এরকম কোন বই নিয়ে লেখা খুব মুশকিল, যে বইয়ের পাতা উলটে দু পাতা যেতেই ঋণ স্বীকারে দেখা যায় নিজের নাম লেখা আছে। অথবা, আরও কিছু পৃষ্ঠা এগুলে কোন গল্পের শিরোনাম, এবং তারপর দু'প্যারা পড়লে হুট করে মনে পড়ে যায় জিমেইলে বা জিটকে গল্পলেখকের সাথে অগুণতি আলাপের স্মৃতি। কিংবা অন্য একটা গল্প শেষে তারিখ বা সাল দেখে যখন মনে পড়ে, অনলাইনে রাত দিন উজাড় করে ওলটপালট করে ফেলা অদ্ভুত কিছু যুদ্ধের স্মৃতি। বইয়ের আকৃতির কথাই ধরুন। সাধারণ বইয়ের মত নয়, খানিকটা ছোট। এবং এটা দেখেই মনে পড়লো, প্রকাশক আলবাব ভাই চেয়েছিলেন, আমাদের ছেলেবেলার সেই বইগুলোর স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে। দুর কৈশোরের আবছা অন্ধকারে যে বইগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে অবিরাম, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, অথবা সাঁতারু ও জলকন্যা! আমার মনে পড়ে আরও কিছু বইয়ের নাম, যেমন বনি, কিংবা বিকেলের মৃত্যু।
বইয়ের প্রচ্ছদে রোমান হরফের ঘড়িটা দেখেও মনে পড়ে গেল, এ গুলো আগে সংখ্যায় দেয়া ছিলো, পরবর্তীতে আমাদেরই নানা গুতোগুতিতে বদলানো হয়েছিলো। এরকম একটা বই নিয়ে কী লেখা যায় বলুন, কেমন করেই বা?
তারপরেও কদিন আগেই ছাপা বা কাগুজেগুরু-র জন্যে লিখেছিলাম এ বইটা নিয়ে। লেখাটা সচলায়তনের পাঠকদের জন্যে এখানেও তুলে দিলাম।
*************
লেখককে অনুসরণ করে চলার আনন্দই আলাদা। অনুসরণ মানে, আক্ষরিক অর্থে পিছু পিছু চলা নয়। লেখকদের অনুসরন করা বরং তারচেয়ে অনেক সহজ, তাদের লেখাগুলোকে ক্রমশ পড়ে যেতে থাকলেই চলে। এটা অনেকটা আত্মজৈবনিক কোন চলচ্চিত্র দেখার মতো, যেখানে পর্দার গায়ে অবিরাম ঘটে চলছে ঘটনা, বড় হয়ে চলছে কোন গল্প, ধীরে ধীরে। সিনেমার প্রিভিউ যদি জানা থাকে আগেই, তাহলে দেখার আনন্দ বেড়ে যায় আরো। আমরা জানছি, পর্দায় এখন ঘটবে এরকম কোন ঘটনা, কিন্তু কীভাবে ঘটবে জানা নেই। তারপর যখন সত্যিই সেই চিত্রায়ন দেখা যাবে, আমরা চমক-লাগা চোখে তাকিয়ে থাকবো।
আনোয়ার সাদাত শিমুলকে অনুসরণ করে চলেছি প্রায় বছর তিনেক হলো। শিমুলের লেখালেখির মূল মাধ্যম ইন্টারনেট, আরও সুস্পষ্ট করে বলতে গেলে, বাংলা ব্লগগুলো। বিশেষ করে ইউনিকোড-বাংলা প্রচলনের ফলে ফোরাম-গঠনের বাংলা ব্লগগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশ। শিমুল সেরকমই একটা ব্লগ - সচলায়তন ডট কম-এ লিখেন তার দিনিলিপি আর গল্প।
প্রায় বছর তিনেক আগে, ব্লগে শিমুলের লেখা প্রথম গল্প পড়েই বুঝেছিলাম যে তাঁর মধ্যে বারুদ ঠাসা আছে। মুগ্ধ হয়েছিলাম পড়ে। এবং এরপর থেকেই শিমুলের নতুন গল্পের জন্যে অপেক্ষায় থাকতাম।
লেখক শিমুলের দেখার চোখ খুব তীক্ষ্ম। ছোট ছোট কোন কিছুও তার নজর এড়ায় না। শিমুলের গল্পের উপাদানগুলো আসে আমাদের চারপাশের খুব পরিচিত জগত থেকেই। খবরের কাগজের শেষপাতার যে আপাত-জৌলুশহীন খবরটি আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়, অথবা প্রতিদিন বাসে চড়ে অফিসে যেতে, চেনা মুখের যে কন্ডাক্টরটি তবু খুব অচেনা রয়ে যায়, শিমুল পরম যত্নে তাদের কথাই তুলে নিয়ে আসেন তাঁর গল্পে।
আনোয়ার সাদাত শিমুল ব্লগ জীবনে প্রথম নজর কেড়েছিলেন যে গল্পটি দিয়ে সেটির নাম 'পাকমন পেয়ার'। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালীন এদেশীয় কিছু বিশ্বাসঘাতক মানুষ পাক-বাহিনীর সঙ্গ দিয়েছিলো আমাদেরই বিরোধীতা করে। তাদের পরবর্তী প্রজন্মরা বড় হয়েছে তেমনই পরিবেশে, এবং আশ্চর্য হলেও সত্য, পূর্বপূরুষদের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসে অনুশোচনা নেই তাদের, বরং তারাও বয়ে বেড়াচ্ছে সেই অশুভ বীজ। শিমুল এই ঘাতক-পরবর্তী-প্রজন্ম, তাদের কথাবার্তা, চিন্তাভাবনার গতিপ্রকৃতি, এই সমস্ত বিষয়গুলোই গল্প হিসেবে লিখেছেন পাকমন পেয়ারে।
বাংলাদেশে যখন এফএম রেডিওর খুব প্রচলন হলো, সবাই লক্ষ্য করলো, সেখানকার রেডিও জকিরা খুব আজব উচ্চারণে বাংলা বলে, ইংরেজিও নয়, আবার বাংলাও নয়, কেউ কেউ এর নাম দিলো বাংরেজি। শিমুলের গল্পে উঠে আসে সেসবও। মোবাইলের প্রাথমিক যুগে যখন একটা প্রজন্মকে ডাকা শুরু হলো ডিজুস জেনারেশান, শিমুল তার গল্পে নিয়ে আসলেন তাদের ভাবনা। এরকম গল্পগুলোয় শিমুলের শব্দচয়ন মুগ্ধ করার মতো, একদম ডিজুস জেনারেশানের মুখের ভাষাই যেন চলে আসে গল্পে। অন্যদিকে শর্মিলা বোস নামের কোন এক জ্ঞানপাপী যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা এবং নির্যাতিতা নারীদের অবমাননা করে কাল্পনিক কিসসা ফেঁদে বসলো, এই মনোভাবে প্রভাবিতদের নিয়ে শিমুল গল্প নিয়ে হাজির হলেন, নাম 'নতুন খাতার পাতায়'।
এভাবে প্রতিদিনকার ঘটনাগুলোই তাদের গন্ডী ভেঙ্গে গল্প হয়ে ওঠে শিমুলের কলমে। এই গল্পগুলো লেখার দিন তারিখ মিলিয়ে পড়ে গেলে, সমসাময়িক ঘটনাগুলোর পদচারণা তার গল্পে এত বেশি পাওয়া যায় যে, সেগুলো আসলে সময়েরই দলিল হয়ে দাঁড়ায়।
'অথবা গল্পহীন সময়'- আনোয়ার সাদাত শিমুলের প্রথম গল্পগ্রন্থ। এ যাবতকালে লিখিত এবং নানা মাধ্যমে আলোচিত ও সমালোচিত এগারোটি ছোট গল্প নিয়ে এ বই। বইয়ের গল্পগুলোর পেছনের তারিখ ধরে পড়ে গেলে বোঝা যাবে, ক্রমশ পরিণত হয়েছে তাঁর লেখা, যেন নিজেকেই ছাড়িয়েছেন প্রতিবারে।
আমি বলবো, এ বইটি শিমুলের লেখক জীবনের একটা ছোট্ট ট্রেলার মাত্র। একটা চমৎকার চলচ্চিত্র আমরা দেখতে যাচ্ছি আগামী কিছু বছরে বা দশকে, চমৎকার কিছু গল্প পেতে যাচ্ছি, এ বইটি আসলে আমাদের সেরকমই আভাস দেয়। একজন নবীন লেখকদের জয়যাত্রা শুরু হোক এই বইটির মাধ্যমে।
-----------
১৬/১২/০৯
মন্তব্য
এমন একজন লেখককে নিয়ে কিছু বলা আসলেই খুব কঠিন..
১) পাঁচ/ ছয় বছর আগে যাযাদিতে যার লেখা "ইরিয়ানা" কিংবা "ভালবাসা এক নিঃশব্দ আততায়ী" প্রায় পুরোটাই মনে আছে এখনো!
২) সচলায়তনের হদিস যার সুত্রে পাওয়া...
৩) যিনি প্রতিটি লেখাতেই পাঠককে মুগ্দ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন!
====================================
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
=====================================
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
কনফুসিয়াস নিয়মিত লিখছেন দেখে ভাল্লাগছে।
--------------------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
শিমুল ভাইয়ের নামটা অনলাইন লেখালেখির জগতে এসে মোটেই অপরিচিত লাগেনি তার যাদুকরী লেখনীর সাথে আগেই টুকটাক মুদ্রিত মাধ্যমে দেখা হয়ে যাওয়ায়...
প্রিয় এই গল্পকার আরো শাণিত, ক্ষুরধার হয়ে সমৃদ্ধ করুন বাংলা ছোটগল্পের ঝুলি, এই কামনা...
_________________________________________
সেরিওজা
আহ! শুরুতে যে কয়টা বইয়ের নাম বললা ভাইয়া সেগুলোর দিকে সস্নেহে তাকালাম একবার...তারপরে শিমুল ভাইয়ের বইটার দিকে... আহ! কী বই একখান!
-----------------------------------------------------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি, বলি আমি এই হৃদয়েরে; সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
গত বছরই পড়া হয়েছিল বইটা। আমার পড়া খুবই কম সারা জীবনে। তাই উচ্চতার অন্য মাপ হিসাব ক'রে বলতে পারি না। অনেস্টলি বলতে গেলে, ব্লোন-অ্যাওয়ে হইনি ওটা প'ড়ে, তবে নন-সিজলিং হ'লেও একটা অ্যাপেটাইট আছে ওইখানে। ওই বই বা অমন গল্পাবলী লেখককে কাছে আনে বৈ দূরে মোটেও সরায় না। এমনকি, লিখতেও ইচ্ছে হয়েছিল ওটা নিয়ে (শিমুলের সাথে প্রথম দেখায় তাকে বলেছিও এটা), কিন্তু "তাইরে নাইরে নাইরে" আর লেখা হয়ে ওঠেনি। ক্রমশ/উত্তরোত্তর পরিণত ব্যাপারটা ওখানে আছে, আর ওই আভাও আছে, যে সামনে আমাদের সময় আরো শিমুলিত হবে। তাই, কনফু আপনার লেখার শেষ প্যারাটাই সবচে' বড় কথা মনে হ'লো আমার। আর, এমনিতেও, ব্যতিক্রমী গঠনের একটা বই(/লেখক!) পর্যালোচনা উপহার পেলাম আপনার কাছ থেকে। বিশেষ ক'রে "বই কথা কও" ব্যাপারটা বা শব্দবন্ধটা অনেকই প্রিয় হয়ে গ্যালো প্রথম দেখাতেই।
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
শিমুলের লেখায় যাদুকরী টান আছে। বইটা আনাতে হয় দেখছি।
আমার প্রথম পড়া হলো পাকমন পেয়ার। যারা বাংলাদেশে ছাত্রছাত্রী বাসায় গিয়ে পড়িয়েছেন তাদের প্রত্যেকেরই এই ঘটনা অনুভবের সুযোগ ছিলো কিন্তু এতো সুন্দর ভাবে তুলে ধরার ক্ষমতা আমাদের সবার নেই---ছোট ছোট বাক্যে অব্যক্ত সত্যগুলোর কি ধারালো প্রকাশ।
আমি টানাটানির সময়েও বইটি অনলাইনে কিনেছিলাম এবং আরো দুজনকে বইটি উপহার দিয়েছি।
লেখক শিমুলের সবচেয়ে বড় সম্পদ তাঁর অবজারভেশন পাওয়ার আর যেকোনো ঘটনার নৈর্ব্যক্তিক বর্ণন দক্ষতা।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
-
কালকে হাতে পাবো প্রিয় শিমুলের এই বইটা। কেমন জানি একটা শিহরণ হচ্ছে কদিন থেকে, মনের গহীনে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আ সা শিমূল কিন্তু জীবনে প্রথম অটোগ্রাফটা আমারে দিছে... এইটা কিন্তু আমার একটা গর্বের বিষয়... রাইখা দিছি অটোগ্রাফসমেত বইখান। বুড়াকালে নিলামে উঠামু...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমি জানি, কনফুর জন্য কাজটা অনেক কষ্ট সাধ্য। ক'জনই বা পারে - জেনে বুঝে কাছের মানুষের বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে! বোধ করি, সেজন্যই এখানে 'ধন্যবাদ' বলাটাও আমার জন্য কষ্টকর...।
আমার ভালো লাগে, কনফুর মতো একজন শক্তিশালী লেখক - বন্ধু আমাকে অনুসরণ করছেন, পরামর্শ-মতামত দিচ্ছেন...। লিখছেন এখানে ওখানে...।
যাঁরা মন্তব্য করেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ।
কবে যে পড়ব!!!
নতুন মন্তব্য করুন