জুবায়ের ভাই...

কনফুসিয়াস এর ছবি
লিখেছেন কনফুসিয়াস (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/০৯/২০০৮ - ১১:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অর্ধেকটা জীবন পেরিয়ে এসে আত্মীয়-অনাত্মীয় নানা জনের বিদায়ে শোকাহত হয়েছি, কিন্তু বন্ধু বিয়োগের ব্যথা এই প্রথম পেতে হলো। অনেক দিন বাদে আজ কারো বিদায়ে তীব্র কষ্ট হচ্ছে, হু হু কান্নায় ভরে যাচ্ছে চোখ।

সচলায়তনের পাতা উলটে পুরনো লেখায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি, কেমন করে বিশ্বাস করি এত প্রাণবন্ত লেখাগুলোর পেছনের মানুষটা এখন আর নেই!
ব্যক্তিগত মেসেজে যেটুকু আলাপ, খুঁজে খুঁজে পড়ছি বারবার, আর চোখ ভিজে আসছে কেবলই।

সচলের পাতায় কার যেন কোন একটা গল্পে আদর করে ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন কিছু। আমি একদম পেয়ে বসি তারপরে, বললাম, এই প্র্যাকটিসটা চালু রাখা দরকার, আপনি নিয়মিত করুন এই কাজটা। হেসে আমাকে মেসেজ দিলেন, আমি কি তবে কানাই মাস্টার? তবে কখনোই তাঁর কথায় মাস্টারি ছিলো না কোন কালে, এত বড় একটা মানুষ, তবু কি অদ্ভুতভাবে কেবলই একজন ভাল বন্ধুর মতন মন্তব্য করতেন প্রতিটি লেখায়।

সচলে আসা তার একটা উপন্যাসের খুব কড়া সমালোচনা করেছিলাম একবার। আর কেউ হলে ওরকম কঠিন করে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারতাম কি? মনে হয়, না। জুবায়ের ভাই বলেই পেরেছি। এবং শান্তি পেয়েছি তার প্রতিক্রিয়া পড়ে, তিনি ভীষণ খুশি এরকম সমালোচনায়- মন্তব্যে পাঁচ তারা দিতে চাইলেন!

আমাকে ফাঁকিবাজ বলেছেন বেশ কবার, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তাঁর অনেকগুলো সিরিজ লেখা পড়তে পড়তে মাঝপথে থেমে গেছি, মন্তব্য করবো বলে মেসেজে জানিয়ে আর করিনি, সময় পাইনি নানা কারণে। আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, আমি সময়ের দোহাই দিতেই প্রশ্রয় দিয়ে বলেছেন, ঠিকাছে। বেশ কদিন আগে আমার ঝুম্পা লাহিড়িকে নিয়ে লেখা পোস্টটায় জানালেন, ঝুম্পার গল্প নিয়ে কিছুমাত্র দ্বিমত নেই আপনার সাথে, আমার কথাগুলোও আপনি বলে দিয়েছেন। আমি তাঁকে ধরলাম এবার ফাঁকিবাজ বলে, বললাম, এ কথা বললে চলবে না, আপনার পোস্টও পড়তে চাই।
কিন্তু জুবায়ের ভাই এবার সত্যিই ফাঁকি দিয়ে গেলেন!

সচলায়তনের শুরুতে মনে আছে, কোন কোন বিষয়ে তর্ক হতো তখন। সে সময়গুলোয় জেনেছি তিনি বেশ একরোখাও আছেন। তারপরে দিন যেতে থাকলে, ক্রমশ সচলায়তনের সবচেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন হয়ে যান তিনি। চাইলেই পরামর্শ পাওয়া যেত যে কোন বিষয়ে, নিজে থেকে খবর নিতেন কোথাও কোন সমস্যা হলেই। সবসময়ে বন্ধুর মত পাশে থেকেছেন।
আমার গল্পগুলো নিয়ে ব্যক্তিগত মেসেজে লিখেছিলেন অনেক কিছু। তাঁর মন্তব্যগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কেবল- সমান্তরাল নিয়ে বলেছিলেন, এই গল্পটি উপন্যাসের উপাদানে ঠাসা। ভেবে দেখবেন উপন্যাসের বিস্তৃতি দিতে চান কি না। অথবা পুরো গল্প থেকে একটা লাইন কোট করে মন্তব্য করেছিলেন, “বাবাকে সেদিন শীতের কুয়াশা কেটে কেটে নদীর ওপার থেকে ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসা ডিঙি নৌকার মাঝির মত লাগছিল আমার কাছে - মনে আছে৷” – এই বর্ণনাটি অসাধারণ। - ভীষণ সম্মানিত বোধ করেছিলাম তখন।
লেখা পড়ে ভাল লাগলে জিজ্ঞেস করতেন, পত্রিকায় কেন পাঠাই না লেখা? আমি হেসে বলতাম, আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু তিনি সাহস দিতেন, আবার পরামর্শও। বলেছেন ছদ্মনামে না লিখে আসল নামে লিখতে, গল্পলেখক হিসেব কনফুসিয়াস-এর বদলে নূরুল হাসানকে পাঠক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করবে বলে আমার বিশ্বাস। এরকম সদয় মন্তব্য আর কার কাছ থেকে পাবো!

ব্লগের পাতায়, মেসেজের ভিড়ে এত এত আলাপের স্মৃতি আজ কেবলই দুর্বল করে দিচ্ছে বারে বারে। জুবায়ের ভাই নানা বিষয়েই বারে বারে চমকে দিয়েছেন আমাকে। নিজেকে কম্পুকানা প্রজন্মের প্রতিনিধি বলতেন, তবু ব্লগিং করতেন নিয়মিত। লেখা নিয়ে উচ্ছ্বাস বা পরামর্শ জানাতে চাইলে, বিব্রত যেন না হই, এই চিন্তায় মেসেজে টোকা দিয়ে জানাতেন। এইরকম স্বজনসুলভ ব্যবহার ব্লগে প্রথম ওনার কাছ থেকেই পেয়েছি।
হায়, আজ স্বজন হারাবার বেদনাও প্রথম পেতে হলো এই জুবায়ের ভাইয়ের কাছ থেকেই!


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

কী বলবো, কনফু? কিচ্ছু ভালো লাগছে না...

হাসান মোরশেদ এর ছবি

-------------------------------------
সমুহ শোকেরা এলো ঝাঁক বেঁধে;
বিদায় জুবায়ের ভাই...

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অমিত আহমেদ এর ছবি
ফারুক হাসান এর ছবি

---

রণদীপম বসু এর ছবি

কখনো কখনো নীরবতাই সবচেয়ে বড় ভাষা হয়ে যায়...!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

স্বপ্নাহত এর ছবি

সচলের পাতায় কার যেন কোন একটা গল্পে আদর করে ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন কিছু।

সেটি ছিল সচল হবার পর আমার একেবারে প্রথম দিককার লেখা একটা ছোট গল্প। মনে আছে, আমার গল্পের উপর মাস্টারি করার পর কনফু ভাই সহ বাকি সবাই তার ছাত্রত্ব লাভের আশায় কেমন ইনিয়ে বিনিয়ে তার কাছে আবেদন করছিল। মুহম্মদ জুবায়ের নামটার গুরুত্ব আমার তখনো জানা ছিলনা। কিন্তু আমার খুব মজা লাগছিল। গর্বও হচ্ছিল, সচলে প্রথমে এসেই এমন একটা মানুষ নিজে থেকেই আমার মাস্টারির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তারপর... সচলে বড় হবার সাথে সাথে এই বড় মানুষটার দীর্ঘ ছায়া আস্তে আস্তে আবিস্কার করতে থাকলাম। উনার কমেন্ট পাওয়াও আমার কাছে তখন থেকে অনেক কিছু। মনে আছে সচল হবার পর আমার প্রথম পোস্টটাতে তিনি আমার লেখার প্রশংসা করে একটা কমেন্ট করেছিলেন। তার সেই প্রশংসা পেয়ে ভাললাগাটুকু অনেকদিন বয়ে বেড়িয়েছি নিজের সাথে। আমি খুব ভাগ্যবান আমার অনেকগুলো ব্লগেই উনি কমেন্ট করেছিলেন। উৎসাহ দিয়েছেন। বোধহয় সচলে উনার করা শেষ কমেন্টটাও আমার একটা ব্লগে করা.... কালকে ঘুরে ফিরে আমার ব্লগে তার কমেন্টগুলো হাতড়ে হাতড়ে আবার দেখলাম, কয়েকবার দেখলাম ....

জুবায়ের ভাই, জানি সম্ভব নয়। তবু অপেক্ষায় থাকবো। সেই আদর মাখা ভুল শুধরে দেয়া কমেন্টগুলো আপনি আর করবেন না, তাই কি হয়?

---------------------------------

বিষণ্ণতা, তোমার হাতটা একটু ধরি?

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

তানবীরা এর ছবি

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

মুশফিকা মুমু এর ছবি

‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দিয়াশলাই-য়ে আমার অণুগল্পটাতে তিনি খুব অল্প দু'এক কথায় সমালোচনা করেছিলেন, বলা ভাল পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিছুটা অভিমান হয়েছিল, বাকিদের এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ, আর আমাকে কেবল এক কথায় পরামর্শ! আজ এতদিন পর মনে হচ্ছে, সেইটুকুও আর কোনদিন পাওয়া হবে না। অনেক না-পাওয়া'র কাতারে আরো একটি যুক্ত হল। কষ্ট লাগছে খুব।
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

নামটা মনে আসলেই কষ্টে ভরে যায় মন,
যখন ভাবি উনি আমাদের মাঝে নেই
একরকম শুন্যতা চেপে ধরে
হৃদস্পন্দন যেন থমকে যায়।

--------------------------------------------------------

নাদিম এর ছবি

ভাল লাগলো আপনার লেখাটা পড়ে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।