এক
মুনীর চৌধুরীর "কবর' নাটকটি মঞ্চে প্রথম দেখি সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়। তখনো এর পেছনের ইতিহাস ভালো করে জানি না। শুধু জানি ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা এই নাটক। কিন্তু তখনো জানি না, ৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট ভ্রাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালানোর প্রতিবাদ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী। প্রতিবাদ করার অপরাধে জেলে পাঠানো হয় তাঁকে। প্রায় বছর খানেক কারাবাসের সময়ে সহবন্দীদের অনুরোধে জেলে বসেই তিনি লেখেন একুশের প্রথম প্রতিবাদী নাটক "কবর'। আর সে নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় কারাগারের ভেতরে, হারিকেনের আলোয়। নাটকের কুশীলব ছিলেন মুনীর চৌধুরীর সহবন্দীরাই। এই তথ্যটুকু অজানা ছিল, তবুও "কবর' নাটকের মধ্যে দিয়েই আমার মঞ্চের প্রতি আগ্রহের সূত্রপাত।
"কবর'-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন মদ্যপ নেতা। মিছিলে গুলিবিদ্ধ লাশেদের যেখানে গণকবর দেওয়া হয়েছিল, রাতের অন্ধকারে নেতা সেখানে গিয়ে দাঁড়ান। একসময় তাঁর মনে হতে থাকে সব লাশেরা যেন কবর ছেড়ে উঠে আসতে চাইছে, তারা আর কবরের ভেতর থাকতে চাইছে না। নেতা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে উঠে আসা লাশেদের কবরে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন, কিন্তু গুলিবিদ্ধ সেইসব লাশেরা কবরে ফিরতে চায়নি, তারা অন্য লাশেদের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছে, তারা মিছিলে যেতে চেয়েছে। সারিবদ্ধভাবে যেতে যেতে তারা উল্লাস করছিল যে তারা মিছিলে যাবে, সে মিছিলে আবারও গুলি চলবে।
নাটকের আবহ সঙ্গীতে গুলির শব্দ ছিল, রাষ্ট ভ্রাষা বাংলা চাই বলে স্লোগান ছিল। সেই স্লোগান আর গুলির শব্দে ভর করে, সত্যিকার অর্থে - সেই প্রথম একুশের চেতনা - দর্শকের সারিতে বসে থাকা আমি, ও আমার মতো আরও কিছু কিশোরের হদৃয়ে প্রবেশ করেছিল। রক্তের মধ্যে ঝনঝন করে বেজে উঠেছিল "অমর একুশে'।
দুই
আজ প্রায় ৫৪ বছর পরে সেদিনের ইতিহাস প্রায় সবটুকুই আমাদের জানা। অমর একুশের দিনে শ্রদ্ধাভরে শহীদদের স্মরণ করাটা আজ আমাদের জাতীয় চেতনার অংশ।
কিন্তু সেদিনের কথায় যাবার আগে ২০ তারিখের কথা আমরা একটু সময় নিয়ে ভাবি। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ জারি হয়েছে মিছিল করা যাবে না। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা সে বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন। তাঁরা জানতেন, সে মিছিলে পুলিশি হামলা হতে পারে, টিয়ার শেল ছোঁড়া হতে পারে। এমনকি আইন অনুযায়ী গুলি করার নির্দেশ দিতে পারে সরকার। তবু কোন সাহসে তাঁরা সেদিন অবলীলায় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন? শুধুমাত্র ভাষার প্রতি ভালোবাসায়? শুধুমাত্র বাংলা ভাষার জন্য ভালোবাসা তাঁদেরকে সাধারণের চেয়ে উর্ধে নিয়ে গিয়েছিল?
তখনও পৃথিবী কি আশ্চর্য রকমের সুন্দর ছিল, মানুষ নি:স্বার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারত অপরের জন্য, ভাষার জন্য, দেশের জন্য। আজ এতদিন পরে বুকের ভেতর দেশপ্রেম বলে যে একটা বায়বীয় অনুভূতি টের পাই, যার প্রায় কোনও গুরুত্বই নেই আমাদের কাছে, টেনে নেওয়া নিশ্বাসের মতন সে অনুভূতি রক্তে এমনকি এক বিন্দু অক্সিজেনেরও জোগান দেয় না, মাত্র অর্ধশতাব্দী আগে সে অনুভূতি কেমন করে এতগুলো মানুষকে কি অসম্ভব বলীয়ান করে তুলেছিল, যে, তাঁরা জীবন দিতেও দ্বিধা করেননি!
ধরে নিন আজ ২০ ফেব্রুয়ারি। আজ রাতে ঘুমোবার আগে ভেবে নিন, কাল আমরা মিছিলে যাব। সালাম বরকত আর রফিকের পাশে হাঁটব।
-----------
সংক্ষেপিত এবং পরিবর্তিত।
মূল লেখা: বাংলালাইভ।
মন্তব্য
আমি যখন কবর নাটকটা পড়েছিলাম, অতটা বুঝিনাই, অতোটা ভালও লাগে নাই। কিন্তু একাদশ শ্রেনীতে পড়ার সময় মঞ্চনাটক প্রতিযোগীতাই এই নাটকটি দেখে এতো মুগ্ধ হয়েছিলাম, বলার মতো না।
রায়হান আবীর
কবর নাটক নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাটাও অনেকটা সেরকম।যখন পাঠ্য ছিল তখন শুধু কাহিনীটুকুই জানতাম।কাহিনীর আড়ালের কাহিনীটা জেনেছি অনেক পরে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে রায়হান আবীর এর মত আমার কলেজেও একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় কলেজ অডিটোরিয়াম এ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল।অসম্ভব ভাল লেগেছিল দেখে।
আর মুনীর চৌধুরীর লেখার সংস্পর্শে আসাও এই নাটকের হাত ধরেই।
-স্বপ্নাহত
হুম। আপনাদের দুইজনের মতই অবস্থা আমারও। কম্পিটিশানের সময়েই প্রথম দেখি নাটকটা। আমাদের বাংলার টিচার ছিলেন তখন আবু মুহম্মদ রইস স্যার। জটিল রকম সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ। পুরো নাটকটা ওনার ডিরেকশানে বাস্তব হয়ে উঠেছিলো মঞ্চের ওপর। এখনো মাথায় গেঁথে আছে সব দৃশ্যগুলো।
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
কনফু'স ক্লাসিকস।
এখনো পারে এমন মানুষ বিরল নয় বোধহয়। অন্তত আমি তাই বিশ্বাস করতে চাই।
লেখাটা খুব স্পর্শ করলো।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন