠা-নিজাম তখন ব্যাস্ত সেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে!
১৮৫৭-র বিদ্রোহটা যদি আর ৫০বছর আগে হত, তাহলে রিটিশদের পাতাতরি গুঁটিয়ে তখনই বিদেয় নিতে হত আমার মনে হয়।
একদম ঠিক কথা।
মারাঠারা আমার দৃষ্টিতে নিরেট দস্যু আর নিজাম হচ্ছে সুযোগ সন্ধানী। এমনকি রাজ্যবিস্তারের লোভ হতে হায়দারও বাদ যাবেন না।
আসলে ভারত উপমহাদেশভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অভাবই ভারত উপমহাদেশের পরাধীনতার মূল কারন। আমরা এখনো কিন্তু অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বাইরে যেতে পারিনি।
হায়দারের সাথে ব্রিটিশদের শত্রুতার শুরু কর্নাটকের মহাযুদ্ধ হতে। ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চরা ভারতে নিজেদের বাণিজ্য বাড়ানো নিয়ে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত ছিল। কর্নাটকের যুদ্ধ শুরু হলে নিজ নিজ বাণিজ্য সুবিধা বাড়ানোর জন্য ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চরা এ যুদ্ধে অংশ নেয়।
ভারতীয় রাজ্যগুলো যখন মারামারি করছিল, তখন ইউরোপীয়রা ভারতে নিজেদের অবস্খান পোক্ত করে।
মহীশুর সালতানাতের সাথে ব্রিটিশদের শত্রুতার মূল কারন হলো: ব্রিটিশদের মিত্র ভারতীয় রাজ্যগুলো (নিজাম, মারাঠা, আরকোট, মালাবার) যখন হায়দার কর্তৃক আক্রমনের শিকার হয় তখন ব্রিটিশরা এসব ভারতীয় রাজ্যগুলোকে সাহায্য করে, অপরদিকে ব্রিটিশদের সাথে শক্রতা ফরাসীদের সাথে মহীশুরের মৈত্রী সর্ম্পক সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে হায়দার বুঝতে পারেন, ভারতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে হলে ব্রিটিশদের ধ্বংস করতে হবে। আরো পরে, হায়দার বুঝতে পারেন, ব্রিটিশরা শুধু বাণিজ্য নয় ভারত উপমহাদেশে সুযোগ পেলে রাজ্যবিস্তার করবে। কিন্তু ভারতের অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ তখন ভারতকে এক হতে দেয়নি।
ভারত উপমহাদেশের অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদই ভারতকে ইউরোপীয়দের হাতে পরাধীন করেছে।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
আজকের পর্ব পড়ে তো মন খারাপ হয়ে গেল। আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। লেখা চলুক।
শান্তুনু দা। রক্ত, সুমন ভাইয়ের পর তুমিও দেখি হাজির। লও ১ টন লও।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
নতুন মন্তব্য করুন