১৩৭১ সালে ফ্রান্সে পঞ্চম চার্লসের রাজত্বকালে মন্টার্গিসে থাকতেন অব্রে ডি মন্টডিডিয়ের নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। অব্রের ড্রাগন নামে এক গ্রেহাউন্ড ছিল। খুব প্রভুভক্ত ছিল ড্রাগন।
একবার অব্রের সিয়র ডি নারসাক নামের এক ফ্রেঞ্চ ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করার কথা ছিল। ড্রাগনকে নিয়ে অব্রে বেরিয়েও পড়লেন কিন্তু ডি নারসাকের বাড়িতে পৌঁছুলেন না। অব্রে আসছে না দেখে নারসাক নিজে চলে গেলেন অব্রের বাড়িতে। কিন্তু না! কোথাও নেই অব্রে কিংবা, তাঁর বিশ্বস্ত কুকুর ড্রাগন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কোন সন্ধান পাওয়া গেল না অব্রে বা, ড্রাগনের।
অব্রে নিঁখোজ হবার তিনদিন পর চতুর্থদিন সকালে ডি নারসাকের বাড়িতে এসে হাজির হয় ড্রাগন। খুব বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছিল ড্রাগনকে। নারসাক দেখেই বুঝতে পারেন এই তিনদিন খুব ধকলে ছিল ড্রাগন। কিন্তু অব্রের কোন খোঁজ নেই। নারসেক অব্রের সন্ধান পাবার আশায় দ্রুত ড্রাগনের খাবার ব্যবস্থা করলেন।
খাওয়ার পর ড্রাগন নারসেকের পোষাকের ধারে কামড় দিয়ে ওর সাথে কোথাও নিয়ে যেতে চাইল। অব্রের সন্ধান পেতে পারেন এই আশায় নারসাক ড্রাগনের সাথে গেলেন। ড্রাগন নারসাককে মন্টারগিসের কাছেই বন্ডির জঙ্গলে নিয়ে গেল। বন্ডির জঙ্গলের ভিতর একটি বিশাল ওক গাছের নিচে ড্রাগন শুয়ে পড়ল আর কোঁকিয়ে কোঁকিয়ে কান্না করা শুরু করল। নারসাক ওক গাছের নিচটা দেখলেন; মনে হচ্ছে, সদ্য কিছু যেন মাটি চাপা দেয়া হয়েছে।
দ্রুত লোকজন জোগাড় করে ওক গাছের নিচের ঢিবিটা খোঁড়ালেন নারসাক। মাটি খুঁড়ে বের করা হল আঘাতে জর্জরিত অব্রে ডি মন্টডিডিয়ের লাশ।
অব্রেকে কবর দেয়া হল প্যারিসে। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও অব্রের খুনিকে খুঁজে বের করতে পারল না।
অব্রের মৃত্যুর পর ড্রাগন থাকত নারসাকের সাথেই। একদিন নারসাকের সাথে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল ড্রাগন। হঠাৎ রাজকীয় দেহরক্ষীর পোশাক পড়া রবার্ট সিভালিয়ের ম্যাকেয়ার নামের এক যুবককে আক্রমন করে বসে ড্রাগন। ড্রাগন প্রশিক্ষিত গ্রেহাউন্ড, যাকে তাকে আক্রমন করার মত কুকুর সে নয়। ম্যাকেয়ারের উপর সন্দেহ হল নারসেকের।
কিছুদিন পরে, নারসাকের সাথে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ড্রাগন ম্যাকেয়ারকে দেখে আবার ওর উপর আক্রমন করে। ম্যাকেয়ারের উপর নারসেকের সন্দেহ আরো ঘণীভূত হয়। ম্যাকেয়ার সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে নারসেক জানতে পারলেন অব্রের সাথে ম্যাকেয়ারের শত্রুতা ছিল। ঘটনা জানাজানি হয়ে যায় খুব দ্রুত।
সেসময় ম্যাকেয়ার স্বয়ং পঞ্চম চার্লসের দেহরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত ছিল। অব্রের মৃত্যু, ম্যাকেয়ারের সাথে অব্রের শত্রুতা, গ্রেহাউন্ড ড্রাগনের ম্যাকেয়ারকে আক্রমন-এই বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে থাকে প্যারিসে। চার্লসের কানে গিয়েও পৌঁছে কথাগুলো। নিজের ব্যাক্তিগত দেহরক্ষীর বিষয়ে এই ধরণের কথা শুনতে পেয়ে ব্যাপারটা যাচাই করতে চাইলেন চার্লস। ঢেকে পাঠালেন নারসাককে যেন অব্রের গ্রেহাউন্ড ড্রাগনকে সাথে করে নিয়ে আসে।
নারসাক ড্রাগনকে নিয়ে পঞ্চম চার্লসের সাথে দেখা করতে এলেন হোটেল সেইন্ট পল-এ। চার্লসের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল ম্যাকেয়ার। ম্যাকেয়ারকে দেখা মাত্রই ড্রাগন ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এই ঘটনায় সবাই খুব অবাক হয়। অব্রের হত্যাকারী হিসেবে সবার সন্দেহ ম্যাকেয়ারের উপর দৃঢ় হয়। স্বয়ং রাজা চার্লসও ম্যাকেয়ারকে সন্দেহ করেন। কিন্তু ম্যাকেয়ার অব্রেকে হত্যার বিষয়টি অস্বীকার করে। রাজা পঞ্চম চার্লস 'ঈশ্বর এই বিষয়টি মীমাংসা করবেন' ভেবে সিদ্ধান্ত নেন, ড্রাগন ও ম্যাকেয়ারের মধ্যে সন্মুখ যুদ্ধ হবে।
১৩৭১ সালের ০৮ অক্টোবর, প্যারিসের নটরডেম ক্যাথিড্রালের সামনে মানুষ-কুকুরের এই সন্মুখ যুদ্ধ হয়। ম্যাকেয়ারের হাতে ছিল একটি বিশাল লাঠি। লড়াই শুরু হলে গ্রেহাউন্ড ড্রাগনের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না ম্যাকেয়ার। অবশেষে ম্যাকেয়ার সবার সামনে স্বীকার করে যে ব্যাক্তিগত শত্রুতার জের ধরে সেই হত্যা করেছিল অব্রেকে।
ম্যাকেয়ারের স্বীকারুক্তির পর রাজা পঞ্চম চার্লস সন্মুখ যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দেন। ড্রাগনকে কলার পরিয়ে নারসেকের কাছে ফেরত দেয়া হয়। রাজা চার্লস এই ঘটনাকে 'ঈশ্বরের ইশারা' হিসেবে বিবেচনা করেন এবং অব্রে হত্যার দায়ে ম্যাকেয়ারকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন।
অব্রেকে আসলেই ম্যাকেয়ার হত্যা করেছিল কি-না এবিষয়ে আর কোন তদন্ত বা, বিচার হয়নি। সেই রাতেই ম্যাকেয়ারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
মন্টারগিসের পুরনো দুর্গের একটি ফায়ারপ্লেসের পাথরের গায়ে ম্যাকেয়ার-ড্রাগনের লড়াই দৃশ্য খোদাই করা আছে।
অব্রের কুকুরের কাহিনী জিন দ্য ল্যা ট্রেইলের ১৬০৭ সালের বই 'জিসকোর্স নোটাবেল দ্যস ডুয়েলস', ১৮৩৪ সালে উইলিয়াম জে থমাসের লিখা বই 'লেস এন্ড লিজেন্ড অব ভেরিয়াস নেশানস', ১৮৬১ সালে প্রকাশিত স্যামুয়েল গ্রিসওল্ড গুডরিচের 'অ্যা পিকটোরিয়াল হিস্ট্রি অব ফ্রান্স' বইতে পাওয়া যায়।
জ্যাঁ ভিসকার্ডির ১৯৩২ সালে লিখা 'ল্য সিয়েন দ্য মন্টার্গিস: এটিউড দ্য ফোকলোর জুরিডিক' বইতে প্রায় একই রকম ঘটনার ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, এই ঘটনার সময়কাল অষ্টম-নবম শতাব্দীতে সম্রাট শার্লেমাইনের সময়।
ম্যাকেয়ার-ড্রাগনের লড়াই ফ্রান্সে লোকমুখে এতটাই প্রসিদ্ধ যে ১৮১৪ সালে এর উপর একটি নাটক লিখা হয়।
মানুষ-কুকুরের এই লড়াই ঐতিহাসিক ঘটনা নাকি, শুধুই ফরাসী লোককথা এ নিয়ে বিতর্ক আছে। ঘটনাটি শার্লেমাইনের (চার্লস দ্য গ্রেট নামেও পরিচিত) সময়কার নাকি, পঞ্চম চার্লসের সময়কার তা নিয়েও বিতর্ক আছে। তবে, মন্টার্গিস শহরের পুরনো ও নটরডেম ক্যাথিড্রালের যাযকদের নথি থেকে ম্যাকেয়ার-ড্রাগনের লড়াইয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়।
অব্রের কুকুর সম্পর্কে শেষ যতটুকু জানা যায় তা হল, ম্যাকেয়ারের মৃত্যুদন্ডের পর যতদিন ড্রাগন বেঁচে ছিল, সে সিয়র ডি নারসাক ও তার পরিবারের সাথেই ছিল।
মন্তব্য
দারুণ লাগল
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
দারুণ। অনেকদিন পর লিখলেন। -রু
ব্যস্ততার কারণে সময় করতে পারি না।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ভালো লেগেছে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
পাগলা কুত্তার সামনে মানুষ ছাইড়া দিসে কেমুন হারামি
লেখা দারুণ হৈসে।
..................................................................
#Banshibir.
আসলেই হারামী।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
বাই দা ওয়ে, আছো কেমন?
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
হারামীপনায় ভারতীয়রাও কম যায়নি। মুঘল আমলে বিদ্রোহী বা খাজনা দিতে অক্ষমদের হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করা হতো। এটা ভারতের খুব পুরনো ট্রাডিশন। ভারতের ইতিহাসে বাঘ বা সিংহের খাঁচায় ছেড়ে দেবার ঘটনা বিরল নয়। কুকুরের পাল দিয়ে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাওয়ানোর ঘটনাও আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ঠিক বলেছ্নে।
মনুস্মৃতিতে কিছু অপরাধের শাস্তি হিসেবে হাতির পদপিষ্ট করার কথা বলা আছে।
দিল্লী সালতানাত, মুঘল, মারাঠা, রাজপুতরা হাতির পায়ে পিষ্ট করে বিদ্রোহী, শত্রু সৈন্যদের হত্যা করত।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
খাঁটি কথা। মোগল আমলে মাথা ফাটানোর হাতিদের আলাদা ট্রেনিং দেয়া হত, তারা নানা খেলাধূলা করতো বন্দীকে নিয়ে। বন্দীর হাত থাকত পিছমোড়া করে বাঁধা, সেই হাত শুঁড় দিয়ে তুলে পা তুলে ভয় দেখাত হাতি। এইসব ছিল বাদশাদের মহা আমোদের বিষয়। একবার আকবরের আমলে তিনি নির্দেশ দেন হাতি যেন মাথা না ফাটায়, কেবল খেলাধূলা করে। পাঁচদিন ধরে চলে ঐ খেলা, বন্দী তো ভয়েই আধমরা! লুল বাদশা জাহাঙ্গীর নিয়মিত হাতির তলে মাথা ফাটানোর আসর বসাতেন পাত্রমিত্র নিয়ে।
ইবলিশের বাচ্চা একেকটা।
..................................................................
#Banshibir.
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
রাজাকারদের জন্য এরকম একটা কুত্তাচালানের ব্যবস্থা করা যায় না?
অতি উত্তম প্রস্তাব।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
সহমত।
--- ঠুটা বাইগা
@ লীলেনদা: চিন্তা করতেই পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছি
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
#অন্যরকম ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছি, ধন্যবাদ আপনাকে।
#ভাল থাকুন সবসময়
______________________________
একটি শালিক উড়ে বেড়ায় বিশাল আকাশ জুড়ে
আজ ফিরতে ব্যাকুল সে শালিকটি
পথ হারানো নীড়ে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
মজার কাহিনি তো!!
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ভালো লাগল।আমাদের একটা পোষা কুকুর ছিল যেটা এই গল্পের ড্রাগনের মত।
বাহ্! আপনি তো বেশ সৌভাগ্যবান।
পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
গল্পটাতে কেমন যেন একটা রূপকথা রূপকথা ভাব আছে,অনেক ভাল লাগল
গপ্প কি বলছেন মশাই!
এ যে খাঁটি সত্য!!
পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
হা!!হা!!
দুঃখিত মশাই।
এই খাটি সত্য কাহিনী (গপ্পো) টার কথাই বলছিলুম আর কি
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
হুম... বিচিত্র দুনিয়া...
পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
অনেকদিন পরে হলেও লিখলেন অন্তত। ভাল লেগেছে, নতুন কিছু জানা হলো।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
আপনার লেখার বিষয়বস্তু বেশ অন্যরকম।
চমৎকার লাগল
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
...অথচ মানুষের বিশ্বস্ততা প্রশ্নবিদ্ধ!
লেখাটা ভালো লাগলো, রাজামশাই।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
সেটাই; মানুষের বিশ্বস্ততা প্রশ্নবিদ্ধ।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
নতুন মন্তব্য করুন