ক্লাশের ভেতরে উৎকট শব্দে হঠাৎ চমকে উঠলাম। বিরক্ত অনেকগুলো মুখের সাথে আমিও শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করি, সবাই ভ্রু কুচকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কি মুশকিল! এই বোরিং লেকচার শুনতে শুনতে কখন যে ঝিমুনি এসে গেছিলো টেরই পাই নি, চট করে পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল ফোনটা বের করলাম, শব্দটা হচ্ছে ওখান থেকেই।
মেসেজ এসেছে। সেই মেসেজের প্রথম চারটে শব্দ পড়ে আবারো চমকালাম, " হ্যাপী বার্থ ডে দোস্ত"। কয় কি! তারিখ তো ঠিকই আছে, কিন্তু মাস কি সেপ্টেম্বর চলে এলো নাকি? মে- কই গেল তাহলে? জুন জুলাই অগাষ্ট?
কিন্তু তারপরেই মনে পড়লো, উরিশশালা! আজকে ১২ই মে। আজ তো আমাদের সবার জন্মদিন!
দিন-মাস-বছর হিসেব করতে গিয়ে অবাক লাগলো। চোদ্দ বছর পেরিয়ে গেছে এর মাঝে! বাসায় ফিরে ফেইসবুকে কথা চালাচালি, জিমেইলে, ফোনে- সব বন্ধুদের বহুদিন বাদে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাংগানো চললো বেশ অনেকক্ষণ।
চোদ্দ বছর আগে, ১৯৯৪ এ, চাঁদে মানুষ যাবার প্রায় বছর পঁচিশেক বাদে আমরা একান্নজন নীল আর্মষ্ট্রং ১২ মে দুপুর বেলায় কুমিল্লা শহরের কাছেই কোটবাড়িতে আমাদের ছোট্ট সুন্দর কলেজে প্রথম পা রেখেছিলাম। সপ্তম শ্রেণীতে পড়া ছোট ছোট মানুষদের লিটল স্টেপস দিয়ে বাবা-মায়ের জায়ান্ট স্বপ্ন পূরণের প্রথম চেষ্টা!
আজ সেই পুরনো ছবিগুলো আবার দেখলাম বসে বসে, আমার সত্যিই কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, এতগুলো দিন কেটে গেছে এর মাঝে। সময় সত্যিই পলক ফেলার আগেই যেন দৌড়ে চলে যায়। মাঝের এতগুলো দিন, মনে হচ্ছে শীতের দুপুরের খুব আরামদায়ক একটা ভাত-ঘুমের চেয়ে খুব লম্বা সময় তো নয়, এতই দ্রুত কেটে গেল।
প্রথম দিন- নিজের নাম বলে বলতে হয়েছিলো- "আমি তোমার ক্লাশমেট, তোমার নাম কি?" সেই "ক্লাশমেট" থেকে একটু একটু করে আমরা এতগুলো ছেলে কেমন করে যে প্রাণের "বন্ধু" হয়ে গেলাম, নিজেরাও জানি না।
যতবারই ভাবি, কিছু একটা লিখি সেই ছয় বছর নিয়ে, আমার জীবনের সামার অব সিক্সটি নাইন সময়গুলো- নিঃশ্বাস আটকে আসে। সত্যিই মনে হয় লিখতে লিখতে মহাকাব্য হয়ে যাবে, তবু বলার কথা শেষ হবে না। চেনা নেই জানা নেই, একান্নটা ভিন্ন পরিবার থেকেঠিক সমান সংখ্যক ভিন্ন মন নিয়ে এসে একসাথে আমরা একান্নবর্তী পরিবার হয়ে গেলাম যেন। দিন রাতের পুরোটা সময় একসাথে খাওয়া-বসা-পড়া, নিঃশ্বাসের বাতাসটুকুই শুধু নয়, এতগুলো কিশোর ছেলে-পেলে আমরা নিজেদের স্বপ্নটুকুও ভাগাভাগি করে নিতাম। আহা, "শেয়ারিং" শব্দটার ঠিক অর্থ নিজের জীবনে বুঝতে চাইলে কেউ যেন আমাদের কলেজে পড়ে।
বন্ধুত্ব ছিলো, স্বপ্ন পূরণের স্বপ্ন ছিলো, আবার রাজনীতিও ছিলো ওখানে, পেয়েছি বিশ্বাসঘাতকতার তিক্ত স্বাদ। জীবনের ঐ ছোট্ট সময়টুকুতে আমরা যেন ঠিক আরেকটা জীবন কাটিয়ে এসেছি।
"৯৪ এর পরের প্রতিটি বছর আমরা ১২ইমে উদযাপন করেছি আমাদের ব্যাচের জন্মদিন হিসেবে। কলেজের নিয়মের বেড়াজালে থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে, খানিকটা সিনিয়র হবার পরে সীমাবদ্ধ আড়ম্বরে।
কলেজ ছেড়ে বেরিয়েছি আজ আট বছর হতে চললো, মাঝের প্রতিটা বছর ঠিক এই দিনে একইভাবে নিজেরা নিজেদের উইশ করেছি। বের হবার পর প্রথম ক"বছর কাছাকাছিই ছিলাম, হয়তো রিক্সা বা বাসের দূরত্বে। ধীরে ধীরে বাড়ল সেটা, গড়ালো মুঠোফোনে। লম্বা সময় বাদে এখন যোগাযোগের মাধ্যম কেবলই ইন্টারনেট। জিমেইলের বাহন চড়ে, অথবা অধুনা ফেইসবুক, দূরত্বের মাপকাঠি এখন রিক্সাভাড়া নেই, হয়ে গেছে অপটিক্যাল ফাইবার। তবু একসময় ভোরের কুয়াশা সরিয়ে একসাথে পা মিলিয়ে যাদের সাথে পা ফেলতাম, যাদের সাথে একসময় নিজের হৎস্পন্দনও বাঁধা ছিলো একসুরে, প্রাণের সেই বন্ধুদের আজ ভীষণ মিস করছি। খুব খুব খুব।
দোস্তরা, ভাল থাকিস, শুভ জন্মদিন তোদের সবাইকে।
শুভ জন্মদিন, আমাদের সবাইকে।
মন্তব্য
আমাদের জন্মদিন হলো ৩০শে এপ্রিল। ১৩ বছর আগে পা রেখেছিলাম সমুদ্র আর পাহাড়ে ঘেরা চত্বরে। এর মধ্যে কতদিকে ছড়িয়ে পড়েছে সবাই। কিন্তু কেউ ভুলিনি একে অন্যকে জন্মদিন উইশ করতে...
ক্যডেট কলেজ ব্লগ দেখলাম নিজেদের ডোমেইন নিয়েছে। ভালো লাগল দেখে
ইয়ামিন,
অনেক ধন্যবাদ।
হু, নিজেদের সার্ভারে নিজেদের ডোমেইন নিয়েছে। বেশ খুশীর খবর।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
আমাদেরটা ৩রা জুন।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন মন্তব্য করুন