আকাশের সাথে আমার পরিচয় হয় বুয়েটে ভর্তির সময়ে। লিখিত ভর্তি পরীক্ষার পর নির্বাচিত ছাত্রদের শারীরিক পরীক্ষার সময় মেডিকেল সেন্টারে তার সাথে প্রথম দেখা। সবাই যখন ডাক্তারের কাছে যাবার অপেক্ষায় বসে আছি এমন সময় ঝড়ে ভেজা কাকের মত একটা ছেলে অপেক্ষাগারে ঢুকলো। আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাই। ছেলেটার চুল উস্কো-খুস্কো, শার্টে অসংখ্য দাগ, মলিন একটা প্যান্ট পরেছে সে। একটু পরে যখন সে বুঝতে পারে যে তার মোটেও দেরী হয়নি বরং তার ক্রম আসতে আরও অনেক দেরী; তখন সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটা চেয়ারের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু বসবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারে না; হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে সে ইতঃস্তত পায়চারী করতে শুরু করে।
আমি উৎসুক চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। ছেলেটি বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার লিখিত পর্বে উত্তীর্ণ হয়েছে, কাজেই তাকে গবেট মনে করতে পারছিলাম না। কিন্তু তার চলাফেরার ভঙ্গিতে চরম হতাশা আর সন্দেহের আভাস খুঁজে পাচ্ছিলাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে ভুল করে এখানে এসে পড়েছে, অথবা তাকে জোর করে এখানে পাঠানো হয়েছে। আমি ধীরপায়ে এগিয়ে তার কাছে যাই ও পরিচিত হবার চেষ্টা করি। চরম অনিচ্ছার সাথে সে জানায় তার নাম আনোয়ারুল পারভেজ আকাশ, বাবা-মার ইচ্ছাতে সে বুয়েটে প্রকৌশল পড়তে এসেছে, কিন্তু সে চেয়েছিলো পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে। এরপর সে চুপ হয়ে যায়।
ডাক্তারের ক্রম এলে আমি আরও একবার অবাক হই, আকাশ নামের এই বিভ্রান্ত ছেলেটির মেধামান আমার ঠিক আগে। আমি ধরেই নিলাম যে আমাদেরকে একই বিভাগে পড়তে হবে এবং সে কারণে তার সাথে খাতির জমানোর জন্য আরেক দফা চেষ্টা করি। কিন্তু সে আমাকে এড়িয়ে যায়, তার নাকি কথা বলার মত মানসিকতা নেই। তার হাবভাব দেখে তখন আমি আর ঘাঁটালাম না। ভাবলাম তার সময় দরকার নতুন জীবনের পথে মানিয়ে নিতে।
তো যাই হোক, পাশাপাশি মেধা-মান অবস্থান হওয়ায় ডাক্তারের কক্ষে যাবার জন্য আমরা একই সারিতে যাচ্ছিলাম। দেখলাম পাশাপাশি চারটি কক্ষে চারজন ডাক্তারের নামফলক। আমাদের থেকে চারজন ছাত্রকে আলাদা আলাদা কক্ষে প্রবেশ করানো হলো। এক সময় আমার পরীক্ষণ শেষ হয় ও বাইরে বেরিয়ে আসার পরে আমি উৎসাহী চোখে আকাশকে খুঁজি, তবে ক্লাস শুরু হবার আগে আর তার সাথে দেখা হয়নি। এর মাঝে আমি নিজেকে বুয়েটের হবু ছাত্র হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করি। স্বপ্নে ভাবি কত কিছু গবেষণা করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছি; আর এরই মধ্যে ক্লাস শুরু হবার তারিখ কাছে এসে পড়ে...
বুয়েটের প্রতিটা টার্মের ক্লাস হয় সপ্তাহ হিসেবে এবং সাধারণত সপ্তাহের হিসেবটা শনিবার থেকেই শুরু ধরা হয়। আমাদের বুয়েট জীবন শুরু হয় ২০০৬ সালের ২৮ জানুয়ারী, শনিবার। সেদিনের স্মৃতি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। ক্লাস ছিলো সকাল আটটায়। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বুয়েট পৌছে ক্লাসরুম খুঁজতে শুরু করি। জানতে পারলাম ক্লাস হবে ওএবি-তে দোতালায়। বুঝতে না পারলেও সে দালান খুঁজতে থাকি ও একসময় বুঝতে পারি এটা হলো ওল্ড-একাডেমিক-বিল্ডিং। এ দালানের নামকরণের সার্থকতা যাচাই করতে গেলে অনায়াসেই করা যায়। এমন রহস্যময় বাড়ী আমি বোধহয় জীবনেও দেখিনি। সে প্রসঙ্গে আরেকদিন কথা বলা যাবে।
ক্লাস ছিলো ২৪৯ নাম্বার রুমে, যেটা সহজেই খুঁজে পাই। তবে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সাথে সাথেই প্রথমে বাথরুম ও তার পরেই মেয়েদের বিশ্রাম কক্ষ চোখে পড়ে। আমার পাশে আরও কয়েকটা ছেলে যাচ্ছিলো, তাদের হাস্যরস শুনে আমার মুখেও একটু মুচকি হাসি এসেই পড়ে। শেষ পর্যন্ত সময়মতই ক্লাসরুমে পৌঁছাই। পদার্থবিজ্ঞান কোর্স এর মাধ্যমে আমাদের বুয়েট জীবন শুরু হয়। ততদিনে আমি আকাশের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছি, তাই তখনও জানা ছিলো না যে সে আমার বুয়েট জীবনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হতে চলেছে, তবে শ্রেষ্ঠ বন্ধু কিনা সে প্রসঙ্গে আরেকদিন কথা হবে।
.
(আশা করি চলবে...)
মন্তব্য
আমি তোরে আর ভালা পাইতেসিনা। ক্লাসেতো ঢুকতে পারতি! ফাজিল না জানে কোনহানকার!... :|
------------------------------------------------
চাঁদের আলো আজ যদি ভাল লাগে, কাল হয়ে যায় ঝাপসা...
আমার এ তরী, যদি চলে যায়, ফিরে আর আসবেনা।
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
ভালা পাইয়া লাভ নাই আপু, আমার লেখা তো প্রথম পাতায় প্রকাশই করে না... পরের পর্ব আদৌ লিখমু কিনা ভাবতাছি। আকাশের গল্প শুনতে চাইলে বুয়েটে আইসো, পরিচয় করাই দিমুনে...
______________________________________
বৃষ্টি ভেজা আকাশ
______________________________________
লীন
নতুন মন্তব্য করুন