শহরগুলোর একটির সাথেও আগেকার স্মৃতির কোন যোগসূত্র খুঁজে পেলাম না। কোন একটা অদ্ভুত উল্টো প্রক্রিয়ায় বর্তমান ইউরোপের আর সব শহরের মতই তারা বিস্ময়কর হয়ে উঠেছিলো। সত্যিকারের স্মৃতিরা কেমন যেন
ভৌতিক হয়ে গিয়েছে, আর তার বদলে মিথ্যে স্মৃতিরা এত বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে যে তারাই বাস্তবতাকে প্রতিস্থাপিত করেছে। এর মানে দাঁড়ালো, আমি তাহলে বিভ্রম আর স্মৃতিকাতরতার মাঝের বিভেদরেখাকে আলাদা করতে পারিনি। যদিও এমন করতে পারাটাই হতো ঠিকঠাক সমাধান। অবশেষে আমি ঠিক তাই খুঁজে পেলাম, বইটি শেষ করার জন্যে আমার যা দরকার ছিলো এবং পার হতে থাকা বছরগুলো আমাকে একমাত্র যা দিতে পারতোঃ সময়ের একটি পটভূমি।
দীর্ঘ দীর্ঘ বাক্য সব। একটার শেষের পরে অপরটার শুরুর মধ্যেকার যোগাযোগ বুঝে ওঠার জন্যে, মাঝে মাঝেই আমার এমন হয়েছে যে পুরো বাক্যটা বেশ ক"বার পড়তে হয়েছে। বাংলা করার পরে আমি আবার পড়ে দেখছিলাম, সেই একই সমস্যা এখনো হচ্ছে কি না। টের পেলাম যে তা এখনো হচ্ছে, তখন ইংরেজিটা মাথা থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে বাংলার উপরে বেশ খানিকক্ষণ ঘষা মাজা চালালাম। বাক্যের গতিপথ মসৃণ হয়ে এলেই তবে থেমেছি।
আমি সেই কার্যকরী সফর সেরে ফিরে এসে প্রায় ঘোরের মধ্য দিয়ে আট মাস ধরে সব কটি গল্প আবার শুরু থেকে লিখলাম, এবং যেহেতু আমার মনে হচ্ছিলো আমার বিশ বছর আগের অভিজ্ঞতার কোন কিছুই এখন আর বাস্তবে নেই, তাই আমার কখনোই এ কথা নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হয়নি যে জীবনের শেষ আর কল্পনার শুরু আসলে কোত্থেকে। তারপরে আমার লেখা এমন তরতর করে এগুলো যে মাঝে মাঝে আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেন গল্প বলার নির্ভেজাল আনন্দের জন্যেই লিখছিলাম কেবল, যার তুলনা হতে পারে একমাত্র নির্ভার হয়ে যাবার মানবীয় অনুভুতির সাথেই। আমি সবগুলো গল্পের উপর একই সাথে কাজ করছিলাম এবং ইচ্ছেমত একটা থেকে আরেকটায় ক্রমাগত যাওয়া-আসা করছিলাম, এর ফলে আমি বিস্তৃত একটা দৃশ্যপট আমার সামনে পেলাম যা আমাকে পরপর অনেকগুলো গল্প শুরু করার ক্লান্তি থেকে বাঁচালো। এবং সেই সাথে বর্ণনার বাহুল্য বা তীব্র বৈপরীত্য ধরে ফেলতে সাহায্য করলো। আমার বিশ্বাস, এভাবেই আমি এই বইটি লিখে ফেলতে পেরেছি, ঠিক যেরকমটা আমি সবসময়েই লিখতে চেয়েছি।
কি সব খটমটে কথাবার্তা, মার্কেজের ওপরে যদি আমি খানিকটা ক্ষেপে টেপেই যাই, খুব কি অন্যায় হবে? আপনারা কী বলেন?
অবশেষে, এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়ানো আর অনিশ্চিত বিচ্যুতির ধাক্কা কাটিয়ে এই বইটি পাতে তুলবার যোগ্য হয়ে উঠলো। প্রথম দুটি বাদে বাকি সবগুলো গল্পই একই সময়ে শেষ হয়েছিলো, এবং প্রতিটি গল্পের সাথেই তাদের শুরুর তারিখ লেখা আছে। এমনকি বইয়ের গল্পগুলোও আমার নোটখাতায় যেভাবে আছে, ঠিক সেই ক্রমানুসারেই সাজানো হয়েছে।
আমি সব সময়েই মনে করি যে, প্রত্যেক গল্পের সর্বশেষ রূপটাই তার ঠিক আগের অবস্থার চেয়ে শ্রেয়তর। তাহলে কেউ কী করে জানবে যে কোন রূপটি চূড়ান্ত? ঠিক যেভাবে রাঁধুনী জেনে যায় তার স্যুপ কখন প্রস্তুত, এটা তেমনই একটা গোপন পেশাগত কৌশল যা কোন নিয়ম বা কারণ মেনে চলে না, বরং সহজাত প্রবৃত্তির জাদুবলে জেনে ফেলা যায়। যাহোক, পরে অনুতাপ করতে হবে এই আশংকায় আমি আমার কোন বইই আর পড়ে দেখি না, তেমনি এই গল্পগুলোও পরবর্তীতে আর পড়িনি। নতুন পাঠকেরাই ভাল জানবে এদের নিয়ে কি করা উচিৎ। যদি আশ্চর্য এই তীর্থযাত্রীদের শেষমেষ ময়লার ঝুড়িতেই আশ্রয় নিতে হয়, সৌভাগ্যক্রমে সেটিও তাদের জন্যে ঘরে ফেরার আনন্দই বয়ে আনবে।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
কার্টাহেনা দে ইনডিয়াজ
এপ্রিল, ১৯৯২।
তো শেষ হলো এই পথ চলা, অবশেষে। এবারের অংশটুকু লিখে আমি প্রায় সপ্তাখানেক ফেলে রেখেছি। প্রতিদিন একবার করে এসে একটা দুটা শব্দ বদলে দিতাম। যেটাকে সবচেয়ে ঠিক মনে হতো, মনে হতো এইটুকু পরিবর্তনে সৌন্দর্যব্রৃদ্ধি ঘটবে, কিন্তু লেখার অঙ্গহানি ঘটবে না কোনমতেই। এই সময়টায় আমি মূল ইংরেজিটা পড়া থেকে বিরত থেকেছি। বার বার বাংলাটুকু পড়ে পড়ে একধরণের কোমলতা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। নিজের কাছে একটা তাড়া ছিলো দ্রুত একটা সমাপ্তিতে পৌঁছার, তবু সেটা করিনি।
এই তীর্থযাত্রীদের গল্প বলতে এসে যখন শেষ দাড়ি টানলাম, আমি নিজেঅ সম্ভবত তীর্থে পৌঁছবার আনন্দই পেলাম। এবং অনুবাদে এই লেখাটা পড়তে গিয়ে আমার আরও মনে হলো, ইংরেজি পড়বার সময় এই লেখার অর্থটুকু বা বক্তব্য বুঝেছিলাম ঠিকই, কিন্তু আত্মীকরণ করা যাকে বলে সেটা ঘটলো এবারই, মানে পুরোপুরি বাংলায় পড়ার সময়।
একসাথে তিন পা হাঁটলে নাকি বন্ধু হয়ে যায়। তো ভাবছিলাম, আপনি আমি আর গ্যাবিতো মার্কেজ, এই যে এ কয়টা দিন ধরে গল্প করতে করতে এত লম্বা পথ হেঁটে এলাম, আমরাও তো বন্ধু হয়ে গেলাম! ব্যাপারটা বেশ আনন্দের। তাই না?
-
মু. নূরুল হাসান
২০/১০/২০০৯
-------------
পুনশ্চঃ
কেউ পুরো লেখাটা একসাথে পড়তে চাইলে-
অখন্ড সংস্করণ।
কৃতজ্ঞতা যাদের কাছেঃ
১। গ্যাবিতো মার্কেজ এবং আমার এলাকার স্থানীয় লাইব্রেরি
২। অভিধান ডট অরগ
৩। নজরুল (ইসলাম) ভাই, তাঁর অসাধারণ টাইপিং দক্ষতা এবং ভীষণ সুন্দর মন।
৪। আলী আহমেদের বাংলা অনুবাদ
৫। সচলায়তনের সব পাঠক, যারা আমার আলসেমীকে একদমই মাথায় চড়তে দেননি।
মন্তব্য
একটা অখন্ড সংস্করণ করা যায় না ব্রাদার?
হাঁটুপানির জলদস্যু
অবশ্যই যায়। কিন্তু আমার প্রলাপগুলা সহ নাকি ছাড়া?
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
আবার জিগস!
হাঁটুপানির জলদস্যু
নীল রংটা এতোটাই চোখে লাগছে যে পড়তে পারছি না। হাল্কা নীল জাতীয় কিছু দেয়া যায় না?
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
রঙ-এর বুদ্ধি ছিলো শিমুলের!
আপাতত বোল্ড আর ইটালিকে ফিরে গেলাম।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
নাহ ! প্রথম পর্ব পড়ার পর অদ্ভুত সব ঝামেলায় পরের পর্বগুলি আর পড়া হয়ে উঠলো না। দেখি একবারে সব পড়ে মন্তব্য করি।
তবে লেখকের নাম দেখেই নিশ্চিন্ত হয়ে জাঝা দিয়ে গেলাম।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
অনুবাদ আমি পড়িনি... একসাথে পড়বো বলে এতদিন রেখে দিয়েছিলাম। আজো পড়বো না... ফুড়সত পেলে পড়বো। তাই সেই নিয়ে কথা হবে পরে।
তবে আপনার এই অনুবাদকালীন অনুভূতিগুলো আমার দারুণ মজা লাগছে। এই জার্নিটা আমি খুব এনজয় করছি।
আমি হইলাম বকলম... অনুবাদ ছাড়া বিদেশী কিছু পড়তে পারি না। ভালো অনুবাদ বলতে আমি সেটাই বুঝি যেটা পড়তে আমার ভালো লাগে... আরাম লাগে।
এবার গল্পগুলা ধীরে সুস্থে অনুবাদ করে ফেলেন... প্রয়োজন হলে পুরো বই কম্পোজ করে দেবো
মহাবিপদ... ছেলেদের কাছ থেকে আজকাল মনের প্রশংসা শুনতে হচ্ছে!!!
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
গল্প অনুবাদের কথা এখনো জানি না, আপাতত মাথায় নেই।
আর, প্রশংসা কি তাইলে জেন্ডার বায়াসড হইতে হয় নাকি?
হুম।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ঠিক, ঠিক - ডাবল হুমমম!!!
কনফুসিয়াস, এর আগের পর্বেও একটা মন্তব্য করেছিলাম - পরে দেখি গায়েব হয়ে গ্যাছে
যাই হোক, আগেও বলেছি আবারো বলছি - অনুবাদের এই উপস্থাপনার ধরনটা কি যে চমৎকার লেগেছে!
ঠিকাছে, দাঁড়ান, নিজ দায়িত্বে ইংরেজী ভার্শনটা জোগাড় করে, পড়ে, আপনাকে ধরা হবে
না...
হতাশ হচ্ছিলাম এজন্য যে, আজকাল মনের নাগাল মেয়েরা পাচ্ছে না... পাচ্ছে ছেলেরা...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দোষ তো তাইলে বস আপনার! আপনিই তো মেয়েদের নাগাল পাইতে দিচ্ছেন না, বরং দিচ্ছেন ছেলেদের! আপনার মন'টা আসলেই অনেক সুন্দর!
হা হা হা।
নজরুল ইসলামের মন্তব্যে উত্তম জা-ঝা
অসাধারণ কনফুসিয়াস।
একটু কষ্ট করবেন কি?
অখন্ড সংস্করনে ইংলিশ লেখাটা যোগ করে দিলে আপনার অভিগ্গতা
পুরোপুরি মিলিয়ে দেখা যেত।
আর করা যেত আপনার অনুবাদ নিয়ে কিছু
পন্ডিতি আলোচনা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ইংলিশটা দিয়া দিবো, নিজের এত্ত বড় সর্বনাশ করি ক্যামনে!
তা হবে না, এইটা পইড়াই "খুব ভাল হইছে" ভাইবা নেন।
(ইংরেজিটা অনলাইনে পাওয়া যায় কিনা জানি না। কম্পোজ করাও বিরাট সময়সাপেক্ষ, যদি সম্ভব হয়, স্ক্যান করে দিয়ে দিবো আপনাকে।)
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
শুরু থেকেই মুগ্ধ হয়ে পড়লাম এই সিরিজটা। তবে অনুবাদের চেয়ে এনজয় করলাম অনুবাদের পেছনের কাহিনী, সময়ে সময়ে অনুবাদকের সিদ্ধান্তহীনতা আর দক্ষতার সাথে তা উৎরে আসা। এক কথায় চমৎকার! ইংরেজিটা পড়ার আর কোন প্রয়োজনই বোধ করলাম না!
তবে ইটালিকটা ভাল লাগলো না। দুই একটা শব্দ বা লাইন ইটালিকে খারাপ লাগে না, কিন্তু আস্ত এক প্যারা ইটালিকে দেখতে কেমন যেন লাগে। আমার মতে "বোল্ড-রেগুলার" অথবা "রঙ-রেগুলার" কম্বিনেশন হলে হয়ত বেশি দৃষ্টিনন্দন হতো। নিতান্তই আমার মত, পাত্তা না দিলেও চলবে
হয়ত জানাই আছে আপনার, তারপরেও, বিভিন্ন রঙের কোড জানার জন্য দেখতে পারেন এখানে।
আর পাঠক হিসেবে নিজের একটা ইচ্ছার কথা জানাই, যদি গল্পগুলোও অনুবাদে হাত দিতেন, তাহলে অনেক ভাল হতো। আশা করি, ভেবে দেখবেন, অথবা ভাবাভাবি বাদ দিয়ে সরাসরি মাঠে নেমে পড়বেন!
আমি সবগুলো গল্পের উপর একই সাথে কাজ করছিলাম এবং ইচ্ছেমত একটা থেকে আরেকটায় ক্রমাগত যাওয়া-আসা করছিলাম, এর ফলে আমি বিস্তৃত একটা দৃশ্যপট আমার সামনে পেলাম যা আমাকে পরপর অনেকগুলো গল্প শুরু করার ক্লান্তি থেকে বাঁচালো।
ভয়ংকর লাগল অভিজ্ঞতাটা। অনেক বড়ো লেখকের ক্ষেত্রেই বোধকরি এরকমটা সম্ভব।
পরে অনুতাপ করতে হবে এই আশংকায় আমি আমার কোন বইই আর পড়ে দেখি না, তেমনি এই গল্পগুলোও পরবর্তীতে আর পড়িনি।
এটা কেমন যেন অসম্ভব অসম্ভব লাগছে না! অবশ্য মহান লেখকদের ক্ষেত্রে কত কীই তো সম্ভব।
কনফুদা আপনার সাথে দিল্লিতক এই ভ্রমণে প্রভূত আনন্দ হলো। আরেকটা কোনো বিরল ভ্রমণ শুরু হোক, সঙ্গে থাকব।
..................................................................................
দেশ সমস্যা অনুসারে
ভিন্ন বিধান হতে পারে
লালন বলে তাই জানিলে
পাপ পুণ্যের নাই বালাই।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী
সব লেখায় হুট করে মন্তব্য করা যায় না। সময় নিয়ে আরাম করে পড়ে কথা বলতে হয়। কনফু'কে কৃতজ্ঞতার বেশি আর কী জানাই! প্রিয় এ মানুষটির সাথে কোনদিন দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম, এই লেখার জন্য কী যা'যা (জা'ঝা না) চান তা'তা পাবেন।
অনেক ব্যস্ততার মাঝে কনফু এরকম লিখে যাবেন। অনেক কঠিন কিছু সহজ ভাবে পড়ার সুযোগ পাবো। আপাততঃ এটুকুই বলে রাখি...
নতুন মন্তব্য করুন