কদিন আগেই ঘাড়ের ব্যথায় কাতর হয়ে দু’দিন ধরে বাসায় শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছিলাম। অনেকদিন ছুটি নেয়া হচ্ছিলো না জগৎ-সংসার থেকে, মহামতি ঘাড়-ব্যথা আমাকে তাই বাধ্যতামূলক ছুটির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো, আর আমি বসে বসে পুরনো অসুখের দিনগুলোর কথা জাবর কাটছিলাম।
কলেজ-হোস্টেলে থাকবার সময় অসুখ বিসুখ বাধিয়ে ফেলাটা দস্তুরমতন সুখকর ছিলো। বেশ কয়েকদিনের জন্যে পিটি-প্যারেড-গেমস থেকে মুক্তি, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? সেই সক্কাল ভোরে বিছানা-বালিশকে অনাগত বউয়ের মতই জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করতো তখন, মনে-প্রাণে জপতে থাকতাম "এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে," তবু হায় বেরসিক বাঁশীর ডাকে সেই ঘুম ভেঙে উঠে কলেজ মাঠে চক্কর লাগাতে হতো। যন্ত্রণার একশেষ!
ক্লাস সেভেনের শেষের দিকে পক্স বাঁধিয়ে একবার এইরকম লম্বা আরামে ছিলাম। আরেকবার দুনিয়ার সবার উপর বিরক্তিতে না খেয়ে খেয়ে হিমোগ্লোবিন কমিয়ে ফেলেছিলাম অনেক, শেষে ড্রাকুলা হয়ে ক্লাসমেটদের কাছ থেকে রক্ত খেয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম। অনেকদিন তখন সিএমএইচে থাকতে হয়েছিলো, সেটাও একটা অভিজ্ঞতাই বটে, কিন্তু সে আলাপ পরে। আজ বলবো অন্য এক দিনের কথা।
কোন এক গরমের সকাল ছিলো সে দিন। ঘন্টা দেড়েকের দুর্বিষহ পিটি শেষে গোসল করে আমার রুমে ফিরেছি, আমার বিছানা ছিলো জানালার পাশেই। রাতে জানলা লাগিয়ে ঘুমিয়েছিলাম, এখন সকালের নাশতা খেতে যাবো, দেরি হয়ে গেলে শাস্তিও খেতে হবে ডেজার্ট হিসেবে, তাই তাড়াহুড়োয় খুলতে গিয়ে দেখি জানলাটা এঁটে বসে আছে টাইট হয়ে, কোনমতেই খুলছে না। রাগের মাথায় কাঁচের উপর দিলাম এক ঘুষি। তাতে কাজ হলো ঠিকই, জানালা খুললো, কিন্তু সেই সাথে কাঁচ গেলো ভেঙে, আর অবধারিতভাবে আমার হাতও কেটে গেলো! আমার রুমমেটরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আমার হাত থেকে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে, এক্ষুণি হাসপাতালে দৌড়াতে হবে, আর আমি তখনো টাওয়েল পড়া। কোনমতে হাফপ্যান্ট গলিয়ে হাত চেপে ধরে দে ছুট! এক ছুটে সোজা ক্যাম্পাসের ভেতরের হাসপাতালে!
হাসপাতালে তখন ছিলেন সঞ্জুদা। ভাল নাম সঞ্জয়, আমাদের মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট। উনি আমার হাতের রক্ত দেখে দিলেন এক চিৎকার। সঞ্জুদা হিন্দু ছিলেন, তবু কেন জানি উত্তেজিত হয়ে গেলেই উনি আল্লাহ আল্লাহ করতেন। আমাকে নিয়ে গেলেন পাশের কেবিনে। ডেটল লাগিয়ে রক্ত মুছছেন, আমি ব্যথায় কঁকিয়ে উঠি, আর তখন উনি আমার চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন ‘আল্লা আল্লা আল্লা’ করে, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার চিৎকার যায় থেমে!
এদিকে অনেক মুছেও রক্ত থামছে না দেখে উনি সিদ্ধান্ত নিলেন, উপায় নেই, স্টিচ দিতে হবে। আমি শুনে ঢোঁক গিললাম, জীবনেও এর আগে সেলাই টেলাই করতে হয় নি।
উনি খানিক খুঁজে টুজে বাঁকানো একটা ভয়ংকর দর্শন সুঁই নিয়ে হাজির, সেইটা দেখে অবধারিতভাবে মাছ ধরার বড়শির কথা মনে পড়ে যায়। আমি তা-ই দেখে কাতলা মাছের মত খাবি খেতে লাগলাম!
তখন হাসপাতালে আরও ভর্তি ছিলেন আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র মুহী ভাই, আমার চিৎকার শুনে তিনিও ততক্ষণে চলে এসেছেন।
আমি ভাবলাম, সেলাই যেহেতু করবে, নিশ্চয়ই আগে এনেস্থেশিয়া দিয়ে নিবে।
কিন্তু কীয়ের কি, সঞ্জুদা মুহী ভাইরে বললেন, ‘মুহী, এক কাজ করো, শক্ত কইরা ওর হাতটা চাইপা ধরো!’ আমি বলি, খাইসে আমারে। সঞ্জুদারে মনে হলো যেন ছুরি হাতে উদ্যত কুরবানীর হুজুর! সেই সাথে উনার মুখের সার্বক্ষণিক আল্লা আল্লা কুরবানীর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে বাজা শুরু করলো।
তো মুহী ভাই শক্ত করে হাত চেপে ধরলেন। সঞ্জুদা সেই বিকটদর্শন সুঁই নিয়ে আমার হাতের চামড়ায় দিলেন খোঁচা! ব্যথায় আমি দিলাম চিৎকার, আর উনি আমার চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন, আল্লা আল্লা আল্লা! কি মুশকিল! জুৎমতন চেঁচাতেও পারি না!
দ্বিতীয় বার সুঁই ফোঁটাতে গিয়ে ওনার বেশ কসরত করতে হলো, বিরক্ত মুখ করে সঞ্জুদা বললেন, ‘মিয়া, তোমার হাতের চামড়া এতো শক্ত ক্যান!’ আমি তো হাঁ। বলে কি এই লোক!
শেষমেষ বহু কায়দা করে উনি সেই শক্ত চামড়া ভেদ করে সুঁই ফোটালেন, আর তারপরেই দিলেন জিভে কামড়। বললেন, ‘সর্বনাশ!’ আমি ভয়ার্ত চোখে ব্যথা ভুলে তার দিকে তাকালাম, ‘কি হইছে?’ উনি হতাশ হয়ে মাথা দুইপাশে নাড়াতে নাড়াতে বললেন, ‘ ভুল হয়া গ্যাছে, ভুল জায়গায় ফুটা করে ফেলছি, বের করে আবার নতুন করে করতে হবে!’
আমি তখন পাথর! কয় কি! রাগে দুঃখে বাংলা সিনেমার জসীমের মতন এক চিৎকার দিলাম, ‘ইয়াআআআআ সঞ্জুদা! ডিশুম!’
নাহ, ডিশুমটা বাস্তবে না। কিন্তু মুহী ভাই সে দিন আমার হাত না ধরে থাকলে সেটা যে বাস্তবেও হয়ে যেত, কোন সন্দেহ নাই!
শেষমেষ উনি তিনটা সেলাই দিয়ে থেমেছিলেন।
এই লেখা টাইপ করতে করতে বার বার চোখ চলে যাচ্ছে হাতের কাঁটা দাগটার উপরে, আর সেদিনের কথা মনে করে কেবলই হেসে ফেলছি!
কি একটা আজব সময়ই না কাটিয়ে এসেছি তখন।
মন্তব্য
মনে হলো ক্যাডেট কলেজে ছিলেন। ... আমাদের অনেক স্বাধীনতা ছিল "সিভিলিয়ান" কলেজগুলোতে।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
পড়ে বেশ ভালো লাগলো। আপনাকেও জানা হলো অন্য আলোয়।
পরশ পাথর
প্রথম বাক্যের জন্যে ধন্যবাদ।
পরের বাক্যের জন্যে একটু ভয় খাইছি!
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
দারুণ স্মৃতি চারণ!! পড়তে পড়তে আমিও হেসে উঠলাম!
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
হায় হায়!! এই লাইভ সেলাই এর কথা শুনেই গা শির শির করছে
সঞ্জুদার কথা খুব মজা লাগল অনেক আরো লিখেন এমন স্মৃতি, খুব ভাল লাগল।
-------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
স্মৃতির বেশ কয়েকটা ঝুড়ি জমিয়েছি জীবনের এতগুলো সময়ে। তার মধ্যে এই ঝুড়িটাই যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সন্দেহ নেই।
এই ভয়েই এতদিন খুলতাম না, আর বন্ধ হবে কি না কে জানে!
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
খাইছে আমারে! জিনালায় ঘুষি মারছেন!!!
ঈশ্বরাসিদ্ধে:
অজ্ঞাতবাস
হু, খুব খিয়াল কইরা মারার চেষ্টা করছিলাম, লাগে নাই।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ঃ)
অনেকদিন আগে অন্য কোথাও কনফু'কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার লেখায় ক্যাডেট জীবনের গল্প কেনো আসে না।
কনফুসিয়াস একটা উত্তরও দিয়েছিলেন, আমার ভালো লেগেছিল সে উত্তর।
এবার আমি মুচকি হাসছি এখন
কথা কিন্তু এখনো বলবৎ আছে।
এডিশনাল হিসেবে আপনার জন্যে মুমু-র মন্তব্য দ্রষ্টব্য।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
এখন পুরোপুরি সুস্থ তো? ভাল থাকবেন।
একশ ভাগ সুস্থ। :)এই লেখাটা কিন্তু প্রায় মাসখানেক পুরনো।
ধন্যবাদ।
(অফটপিকঃ আপনার ফ্যামিলি-ছবি দেখে মনে করতে চেষ্টা করলাম আশে পাশে কোথাও আপনাদেরকে দেখেছি কি না। মনে হয় দেখি নি, দেখলে অন্তত আপনার লিটল প্রিন্সেসটাকে নিশ্চিত মনে থাকতো!)
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ক্যাডেট কলেজের পোলাপাইন স্কুল কলেজে থাকতে চরম বাঁদর থাকে, পরে সম্ভবত সিভিলিয়ানদেন তুলনায় ভদ্র হয়ে যায়।
কলেজে আমার একবার আংগুল কেটেছিলো পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময়; তা ও আবার অনামিকা। সেলাই এখন পর্যন্ত দেয়া লাগে নি। সুঁই দেখলেই ফিট খাই।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
আমি কখনই বাঁদর টাদর ছিলাম না। চিরকালই ভাল পোলা।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
- তোয়ালে পরেই দৌড়টা দিতেন!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নাথিং নিউ ব্রো।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
প্রিয় কনফু,
তোর লিখাটা পরে পুরনো কথা মনে পরে গেল। তোর লিখার সময় তা মনে করতে পারছি না। অনেক পরাধীণতার মাঝেও আমাদের নিজেদের বানানো স্বাধীণতার কথা মনে পরে যায়। এখনও সেই দিন গুলোএ মনে হয় অনেক তাজা। মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। ঠিক ই বলেছিস, একবার সেই খাচার মুখ খুললে আর থামবে না।
সঞ্জুদা র খাবার খাওয়ার কথা গুলো মনে আছে?
নাঈম,
এইখানে তোর কমেন্ট দেখেই আমি টাস্কি। অনেক থ্যাংক্স দোস্ত।
সন্জুদার কথা ক্যামনে ভুলি!
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
হাহাহা
গত রোজায় ব্যাচের টি শার্টের অর্ডার দিয়ে বঙ্গবাজার থেকে ফিরছিলাম রিকশায়... চানখারপুলের সামনে বাজে জ্যামে প্রায় ঘন্টাখানেক আটকা পড়েছিলাম তিনজনে এক রিকশায়। একেবারে শেষমুহূর্তে জ্যাম প্রায় ছেড়ে যাচ্ছে যখন হুট করে একটা বাস এসে আমাদের পথে দাঁড়িয়ে যায়... রিকশাওয়ালা মহা উত্তেজিত হয়ে হাত দিয়ে বাস সরাতে চাইছিলো বোধহয়। দড়াম করে বাড়ি বসায়ে দিলো বাসের জানালায়... গ্লাস তো ভাংলোই, তার ও হাত কেটে একাকার... পরে খেপা লোকজনের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়ে কিছু টাকা বাড়তি টাকা খসিয়ে আমাদের রিকশা ছাড়তে হলো। সেই বিশ মিনিটের রাস্তায় এক ঘন্টা জ্যামে নষ্ট করে শেষমেশ হেঁটেই হলে ফিরতে হয়েছিলো আমাদের।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
নতুন মন্তব্য করুন